Risingbd:
2025-10-20@11:20:52 GMT

দক্ষিণেশ্বরে মায়ের বাড়ি  

Published: 20th, October 2025 GMT

দক্ষিণেশ্বরে মায়ের বাড়ি  

কলকাতা, সময় বিকেল চারটা। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। আমি, মা আর আমার বোন রোশনি বেরিয়ে পরলাম ঘরের বাইরে- গন্তব্য দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি। গতকাল রাতে আমরা বাংলাদেশ থেকে এসে পৌঁছেছি। খারাপ আবহাওয়ার জন্য প্লেন চার ঘণ্টা দেরী করে। ফলে কলকাতা পৌঁছাতে সেই রাতই হয়ে যায়। আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিল পাঁচটার ভেতর কলকাতা পৌঁছে দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি দর্শন করে আমাদের ভ্রমণ শুরু করব। কিন্তু বিধিবাম! 

এ দিকে বাংলাদেশের বৃষ্টি যে আমাদের সাথে সাথে কলকাতায় এসে হাজির হবে তা ভাবতেও পারিনি। আগের দিন প্লেন দেরী করে পৌঁছানোর কারণে পরদিন সকাল সকাল ভেবেছিলাম দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে যাব কিন্তু মুষল ধারায় বৃষ্টির জন্য তাও হলো না। গৃহবন্দি হয়ে থাকতে হলো মামার বাসায়। তবে একদিকে ভালোই হয়েছে, সারাদিন মামির হাতের বিভিন্ন ধরনের রান্না চেখে দেখার সুযোগ মিলেছে।

বৃষ্টি একটু কমতেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। বাসা থেকে বের হয়ে ট্যাক্সি নিয়ে চললাম আমাদের নতুন গন্তব্যে। আমরা বিটি রোড ধরে এগিয়ে চলছি। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলাম গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে। আমাদের ঢাকা শহরের মতই যানজট তবে আশপাশের সব ভবন বেশ পুরনো। বলে রাখা ভালো দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান,  কলকাতার অদূরে হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত একটি কালীমন্দির। এটি উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার কামারহাটি শহরের অন্তঃপাতী দক্ষিণেশ্বরে অবস্থিত। ১৮৫৫ সালে প্রসিদ্ধ মানবদরদি জমিদার রানি রাসমণি এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।  মন্দিরে দেবী কালীকে ‘ভবতারিণী’ নামে পূজা করা হয়। 

ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট যোগী রামকৃষ্ণ পরমহংস এই মন্দিরে কালীসাধনা করতেন। কথিত আছে, রানি রাসমণি দেবী কালীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দির প্রতিষ্ঠাকালে রামকৃষ্ণ পরমহংসের দাদা রামকুমার চট্টোপাধ্যায় রানিকে প্রভূত সাহায্য করেছিলেন। রামকুমারই ছিলেন মন্দিরের প্রথম প্রধান পুরোহিত। ১৮৫৭-৫৮ সালে কিশোর রামকৃষ্ণ পরমহংস এই মন্দিরের পূজার ভার গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে তিনি এই মন্দিরকেই তাঁর সাধনক্ষেত্ররূপে বেছে নেন। 

দেখতে দেখতে আমরা ডানলপ মোড়ে এসে পৌঁছালাম। সেখান থেকে ডান দিকে যাওয়া শুরু করলো আমাদের গাড়ি। কিছুদূর যাবার পর গাড়ি থামিয়ে দিল পুলিশ। কারণ সোজা আর যাওয়া যাবে না। রাস্তায় কাজ চলছে। অগত্যা আমাদের উল্টো পথে হাঁটা শুরু করতে হলো গাড়ি রেখে। রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ! ময়লা আবর্জনা ফেলা। আমি মনে মনে ভাবছিলাম আমাদের দেশের রাস্তা এতো খারাপ না, অন্তত কোন দর্শনীয় স্থানের। 

কিছু দূর যাবার পর আবার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে হলো। নামার পর বাঁ দিকে হলো বেলুর মঠ যাবার ঘাঁট, ডান দিকে দক্ষিণেশ্বরের ভেতরে যাবার রাস্তা। বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখলাম খুব সুন্দর একটি ব্রিজ। রোশনিকে জিজ্ঞেস করলাম। ও বলল- বালি ব্রিজ। সামনে থেকে দেখছিলাম বালি ব্রিজের অসাধারণ দৃশ্য! আমি কালক্ষেপণ না করে একের পর এক ছবি তুলতে লাগলাম। আমি আরো কিছুটা সামনে গিয়ে ছবি তুলতে চাইলাম কিন্তু হলো না। রোশনি বলল, চল আর ছবি তুলতে হবে না। সামনে আরো অনেক কিছু আছে দেখার। আজ শনিবার মন্দিরে ভিড় হবে। আমরা চললাম মন্দির পানে। রাস্তার দুই ধারে দোকান বিভিন্ন ধরনের দ্রব্যাদি নিয়ে বসেছে। আমরা এসে পৌঁছালাম দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির প্রবেশ দ্বারে। বাইরে থেকেই দেখা যায় ভেতরের অসাধারণ কারুকার্যময় মন্দিরের দৃশ্য।

রোশনি বলছিল, বিশ বছর আগেও এত গুচ্ছের খাবারের দোকান আর বেলন-চাকি, পাথরের শিবলিঙ্গ, লোকনাথ বাবা, রুদ্রাক্ষের মালা, পুঁতি দিয়ে তৈরি নানারকম মালা, প্লাস্টিকের খেলনা এমনকি নকল জবাফুলের মালা ইত্যাদিসহ বত্রিশ ভাজার এত দোকান ছিল না। খাবারও তখন আমরা টিফিনক্যারিতে করে লুচি তরকারি কমলা নিয়ে যেতাম। আর হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়লেই সতরঞ্চি বিছিয়ে খাবার খেতে বসতাম। আর অমনি বাদরকুল গাছের মাথা থেকে সড়সড় করে নেমে এসে এক থাপ্পড়ে হাতের লুচি নিয়ে উধাও হতো। গঙ্গার দিক থেকে শীতল হাওয়া এসে মনটা ভরিয়ে দিতো। 

দক্ষিণেশ্বরের কথা বললে বোধহয় আমার ফুরাবে না। সেই সব কচুরির দোকান। আমরা বরাবর মন্দিরে পুজো দিয়ে এসে দু’ নম্বর দোকানটায় কচুরি খেতাম। আজও তাই খাই। যদিও কোন যোগ্যতায় সেটি প্রথম দোকানের চেয়ে বেশি ভালো জানি না। ওখানেও তো খাবারের স্টিলের থালা তেলতেলে আর ছোলার ডাল একটু খানি আর কচুরিও একই রকম ছোট ও মোটা যাতে ঠান্ডা হলে দাঁত দিয়ে ছেঁড়া আর আখের খোসা ছাড়ানোর মতই ব্যায়াম হয়। ঘাটে গিয়ে গঙ্গার জলে হাত ডুবিয়ে চোখে-মুখে জল দিয়ে সেখানেই থাকা ডালার দোকান থেকে পুজোর ডালা নিয়ে আসা ছিল হ্যাবিট। পরে যখন ডালার পুনর্বাসন হলো তখনও ৩৯ নম্বর দোকান থেকেই বরাবর ডালা নিই। কেন? তা কি জানি? ওখানেও তো দেখি বাসি ক্ষীরের ছোট্ট ছোট্ট প্যাঁড়া আর তিন চারটি জবা ফুল দিয়ে তৈরি বিশাল মালা আর বিয়ের ওড়নার টুকরোর মতো একটা ঢাকনি দেওয়া থাকে ডালায় অন্য দোকানের মতই! জুতো খুলে সেই যে মন্দির চত্ত্বর পরিভ্রমণে বের হই ফেরার পরে যথেষ্ট পুণ্য এবং ফাটা গোড়ালিময় মাটি নিয়ে তবেই ফিরি তার আগে নয়। 

রোশনির সেই ছোট বেলাকার স্মৃতি শুনতে শুনতে আমরা মন্দিরে এসে ঢুকলাম। জুতা আর ক্যামেরা নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করা যায় না, তাই রোশনি বলল, মাসি আর তুই গঙ্গার ঘাঁটে গিয়ে হাত-পা ধুয়ে পূজার ডালা নিয়ে ভেতরে গিয়ে ঘুরে আয়। আমি আর মা পূজার ডালা নিয়ে ভেতর পানে অগ্রসর হলাম। মন্দিরে প্রবেশের মুখে বেশ নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুরুষ মহিলা আলাদা আলাদা লাইনে দিয়ে ঢুকতে হয়। ভেতরে প্রবেশের পর অন্যরকম এক পরিবেশ। একদিকে কীর্তন চলছে, অন্যদিকে দেবীর মুখ দর্শন আর পূজা দেওয়ার জন্য বিশাল লাইন। আমি আর মা লাইনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মন্দির চত্বর বৃষ্টির জন্য ভেজা কিন্তু ভক্তের অভাব নাই। কালীবাড়ি চত্বরে কালীমন্দির ছাড়াও একাধিক দেবদেবীর মন্দির আছে। মূল মন্দিরটি নবরত্ন মন্দির। এটি টালিগঞ্জের রামনাথ মণ্ডল নির্মিত নবরত্ন মন্দিরের আদর্শে নির্মিত বুঝি। 

আমরা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে মায়ের মুখ দর্শন করে ‘দ্বাদশ শিবমন্দির’ নামে পরিচিত বারোটি আটচালা শিবমন্দির দর্শন করতে গেলেম। শিব মন্দিরের পাশ দিয়ে বেঁয়ে গেছে নদী- অসাধারণ পরিবেশ! অন্য পাশে মন্দিরের উত্তরে রয়েছে ‘শ্রীশ্রীরাধাকান্ত মন্দির’ নামে পরিচিত রাধাকৃষ্ণ মন্দির এবং মন্দিরের দক্ষিণে রয়েছে নাটমন্দির। মন্দির চত্বরের উত্তর-পশ্চিম কোণে রয়েছে রামকৃষ্ণ পরমহংসের বাসগৃহ। মূল মন্দির চত্বরের বাইরে রামকৃষ্ণ পরমহংস ও তাঁর পরিবারবর্গের স্মৃতিবিজড়িত আরও কয়েকটি স্থান রয়েছে। আমরা পুরোটা মন্দির ঘুরে দেখলাম। এ এক অন্যরকম অনুভূতি, জাগতিক সব চিন্তার বাইরে! 

দেখতে দেখতে আমাদের বিদায়ের কাল ঘনিয়ে এলো। আমরা মন্দির থেকে বাইরে বের হয়ে সেই বিখ্যাত কচুরি খেয়ে ফিরে চললাম আমাদের গন্তব্যে।    

ঢাকা/তারা

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ল মন দ র মন দ র র প রব শ র জন য আম দ র কলক ত

এছাড়াও পড়ুন:

দক্ষিণেশ্বরে মায়ের বাড়ি  

কলকাতা, সময় বিকেল চারটা। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। আমি, মা আর আমার বোন রোশনি বেরিয়ে পরলাম ঘরের বাইরে- গন্তব্য দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি। গতকাল রাতে আমরা বাংলাদেশ থেকে এসে পৌঁছেছি। খারাপ আবহাওয়ার জন্য প্লেন চার ঘণ্টা দেরী করে। ফলে কলকাতা পৌঁছাতে সেই রাতই হয়ে যায়। আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিল পাঁচটার ভেতর কলকাতা পৌঁছে দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি দর্শন করে আমাদের ভ্রমণ শুরু করব। কিন্তু বিধিবাম! 

এ দিকে বাংলাদেশের বৃষ্টি যে আমাদের সাথে সাথে কলকাতায় এসে হাজির হবে তা ভাবতেও পারিনি। আগের দিন প্লেন দেরী করে পৌঁছানোর কারণে পরদিন সকাল সকাল ভেবেছিলাম দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে যাব কিন্তু মুষল ধারায় বৃষ্টির জন্য তাও হলো না। গৃহবন্দি হয়ে থাকতে হলো মামার বাসায়। তবে একদিকে ভালোই হয়েছে, সারাদিন মামির হাতের বিভিন্ন ধরনের রান্না চেখে দেখার সুযোগ মিলেছে।

বৃষ্টি একটু কমতেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। বাসা থেকে বের হয়ে ট্যাক্সি নিয়ে চললাম আমাদের নতুন গন্তব্যে। আমরা বিটি রোড ধরে এগিয়ে চলছি। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলাম গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে। আমাদের ঢাকা শহরের মতই যানজট তবে আশপাশের সব ভবন বেশ পুরনো। বলে রাখা ভালো দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান,  কলকাতার অদূরে হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত একটি কালীমন্দির। এটি উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার কামারহাটি শহরের অন্তঃপাতী দক্ষিণেশ্বরে অবস্থিত। ১৮৫৫ সালে প্রসিদ্ধ মানবদরদি জমিদার রানি রাসমণি এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।  মন্দিরে দেবী কালীকে ‘ভবতারিণী’ নামে পূজা করা হয়। 

ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট যোগী রামকৃষ্ণ পরমহংস এই মন্দিরে কালীসাধনা করতেন। কথিত আছে, রানি রাসমণি দেবী কালীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দির প্রতিষ্ঠাকালে রামকৃষ্ণ পরমহংসের দাদা রামকুমার চট্টোপাধ্যায় রানিকে প্রভূত সাহায্য করেছিলেন। রামকুমারই ছিলেন মন্দিরের প্রথম প্রধান পুরোহিত। ১৮৫৭-৫৮ সালে কিশোর রামকৃষ্ণ পরমহংস এই মন্দিরের পূজার ভার গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে তিনি এই মন্দিরকেই তাঁর সাধনক্ষেত্ররূপে বেছে নেন। 

দেখতে দেখতে আমরা ডানলপ মোড়ে এসে পৌঁছালাম। সেখান থেকে ডান দিকে যাওয়া শুরু করলো আমাদের গাড়ি। কিছুদূর যাবার পর গাড়ি থামিয়ে দিল পুলিশ। কারণ সোজা আর যাওয়া যাবে না। রাস্তায় কাজ চলছে। অগত্যা আমাদের উল্টো পথে হাঁটা শুরু করতে হলো গাড়ি রেখে। রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ! ময়লা আবর্জনা ফেলা। আমি মনে মনে ভাবছিলাম আমাদের দেশের রাস্তা এতো খারাপ না, অন্তত কোন দর্শনীয় স্থানের। 

কিছু দূর যাবার পর আবার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে হলো। নামার পর বাঁ দিকে হলো বেলুর মঠ যাবার ঘাঁট, ডান দিকে দক্ষিণেশ্বরের ভেতরে যাবার রাস্তা। বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখলাম খুব সুন্দর একটি ব্রিজ। রোশনিকে জিজ্ঞেস করলাম। ও বলল- বালি ব্রিজ। সামনে থেকে দেখছিলাম বালি ব্রিজের অসাধারণ দৃশ্য! আমি কালক্ষেপণ না করে একের পর এক ছবি তুলতে লাগলাম। আমি আরো কিছুটা সামনে গিয়ে ছবি তুলতে চাইলাম কিন্তু হলো না। রোশনি বলল, চল আর ছবি তুলতে হবে না। সামনে আরো অনেক কিছু আছে দেখার। আজ শনিবার মন্দিরে ভিড় হবে। আমরা চললাম মন্দির পানে। রাস্তার দুই ধারে দোকান বিভিন্ন ধরনের দ্রব্যাদি নিয়ে বসেছে। আমরা এসে পৌঁছালাম দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির প্রবেশ দ্বারে। বাইরে থেকেই দেখা যায় ভেতরের অসাধারণ কারুকার্যময় মন্দিরের দৃশ্য।

রোশনি বলছিল, বিশ বছর আগেও এত গুচ্ছের খাবারের দোকান আর বেলন-চাকি, পাথরের শিবলিঙ্গ, লোকনাথ বাবা, রুদ্রাক্ষের মালা, পুঁতি দিয়ে তৈরি নানারকম মালা, প্লাস্টিকের খেলনা এমনকি নকল জবাফুলের মালা ইত্যাদিসহ বত্রিশ ভাজার এত দোকান ছিল না। খাবারও তখন আমরা টিফিনক্যারিতে করে লুচি তরকারি কমলা নিয়ে যেতাম। আর হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়লেই সতরঞ্চি বিছিয়ে খাবার খেতে বসতাম। আর অমনি বাদরকুল গাছের মাথা থেকে সড়সড় করে নেমে এসে এক থাপ্পড়ে হাতের লুচি নিয়ে উধাও হতো। গঙ্গার দিক থেকে শীতল হাওয়া এসে মনটা ভরিয়ে দিতো। 

দক্ষিণেশ্বরের কথা বললে বোধহয় আমার ফুরাবে না। সেই সব কচুরির দোকান। আমরা বরাবর মন্দিরে পুজো দিয়ে এসে দু’ নম্বর দোকানটায় কচুরি খেতাম। আজও তাই খাই। যদিও কোন যোগ্যতায় সেটি প্রথম দোকানের চেয়ে বেশি ভালো জানি না। ওখানেও তো খাবারের স্টিলের থালা তেলতেলে আর ছোলার ডাল একটু খানি আর কচুরিও একই রকম ছোট ও মোটা যাতে ঠান্ডা হলে দাঁত দিয়ে ছেঁড়া আর আখের খোসা ছাড়ানোর মতই ব্যায়াম হয়। ঘাটে গিয়ে গঙ্গার জলে হাত ডুবিয়ে চোখে-মুখে জল দিয়ে সেখানেই থাকা ডালার দোকান থেকে পুজোর ডালা নিয়ে আসা ছিল হ্যাবিট। পরে যখন ডালার পুনর্বাসন হলো তখনও ৩৯ নম্বর দোকান থেকেই বরাবর ডালা নিই। কেন? তা কি জানি? ওখানেও তো দেখি বাসি ক্ষীরের ছোট্ট ছোট্ট প্যাঁড়া আর তিন চারটি জবা ফুল দিয়ে তৈরি বিশাল মালা আর বিয়ের ওড়নার টুকরোর মতো একটা ঢাকনি দেওয়া থাকে ডালায় অন্য দোকানের মতই! জুতো খুলে সেই যে মন্দির চত্ত্বর পরিভ্রমণে বের হই ফেরার পরে যথেষ্ট পুণ্য এবং ফাটা গোড়ালিময় মাটি নিয়ে তবেই ফিরি তার আগে নয়। 

রোশনির সেই ছোট বেলাকার স্মৃতি শুনতে শুনতে আমরা মন্দিরে এসে ঢুকলাম। জুতা আর ক্যামেরা নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করা যায় না, তাই রোশনি বলল, মাসি আর তুই গঙ্গার ঘাঁটে গিয়ে হাত-পা ধুয়ে পূজার ডালা নিয়ে ভেতরে গিয়ে ঘুরে আয়। আমি আর মা পূজার ডালা নিয়ে ভেতর পানে অগ্রসর হলাম। মন্দিরে প্রবেশের মুখে বেশ নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুরুষ মহিলা আলাদা আলাদা লাইনে দিয়ে ঢুকতে হয়। ভেতরে প্রবেশের পর অন্যরকম এক পরিবেশ। একদিকে কীর্তন চলছে, অন্যদিকে দেবীর মুখ দর্শন আর পূজা দেওয়ার জন্য বিশাল লাইন। আমি আর মা লাইনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মন্দির চত্বর বৃষ্টির জন্য ভেজা কিন্তু ভক্তের অভাব নাই। কালীবাড়ি চত্বরে কালীমন্দির ছাড়াও একাধিক দেবদেবীর মন্দির আছে। মূল মন্দিরটি নবরত্ন মন্দির। এটি টালিগঞ্জের রামনাথ মণ্ডল নির্মিত নবরত্ন মন্দিরের আদর্শে নির্মিত বুঝি। 

আমরা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে মায়ের মুখ দর্শন করে ‘দ্বাদশ শিবমন্দির’ নামে পরিচিত বারোটি আটচালা শিবমন্দির দর্শন করতে গেলেম। শিব মন্দিরের পাশ দিয়ে বেঁয়ে গেছে নদী- অসাধারণ পরিবেশ! অন্য পাশে মন্দিরের উত্তরে রয়েছে ‘শ্রীশ্রীরাধাকান্ত মন্দির’ নামে পরিচিত রাধাকৃষ্ণ মন্দির এবং মন্দিরের দক্ষিণে রয়েছে নাটমন্দির। মন্দির চত্বরের উত্তর-পশ্চিম কোণে রয়েছে রামকৃষ্ণ পরমহংসের বাসগৃহ। মূল মন্দির চত্বরের বাইরে রামকৃষ্ণ পরমহংস ও তাঁর পরিবারবর্গের স্মৃতিবিজড়িত আরও কয়েকটি স্থান রয়েছে। আমরা পুরোটা মন্দির ঘুরে দেখলাম। এ এক অন্যরকম অনুভূতি, জাগতিক সব চিন্তার বাইরে! 

দেখতে দেখতে আমাদের বিদায়ের কাল ঘনিয়ে এলো। আমরা মন্দির থেকে বাইরে বের হয়ে সেই বিখ্যাত কচুরি খেয়ে ফিরে চললাম আমাদের গন্তব্যে।    

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত নিবন্ধ