এজেন্ট ব্যাংকিং ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তি
Published: 16th, January 2025 GMT
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৩ সালে ইউএনডিপির সহযোগিতায় এজেন্ট ব্যাংকিং ‘পাইলট’ প্রকল্প হাতে নেয়। আমি তখন ব্যাংক এশিয়ার রিটেইল ও ক্ষুদ্র ব্যবসা বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত। এজেন্ট ব্যাংকিং পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করার সুযোগ আমরা তখন গ্রহণ করি এবং এই ব্যবসার একটি মডেল দাঁড় করাই। এজেন্ট ব্যাংকিং ব্যবসার কার্যকারিতা হচ্ছে, এটি ব্যাংকগুলোকে গ্রামীণ এবং দূরবর্তী গ্রাহকদের কাছে কম খরচে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার সবচেয়ে বড় মাধ্যম এজেন্ট ব্যাংকিং।
অনেক ব্যাংক থাকা সত্ত্বেও খুব কম ব্যাংক গ্রামীণ এলাকায় তাদের শাখা স্থাপন করেছে এবং গ্রামীণ গ্রাহকদের সেবা দিয়েছে। বাণিজ্যিক বিবেচনায় অধিকাংশ বেসরকারি ব্যাংক তাদের শাখা সম্প্রসারণ শুধু শহরেই সীমিত রেখেছে। গ্রামে ব্যাংকের শাখা স্থাপন করে যে পরিচালন ব্যয় বহন করতে হয়, তার তুলনায় আয় অনেক কম। এ কারণে শাখাগুলো বাণিজ্যিকভাবে কার্যকরী হতে পারে না। আমাদের দেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর একটি বিরাট অংশ সবসময় আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং পরিষেবা থেকে বঞ্চিত থেকেছে।
একজন ব্যাংকার হিসেবে আমি আর্থিক অন্তর্ভুক্তির যেসব প্রতিবন্ধকতা দেখতাম, তার মধ্যে অন্যতম ছিল গ্রাম এবং শহরে ব্যাংক হিসাব খোলার হারে বিশাল পার্থক্য। এই বিভেদ দূর করতে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ভূমিকা অতুলনীয়। কারণ এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ৮৬ শতাংশ গ্রাহকই গ্রামীণ জনপদের। গ্রাম ও শহরের মধ্যে আর্থিক উন্নয়ন এবং অগ্রগতিতে যে বৈষম্য দেখা যায়, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের কারণে তা কমে আসবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। সাক্ষরতার হার কম হওয়ার কারণে অনেক গ্রামবাসীর জন্য ব্যাংকিং সেবা পাওয়া একটি দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিল, সেখানে আমরা আঙুলের ছাপ দিয়ে মানুষের বাড়ির কাছে গিয়ে তাদের ব্যাংকিং সেবা দিয়েছি। শিক্ষার হার কম হলেও গ্রামের মানুষ ব্যাংকিং সেবা পেতে সমর্থ হয়েছে। গ্রাম এলাকায় ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেওয়ার খরচ সাধারণত বেশি হলেও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের উদ্যোক্তা মডেলের কারণে সেই খরচ কমে গেছে। উদ্যোক্তারা অল্প খরচে মানুষের দোরগোড়ায় ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিয়েছেন। এ ছাড়া পুরুষ ও নারীর ব্যাংক হিসাব খোলায় বৈষম্য কমাতে সাহায্য করেছে এজেন্ট ব্যাংকিং। নারীদের অ্যাকাউন্টের সংখ্যা বরাবরই ব্যাংকিং খাতে কম ছিল, যার পরিবর্তন হয়েছে এজেন্ট ব্যাংকিং আসার পর। বাড়ির কাছে এবং সহজে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সুবিধা থাকার কারণে নারীরা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। এখন এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে নারীর অ্যাকাউন্ট সংখ্যা পুরুষের চেয়ে বেড়েছে, যা ব্যাংকিং ইতিহাসে একটি মাইলফলক।
এজেন্ট ব্যাংকিং রেমিট্যান্স বিতরণের প্রতিবন্ধকতাও অতিক্রম করতে সাহায্য করেছে। যেসব ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সেবা দিচ্ছে, তাদের রেমিট্যান্স বিতরণ ব্যবস্থায় একটি বড় ভূমিকা পালন করছে এই চ্যানেল। আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স সেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের বিকল্প নেই বললেই চলে।
ক্ষুদ্রঋণ এবং কৃষিঋণ বিতরণ বাড়ানোর বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা সবসময় ছিল। কিন্তু এই ঋণ বিতরণ ও আদায় নিয়ে প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থাতে কম খরচ বা সহজ উপায় ছিল না। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ ও কৃষিঋণ বিতরণ ত্বরান্বিত হয়েছে এবং প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছাতে পেরেছে। ভবিষ্যতে এ পথ ধরে ক্ষুদ্রঋণ ও কৃষিঋণ আরও বিস্তার লাভ করবে। গ্রামীণ অর্থনীতি বহুল কাঙ্ক্ষিত ঋণসেবা পেয়ে অগ্রসর হবে– এই আশা আমরা রাখতে পারি।
সামাজিক নিরাপত্তার ভাতা বিতরণে একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষকে যুক্ত করা গেছে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে। এর ফলে সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা বিতরণে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি সৃষ্টি হয়েছে। একজন ভাতাভোগী তাঁর ইচ্ছামতো টাকা তুলতে পারছেন এবং চাইলে প্রয়োজনে সঞ্চয়ও করতে পারছেন। আর্থিক সাক্ষরতা বিষয়টি গ্রামীণ জনপদে সবসময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রামীণ জনপদে আর্থিক সাক্ষরতার বিস্তার ঘটছে, যা স্থানীয় জনগণের মধ্যে ব্যাংকিং সেবার প্রতি সচেতনতা এবং আগ্রহ বাড়াচ্ছে। এ উদ্যোগের ফলে গ্রামের মানুষ সহজে তাদের আর্থিক কার্যক্রম সম্পাদন করতে পারছে; যার মধ্যে রয়েছে সঞ্চয়, লেনদেন, বিল পরিশোধ এবং অন্যন্য ব্যাংকিং সেবা। ভবিষ্যতে আর্থিক সাক্ষরতা গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন এবং স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
আমরা এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে যে ধারা সৃষ্টি করেছি, তাকে আধুনিক ব্যাংকিংয়ের রূপায়ণ বলা যায়। বাংলাদেশে প্রথম বায়োমেট্রিক ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাচাইকরণ এবং ডিজিটাল কেওয়াইসি ব্যবহার করে ব্যাংকিং লেনদেন শুরু হয় এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের হাত ধরে। আমরা যখন এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের কাজ শুরু করি, তখন দেশে ২জি নেটওয়ার্ক থাকার কারণে প্রায়ই লেনদেন করতে গ্রাহকরা অসুবিধার সম্মুখীন হতেন। সময়ের সঙ্গে সারাদেশে ৩জি নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণ হয় এবং গ্রাম পর্যায়ে ইন্টারনেটের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়, যা এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সেবা গ্রহণ করা আরও সহজ করে দেয়। এজেন্ট ব্যাংকিং প্ল্যাটফর্ম প্রযুক্তিভিত্তিক। এ কারণে আমি মনে করি, ভবিষ্যতে ডিজিটাল ব্যাংকিয়ের রূপায়ণ হবে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। ডিজিটাল ব্যাংকিং চালু করার মতো পরিপূর্ণ অবকাঠামো আমাদের এখনও নেই। তাই আমি বিশ্বাস করি, এজেন্ট ব্যাংকিং দিয়েই ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের সম্প্রসারণ করা যাবে এবং এর দ্বারাই আমাদের দেশে ব্যাংকিং সেবা পূর্ণতা লাভ করবে। পৃথিবীজুড়ে ডিজিটাল ব্যাংকিয়ের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। আমাদের এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের উদ্যোক্তারা গ্রাহকসেবার ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা রাখছেন। অপেক্ষাকৃত কম অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন, বয়স্ক এবং নারী গ্রাহক এজেন্টদের মাধ্যমে সেবা পেয়ে উপকৃত হচ্ছেন। ভবিষ্যতে ব্যাংকের অ্যাপ ও অন্যান্য সেবা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দিতে এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যকর ভূমিকা রাখবে। ভবিষ্যতে এজেন্ট পয়েন্টগুলো ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের হাব বা কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করবে, যা গ্রামীণ এবং প্রান্তিক জনগণের কাছে আধুনিক ব্যাংকিং সেবা পৌঁছানোর একটি কার্যকর মাধ্যম হবে। এর মাধ্যমে ডিজিটাল সেবার প্রাপ্যতা ও ব্যবহারে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
লেখক: চেয়ারপারসন, জায়তুন বিজনেস সলিউশন এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ব্যাংক এশিয়া
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব যবস থ আর থ ক ব তরণ
এছাড়াও পড়ুন:
শ্রমিকদের দাবির প্রেক্ষিতে খুলছে ৪ বন্ধ কারখানা
নয় দিন বন্ধ থাকার পর আগামীকাল মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) থেকে নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডের চারটি কারখানায় চালু হচ্ছে।
বেতন, বোনাসসহ বিভিন্ন দাবি বাস্তবায়নে আন্দোলনের মুখে গত ২৫ অক্টোবর বিকেলে চারটি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।
আরো পড়ুন:
ঝিনাইদহে গাছ থেকে পড়ে শ্রমিকের মৃত্যু
বরিশালে অপসো ফার্মার ৫০০ শ্রমিক ছাঁটাইয়ের অভিযোগ
কারখানাগুলো হলো দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিল লিমিটেড, সেকশন সেভেন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, মেইগো বাংলাদেশ লিমিটেড ও ইপিএফ প্রিন্টিং লিমিটেড।
সেকশন সেভেন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের পরিচালক আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘‘২৬ অক্টোবর থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারখানা বন্ধ রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে শ্রমিকেরা কারখানা চালুর দাবি জানান। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে কারখানা চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমাদের কারখানায় সাড়ে ৩ হাজার শ্রমিক রয়েছে।’’
ইপিজেড সূত্র জানিয়েছে, বন্ধ চারটি কারখানায় সাড়ে ৬ হাজার শ্রমিক রয়েছে।
উত্তরা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার জানান, শ্রমিকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) থেকে বন্ধ থাকা চার কারখানা চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
এ দিন থেকে স্বাভাবিকভাবে কার্যক্রম শুরু হবে এবং শ্রমিকদের যথাসময়ে কারখানায় আসার আহ্বান জানানো হয়েছে।
উত্তরা ইপিজেডের ২৭টি কারখানায় ৩৫ হাজার শ্রমিক কর্মরত রয়েছে।
ঢাকা/সিথুন/বকুল