ট্রাম্প কি ‘রোমান সাম্রাজ্য’ গড়ার পথে হাঁটছেন
Published: 12th, February 2025 GMT
আপনারা তো নয়া উদারতাবাদ ও নয়া রক্ষণশীলতার কথা শুনেছেন। আর এখন আপনাদের নয়া সাম্রাজ্যবাদের জমানায় স্বাগত জানাতে হচ্ছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণকালে সূচনা বক্তব্যে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে তাঁর দেশ আবার নিজেকে ‘একটি উদীয়মান জাতি হিসেবে বিবেচনা করবে, এমনভাবে তা করবে যেন আমাদের সম্পদ বাড়ে, আমাদের ভূখণ্ড সম্প্রসারিত হয়।’
অনেকেই আশা করেছিলেন যে ভূখণ্ড বা ভৌগোলিক সীমারেখা সম্প্রসারণ নিয়ে ট্রাম্পের কথাবার্তা শুধু ফাঁকা বুলি, যা মিইয়ে যাবে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি ঘন ঘন যেসব ভূখণ্ড দখল করার কথা বলছেন, তা ফাঁকা বুলি হিসেবে উপেক্ষা করা বা উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়।
ট্রাম্প বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই বলেছেন যে আমেরিকা গ্রিনল্যান্ড নিয়ে নেবে। তিনি পানামা খাল ফিরিয়ে নেওয়ার কথাও জোরেশোরে উচ্চারণ করেছেন। কানাডাকে আমেরিকার ৫১তম অঙ্গরাজ্য করার কথা বারবারই বলছেন। আর গেল সপ্তাহে তিনি গাজার মালিকানা দাবি করে বসেছেন।
এভাবে বিভিন্ন ভূখণ্ড দখল করার বিষয়ে ট্রাম্পের প্রবল বাসনা তাঁর অনেক সমর্থককেও হতভম্ব করেছে। কিন্তু বৈশ্বিক প্রবণতার অংশ হিসেবে দেখলে ট্রাম্পের এই সম্প্রসারণবাদী অভিলাষ বুঝতে পারা সহজ হয়। যে দুজন বিশ্বনেতাকে তিনি তাঁর সত্যিকারের সতীর্থ হিসেবে দেখেন, তাঁরাও ভৌগোলিক সীমারেখা বাড়ানোকে একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় লক্ষ্য হিসেবে মনে করেন আর নিজেদের বিরাটত্বের অংশ হিসেবে বিবেচনা করেন। এই দুজন হলেন ভ্লাদিমির পুতিন ও সি চিন পিং।
রাশিয়ার সরকারি লোকজন প্রায়ই ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধকে তাঁদের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে যৌক্তিক বলে দাবি করেন। কিন্তু পুতিন নিজে এই ধারণায় প্রবলভাবে মোহাবিষ্ট যে ইউক্রেন কোনো পূর্ণাঙ্গ দেশ নয়, বরং ‘রুশ বিশ্বের’ অংশ।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লেভরভ একবার বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছিলেন যে ইউক্রেনে অভিযান চালানোর আগে পুতিন তাঁর তিনজন উপদেষ্টার কথা শুনেছেন। তাঁরা হলেন: আইভান দ্য টেরিবল, পিটার দ্য গ্রেট ও ক্যাথরিন দ্য গ্রেট। এই তিন রুশ শাসকই [জার] রুশ ভূখণ্ডের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটিয়েছিলেন। আর [জেরিনা] ক্যাথরিন তো ইউক্রেনের অনেকটা ভেতরে ঢুকে পড়েছিলেন।
পুতিন স্পষ্টতই পুরোনো রুশ সাম্রাজ্যের হৃৎপিণ্ডের মানে ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চান এবং সম্ভবত আরও পশ্চিমে অগ্রসর হতে চান।
একইভাবে সি মনে করেন যে তাইওয়ানের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা চীনের জাতীয় অভীষ্ট এবং তাঁর নিজের এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব। সম্প্রতি এক ভাষণে তিনি দাবি করেছেন: ‘তাইওয়ান হলো চীনের পবিত্র ভূখণ্ড।’
সি এ–ও বলে আসছেন যে তাইওয়ানের বিষয়টি আর প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলতে দেওয়া যায় না। বরং চীনের সঙ্গে একীভূত হওয়ার কাজটি সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে তিনি এক যুগান্তকারী অর্জন সাধন করবেন, যা তাঁকে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও সে–তুংয়ের সমমর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে পারে।
সাম্রাজ্য বিষয়ে ট্রাম্পের আগ্রহ অবশ্য সাম্প্রতিক কালের। তাঁর উপদেষ্টারা এখন চেষ্টা করছেন গ্রিনল্যান্ড, পানামা ও গাজা নিয়ে তাঁর বিবৃতিগুলোকে অতীতের জের টেনে যৌক্তিকতা দেওয়ার। একে বলা হয় ‘সেনওয়াশিং’ [যার মানে হলো, কোনো অযৌক্তিক, উগ্র বা পাগলাটে লোকের কথাবার্তা বা চিন্তাভাবনাকে খানিকটা যৌক্তিক বা স্বাভাবিক দেখানোর প্রয়াস, যদিও বাস্তবে সেটা তা নয়।]
পুতিনের বিষয়ে এটা বলা যায় যে প্রথম দিকে তাঁর সাফাই গাওয়া লোকজন জাতীয় নিরাপত্তার বয়ানের আবরণে তাঁর চিন্তা ও পদক্ষেপকে যৌক্তিকতা দিয়েছে।
এখন গ্রিনল্যান্ডে তো মূল্যবান খনিজ সম্পদ রয়েছে। আর চীনারা পানামা খালের আশপাশেই ঘোরাফেরা করছে। কিন্তু কানাডা বা গাজা নিয়ে ট্রাম্পের পক্ষে কী সাফাই গাওয়া যায়? এখানে এসে যৌক্তিকতার ব্যাখ্যা তো উদাসীনদের কিংবা বিদ্রূপের হাসি হেসে থাকে এমন সব লোকের কাছে চলে গেছে।
ট্রাম্পের ভূখণ্ড সম্প্রসারণের কোনো গ্রহণযোগ্য কৌশলগত যৌক্তিকতা না থাকায় একমাত্র বিকল্প ব্যাখ্যা হলো তাঁর ব্যক্তিগত মহিমা প্রতিষ্ঠা করা। যদি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার কোনো এক রহস্যজনক কারণে তাঁর হাতে না ওঠে, তাহলে আমেরিকার ভূসীমা সম্প্রসারণের কৃতিত্ব হিসেবে ট্রাম্প অন্তত দক্ষিণ ডাকোটায় মাউন্ট রুশমোরে খোদাই করা জর্জ ওয়াশিংটন, থমাস জেফারসন, থিওডোর রুজভেল্ট ও আব্রাহাম লিংকনের আবক্ষ প্রতিকৃতির পাশে নিজের চেহারা খোদাই করে রাখতে পারবেন!
কোনো রকম যৌক্তিকতার তোয়াক্কা না করে ট্রাম্প যে আমেরিকার ভূসীমা বাড়াতে উদ্গ্রীব, তা আরো পরিষ্কার হয়ে গেছে ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটেই ফ্রেডরিখসেনের সঙ্গে তাঁর জঘন্য ফোনালাপের পর। গ্রিনল্যান্ডের সার্বভৌমত্ব ছাড়া তিনি অন্য যেকোনো কিছু ট্রাম্পের চাহিদা অনুসারে কমবেশি দিতে সম্মত আছেন। যেমন যুক্তরাষ্ট্র যদি সামরিক ঘাঁটি বাড়াতে চায় বা খনিজ সম্পদের মালিকানা চায়। কিন্তু ট্রাম্প ওসবে তুষ্ট নয়। গ্রিনল্যান্ড তাঁর চাইই।
ট্রাম্পের কানাডা বা গাজা দখল করে নেওয়াটা আপাত-অসম্ভব, কিন্তু পানামা খাল ও গ্রিনল্যান্ড নয়। আমেরিকার সেনা নামলে তাদের সামনে পানামাবাসী বা ডেনিশরা একেবারে অসহায় হয়ে পড়বে।
যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের নেতৃত্ব যখন সম্প্রসারণবাদী উচ্চাভিলাষী মানুষের হাতে, তখন বিষয়টি বর্তমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার জন্য খুবই বিবর্ণ। বিশ্ব সম্ভবত সেই সময় থেকে সরে যাচ্ছে, যখন ছোট দেশগুলো আন্তর্জাতিক আইনের সুরক্ষা দাবি করতে পারে।
প্রাচীন গ্রিস ইতিহাসবিদ থুসিডাইস তো বলে গিয়েছিলেন: ‘শক্তিশালীরা যা পারে, তা–ই করবে আর দুর্বলরা আক্রান্ত হবে, যা তাদের হতেই হবে।’
এ রকম একটি বিশ্ব হয়তো বা বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে এক অস্বস্তিকর শান্তির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ হবে তাদের প্রভাববলয়ের ভিত্তিতে। যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম গোলার্ধেই মনোনিবেশ করবে, রাশিয়ার নজর থাকবে পূর্ব ইউরোপে আর চীনের পূর্ব এশিয়ায়। ১৯ শতকে বৃহৎ শক্তিরা সারা দুনিয়াকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেওয়ার জন্য রীতিমতো বৈশ্বিক সম্মেলনও করেছিল। যেমন: ১৮৮৪-৮৫ সময়কালে বার্লিনে তারা সমবেত হয়েছিল আফ্রিকা ভাগ-দখল করার জন্য।
তবে এই ধরনের বণ্টন-দখল অন্তর্নিহিতভাবেই অস্থিতিশীল। ১৯ শতকে বৃহৎ শক্তিগুলোর বোঝাপড়া ২০ শতকে এসে ভেঙে পড়ে দুটি বিশ্বযুদ্ধে রূপ নেয়।
সাম্রাজ্যবাদী আদর্শের উত্থান অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জন্যও তাৎপর্যবাহী। সাম্রাজ্য মানে সম্রাটও। পুতিন ও সির সম্প্রসারণবাদী পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হচ্ছে দেশের ভেতরে ব্যক্তি বন্দনা ও রাজনৈতিক দমন-পীড়নের হাত ধরে। ট্রাম্পের বিদেশবিষয়ক অভিলাষ মিলিত হয়েছে ভেতরকার নিজস্ব শত্রুকে নির্মূল করার লক্ষ্যের সঙ্গে।
এই নির্মূলকরণের বেশির ভাগটাই আবার করছেন ইলন মাস্ক। তিনি আবার বলেছেন যে তিনি প্রতিদিনই রোমান সাম্রাজ্যের কথা ভাবেন। আমেরিকার হয়তো একজন ‘হাল আমলের সুল্লা’ প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি। লুসিয়াস সুল্লা ফেলিক্স ছিলেন একজন রোমান স্বৈরশাসক যিনি রাষ্ট্রকে সংস্কার করার পাশাপাশি শত শত বিরোধীদের হত্যা করেছিলেন।
তো? আপনাকে কিন্তু সতর্ক করা হয়েছে।
গিডিয়ন রাখম্যান ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এর (এফটি) পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রধান কলামিস্ট। এফটি থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে রূপান্তর তানিম আসজাদ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আম র ক র ইউক র ন ক ত কত র জন য ল কর র
এছাড়াও পড়ুন:
রাখাইনে করিডোর কি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আশার আলো দেখাবে
রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে নতুন আলোচনা ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এর সূত্রপাত হয় সম্প্রতি মিয়ানমার সীমান্তে হিউম্যানিটারিয়ান বা মানবিক করিডর গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্যের মাধ্যমে, যেখানে তিনি বলেন, বাংলাদেশ এ বিষয়ে একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গত দুই মাসে রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে ক্রমাগত নানা আলোচনা ও সমালোচনা চলমান। রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম ইতিবাচক আলোচনা শুরু হয় মার্চ মাসে, যখন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে পবিত্র রোজার মাসে তাদের সঙ্গে ইফতার করেন।
এ সময় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাদের মেহমান উল্লেখ করে বলেন, তিনি প্রত্যাশা করেন আগামী রোজা রোহিঙ্গারা নিজ দেশে করতে পারবেন।
পরবর্তী সময়ে ষষ্ঠ বিমসটেক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে একটি পার্শ্ব আলোচনার পর মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে নীতিগতভাবে সম্মত।
এ নিয়েও জনসাধারণের মধ্যে একধরনের ধোঁয়াশা কাজ করে। কেননা, আরাকান আর্মিকে উপেক্ষা করে এ ধরনের মন্তব্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে খুব বেশি আশার আলো দেখাবে না। এর বেশ কিছুদিন পরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের সঙ্গে যে সহিংস দ্বন্দ্ব চলমান, সে প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এখনই সম্ভব নয়।
এই চলমান আলোচনায় নতুন বিতর্ক তৈরি হয় রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার আলোচনার মাধ্যমে, যদিও এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন, এ বিষয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কারও সঙ্গে তাঁদের এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। এমন নানামুখী আলোচনায় জনমনে বিভ্রান্তি আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার প্রধান যুক্তি হলো, এতে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারে অবস্থানরত জনগোষ্ঠীর সাহায্যার্থে ত্রাণ এবং অন্যান্য প্রয়োজনের সামগ্রী পাঠানো সম্ভব হবে।
মানবিক করিডর ও রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে আলোচনার আগে একটু দেখে নেওয়া যাক মানবিক করিডর বলতে আসলে কী বোঝায়।
জাতিসংঘের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সশস্ত্র সংঘাতপূর্ণ এলাকায় সংঘাত বা যুদ্ধ পরিস্থিতির সাময়িক বিরতির জন্য অনেক ধরনের পন্থা অবলম্বন করা হয়, তার মধ্যে একটি হলো মানবিক করিডরের প্রস্তাব।
এই মানবিক করিডরের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এমন একটি জায়গা নির্ধারণ করা হয়, যেখানে সশস্ত্র সংঘাত যেন না ঘটে। সে বিষয়ে দুই পক্ষ জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একমত হয়। মানবিক করিডরের পরবর্তী ধাপে সেই ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের অধিবাসীদের একটি নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় অথবা সেখানে খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবার ব্যবস্থা হয়।
এ ধরনের মানবিক করিডরের উদাহরণ আমরা ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে সংঘাতপূর্ণ বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে দেখতে পাই। এখানে সামগ্রিক কর্মকাণ্ড জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হবে, সেটাই প্রত্যাশা করা হয়। বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, জাতিসংঘের ত্রাণবিষয়ক প্রতিষ্ঠান রেডক্রস এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির মধ্যে অন্যতম হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইহুদি শিশুদের যুক্তরাজ্যে স্থানান্তর, নব্বইয়ের দশকে সারায়েভো সংকট, ২০১৮ সালে সিরিয়ার জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা এবং সর্বশেষ দেখতে পাই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে।
যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা।রাখাইনকে ঘিরে মানবিক করিডর গড়ে তোলার এই নীতিগত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে গবেষক, রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক ও সাধারণ জনগণের মধ্যে বেশ কিছু প্রশ্ন, আশঙ্কা ও দ্বিধা তৈরি হয়েছে।
তবে শঙ্কার পাশাপাশি কোনো কোনো গবেষক মনে করছেন, মানবিক করিডরের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলার চলমান সংলাপ আরও জোরদার হবে, যা ভবিষ্যতে এই সংকট মোকাবিলায়, বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
তবে এই ইতিবাচক প্রত্যাশা ছাপিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে কেন্দ্র করে যে দ্বিধা রয়েছে, সেটি হলো এই মানবিক করিডরের মাধ্যমে ভবিষ্যতে কি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত হবে, নাকি আরও বিলম্বিত হবে, নাকি আরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার সুযোগ পাবে।
ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি, এক লাখের ওপরে রোহিঙ্গা শরণার্থী আবারও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ এই দায় যেমন এড়িয়ে যেতে পারছে না, তেমনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনার ভারও বহন করতেও হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসহ তাদের অন্যান্য সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে মানবিক করিডর কতটা বাস্তবসম্মত হবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। কেননা, কোনো বিস্তারিত দিকনির্দেশনা আমাদের সামনে নেই।
অতীতের বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, মানবিক করিডরের অন্যতম প্রধান ব্যবহার হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ জাতিগোষ্ঠীকে সংঘাতপূর্ণ স্থান থেকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা। যেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে চলমান অনুপ্রবেশ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, সেখানে মানবিক করিডরের মাধ্যমে আরও বৃহৎ অংশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে স্থানান্তর করার প্রক্রিয়ায় শুরু অস্বাভাবিক নয়।
এ প্রেক্ষাপটে যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা।
এর বাইরে আরেকটি চিন্তার জায়গা হলো সীমান্ত এলাকা বাংলাদেশ কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে, সেটি। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি দেখলে বোঝা যায়, সীমান্ত প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের বর্তমান প্রচেষ্টা খুব যে সুখকর, সেটি বলা যাবে না।
এ ছাড়া এই অঞ্চল বিভিন্ন কারণে মাদক ব্যবসা, মানব পাচার, সহিংসতা ও অন্যান্য নিরাপত্তাঝুঁকির জন্য একটি অন্যতম হটস্পট, যা নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের নানাভাবে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয় কি না, সেটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। মানবিক করিডরের মাধ্যমে বাংলাদেশ কীভাবে লাভবান হতে পারে, সে বিষয়েও যথাযথ পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে এবং নিজেদের স্বার্থেই আমাদের স্বচ্ছ থাকতে হবে।
এর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোসহ অন্য অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ করারও বিশেষ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কেননা, এর পরবর্তী পরিণতি ও ব্যবস্থাপনার দায়দায়িত্ব ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারকেই গ্রহণ ও বহন করতে হবে। যদিও জাতিসংঘের মানবিক করিডরের প্রস্তাব বেশ পুরোনো, কিন্তু তড়িঘড়ি করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হিতে বিপরীত হতে পারে। শরণার্থী বিষয়ে একটি টেকসই রূপরেখা এবং পরিকল্পনানীতি না থাকার কারণে সরকারকে অ্যাডহক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যাজনক হয়।
এসব বিবেচনায় নিয়ে একজন গবেষক হিসেবে আমি বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গাবিষয়ক একটি জাতীয় রোডম্যাপ বা রূপরেখা এবং শরণার্থীবিষয়ক নীতি প্রণয়ন করার পক্ষে কথা বলে আসছি। আমাদের সে ধরনের কোনো দৃশ্যমান পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি বিগত সময়ে ছিল না। বিশেষ করে যদি প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হয় এবং জাতিসংঘের প্রস্তাবিত মানবিক করিডর আমাদের প্রত্যাশামতো কাজ না করে, তাহলে বিকল্প কী হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি আমাদের থাকা উচিত। সেটি না হলে রোহিঙ্গা সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করবে এবং তাদের নিজ দেশে স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন একটি ‘মিথ’ হিসেবে থেকে যাবে, যা আমাদের ও রোহিঙ্গা উভয়ের জন্যই হতাশার একটি বিষয় হবে।
● বুলবুল সিদ্দিকী সহযোগী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়