ট্রাম্প কি ‘রোমান সাম্রাজ্য’ গড়ার পথে হাঁটছেন
Published: 12th, February 2025 GMT
আপনারা তো নয়া উদারতাবাদ ও নয়া রক্ষণশীলতার কথা শুনেছেন। আর এখন আপনাদের নয়া সাম্রাজ্যবাদের জমানায় স্বাগত জানাতে হচ্ছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণকালে সূচনা বক্তব্যে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে তাঁর দেশ আবার নিজেকে ‘একটি উদীয়মান জাতি হিসেবে বিবেচনা করবে, এমনভাবে তা করবে যেন আমাদের সম্পদ বাড়ে, আমাদের ভূখণ্ড সম্প্রসারিত হয়।’
অনেকেই আশা করেছিলেন যে ভূখণ্ড বা ভৌগোলিক সীমারেখা সম্প্রসারণ নিয়ে ট্রাম্পের কথাবার্তা শুধু ফাঁকা বুলি, যা মিইয়ে যাবে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি ঘন ঘন যেসব ভূখণ্ড দখল করার কথা বলছেন, তা ফাঁকা বুলি হিসেবে উপেক্ষা করা বা উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়।
ট্রাম্প বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই বলেছেন যে আমেরিকা গ্রিনল্যান্ড নিয়ে নেবে। তিনি পানামা খাল ফিরিয়ে নেওয়ার কথাও জোরেশোরে উচ্চারণ করেছেন। কানাডাকে আমেরিকার ৫১তম অঙ্গরাজ্য করার কথা বারবারই বলছেন। আর গেল সপ্তাহে তিনি গাজার মালিকানা দাবি করে বসেছেন।
এভাবে বিভিন্ন ভূখণ্ড দখল করার বিষয়ে ট্রাম্পের প্রবল বাসনা তাঁর অনেক সমর্থককেও হতভম্ব করেছে। কিন্তু বৈশ্বিক প্রবণতার অংশ হিসেবে দেখলে ট্রাম্পের এই সম্প্রসারণবাদী অভিলাষ বুঝতে পারা সহজ হয়। যে দুজন বিশ্বনেতাকে তিনি তাঁর সত্যিকারের সতীর্থ হিসেবে দেখেন, তাঁরাও ভৌগোলিক সীমারেখা বাড়ানোকে একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় লক্ষ্য হিসেবে মনে করেন আর নিজেদের বিরাটত্বের অংশ হিসেবে বিবেচনা করেন। এই দুজন হলেন ভ্লাদিমির পুতিন ও সি চিন পিং।
রাশিয়ার সরকারি লোকজন প্রায়ই ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধকে তাঁদের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে যৌক্তিক বলে দাবি করেন। কিন্তু পুতিন নিজে এই ধারণায় প্রবলভাবে মোহাবিষ্ট যে ইউক্রেন কোনো পূর্ণাঙ্গ দেশ নয়, বরং ‘রুশ বিশ্বের’ অংশ।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লেভরভ একবার বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছিলেন যে ইউক্রেনে অভিযান চালানোর আগে পুতিন তাঁর তিনজন উপদেষ্টার কথা শুনেছেন। তাঁরা হলেন: আইভান দ্য টেরিবল, পিটার দ্য গ্রেট ও ক্যাথরিন দ্য গ্রেট। এই তিন রুশ শাসকই [জার] রুশ ভূখণ্ডের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটিয়েছিলেন। আর [জেরিনা] ক্যাথরিন তো ইউক্রেনের অনেকটা ভেতরে ঢুকে পড়েছিলেন।
পুতিন স্পষ্টতই পুরোনো রুশ সাম্রাজ্যের হৃৎপিণ্ডের মানে ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চান এবং সম্ভবত আরও পশ্চিমে অগ্রসর হতে চান।
একইভাবে সি মনে করেন যে তাইওয়ানের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা চীনের জাতীয় অভীষ্ট এবং তাঁর নিজের এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব। সম্প্রতি এক ভাষণে তিনি দাবি করেছেন: ‘তাইওয়ান হলো চীনের পবিত্র ভূখণ্ড।’
সি এ–ও বলে আসছেন যে তাইওয়ানের বিষয়টি আর প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলতে দেওয়া যায় না। বরং চীনের সঙ্গে একীভূত হওয়ার কাজটি সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে তিনি এক যুগান্তকারী অর্জন সাধন করবেন, যা তাঁকে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও সে–তুংয়ের সমমর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে পারে।
সাম্রাজ্য বিষয়ে ট্রাম্পের আগ্রহ অবশ্য সাম্প্রতিক কালের। তাঁর উপদেষ্টারা এখন চেষ্টা করছেন গ্রিনল্যান্ড, পানামা ও গাজা নিয়ে তাঁর বিবৃতিগুলোকে অতীতের জের টেনে যৌক্তিকতা দেওয়ার। একে বলা হয় ‘সেনওয়াশিং’ [যার মানে হলো, কোনো অযৌক্তিক, উগ্র বা পাগলাটে লোকের কথাবার্তা বা চিন্তাভাবনাকে খানিকটা যৌক্তিক বা স্বাভাবিক দেখানোর প্রয়াস, যদিও বাস্তবে সেটা তা নয়।]
পুতিনের বিষয়ে এটা বলা যায় যে প্রথম দিকে তাঁর সাফাই গাওয়া লোকজন জাতীয় নিরাপত্তার বয়ানের আবরণে তাঁর চিন্তা ও পদক্ষেপকে যৌক্তিকতা দিয়েছে।
এখন গ্রিনল্যান্ডে তো মূল্যবান খনিজ সম্পদ রয়েছে। আর চীনারা পানামা খালের আশপাশেই ঘোরাফেরা করছে। কিন্তু কানাডা বা গাজা নিয়ে ট্রাম্পের পক্ষে কী সাফাই গাওয়া যায়? এখানে এসে যৌক্তিকতার ব্যাখ্যা তো উদাসীনদের কিংবা বিদ্রূপের হাসি হেসে থাকে এমন সব লোকের কাছে চলে গেছে।
ট্রাম্পের ভূখণ্ড সম্প্রসারণের কোনো গ্রহণযোগ্য কৌশলগত যৌক্তিকতা না থাকায় একমাত্র বিকল্প ব্যাখ্যা হলো তাঁর ব্যক্তিগত মহিমা প্রতিষ্ঠা করা। যদি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার কোনো এক রহস্যজনক কারণে তাঁর হাতে না ওঠে, তাহলে আমেরিকার ভূসীমা সম্প্রসারণের কৃতিত্ব হিসেবে ট্রাম্প অন্তত দক্ষিণ ডাকোটায় মাউন্ট রুশমোরে খোদাই করা জর্জ ওয়াশিংটন, থমাস জেফারসন, থিওডোর রুজভেল্ট ও আব্রাহাম লিংকনের আবক্ষ প্রতিকৃতির পাশে নিজের চেহারা খোদাই করে রাখতে পারবেন!
কোনো রকম যৌক্তিকতার তোয়াক্কা না করে ট্রাম্প যে আমেরিকার ভূসীমা বাড়াতে উদ্গ্রীব, তা আরো পরিষ্কার হয়ে গেছে ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটেই ফ্রেডরিখসেনের সঙ্গে তাঁর জঘন্য ফোনালাপের পর। গ্রিনল্যান্ডের সার্বভৌমত্ব ছাড়া তিনি অন্য যেকোনো কিছু ট্রাম্পের চাহিদা অনুসারে কমবেশি দিতে সম্মত আছেন। যেমন যুক্তরাষ্ট্র যদি সামরিক ঘাঁটি বাড়াতে চায় বা খনিজ সম্পদের মালিকানা চায়। কিন্তু ট্রাম্প ওসবে তুষ্ট নয়। গ্রিনল্যান্ড তাঁর চাইই।
ট্রাম্পের কানাডা বা গাজা দখল করে নেওয়াটা আপাত-অসম্ভব, কিন্তু পানামা খাল ও গ্রিনল্যান্ড নয়। আমেরিকার সেনা নামলে তাদের সামনে পানামাবাসী বা ডেনিশরা একেবারে অসহায় হয়ে পড়বে।
যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের নেতৃত্ব যখন সম্প্রসারণবাদী উচ্চাভিলাষী মানুষের হাতে, তখন বিষয়টি বর্তমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার জন্য খুবই বিবর্ণ। বিশ্ব সম্ভবত সেই সময় থেকে সরে যাচ্ছে, যখন ছোট দেশগুলো আন্তর্জাতিক আইনের সুরক্ষা দাবি করতে পারে।
প্রাচীন গ্রিস ইতিহাসবিদ থুসিডাইস তো বলে গিয়েছিলেন: ‘শক্তিশালীরা যা পারে, তা–ই করবে আর দুর্বলরা আক্রান্ত হবে, যা তাদের হতেই হবে।’
এ রকম একটি বিশ্ব হয়তো বা বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে এক অস্বস্তিকর শান্তির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ হবে তাদের প্রভাববলয়ের ভিত্তিতে। যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম গোলার্ধেই মনোনিবেশ করবে, রাশিয়ার নজর থাকবে পূর্ব ইউরোপে আর চীনের পূর্ব এশিয়ায়। ১৯ শতকে বৃহৎ শক্তিরা সারা দুনিয়াকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেওয়ার জন্য রীতিমতো বৈশ্বিক সম্মেলনও করেছিল। যেমন: ১৮৮৪-৮৫ সময়কালে বার্লিনে তারা সমবেত হয়েছিল আফ্রিকা ভাগ-দখল করার জন্য।
তবে এই ধরনের বণ্টন-দখল অন্তর্নিহিতভাবেই অস্থিতিশীল। ১৯ শতকে বৃহৎ শক্তিগুলোর বোঝাপড়া ২০ শতকে এসে ভেঙে পড়ে দুটি বিশ্বযুদ্ধে রূপ নেয়।
সাম্রাজ্যবাদী আদর্শের উত্থান অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জন্যও তাৎপর্যবাহী। সাম্রাজ্য মানে সম্রাটও। পুতিন ও সির সম্প্রসারণবাদী পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হচ্ছে দেশের ভেতরে ব্যক্তি বন্দনা ও রাজনৈতিক দমন-পীড়নের হাত ধরে। ট্রাম্পের বিদেশবিষয়ক অভিলাষ মিলিত হয়েছে ভেতরকার নিজস্ব শত্রুকে নির্মূল করার লক্ষ্যের সঙ্গে।
এই নির্মূলকরণের বেশির ভাগটাই আবার করছেন ইলন মাস্ক। তিনি আবার বলেছেন যে তিনি প্রতিদিনই রোমান সাম্রাজ্যের কথা ভাবেন। আমেরিকার হয়তো একজন ‘হাল আমলের সুল্লা’ প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি। লুসিয়াস সুল্লা ফেলিক্স ছিলেন একজন রোমান স্বৈরশাসক যিনি রাষ্ট্রকে সংস্কার করার পাশাপাশি শত শত বিরোধীদের হত্যা করেছিলেন।
তো? আপনাকে কিন্তু সতর্ক করা হয়েছে।
গিডিয়ন রাখম্যান ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এর (এফটি) পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রধান কলামিস্ট। এফটি থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে রূপান্তর তানিম আসজাদ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আম র ক র ইউক র ন ক ত কত র জন য ল কর র
এছাড়াও পড়ুন:
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তরুণ গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় মামলা, গ্রেপ্তার ৫
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলায় দুর্বৃত্তদের গুলিতে মো. রাব্বি মিয়া (২০) নামের এক তরুণ আহত হওয়ার ঘটনায় ১০ জনের নামে মামলা হয়েছে। গুলির ঘটনায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আজ শনিবার সকালে আহত রাব্বির মা জোহরা খাতুন বাদী হয়ে মামলাটি করেন।
গুলিবিদ্ধ রাব্বি উপজেলার শাহবাজপুর গ্রামের হেলাল মিয়ার ছেলে। বর্তমানে রাব্বি পরিবারের সঙ্গে নবীনগর পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মাঝিকাড়া এলাকায় ভাড়া থাকেন। তিনি পেশায় একজন অ্যাম্বুলেন্সচালক।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন নবীনগর উপজেলার টিঅ্যান্ডটিপাড়ার বাসিন্দা মো. আতাউর রহমান (৪৮), জাহিদ মিয়া (১৯), জুবায়েদ মুন্সী (১৯), মো. আহসান উল্লাহ (৪৪) ও মো. জসিম উদ্দিন (৪৪)। তাঁরা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) মো. খুরশিদ আলম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ নভেম্বর টিঅ্যান্ডটিপাড়ার বাসিন্দা মো. সানি (২০) ও একই পাড়ার মো. জিসানের মধ্যে কথা–কাটাকাটি ও তর্ক হয়। একপর্যায়ে ঝগড়ার সময় সানি জিসানকে ছুরিকাঘাত করেন। এ ঘটনার জেরে উভয় পক্ষ সালিস ডাকে। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা সোয়া ছয়টার দিকে নবীনগর পৌর এলাকার কালীবাড়ি মোড়ের জমিদারবাড়ির মাঠে সানিসহ তাঁর লোকজন ও জিসানসহ তাঁর লোকজন সালিসে বসেন।
গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত রাব্বি সানির পক্ষের সমর্থক। তবে সালিসের রায়ে সানি ও তাঁর লোকজন সম্মত হননি। সালিস ছেড়ে ওঠার সময় জিসানসহ তাঁর লোকজন সানির লোকজনের ওপর হামলা চালান। একপর্যায়ে জিসান বন্দুক বের করে গুলি করেন। এতে রাব্বি গুলিবিদ্ধ হন এবং প্রতিপক্ষের হামলায় সানি আহত হন।
গুরুতর আহত অবস্থায় স্থানীয় লোকজন রাব্বিকে উদ্ধার করে নবীনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
নবীনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান বলেন, তরুণের বুকের বাঁ পাশের পাঁজরে গুলি লেগেছে।
নবীনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল মধ্যরাত পর্যন্ত উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে গুলির ঘটনার সঙ্গে জড়িত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলার অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।