সৃষ্টিশীলতা এবং প্রতিভা যাঁদের বহুমুখী, তাঁদের মূল্যায়ন সমস্যাসংকুল। কারণ, তাঁদের সৃষ্টিকর্মের বৈচিত্র্য মূল্যায়নকারীদের বিভ্রান্ত করে। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ ধরনের বহুমুখী প্রতিভাধর ব্যক্তি বঞ্চিত হন যথাযথ মূল্যায়ন থেকে। সাংবাদিকতা, রাজনীতি ও গবেষণা—এই তিন মাধ্যমে সৈয়দ আবুল মকসুদ (১৯৪৬—২০২১) ছিলেন সক্রিয়। ফলে কোনো একটা পরিচয়ে চিহ্নিত করতে না পারায় প্রতিটি ক্ষেত্রে মূল্যায়ন থেকেই প্রায়ই বাদ পড়ে গেছেন তিনি। বিশ্বাস করি, সৎ লেখকমাত্রই সংগ্রামী। লেখা ছাড়া লেখকের আর কী হাতিয়ার আছে? সামাজিক আর রাষ্ট্রীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে সম্বল করে একাই শুভ্র সফেদ বসনে প্রতিবাদী হাঁটা হেঁটেছেন বহুদিন রাজপথে।
রাজনীতি–সমালোচক হিসেবে স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হলেও তাঁর সমালোচনার যথার্থ নিরূপণকারী সমালোচক পাওয়া যায়নি। হয়তো এসব কারণেই তাঁর সাফল্যসমূহের যথেষ্ট পরিচিতি ঘটেনি। কিন্তু সব ক্ষেত্রে তাঁর অবদান একত্রে বিবেচনা করে দেখলে তাঁর মতো পরিশ্রমী, নানা গুণ–সমন্বিত ব্যক্তিত্ব কজনকে শনাক্ত করা সম্ভব আমাদের সমাজ-ইতিহাসে?
সততা, সংগ্রাম, বিশ্বাস আর মেধার অপূর্ব সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা কুসমিত ইস্পাত চরিত্রের এক সমাজহিতৈষী লেখক ছিলেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। বিন্দু থেকে সিন্ধু হয়ে ওঠা একজন মানুষ কী করে সফল হয়ে ওঠে, তারই দৃষ্টান্ত তিনি। জন্মের দুই বছর পরই মাকে হারিয়ে অনুভব করেছেন আর্তের আর্তি, দুঃখিত অশ্রু। তাই আজীবন অসহায়ের ভার বইতে কাঁধ পেতে দিয়েছেন, সচল রেখেছেন কলম।
তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের বুদ্ধিজীবী। বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের ক্ষুরধার চিন্তা, গবেষণা ও গবেষণাপ্রসূত ভাবনা থেকে অনেক সমস্যার সমাধানের পথ দেখাতে পারেন। এ সমাধানগুলো যখন জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তথা জনগণের অধিকার ও স্বার্থের একীভূত হয়ে যায়, তখন তারা পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল বা গণমানুষের বুদ্ধিজীবীতে পরিণত হন। সৈয়দ আবুল মকসুদ ছিলেন তেমনই একজন গণমানুষের বুদ্ধিজীবী। তবে তাঁর বুদ্ধিভিত্তিক কার্যক্রম তাঁকে এলিটস হিসেবে পরিণত করেনি, তাঁকে জনমানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরেও নিয়ে যায়নি; বরং তাঁকে তাদের কাতারে নিয়ে এসেছে। তিনি নিজে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন এবং এ কাজ করতে গিয়ে তিনি জনস্বার্থের ধারক ও বাহকে পরিণত হয়েছিলেন। আজীবন তিনি তাঁর বহুমুখী প্রতিভা জনকল্যাণে নিবেদিত করেছিলেন এবং তাঁদেরই একজনে পরিণত হয়েছিলেন।
এক পাশে মানুষ ও সমাজ এবং অপর পক্ষে সাহিত্য-সংস্কৃতি-সাংবাদিকতা তাঁর মন-মনন-মানস ও কাজের ভুবন—এই দুই ধারায় বিভক্ত হয়েছে। সাহিত্যচর্চায় যাঁরা নিবেদিত, তাঁদের কেউ কেউ সমাজমনস্ক হতেই পারেন, তার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়, তাঁদের রচনায় ক্বচিৎ কেউ সীমিত পরিসরে সামাজিক নানা কর্মকাণ্ডে নিজেকে যুক্ত করার গরজও বোধ করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন স্বভাবত স্বতন্ত্র। নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন মানুষের দুর্দশা লাঘবে, সামাজিক কল্যাণে, অন্যায়-অবিচার-শোষণ-পীড়নের বিপক্ষে প্রতিবাদী ভূমিকা পালনে, রাষ্ট্র-সরকার-প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-জুলুম প্রতিকারে। তাঁর গভীর দায়বদ্ধতা ছিল সমাজের প্রতি, প্রবল মমত্ব-সহানুভূতি-ভালোবাসা ছিল মানুষের প্রতি। এ ক্ষেত্রে প্রাণিত ও পরিচালিত হয়েছেন বিবেকের অনুশাসনে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন জাতি-ধর্ম-গোত্র-বর্ণ-লিঙ্গনির্বিশেষে সব পীড়িত ও নিরুপায় মানুষের জন্য। অনেক সামাজিক-সাংস্কৃতিক-মানবাধিকার–বিষয়ক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত এবং সক্রিয় ভূমিকা পালন করতেন। সংখ্যালঘু নিপীড়ন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সংকট-সমস্যা, নারী নিগ্রহ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, পরিবেশরক্ষা, নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়ে তিনি ছিলেন সচেতন ও উচ্চ কণ্ঠ। রাষ্ট্রের একজন কর্তব্যনিষ্ঠ নাগরিক ও সামজের সচেতন সদস্য হিসেবে তাঁর ভূমিকা পালন করেছেন, সততার সঙ্গে কোনো ভীতি বা প্রলোভন তাঁকে আদর্শচ্যুত করতে পারেনি কখনো।
ছাত্রাবস্থাতেই তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী ও বাম ঘরানার রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের পর মস্কোপন্থী ন্যাপ নেতা ক্যাপ্টেন (অব.
কিছুদিন পর বার্তা সংস্থা বাংলাদেশ প্রেস ইন্টারন্যাশনালে যোগ দেন, যা পরে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। বাসসে ছিলেন বার্তা সম্পাদক ও উপপ্রধান বার্তা সম্পাদক। সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালন করতে পৃথিবীর ১৭টি দেশ সফর করেছেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ হিসেবে বাসস থেকে পদত্যাগ করেন। এর পর থেকে তিনি ‘সহজিয়া কড়চা’ এবং ‘বাঘা তেঁতুল’ শিরোনামে প্রথম আলোতে নিয়মিত কলাম লিখতে শুরু করেন। যে লেখাগুলো তৎকালীন সময়ে বেশ আলোচিত ছিল পাঠকমহলে।
অনেক ব্যর্থ কাজের সমালোচনা করে সরকারের তীর্যক সমালোচনা করতে সামান্য দ্বিধা করতেন না। আবার জনকল্যাণের জন্য ক্ষমতাসীনদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে কার্পণ্য করতেন না। সব সরকারের বিরুদ্ধেই তিনি ছিলেন প্রতিবাদী কণ্ঠের অধিকারী। এমনকি তাঁদের বিরুদ্ধে আদালতেও গিয়েছেন। তিনি ছোট–বড়, দেশীয় আন্তর্জাতিক সব অন্যায়েরই প্রতিবাদ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণের প্রতিবাদে তিনি সত্যাগ্রহ শুরু করেন। এরই অংশ হিসেবে পশ্চিমা বেশভূষা ছেড়ে তিনি সাদা খদ্দরের সেলাইবিহীন কাপড় পরা ধরেন। আমৃত্যু তিনি এ প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছেন। এ জন্য তাঁকে অনেক সময় ঠাট্টা-মশকরাও সহ্য করতে হয়েছে। তবু তিনি তাঁর প্রতিবাদ থেকে সামান্য বিচ্যুত হননি।
মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ তাঁর হয়েছিল রাজনীতি ও সাংবাদিকতার সূত্রে। সে কারণে মাওলানা ভাসানীর প্রতি তাঁর অনুরাগ-আকর্ষণ, এমনকি যথেষ্ট দুর্বলতাও গড়ে ওঠে।
তাঁর প্রকাশিত বই প্রায় ৫০টি এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বই লিখেছেন ভাসানীকে নিয়ে। তিনিই প্রথম ভাসানীর প্রামাণ্য ও পূর্ণাঙ্গ জীবনী রচনা করেন; সেই বইয়ের নাম ভাসানী (১৯৮৬)। এতে আলোচিত হয়েছে মাওলানা ভাসানীর জীবন, কর্মকাণ্ড, রাজনীতি ও দর্শন। এর বাইরেও ভাসানী সম্পর্কে তাঁর উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে মওলানা ভাসানী: সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের ব্যঙ্গচিত্র (২০১৩), কাগমারী সম্মেলন: মওলানা ভাসানীর পূর্ব বাংলার স্বাধিকার ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম (২০১৭), ভাসানীর ভারত প্রবাস (২০১৯), ভাসানীর ঐতিহাসিক অভিভাষণ (২০২২)। উল্লিখিত বইগুলোতে মাওলানা ভাসানীর সংগ্রাম, সাংগঠনিক ক্ষমতা, দৃঢ় মনোভঙ্গি, দূরদৃষ্টি ও বিচক্ষণতার বিশ্বস্ত পরিচয় ফুটে উঠেছে।
গান্ধীর জীবন ও রাজনৈতিক দর্শন মকসুদকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। গান্ধীর মানবপ্রীতি, সেবাধর্ম, অহিংস নীতি ও সত্যাগ্রহ পন্থার আদর্শকে তিনি নিজের জীবনে গ্রহণের চেষ্টা করেন। ঢাকায় গড়ে তোলেন ‘মহাত্মা গান্ধী স্মারক সদন’,Ñপাশাপাশি গান্ধী গবেষণাতেও মন দেন। ফলে বাংলা ও ইংরেজিতে দুই ভাষাতেই গান্ধীবিষয়ক কয়েকটি বই প্রকাশ করেন। বাংলাদেশে গান্ধী চর্চায় আবুল মকসুদের মতো এমন প্রগাঢ় ভক্তি ও নিষ্ঠায় আগে-পরে আর কেউ কাজ করেছেন বলে জানা নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়েও তাঁর অনন্য কাজ রয়েছে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ পৃথিবী ছেড়েছেন ২০২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। এর ছয় দিন আগে; অর্থাৎ ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোতে তিনি লেখেন, ‘আজকাল নেতারা কেউ কেউ বলেন, জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা নন। কিছুকাল যাবৎ এর সঙ্গে যোগ করা হচ্ছে, তিনি ছিলেন “পাকিস্তানের এজেন্ট”। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এ কথার অর্থ যে কতটা ক্ষতিকর, তা যাঁরা বলছেন, তাঁরা ভেবে দেখেননি। মুক্তিযুদ্ধে জিয়া এবং অন্য কার কী ভূমিকা, তা প্রবাসী সরকার এবং বঙ্গবন্ধুর সরকারের না জানা খুব বড় ব্যর্থতা। জিয়া পাকিস্তানের এজেন্ট হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনে ছিলেন, এই অভিযোগ যদি সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পূর্ণ পুনর্লিখনের প্রয়োজন হবে। দীর্ঘ ৯ মাস একজন “পাকিস্তানি চর” প্রবাসী সরকারের সঙ্গে কাজ করলেন, তারা কিছু টেরই পেল না। স্বাধীনতার পর সেই চরকেই সেনাবাহিনীর শীর্ষ দুটি পদের একটি দেওয়া হয়। তিনি যে পাকিস্তানের এজেন্ট, সেটা কেউ জানতেই পারলেন না।’
‘শত্রুকে নিন্দা করারও পরিমিত ভাষা আছে। সেটা অতিক্রম করলে লাভের চেয়ে লোকসান হয় বেশি। আওয়ামী লীগের সবাই অবশ্য এ কাজ করছেন না। জিয়াউর রহমানের বীর উত্তম খেতাব প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখন প্রত্যাহার করলে মৃত জিয়ার কোনো ক্ষতি নেই। তবে যেকোনো উদ্দেশ্যেই হোক, এমন কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করা উচিত হবে না, যা ভবিষ্যতের কোনো সরকার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে অপছন্দের বহু ব্যক্তির পদক ছিনিয়ে নিয়ে অপমান করতে পারে।’
আপনজনদের কাছে সব মৃত্যুই অপ্রত্যাশিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত। কারণ, সব পরিবারই আপনজনের মৃত্যুতে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষত বয়োজ্যেষ্ঠদের মৃত্যুতে পরিবার বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ, বয়োজ্যেষ্ঠদের মৃত্যুতে পরিবার শুধু তাদের অর্থনৈতিক সহায়তা থেকেই বঞ্চিত হয় না, বঞ্চিত হয় তাদের অভিভাবকত্ব থেকেও, যে অভিভাবকত্ব সাধারণত বটবৃক্ষের মতো ছায়া ও সুরক্ষা দেয়।
সৈয়দ আবুল মকসুদের মৃত্যুর ক্ষতির মাত্রা অপূরণীয়। কারণ, তাঁর পরিবার ছিল অনেক বড়, সারা দেশে বিস্তৃত টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত। দেশের অগণিত মানুষের তিনি ছিলেন অভিভাবক, আপনজন। তিনি তাঁদের পক্ষে কথা বলতেন। প্রতিবাদ করতেন। দেনদরবার করতেন। তিনি তাঁদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরতেন। সব ধরনের দাবি-দাওয়ার পরিবেশ থেকে ভোটাধিকার পর্যন্ত। এমনকি ব্যক্তিগত দাবি-দাওয়াও। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন ক্রমসংকুচিত নাগরিক সমাজের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব।
নাগরিক সমাজের কোনো প্রতিবাদই তাঁকে ছাড়া হতো না। তিনি কর্তৃপক্ষের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে প্রতিবাদ করতেন অসমসাহসিকতার সঙ্গে। তাঁর প্রতিবাদের ভাষা ছিল বুদ্ধিদীপ্ত ও অনেক ক্ষেত্রেই জুতসই। তিনি অন্যায়কে অন্যায় বলতে দ্বিধা করতেন না।
মফিজ ইমাম মিলন সাংবাদিক ও গবেষক
ই-মেইল: [email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরক র র কর ছ ল পর ব র ক জ কর অন য য় কর ছ ন ত হয় ছ র জন ত ব দ কত করত ন
এছাড়াও পড়ুন:
ইরানের সঙ্গে সংঘাত: ইসরায়েলকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা দিতে সৌদি সরকারকে অনুরোধ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র
গত জুনে সংঘাতের সময় ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে উপর্যুপরি আঘাত হানছিল। তা প্রতিরোধ করতে গিয়ে দেশটির ভান্ডারে থাকা টার্মিনাল হাই অল্টিটিউড এরিয়া ডিফেন্সে (থাড) টান পড়েছিল। সংঘর্ষ চলাকালে সৌদি আরবের হাতে এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থা না থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি অন্য আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা তাদের ছিল। তাই সংকটকালে ইসরায়েলকে কিছু আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দিতে সৌদি আরবকে অনুরোধ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু রিয়াদ তাতে রাজি হয়নি।
অনুরোধের বিষয়টি জানেন, এমন দুজন মার্কিন কর্মকর্তা মিডল ইস্ট আইকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
দুজনের একজন বলেন, ‘যুদ্ধ চলাকালে আমরা সবাইকে (মধ্যপ্রাচ্যের যেসব দেশে মার্কিন প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ছিল) তাদের সবাইকে (ইসরায়েলকে কিছু ধার দেওয়া) অনুরোধ করেছিলাম। যখন কাজ হলো না, তখন আমরা চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছিলাম। শুধু কোনো একটি দেশকে অনুরোধ করা হয়েছিল, তা কিন্তু নয়।’
কিন্তু ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলকে সাহায্য করার জন্য সবচেয়ে ভালো অবস্থানে ছিল সৌদি আরব। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলে আসছিলেন, ইরান শুধু ইসরায়েল নয়, সৌদি আরবের জন্যও হুমকি।
তেলসমৃদ্ধ উপসাগরীয় এই দেশের হাতে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আগেই নিজেদের বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করা হয়েছিল। কিছুদিন আগেও এসব প্রতিরক্ষাব্যবস্থা লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন দিয়ে হামলা চালিয়েছিল ইয়েমেনের হুতিরা।
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যখন সংঘর্ষ চলছিল, ঠিক তখনই নিজেদের কেনা থাড ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার প্রথম ব্যাটারিটি গ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল সৌদি আরব। ব্যাটারিটি নিজেদের সার্বভৌম তহবিল দিয়েই কিনেছিল রিয়াদ। ঘটনা হলো, ইসরায়েল ও ইরানের যুদ্ধবিরতির মাত্র ৯ দিন পর ৩ জুলাই সৌদি সেনাবাহিনী এই ব্যাটারি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করেছে।
ইরান-ইসরায়েলের সংঘাতের একপর্যায়ে মার্কিন কর্মকর্তাদের মধ্যে নিজেদের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার মজুত ফুরিয়ে যাওয়া নিয়ে উদ্বেগ ছিল। কারণ, তখন ইসরায়েলের বিভিন্ন নিশানায় ব্যাপক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছিল ইরান।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের সময় মিডল ইস্ট আই-ই প্রথম জানিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এবং ইসরায়েলের নিজস্ব আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা অ্যারো দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। পরে দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও দ্য গার্ডিয়ান নিজেদের প্রতিবেদনে মিডল ইস্ট আইয়ের তথ্য নিশ্চিত করেছিল।
চলতি মাসে এক প্রতিবেদনে গার্ডিয়ান জানিয়েছে, ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের পর যুক্তরাষ্ট্রের হাতে মাত্র ২৫ শতাংশ প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা অবশিষ্ট ছিল, যা পেন্টাগনের পরিকল্পনামাফিক বিশ্বব্যাপী দেশটির সামরিক অভিযানের জন্য প্রয়োজনীয় মজুতের তুলনায় অনেক কম।
এক মার্কিন কর্মকর্তা ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের হাতে কী পরিমাণ প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ছিল, সেই গোপন সংখ্যা মিডল ইস্ট আইকে নিশ্চিত করেছেন।
ইরানের হামলা থেকে ইসরায়েলকে রক্ষা জন্য যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের স্ট্যান্ডার্ড মিসাইল-৩ (এসএম-৩) ছুড়েছিল। এসব ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছিল দেশটির রণতরি আরলি বার্ক ক্লাসের গাইডেড-মিসাইল ডেস্ট্রয়ার থেকে।
ইসরায়েলের তিন স্তরের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা তো ছিলই, সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত শক্তি। তা সত্ত্বেও যুদ্ধবিরতির আগপর্যন্ত ইসরায়েলি শহরগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে সক্ষম হয়েছিল ইরান।
যুক্তরাজ্যের দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের পাঁচটি সামরিক স্থাপনায় সরাসরি আঘাত করতে সক্ষম হয়েছিল।
বিশ্লেষকদের মতে, ইরান যেভাবে বৃষ্টির মতো ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে, সেটার বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা প্রত্যাশার চেয়ে ভালো করেছে। তবে সংঘাত দীর্ঘ সময় ধরে চলায় ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার দুর্বল দিকটি বুঝে গিয়েছিল ইরান। তাই তারা ইসরায়েলে বেশি পরিমাণে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে পেরেছিল।
মিচেল ইনস্টিটিউট ফর অ্যারোস্পেস স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক ডগলাস বারকি বলেন, দুর্বলতাটা হলো, যুদ্ধের একটা পর্যায়ে আপনার প্রতিরক্ষাব্যবস্থার মজুত ফুরিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে। আমাদের হাতে যে পরিমাণ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আছে, সেগুলো শেষ হয়ে যাওয়ার পর নতুন করে তৈরি করার সক্ষমতা সীমিত।
গত শুক্রবার দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানিয়েছে, আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার ঘাটতির এই পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু কর্মকর্তা সৌদি আরবের কেনা থাড প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ইসরায়েলে পাঠানোর বিষয়েও রিয়াদের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন।
একজন মার্কিন কর্মকর্তা মিডল ইস্ট আইকে নিশ্চিত করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সৌজন্য অনুরোধ ও চুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পরই সৌদি আরবের সঙ্গে এ বিষয়ে গভীর আলোচনা শুরু হয়েছিল।
উভয় মার্কিন কর্মকর্তা মিডল ইস্ট আইকে আরও বলেছেন, ইসরায়েলকে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দিতে যুক্তরাষ্ট্র সংযুক্ত আরব আমিরাতকেও অনুরোধ করেছিল। তবে দেশটির কাছ থেকে ইসরায়েল আদৌ কোনো আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা পেয়েছিল কি না, এই দুই কর্মকর্তার কেউ তা নিশ্চিত করতে রাজি হননি।
যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে আমিরাতই প্রথম দেশ, যারা প্রথম থাড কিনেছিল এবং ব্যবহার করেছিল। দেশটি থাড কিনেছিল ২০১৬ সালে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরান যেভাবে ইসরায়েলের উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষা ভেদ করে হামলা চালাতে পেরেছে, তা উপসাগরীয় অঞ্চলের তুলনামূলক কম সুরক্ষিত দেশগুলোকে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।