কেউ কথা বলছেন মারমা ভাষায়, কেউ ম্রো ভাষা। পাশেই আবার কারও কণ্ঠে বাংলা বুলি। পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানের পথেঘাটে এমন দৃশ্য প্রতিদিনের। জেলাটিতে একসঙ্গে বসবাস করেন ১৪টি জাতিগোষ্ঠীর মানুষ, যাঁদের রয়েছে স্বতন্ত্র ভাষাও। দেশের আর কোনো জেলায় এত জাতিগোষ্ঠী ও ভাষাভাষীর মানুষের একত্রে বসবাস নেই। অনেকেই তাই বান্দরবান জেলাকে সম্বোধন করেন জাতি ও ভাষাবৈচিত্র্যের জীবন্ত জাদুঘর হিসেবে।

বান্দরবানে বসবাসকারীদের মধ্যে রয়েছে চাকমা, মারমা, ম্রো, ত্রিপুরা, বমসহ ১৩টি পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠী। এর বাইরে রয়েছে বাঙালির বসবাস। তবে পরিচর্যার অভাব এবং ব্যবহার কমে আসায় পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর কিছু ভাষা হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। ম্রো জনগোষ্ঠীর রেংমিটচ্য গোত্রের রেংমিটচ্য ভাষা জানা মানুষ বেঁচে রয়েছেন মাত্র সাতজন।

কেবল জাতিগত ও ভাষাগত বৈচিত্র্য নয়, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণেও অনন্য বান্দরবান। এ জেলায় দেশের সর্বোচ্চ পাহাড় তাজিংডং; দেশে উৎপত্তি হয়ে সাগরে পতিত হওয়া সাঙ্গু-মাতামুহুরী নদী রয়েছে। এই দুই নদী অববাহিকার চিরসবুজ বনাঞ্চলের নৈসর্গিক সৌন্দর্যও মুগ্ধ করে পর্যটকদের।

ক্ষুদ্র নৃ–গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের (কেএসআই) তথ্যে জানা গেছে, ৪ হাজার ৪৭৯ বর্গকিলোমিটারের বান্দরবান জেলার ৭টি উপজেলায় সরকারিভাবে স্বীকৃত ১১টি পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। এ ছাড়া কিছুসংখ্যক রাখাইন ও মণিপুরি বসবাস করছেন। বসবাস রয়েছে বাঙালি জনগোষ্ঠীরও। সেই হিসাবে জেলায় বর্তমানে ১৩টি পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠী এবং বাঙালির বসবাস রয়েছে।

জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ অনুযায়ী, জনসংখ্যায় মারমা ও রাখাইন (একত্রে হিসাব করা হয়েছে) সংখ্যায় বেশি। তাদের সংখ্যা ৮৪ হাজার ৫২৫। জনসংখ্যা বিচারে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ম্রো জনগোষ্ঠী। ম্রো রয়েছে ৫১ হাজার ৪৪৮ জন। এর বাইরে ত্রিপুরা ২২ হাজার ৫৭২ জন,  তঞ্চঙ্গ্যা ১৪ হাজার ৮৮৯, বম ১১ হাজার ৮৫৪, চাকমা ৩ হাজার ৭১২, খুমি ৩ হাজার ২৮৭, চাক ২ হাজার ৬৬২, খেয়াং ২ হাজার ৫০২ এবং অন্যান্য জনগোষ্ঠীর বাসিন্দা রয়েছে ২৭৩ জন। অন্যান্যের মধ্যে পাংখোয়া ও লুসাইরা রয়েছেন। জেলায় মোট জনসংখ্যা ৪ লাখ ৮১ হাজার ১০৬ জন। এর মধ্যে বাঙালি ২ লাখ ৮৩ হাজার ১২৩ জন এবং পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠী ১ লাখ ৯৭ হাজার ৯৮৩ জন।

পাহাড়ি ১৩টি জনগোষ্ঠীর প্রত্যেকেরই স্বতন্ত্র ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। তাঁদের বসবাসের জনবিন্যাসেও বৈচিত্র্য দেখা যায়। কোনো জনগোষ্ঠী পাহাড়ের চূড়ায়, কেউ আবার পাহাড়ের ঢালে এবং কেউ আবার নদীর তীরে থাকতে পছন্দ করেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথম জেলা প্রশাসক ক্যাপ্টেন টি এইচ লুইন লিখেছেন, এ অঞ্চলের পাহাড়িরা খ্যংসা বা নদীতীরের বাসিন্দা এবং তংসা বা পাহাড়ের বাসিন্দা নামে দুই ভাগে বিভক্ত। চাকমা ও মারমারা খ্যংসা এবং অন্যরা সবাই তংসা দলের। দেশের সবচেয়ে উঁচু তাজিংডং, কেওক্রাডাং ও  সিপ্পী পাহাড়ের শীর্ষদেশে বম, ম্রো, লুসাই, পাংখোয়া ও খুমিদের বসবাস দেখা যায়। চিম্বুক, মিরিঞ্জা, রংরাং, ক্রিস্টং, বড়মদকসহ মাঝারি পাহাড়গুলোতে বেশি সংখ্যায় ম্রো, খুমি, ত্রিপুরারা বসবাস করেন। অপেক্ষাকৃত কম উঁচু পাহাড়ে তঞ্চঙ্গ্যা, চাক, খেয়াংদের বসবাস গড়ে উঠেছে। চাকমা ও মারমাদের বসবাস পাহাড়ের পাদদেশে ও নদী-খালের তীরে।

ভাষার হালচাল

জেলা পরিষদের আইনে বান্দরবানে ১১টি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর কথা বলা হয়েছে। মণিপুরি ও রাখাইনের কথা আইনে নেই। জেলা পরিষদে আইনে স্বীকৃত ১১টি জনগোষ্ঠীর ভাষা উল্লেখ করা হয়েছে মূলত ৮টি। কিছু ধ্বনিগত পার্থক্য থাকলেও বম, পাংখোয়া ও লুসাইদের ভাষা প্রায় একই। চাকমা–তঞ্চঙ্গ্যা ও মারমা–রাখাইনদের ভাষা ও বর্ণমালাও অভিন্ন। রাঙামাটি কেএসআইয়ের সাবেক পরিচালক ও ভাষা গবেষক সুগত চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় ভাষা বইয়ে পাহাড়ে তিনটি ভাষা পরিবারের জনগোষ্ঠী রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যার একটি ভাষা পরিবারের। বম, পাংখোয়া ও লুসাইরা আরেকটি ভাষা পরিবারের। অন্য পরিবারটিতে রয়েছে মারমা, ম্রোসহ অন্যরা।

চাকমা-তঞ্চঙ্গ্যা ও মারমা-রাখাইন ছাড়া কোনো জনগোষ্ঠীর নিজস্ব হরফ বা বর্ণমালা ছিল না। খ্রিষ্টান মিশনারিদের সহযোগিতায় বম, পাংখোয়া ও লুসাইরা ১৯১৮ সালের দিকে নিজস্ব বর্ণমালা উদ্ভাবন করেন। বর্তমানে এ বর্ণমালায় ৮০ শতাংশ বম লিখতে ও পড়তে পারেন। তাঁরা নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালায় পারিবারিক ও সামাজিক কাজ করে থাকেন। ম্রো বর্ণমালা উদ্ভাবন হয়েছে ১৯৮৪-৮৫ সালে। ক্রামা ধর্মের প্রবর্তক মেনলে ম্রো এটি উদ্ভাবন করেছেন। এ বর্ণমালায় ৬০ শতাংশের বেশি ম্রো লিখতে ও পড়তে পারেন। এ বর্ণমালায় কয়েকটি বিদ্যালয়ের শিশুদের মাতৃভাষায় পড়ানো হয়ে থাকে। বর্ণমালা উদ্ভাবনে অনেকটা জীবন্ত হয়ে ওঠা ম্রো ভাষায় সাহিত্যচর্চা করে আসছেন ইয়াংঙান ম্রো। ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ককবরক ভাষার উদ্ভাবিত বর্ণমালা নিয়ে বিতর্ক নিরসন হয়েছে কয়েক বছর আগে। তাঁরা রোমান বর্ণমালা ব্যবহারে একমত হয়েছেন। তবে ব্যবহারের পরিসর সীমিত। নিজেদের উদ্যোগে চাক ও খুমিরা বর্ণমালা উদ্ভাবন করেছেন। বিতর্ক শেষ না হওয়ায় খেয়াং জনগোষ্ঠীর বর্ণমালা এখনো উদ্ভাবন পর্যায়ে রয়েছে।

নিজস্ব পোশাকে ম্রো জনগোষ্ঠীর নারীরা। বান্দরবান সদরের সুয়ালক ইউনিয়নের ক্রামাদি পাড়া থেকে সম্প্রতি তোলা.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: দ র বসব স জনগ ষ ঠ র ব ন দরব ন পর ব র র খ ইন ব স কর

এছাড়াও পড়ুন:

আইএমএফের পর্ষদ বৈঠক ২৩ জুন, এরপর মিলতে পারে দুই কিস্তি অর্থ

২৩ জুন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্বাহী পর্ষদের বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেই বৈঠকে বাংলাদেশের সঙ্গে আইএমএফের চলমান ঋণ কর্মসূচির দুই কিস্তির অর্থ ছাড়ের বিষয়টি উত্থাপনের কথা রয়েছে। বৈঠকে অনুমোদন হলে চলমান ঋণ কর্মসূচির আওতায় একসঙ্গে দুই কিস্তির অর্থ পাবে বাংলাদেশ। আইএমএফ গতকাল শুক্রবার তার কার্যসূচিতে নির্বাহী পর্ষদের বৈঠকের এ তারিখ নির্ধারণসংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করেছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আইএমএফের এ বৈঠকে চলমান ঋণ কর্মসূচির তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যালোচনার (রিভিউ) প্রতিবেদন উপস্থাপনের কথা রয়েছে। এ প্রতিবেদন পর্ষদ অনুমোদন করলে বাংলাদেশ একসঙ্গে পেয়ে যাবে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ। দুই কিস্তির অর্থ একসঙ্গে হতে পারে ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার।

এর আগে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য সাড়ে তিন বছর মেয়াদি ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। ঋণ অনুমোদনের সময় আইএমএফ বলেছিল, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, ঝুঁকিতে থাকা ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশসম্মত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করবে এ ঋণ কর্মসূচি। চলতি হিসাবের ঘাটতি বেড়ে যাওয়া, টাকার দরপতন ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া—মূলত এ তিন কারণে ওই সময় আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়েছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।

আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির মধ্যে বর্ধিত ঋণসহায়তা (ইসিএফ) ও বর্ধিত তহবিলসহায়তা (ইএফএফ) বাবদ ঋণ রয়েছে ৩৩০ কোটি ডলার। আর রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ) বাবদ ঋণ রয়েছে ১৪০ কোটি ডলার। আরএসএফ আইএমএফের একটি নতুন তহবিল, যেখান থেকে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশকেই প্রথম ঋণ দেওয়া হচ্ছে। ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আইএমএফের কাছ থেকে প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। একই বছরের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ও ২০২৪ সালের জুনে তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ তিন কিস্তিতে আইএমএফ থেকে এখন পর্যন্ত ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকি আছে ঋণের ২৩৯ কোটি ডলার।

আইএমএফের ঋণের চতুর্থ কিস্তির অর্থ গত বছরের ডিসেম্বরে পাওয়ার কথা থাকলেও তা আর পাওয়া যায়নি। আইএমএফের সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অবস্থিত। প্রায় প্রতিবছর ওয়াশিংটনসহ প্রতিবেশী রাজ্যগুলোতে বড় ধরনের তুষারপাত হয়। গত বছরও তাই হয়েছে। অতিমাত্রার বরফের কারণে অচল হয়ে যায় জনজীবন। মার্কিন প্রশাসন সতর্কবার্তা জারি করে। তুষারপাতের কারণে আইএমএফসহ অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল অনেক দিন।

পরে আইএমএফের পক্ষ থেকে প্রথমে এ বছরের ফেব্রুয়ারি ও পরে মার্চে পর্ষদ বৈঠকের কথা বলা হয়। গত এপ্রিলে আইএমএফের একটি দল পর্যালোচনা করতে ঢাকায় আসে দুই সপ্তাহের জন্য। এর মধ্যে শর্ত পরিপালন নিয়ে দর–কষাকষিতে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ ছাড় আটকে যায়। এরপর ওয়াশিংটনে গত ২১ থেকে ২৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের বসন্তকালীন বৈঠকে এ বিষয়ে আরও আলোচনা হলেও কোনো সুরাহা হয়নি। তখন দর-কষাকষি হচ্ছিল মূলত মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা নিয়ে। আইএমএফ তা চাইলেও করতে চাইছিল না সরকার।

সবশেষে গত মাসে এ নিয়ে আইএমএফের সঙ্গে কয়েকটি ভার্চ্যুয়াল বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ১২ মে দুই পক্ষ চূড়ান্ত সমঝোতায় পৌঁছায় ও বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করে বাংলাদেশ। ১৪ মে আইএমএফ ওয়াশিংটন থেকে এক বিবৃতিতে জানায়, দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে এবং ঋণের অর্থ ছাড় করা হবে জুনে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সাধারণত পর্ষদ বৈঠকে অনুমোদন হওয়ার দুই থেকে তিন দিনের মাথায় আইএমএফ অর্থ ছাড় করে দেয়। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • তদন্ত প্রতিবেদন দিতে এক মাস সময় বাড়ালেন ট্রাইব্যুনাল
  • কেন এবার একসঙ্গে পেকে যাচ্ছে ক্ষিরশাপাতি, আম্রপালি, ল্যাংড়া
  • শরীরের পাঁচ থেকে সাতটি অঙ্গ একসঙ্গে ব্যথা হয় যে কারণে
  • বাবাকে একটি সুন্দর দিন উপহার দিতে যা যা করতে পারেন
  • ফেনীতে একসঙ্গে তিন সন্তানের জন্ম দিলেন গৃহবধূ 
  • আগামী সপ্তাহে বাংলাদেশের কিস্তির প্রস্তাব উঠছে আইএমএফ পর্ষদে
  • আইএমএফের পর্ষদ বৈঠক ২৩ জুন, এরপর মিলতে পারে দুই কিস্তি অর্থ
  • এবার বাগ্‌দানের কথা নিজেই জানালেন ডুয়া
  • দেশের ক্রিকেট নিয়ে সাকিবের সঙ্গে যে আলোচনা হয়েছে মিরাজের
  • নিজের সিনেমা দেখারও টিকিট পাননি জয়া আহসান