মামলা করেও জাফলং, ভোলাগঞ্জ ও শারফিন টিলা রক্ষা করতে পারছে না সিলেটের প্রশাসন। গত বছরের ৫ থেকে ৭ আগস্ট দুটি কোয়ারি থেকে লুট হয়েছে অন্তত ৫০ কোটি টাকার পাথর। এরই মধ্যে ভোলাগঞ্জের বাঙ্কার ও শারফিন টিলা ধ্বংস করা হয়েছে।

সম্প্রতি বিভিন্ন মহাল পরিদর্শন করে দেখা গেছে, বিজিবি ও আনসার সদস্যদের সামনে বালু-পাথর তোলা হচ্ছে। জাফলং কোয়ারির ডাউকি নদীর জিরো পয়েন্টের পাশ থেকে দেড় কিলোমিটার দক্ষিণ পর্যন্ত শত শত নৌকা দিয়ে শ্রমিকরা বালু তুলছেন। শারফিন টিলায় অর্ধশতাধিক মেশিন লাগিয়ে মাটি খুঁড়ে তোলা হচ্ছে পাথর। জৈন্তাপুরের সারি নদীতে দেখা গেছে একই দৃশ্য।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১৩ জানুয়ারি খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো পাথর ও বালুমহাল বন্ধের আদেশ বাতিল করে। এর পর ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী মনে করেন, সরকার পরিবর্তনের পর প্রশাসনের দুর্বলতা ও ইজারাবিহীন থাকার কারণে তাদের ঠেকানো যাচ্ছে না। সঠিক ব্যবস্থাপনায় ইজারা দিলে সরকার রাজস্ব পাবে এবং যত্রতত্র উত্তোলন বন্ধ হবে।

ভোলাগঞ্জ ও বাঙ্কার
কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ ছাড়াও উৎমা, শারফিন টিলা, ধলাই নদী ও সাদা পাথর পর্যটন কেন্দ্রের অবস্থান। কোয়ারির পাশে রেলওয়ের মালিকানাধীন বদ্বীপ আকারের রোপওয়ের (বাঙ্কার) সংরক্ষিত এলাকা। সরকার পরিবর্তনের পর কয়েক দিনে সাদা পাথর লুট করা হয় ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকার। সম্প্রতি অভিযোগ উঠেছে, বাঙ্কার থেকে রাতে চুরি করা পাথর থেকে নৌকাপ্রতি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা করে নিচ্ছে বিজিবি। ভোলাগঞ্জ বাঙ্কার থেকে পাথর তোলায় মদদ দিচ্ছেন বিএনপিসহ স্থানীয় কয়েকজন সমন্বয়ক। পাথর চুরির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গত ২৭ জানুয়ারি বাঙ্কারে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) উপপরিদর্শক মঞ্জুরুল ইসলামসহ চারজনকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
আরএনবি ইনচার্জ আরিফুল ইসলাম জানান, তারা দিনে দায়িত্ব পালন করেন। রাতে থাকেন না।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ আবুল হাসনাত বলেন, নিয়মিত টাস্কফোর্সের অভিযানেও কাজ হচ্ছে না।

শারফিন টিলা
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম ইসলামপুর ইউনিয়নের শারফিন টিলা থেকে সরকার পতনের পর প্রায় ৫০ কোটি টাকার পাথর লুট করা হয়েছে। ১৩৭ দশমিক ৫০ একরের শারফিন টিলাকে কয়েক বছর আগে পরিবেশ অধিদপ্তর ‘মরা কঙ্কাল’ বলেছিল। গত ২৫ জানুয়ারি পরিবেশ আদালতে অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক বদরুল হুদা মামলা করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় কোম্পানীগঞ্জের বিএনপিকর্মী ও কাঁঠালবাড়ি গ্রামের মোহাম্মদ আলীকে। এ মামলায় সাক্ষী করা হয় তাঁর বাবা ইউপি চেয়ারম্যান জিয়াদ আলীকে। এর পর গত ২৭ জানুয়ারি পরিবেশ আদালতে ৪০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এ ছাড়া চাঁদা আদায়ের অভিযোগে গত ১১ ফেব্রুয়ারি ১৩ পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়।

গত সাড়ে পাঁচ মাসে সেখানে পাঁচটি অভিযান ও ৯টি মামলা করা হয়েছে। শারফিন ওয়াক্‌ফ এস্টেটের মোতাওয়াল্লি আনোয়ার হোসেন আনাই সমকালকে বলেন, ‘বাধা দিয়েও টিলাটি রক্ষা করা যায়নি। লিস্টার মেশিন দিয়ে পাথর তোলা হচ্ছে।’
থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ বলেন, ‘পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় গত ১৮ ফেব্রুয়ারি মামলা হয়েছে। গত বুধবার অভিযান চালানো হয়েছে। তবু কেউ থামছে না।’

জাফলং পাথর কোয়ারি
গোয়াইনঘাটের জাফলং জিরো পয়েন্ট থেকে সরকার পতনের পর ১২০ কোটি টাকার পাথর লুট করা হয় বলে সে সময় উপজেলা প্রশাসন জানায়। সম্প্রতি প্রকাশ্যে বিভিন্ন স্থান থেকে শুরু হয়েছে বালু তোলা।

সরেজমিন দেখা গেছে, জাফলং পাথর কোয়ারি, জিরো পয়েন্ট, পিয়াইন ও ডাউকি নদী এবং এর আশপাশ এলাকা থেকে কয়েক হাজার শ্রমিক নির্বিচারে বালু ও পাথর উত্তোলন করছেন। রাতে জাফলংয়ের নয়াবস্তি, কান্দুবস্তির জুমপাড় ও মন্দিরের জুম এলাকায় গর্ত করে পাথর উত্তোলন করতে দেখা গেছে। সেখানে চালানো হচ্ছে এক্সক্যাভেটর। গত পাঁচ মাসে সেখানে ১৫-১৬টি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। সর্বশেষ গত শনিবার আরেকটি অভিযান চালানো হয়। থানায় মামলা হয়েছে ৮-৯টি। সম্প্রতি দখলদারিত্ব নিয়ে একাধিক মারামারি হয়েছে বিএনপি নেতাকর্মীর মধ্যে।
জাফলং নিয়ন্ত্রণ করছেন কয়েক বছর আগে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত নেতা ও অপসারিত গোয়াইনঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান শাহ আলম স্বপন। রয়েছেন পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আমজাদ বক্স, সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রানা, কোষাধ্যক্ষ আবদুর রাজ্জাক, বিএনপি নেতা আবদুস সাত্তার, গোয়াইনঘাট উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মিজানুর রহমান হেলোয়ার, উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ইউসুফ আহমেদসহ কয়েকজন। শারফিন টিলা ধ্বংসের নেপথ্যে রয়েছেন মাজারের সাবেক খাদেমের ছেলে মনির মিয়া, তাঁর ভাই রফিক মিয়া, ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক সভাপতি ফয়জুর রহমান, বিএনপিকর্মী সেবুল আহমেদ, ইব্রাহিম, ইসমাইলসহ স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা। জাফলংয়ে ক্যাশিয়ারের ভূমিকা পালন করছেন পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আমজাদ বক্স।

সারি নদী ও শ্রীপুর
জৈন্তাপুরের পাথর ও বালুমহাল শ্রীপুর ও সারি নদী। নদীতে কাজ করা শ্রমিকের সংখ্যা চার হাজারের বেশি। শ্রমিকদের কাছ থেকে প্রতিদিন চাঁদা ওঠে প্রায় ৮ লাখ টাকা। অভিযোগ রয়েছে, সপ্তাহে বিভিন্ন দপ্তরে টাকা পাঠান হয়। এগুলোসহ কানাইঘাটের লোভাছড়া, গোয়াইনঘাটের বিছনাকান্দি কোয়ারি ও মহাল থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার বালু-পাথর তোলা হচ্ছে। গত পাঁচ মাসে সাতটি অভিযান ও তিনটি মামলা হয়েছে। জব্দ করা পাথর গত ২৮ ডিসেম্বর নিলামের জন্য দরপত্র ডেকেছিল খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো। গত ১৬ জানুয়ারি লুট করে নেওয়া হয়েছে সেই পাথরও।
সারি নদী নিয়ন্ত্রণ করছেন বৃহত্তর সারি বারকি শ্রমিক সংগঠনের সভাপতি আমির আলী, সাধারণ সম্পাদক নজির আহমদ, চারিকাটা ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান সামসুজ্জামান সেলিম, নিজপাট ইউনিয়নের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রহিম উদ্দিন ও তাঁর ভাই তাজউদ্দিনসহ কয়েকজন।

সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক শাহ সাহেদা বলেন, পাথর ও বালুখেকোরা প্রকাশ্যে আদালত ও সরকারকে অমান্য করছে।
অভিযোগ অস্বীকার করে বিএনপির সাবেক নেতা শাহ আলম স্বপন সমকালকে বলেন, বালু-পাথরের কোনো ব্যবসা নেই। শারমিন টিলার মনির মিয়া টিলা ধ্বংসের পেছনে জড়িত নন।
বৃহত্তর সারি বারকি শ্রমিক সংগঠনের সভাপতি আমির আলী শ্রমিক চাঁদা ১০০ টাকা তোলেন বলে স্বীকার করেন। জাফলংয়ে বিএনপি নেতা আমজাদ বক্সের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি ধরেননি।
সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, উপজেলা বা জেলা প্রশাসনের টাস্কফোর্স ও মোবাইল কোর্টের অভিযানে থানা-পুলিশ সহায়তা করে। খবর পেলে পুলিশও অভিযান চালায়।
বিজিবি সিলেট সদরদপ্তরের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল সাইফুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সীমান্তের ১৫০ গজের ভেতর থেকে বালু-পাথর তুললে আমরা বাধা দিই। এর বাইরে অবৈধভাবে কেউ কাজ করলে সেটা উপজেলা প্রশাসন দেখে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদ বলেন, বারবার অভিযান হচ্ছে। মামলাও করা হচ্ছে। পরিস্থিতিরও উন্নতি হচ্ছে।

 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: পর ব শ ল ট কর ব এনপ সরক র ইসল ম উপজ ল করছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলায় ৩ পুলিশ নিহত

যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যে বন্দুক হামলায় তিন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। গুরুতর আহত হয়েছেন আরো দুই পুলিশ। 

পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) স্থানীয় সময় দুপুর ২টার কিছু পর এক পারিবারিক বিরোধের তদন্তে গিয়ে হামলার মুখে পড়ে পুলিশ। খবর বিবিসির। 

আরো পড়ুন:

শেরপুরে পুলিশের উপর হামলা: থানায় মামলা, গ্রেপ্তার ৪

ভাঙ্গা উপজেলা পরিষদ ও থানায় হামলা, ভাঙচুর-আগুন

পেনসিলভানিয়া স্টেট পুলিশের কমিশনার কর্নেল ক্রিস্টোফার প্যারিস জানান,  অভিযুক্ত বন্দুকধারী পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছে।

গুলির ঘটনার পর ইয়র্ক কাউন্টির নর্থ কোডোরাস টাউনশিপের স্প্রিং গ্রোভ এলাকার একটি স্কুল জেলা সাময়িকভাবে ‘শেল্টার ইন প্লেস’ ঘোষণা করে। তবে পরে জানানো হয়, স্কুল কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।

কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, জনসাধারণের জন্য বর্তমানে কোনো সক্রিয় হুমকি নেই। এ ঘটনা ঘটে ফিলাডেলফিয়া থেকে প্রায় ১০০ মাইল (১৬০ কিমি) পূর্বে অবস্থিত ইয়র্ক কাউন্টির এক গ্রামীণ এলাকায়। 

তারা বলছে, আগের দিন শুরু হওয়া একটি তদন্তের অংশ হিসেবে কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছিলেন। তবে তদন্ত চলমান থাকায় বিস্তারিত কিছু প্রকাশ করা হয়নি।

পেনসিলভানিয়ার গভর্নর জোশ শাপিরো বিকেলে ঘটনাস্থলে পৌঁছে নিহতদের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি বলেন, “আমরা তিনজন মহামূল্যবান প্রাণ হারালাম, যারা এই দেশকে সেবা দিয়েছেন। এই ধরনের সহিংসতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সমাজ হিসেবে আমাদের আরো ভালো করতে হবে।”

নিহত তিন কর্মকর্তার সম্মানে গভর্নর শাপিরো রাজ্যের সব সরকারি ভবন ও স্থাপনায় পতাকা অর্ধনমিত রাখার নির্দেশ দেন।

ঢাকা/ইভা 

সম্পর্কিত নিবন্ধ