আরাকান ইস্যুতে বাংলাদেশ কি কৌশল পাল্টাবে
Published: 21st, February 2025 GMT
সার্বভৌমত্ব ও স্বায়ত্তশাসনকামী আরাকান আর্মি বাংলাদেশ সীমান্তে নতুন প্রতিবেশী হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। অর্থাৎ প্রতিবেশী পাল্টায় না বলে বাংলাদেশে যে বয়ান প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, তা বদলে যাচ্ছে। নতুন প্রতিবেশীর সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক নির্মাণে বাংলাদেশ কি প্রস্তুত?
প্রায় ১৬ বছর স্বৈরশাসনের অধীনে থাকা বাংলাদেশ তার প্রতিবেশী মিয়ানমারের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে পারেনি। বাংলাদেশ এত দিন একতরফাভাবে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের দুঃশাসনকে সমর্থন করে গেছে। বিগত বছরগুলোতে রোহিঙ্গা বিষয়ে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া দূরে থাক, জান্তা সরকারের সঙ্গে একটিবারের জন্যও কোনো কার্যকর আলোচনায় বসতে পারেনি।
অন্যতম বড় যে ভুল বিগত স্বৈরাচারী সরকার করেছে, তা হলো গত বছর বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া জান্তা সরকারের সেনাসদস্যদের ফেরত দেওয়া। লক্ষণীয় বিষয় হলো, কোন বাহনে, কখন, কীভাবে তাঁরা বাংলাদেশ থেকে ফিরে যাবেন, সে ব্যাপারে মিয়ানমারের শর্ত মেনে তাঁদের ফেরত দেওয়া হয়েছিল।
অথচ রোহিঙ্গা গণহত্যাকারী এবং গণহত্যার সাক্ষী হিসেবে এই সেনাসদস্যদের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল; সেখানে তাঁদের সাক্ষ্য নেওয়া যেতে পারত। কেন মিয়ানমার সরকারের শর্তানুযায়ী সে দেশ থেকে পালিয়ে আসা সৈন্যদের ফেরত দিল বাংলাদেশ?
এর কারণ হলো বাংলাদেশের তৎকালীন সরকার ধরে নিয়েছিল, তারা নিজেরা এবং মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী চিরকাল ক্ষমতায় থাকবে। এর ফলে তারা এমন কিছু করতে চায়নি, যাতে মিয়ানমারের জান্তা সরকার ক্ষুব্ধ হতে পারে। এ–জাতীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে অনুসৃত বাংলাদেশের মিয়ানমার নীতির মূল বৈশিষ্ট্য হলো, মিয়ানমারের কাছে নতজানু হয়ে থাকা।
‘স্টেট অ্যাক্টর’ ও ‘নন-স্টেট অ্যাক্টর’
পরিতাপের বিষয় হলো, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও মিয়ানমারের প্রতি এখনো আগের নীতিই অনুসরণ করছে। ফলে ২০২৪ সালে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মিয়ানমারের আরাকান আর্মির সঙ্গে কোনো সংলাপে বসতে পারেনি; বরং তাদের ‘নন-স্টেট অ্যাক্টর’ আখ্যা দিয়ে তাদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে চলেছে।
রোহিঙ্গা সংকটে যেসব দেশ বাংলাদেশের মতো ভুক্তভোগী বা ঝুঁকিতে নেই, তারাও নন-স্টেট অ্যাক্টর তথা মিয়ানমারের আরাকান আর্মির সঙ্গে রীতিমতো আনুষ্ঠানিকভাবে যোগাযোগ শুরু করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা তথা সংলাপ আয়োজনের ক্ষেত্রে উদ্যোগী নয়।
প্রশ্ন উঠতে পারে, নন-স্টেট অ্যাক্টরের সঙ্গে যোগাযোগ করা না করার কোনো নীতি বা নির্দেশনা কি বাংলাদেশের আছে? সত্যি কথা হলো, বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত কোনো শরণার্থী নীতিই প্রণয়ন করতে পারেনি। তাহলে কোন নীতি বা সনদ অনুযায়ী আরাকান আর্মি নন-স্টেট অ্যাক্টর হওয়ায় তাদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে দূরত্ব তৈরি করা হলো? নাকি এটি নিছক একটি অজুহাত?
একটি রাষ্ট্র কেবল জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত সরকার দ্বারা পরিচালিত আরেকটি রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ করবে—এমন নীতিতে বহাল থাকতে পারে না। মনে রাখত হবে, বাংলাদেশের বর্তমানে দায়িত্বশীল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনগণ কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচিত সরকার নয়; নির্বাচিত না হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পর্ক বজায় রেখেছে। অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক ও সংলাপের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশকে এ বিষয়টা বিবেচনায় রাখতে হবে।
সন্দেহ নেই, আরাকান আর্মি একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। তারা কয়েক দশক ধরে নিজ ভূমিতে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অবিচল ছিল। কিন্তু শুধু সশস্ত্র গোষ্ঠী হওয়ার কারণে এবং কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না থাকায় তাদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখাটা বাংলাদেশের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশের পৌনে তিন শ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকায় এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে তারা মিয়ানমারের সামরিক শাসকের অধীনে থাকা আরও এক বা একাধিক শহর দখল করতে যাচ্ছে।
যে বিষয়টা আমাদের গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় রাখতে হবে, তা হলো এই আরাকান আর্মি রোহিঙ্গা সংকটের যেমন অন্যতম কারণ, তেমনি তাদের ছাড়া এই সংকট ব্যবস্থাপনার আর কোনো পথ নেই।
এসব কারণে তাদের নন-স্টেট অ্যাক্টর আখ্যা দিয়ে দূরে থাকার বদলে বাংলাদেশ সরকারের মিয়ানমার নীতি এবং আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগের কৌশল নিয়ে ভাবতে হবে। অতীতের মতো দেশের স্বার্থবর্জিত, অদূরদর্শী ও ‘নীতি ছাড়া নীতি’তে (নো পলিসি ইজ আ পলিসি) নয়; বরং দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে টেকসই ও কার্যকর সম্পর্ক নির্মাণে সহায়ক নীতি প্রণয়ন করতে হবে।
আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের ‘দখলদারি’ শেষে তালেবান দেশটির ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। এরপর চীন ও রাশিয়া কিন্তু কোনো রাখঢাক না করেই তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। এই যোগাযোগপ্রক্রিয়া তারা বেশ আগেই শুরু করেছিল। এই যোগাযোগ ও সম্পর্ক তৈরির অনেক কারণের মধ্যে চীন ও রাশিয়ার কাছে অন্যতম কারণ ছিল, নিজ দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া।
আফগানিস্তানের উদাহরণ থেকে আমাদেরও বুঝতে হবে, আরাকান আর্মির মতো দলকে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে মেনে নেওয়া এখন সময়ের দাবি। এ রকম দাবি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তৈরি হয়; কোনো নীতি, সংবিধান, সনদ মেনে বা বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হয় না।
বাংলাদেশের স্বার্থেই রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান বা বর্তমানের চেয়ে ভালো বিকল্প বের করা উচিত। রোহিঙ্গা বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের দিকে বাংলাদেশ হয়তো বেশি মনোযোগ দিচ্ছে; কিন্তু ‘বাক্সবন্দী চিন্তা’ থেকে বের হয়ে আসা এবং বিগত সরকারের মিয়ানমার নীতির বাইরে রোহিঙ্গা সংকট ব্যবস্থাপনার ভালো বিকল্প খোঁজ করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার কি ততটা মনোযোগ দিচ্ছে?
বলা হয়ে থাকে যে মানবাধিকারের বিষয়ে নন-স্টেট অ্যাক্টরদের কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না। ২০১৭ সালে মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সরকার (তথাকথিত) ছিল। রোহিঙ্গা গণহত্যায় স্টেট অ্যাক্টর, অর্থাৎ সরকারের অংশগ্রহণের মাধ্যমে মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত করার নজির কি পৃথিবী দেখেনি? তখন তারা কার কাছে দায়বদ্ধ ছিল?
স্টেট অ্যাক্টর ও নন-স্টেট অ্যাক্টর নিয়ে বিভ্রান্তির অবসানের জন্য আমরা নিজের দেশের দিকেও তাকাতে পারি। আমাদের বিগত সরকার, তথা স্টেট অ্যাক্টর গত দেড় দশকের বেশি সময় স্বৈরাচারী শাসন কায়েম করে জনগণের অনেক অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেই সরকারের পতন হয়েছে এবং অভ্যুত্থানকারীদের সমর্থনেই নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। এ থেকে স্পষ্ট যে নন-স্টেট অ্যাক্টরও পরবর্তী সময়ে ‘স্টেট অ্যাক্টর’ হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশ কী অর্জন করতে চায়
আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাওয়াটাই অবশ্য বড় কথা নয়; যোগাযোগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ কী অর্জন করতে চায়, তা সরকারের কাছে পরিষ্কার কি না, সেটিই হলো মুখ্য বিষয়। নিজস্ব অবস্থান থেকে সরে আসার একাধিক রেকর্ড রয়েছে আরাকান আর্মির। এর ফলে সংলাপ বা সম্পর্ক তৈরির আগে অনেক বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকতে হবে এবং ‘হোমওয়ার্ক’ করতে হবে।
একটি ছোট উদাহরণ দেওয়া যাক। ২০২২ সালে আরাকান আর্মির কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল ওয়াং ম্রা নাইং যেভাবে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কথা বলেছিলেন, ২০২৫ সালেও কি তিনি একই অবস্থানে বহাল আছেন? বাংলাদেশ সরকারের কাছে এ প্রশ্নের যথাযথ উত্তর থাকা দরকার।
২০২২ সালে এক সাক্ষাৎকারে নতুন আরাকান রাষ্ট্র তৈরির বাধা প্রসঙ্গে ওয়াং ম্রা নাইং বলেছিলেন, ‘আশপাশের শক্তিশালী দেশগুলো কেউ চাইছে না এ অঞ্চলে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হোক। এ রকম নতুন রাষ্ট্র বেরিয়ে এলে শক্তিশালী দেশগুলোর ভয় হলো, তাদের “বিচ্ছিন্নতাবাদীরা” উৎসাহিত হবে।’ (পার্বত্য নিউজ, ৩ জানুয়ারি ২০২২)
সেই সময় আরাকান আর্মির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, তারা রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকারের স্বীকৃতি দেয় এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে চায়। ২০২৪ সালের শুরুর দিক পর্যন্ত আরাকান আর্মির মনোভাব অনেকটা অনুকূলে থাকলেও আলোচনার জন্য সে সুযোগগুলো বাংলাদেশ হাতছাড়া করেছে।
২০২৫ সালে এসে আরাকান আর্মি রোহিঙ্গা বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি নয়; বরং রাখাইনে রয়ে যাওয়া রোহিঙ্গারা এখন তাদের হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে—এমন খবর জানা গেছে। এর ফলাফল কী? রাখাইনে রয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ একটু একটু করে প্রতিদিন বাংলাদেশে প্রবেশ করছে।
নীতি বা অবস্থান পাল্টানো আরাকান আর্মির কাছে নৈমিত্তিক ব্যাপার। তা ছাড়া তারা যেহেতু বাইরের স্বীকৃতির চেয়ে অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্বের জন্য লড়ছে, সে ক্ষেত্রে প্রতিবেশীর কাছ থেকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া এ মুহূর্তে তাদের অগ্রাধিকারের তালিকায় নেই। তাই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে তারা বাংলাদেশের প্রস্তাব কেন বিবেচনা করবে, তা নিয়ে বাংলাদেশের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভালের কাজে নিয়োজিত সংস্থাগুলোকে একটু ভালোভাবে হোমওয়ার্ক করা প্রয়োজন। এতে দেশের ভেতর কাজ করা সংস্থাগুলোর মধ্যে যেমন ঐকমত্য সৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন, তেমনি বাইরের শক্তির সঙ্গে আলোচনা ও দেনদরবারে মুনশিয়ানা দেখানোর এটাই সময়।
মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ-মিয়ানমারের পুরো সীমান্তে আরাকান আর্মির অবস্থান। আরাকান আর্মি কোনো বিষয়ে বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান নিলে এর পুরো সুবিধা নেবে ভারত।
আরাকান আর্মিকে হটানোর জন্য বাংলাদেশের ভেতরে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়ার উপদেশ দিয়েছেন কেউ কেউ। রোহিঙ্গাদের জন্য এবং বাংলাদেশের জন্য এর পরিণতি কী হবে, তা নিশ্চয়ই রোহিঙ্গা বিষয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত সরকারের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধির কার্যালয় প্রজ্ঞার সঙ্গে বিবেচনা করে দেখবে। কিন্তু আরাকান আর্মির জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় যে সামগ্রী বাংলাদেশ থেকে যায়, তা সরবরাহের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার বিষয়টিকে পুঁজি করেই তাদের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা প্রয়োজন।
সেই আলোচনায় রোহিঙ্গা ইস্যু আনলে লাভ হবে কি না, তা অনেকাংশে নির্ভর করে আলোচনায় বাংলাদেশের কৌশলী কূটনীতির ওপর। মনে রাখা প্রয়োজন, আরাকান আর্মি সেই দল, যারা রোহিঙ্গামুক্ত আরাকান চায়। এ কারণেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগের বিকল্প নেই। অস্ত্র বা কঠোর আইনি নিষেধাজ্ঞার ভীতি নয়, এখানে প্রয়োজন দূরদর্শী কৌশল, যা বাস্তবমুখী কিন্তু নতজানু নয়।
কূটনীতিতে সফট পাওয়ার বা নমনীয় শক্তির ব্যবহার জটিল সম্পর্ককেও সহজ করতে পারে। স্ট্র্যাটেজিক মনিটর ২০১৪: ফোর স্ট্র্যাটেজিক চ্যালেঞ্জেস নামক জার্নালে ২০১৪ সালে চারটি রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় শক্তির দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতির ঊর্ধ্বে ওঠার বিষয় নিয়ে ‘ফোর স্টেট অ্যান্ড নন–স্টেট অ্যাক্টরস: বিয়ন্ড দ্য ডাইকোটমি’ শিরোনামে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। এ নিবন্ধে এমনটা বলা হয়েছে, সামনের দিনগুলোতে পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক আইনের কঠোর শক্তির (‘অনমনীয় আইনি কাঠামো’র) পরিবর্তে নমনীয় শক্তির (সফট পাওয়ার) গুরুত্ব বাড়বে, যা নন-স্টেস্ট অ্যাক্টরদের সঙ্গে সমঝোতার মূল কৌশল হবে।
রোহিঙ্গা সংকট যতটা না আরাকানের সমস্যা, তার চেয়ে বেশি এটি বাংলাদেশের সমস্যা। বাংলাদেশের স্বার্থে তাই এ বিষয়ে প্রথমে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে সরকারের দায়িত্বশীলদের আলোচনা ও ঐকমত্য সৃষ্টি প্রয়োজন এবং এর ভিত্তিতে দেশের বাইরের শক্তির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে হবে। সেই সংযোগে দেশের স্বার্থে বাংলাদেশ বাস্তবমুখী ও নমনীয় শক্তির ব্যবহার করুক, সরে আসুক বিগত সময়ের নতজানু নীতি থেকে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
ড.
ইশরাত জাকিয়া সুলতানা সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
ড. শেখ তৌফিক এম হক অধ্যাপক ও পরিচালক, সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক ল ন সরক র য গ য গ কর সরক র র অবস থ ন ত সরক র ত আর ক র জন য আম দ র ব গত স হয় ছ ল ব ষয়ট
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই সনদে আমাদের যে সম্মতি সেটি আইনের ঊর্ধ্বে: সালাহউদ্দিন
জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি চায় জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল। তবে এটিকে আইনি ভিত্তি দেওয়ার বিষয়ে একমত নয় বিএনপি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘জনগণের সার্বভৌম এখতিয়ারের ভিত্তিতেই আমরা এই ঘোষণাপত্রকে বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করছি। সেটা আমরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছি। এর চেয়ে বড় জাতীয় সম্মতি আর নেই। এটা আইনের ঊর্ধ্বে। এটা জনগণের অভিপ্রায়। এটা সার্বভৌম ব্যাপারের কাছাকাছি হয়ে গেছে।’
আজ বৃহস্পতিবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের সংলাপের ২৩তম দিনের বিরতিতে সাংবাদিকদের এ কথাগুলো জানান সালাহউদ্দিন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কর্তৃক জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ নামে যে খসড়া বিএনপির কাছে পাঠানো হয়েছে, সেখানে বাক্যগত কিছু অসামঞ্জস্যতা ছিল বলে জানান সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, ‘সেগুলো আমরা সংশোধন করেছি। সনদে প্রস্তাব আছে সরকার গঠনের দুই বছরের মধ্যে এই অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করার জন্য। আমরা এটার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। তারা বলেছিল এই প্রতিশ্রুতিগুলো পালনের জন্য, সংবিধানে এবং বিভিন্ন আইনে, বিধিবিধানে। সেখানে যা পরিবর্তন করতে হবে, সে বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। আমরা প্রতিশ্রুতিও দিয়েছি।’
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘এই সনদে শুধু কমিশন নয়, সব রাজনৈতিক দল সই করবে। এটি একটি জাতীয় ঐকমত্য। এটি জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়। এটি আইনের চেয়েও বড়, এটি একধরনের “লেজিটিমেট এক্সপেকটেশন অব দ্য পিপল”। জনগণের এই প্রত্যাশা সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে যুক্ত করার জন্য আমরা অঙ্গীকার করেছি।’ তিনি বলেন, ‘গণ–অভ্যুত্থান ও ছাত্র আন্দোলনের পথ ধরে এই ঘোষণাপত্র এসেছে। সেটার বৈধতা আমরা সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেব। এটাকে যদি আমরা আইনে ভিত্তি না বলি তাহলে কোনটাকে বলব?’
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমরা প্রস্তাব করেছি উচ্চকক্ষ আইন পর্যালোচনা ও সুপারিশের কাজ করবে, কিন্তু কোনোভাবেই তারা সংবিধান সংশোধনের এখতিয়ার পাবে না।’ তিনি বলেন, ‘উচ্চকক্ষের সদস্যরা সরাসরি নির্বাচিত না হওয়ায় তাঁদের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধনের চিন্তা গণতান্ত্রিক চেতনাবিরোধী। সংবিধান সংশোধনের এখতিয়ার কেবল সার্বভৌম জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের হাতে থাকা উচিত।’
উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষের যৌথভাবে পাস হওয়া আইনের মধ্য দিয়ে একটি শেয়ারড লেজিসলেটিভ প্রসেস গড়ে ওঠার প্রস্তাব দলের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে বলে বিএনপির এই নেতা জানান। তিনি আরও বলেন, ‘উচ্চকক্ষ আইন পর্যালোচনা করবে, সুপারিশ করতে পারবে, কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে নিম্নকক্ষে। তবে আমরা উচ্চকক্ষের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধনের বিষয়টি দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করছি।’
বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘আমরা দেখছি কিছু পক্ষ সংবিধান সংশোধনকে কঠিনতর করতে পিআর পদ্ধতির মাধ্যমে অনির্বাচিত বা পরোক্ষভাবে নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে উচ্চকক্ষে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করতে চাইছে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’
৭০ অনুচ্ছেদ বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমরা আগেই প্রস্তাব করেছিলাম, ৭০ অনুচ্ছেদে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সংসদ সদস্যদের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সেই প্রস্তাব আজ গৃহীত হয়েছে। ফলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে এমপিরা দলীয় চাপে থাকবেন না, গোপন ব্যালটে স্বাধীনভাবে ভোট দেবেন। যদি উচ্চ ও নিম্নকক্ষ দুটিই থাকে, তাহলে উভয় কক্ষের সদস্যরা যৌথভাবে গোপন ব্যালটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করবেন।’
সালাহউদ্দিন আহমদ জানান, সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি বর্তমানে শুধু প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতিকে স্বাধীনভাবে নিয়োগ দিতে পারেন। তবে এ ক্ষমতার বাইরে রাষ্ট্রপতির আরও কিছু দায়িত্ব থাকা উচিত বলে বিএনপি প্রস্তাব দিয়েছে। আলোচনার পর তা প্রকাশ করা হবে।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে সংসদে একটি মধ্যবর্তী বিধান অন্তর্ভুক্ত করা যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে এবং কমিশন এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত দেবে।
এ ছাড়া মৌলিক অধিকার–সংক্রান্ত আলোচনাও এখনো চলছে। তিনি বলেন, ‘আমরা চিন্তা করছি বিদ্যমান মৌলিক অধিকারের সঙ্গে আধুনিক সময়ের আলোকে কিছু অধিকার যেমন ইন্টারনেটের অধিকার যুক্ত করা যায় কি না। তবে মৌলিক অধিকার একবার সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হলে তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কারণ, সংবিধানের ২৬ থেকে ৪৭ অনুচ্ছেদে থাকা অধিকারগুলো সেলফ এনফোর্সেবল এবং ৪৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নাগরিকেরা তা প্রয়োগে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন। তাই অত্যন্ত সচেতনভাবে নতুন কোনো অধিকার সংযোজন করতে হবে।’
সালাহউদ্দিন বলেন, ‘পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে গৃহীত রাষ্ট্রের মূলনীতিগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত বাক্যটি যুক্ত করার ক্ষেত্রে আমরা একমত। এতে বলা হয়েছে—সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি বজায় রাখা। তবে কিছু দলের আপত্তি থাকায় এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পরে আসবে।’
আজকের আলোচনায় অংশ নিয়েছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), গণসংহতি আন্দোলনসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (জাতীয় ঐকমত্য কমিশন) মনির হায়দারের সঞ্চালনায় বৈঠকে উপস্থিত আছেন কমিশনের সদস্য সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান ও আইয়ুব মিয়া।