অস্টিওপোরোসিসে কেন অবহেলা করবেন না
Published: 20th, October 2025 GMT
অস্টিওপোরোসিস মানে ছিদ্রযুক্ত হাড়। এ রোগে হাড়ের ঘনত্ব কমে যায়। ফলে হাড় ভঙ্গুর হয়ে পড়ে এবং খুব সামান্য আঘাতেই ভেঙে যেতে পারে। এই রোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মেরুদণ্ড, কোমর ও কবজির হাড়।
হাড় দুর্বল হলেও শুরুতে কোনো উপসর্গ দেখা দেয় না বলে অস্টিওপোরোসিসকে ‘নীরব রোগ’ বলা হয়। এ ছাড়া এই রোগের প্রথম লক্ষণই অনেক সময় হাড় ভেঙে যাওয়া। তখন আর কিছু করার থাকে না।
বিশ্বে ২০ কোটির বেশি মানুষ এ রোগে আক্রান্ত। গবেষণা বলছে, প্রতি তিনজন নারীর একজন এবং পাঁচজন পুরুষের একজন কোনো এক পর্যায়ে অস্টিওপোরোটিক ভাঙনের শিকার হন। এটা শুধু ব্যথা বা বিকলাঙ্গতা নয়, অনেক সময় দীর্ঘমেয়াদি প্রতিবন্ধকতা ও মানসিক কষ্টের কারণ।
আরও পড়ুনসহজলভ্য এই ৮ খাবার থেকে পাবেন উচ্চমাত্রার ক্যালসিয়াম০৮ আগস্ট ২০২৪ঝুঁকিতে যাঁরাবাংলাদেশে নারীদের মধ্যে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা ও পুষ্টিহীনতার কারণে রোগটির প্রকোপ বাড়ছে। অস্টিওপোরোসিসজনিত হাড় ভাঙা নারীদের শয্যাশায়ী হওয়ার অন্যতম কারণ। এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন—
৫০ বছরের বেশি বয়সী নারী ও পুরুষ।
রজঃনিবৃত্ত (মেনোপজ) পরবর্তী নারী।
ধূমপায়ী ও অতিরিক্ত মদ্যপানকারী ব্যক্তি।
যাঁরা কম ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি গ্রহণ করেন।
কায়িক শ্রম বা ব্যায়ামের অভাব।
দীর্ঘদিন স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ সেবনকারী।
আরও পড়ুনহাড়ের ঘনত্ব বাড়ায় যে ৫টি পুষ্টি উপাদান১৮ জুলাই ২০২৫প্রতিরোধই সেরা উপায়অস্টিওপোরোসিস সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য নয়। তবে প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। জীবনযাপনে কয়েকটি পরিবর্তন আনলেই হাড় শক্ত রাখা যায়।
পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম গ্রহণ: দুধ, দই, পনির, ছোট মাছ, শাকসবজি, তিল ইত্যাদিতে প্রচুর ক্যালসিয়াম থাকে।
ভিটামিন ডি: প্রতিদিন রোদে ১৫-২০ মিনিট থাকলে শরীরে ভিটামিন ডি তৈরি হয়। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শে সাপ্লিমেন্ট নিতে হয়।
নিয়মিত ব্যায়াম: হাঁটা, সিঁড়ি ভাঙা, হালকা দৌড় বা ওজন নিয়ে ব্যায়াম হাড় মজবুত রাখে।
ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার: এগুলো হাড়ের গঠন ব্যাহত করে ও ক্যালসিয়াম শোষণ কমায়।
হাড়ের পরীক্ষা: বয়স ৫০ পার হলে বা ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর সদস্য হলে বছরে অন্তত একবার হাড়ের ঘনত্ব পরীক্ষা করা উচিত।
শেষ কথাপরীক্ষায় অস্টিওপোরোসিস প্রমাণিত হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ ব্যবহার করা হয়। অস্টিওপোরোসিস নীরবে হাড় ক্ষয় করে, কিন্তু সময়মতো সচেতনতা ও ব্যবস্থা নিলে এর ক্ষতি রোধ করা সম্ভব। ভালো খাদ্যাভ্যাস, রোদে থাকা, নিয়মিত ব্যায়াম, আর সময়মতো পরীক্ষা—এই চারটি অভ্যাসই আপনার হাড়কে ভাঙন থেকে রক্ষা করতে পারে।
আরও পড়ুনমেনোপজের পর হাড় ক্ষয় ঠেকাতে যা করবেন০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক য লস য় ম পর ক ষ
এছাড়াও পড়ুন:
মুসলিম সভ্যতায় কৃতী শিক্ষার্থীদের সম্মাননা দেওয়া
আবু নুওয়াস হিজরি চতুর্থ শতাব্দীর একজন কবি এবং আব্বাসি শাসনের প্রথম পর্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব। তার জন্ম ইরানের আহওয়াজ শহরে। তবে শৈশব, কৈশোর ও শিক্ষাজীবন কাটে ইরাকে বসরায়।
সেখানে তিনি বিভিন্ন শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। তিনি বিখ্যাত কারী ইয়াকুব হাজরামির কাছে কিরাত (কোরআনের পাঠরীতি) শেখেন।
কিরাত শাস্ত্রে বুৎপত্তি অর্জনের পর উস্তাদ ইয়াকুব হাজরামি তাকে কাছে ডাকেন। নিজের আঙুল থেকে আংটি খুলে তার হাতে তুলে দেন এবং বলেন, ‘আজ তোমার কিরাতের পাঠ গ্রহণ সমাপ্ত হল। এখন তুমি কোরআনের পাঠরীতি সম্বন্ধে বসরা অঞ্চলের সবচেয়ে পণ্ডিত ব্যক্তি।’ (আবুল ফারাজ আসফাহানি, কিতাবুল আগানি, ১/১৩)
দক্ষ, যোগ্য ও শাস্ত্রীয় জ্ঞানে পাণ্ডিত্যের অধিকারী প্রিয় শিক্ষার্থীদের সম্মাননা, সংবর্ধনা ও ভবিষ্যৎ উন্নতির জন্য দোয়া করা ছিল মুসলিম সভ্যতায় সাধারণ রেওয়াজ।দক্ষ, যোগ্য ও শাস্ত্রীয় জ্ঞানে পাণ্ডিত্যের অধিকারী প্রিয় শিক্ষার্থীদের সম্মাননা, সংবর্ধনা ও ভবিষ্যৎ উন্নতির জন্য দোয়া করা ছিল মুসলিম সভ্যতায় সাধারণ রেওয়াজ। আবু হুরাইরা (রা.)–এর হেফজ শক্তি ও হাদিস সংরক্ষণের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নবিজি (সা.) দোয়া করেছিলেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১১৯)
তিনি ইবনে আব্বাস (রা.) এর জন্যও জ্ঞানের প্রাচুর্যর দোয়া করেছিলেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৪৩)
পাঠ সমাপ্তি উপলক্ষে শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে সম্মাননা ও সংবর্ধনা দেওয়া হতো। তাদেরকে বিভিন্ন মূল্যবান সামগ্রী দিয়ে পুরস্কৃত করা হতো। এই ধরনের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শিক্ষা ও সামাজিক জগতের মধ্যে সীমিত থাকতো বিষয়টা এমনও নয়। এর প্রভাব কখনো কখনো রাজনৈতিক অঙ্গনেও উত্তাপ ছড়াত।
আরও পড়ুনমুসলিম সভ্যতায় দরিদ্রদের চিকিৎসাসেবা০৩ নভেম্বর ২০২৫আব্বাসি খলিফা মুতাওয়াক্কিল বিল্লাহ (মৃ. ২৪৭) এর পুত্র মুতাজ যখন পাঠ গ্রহণ সমাপ্ত করেন, তখন খলিফা অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। পুত্রের উস্তাদ শায়খ মুহাম্মদ ইবনে ইমরানকে তিনি ৫ হাজার দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) মূল্যের রত্ন উপহার প্রদান করলেন।
এই বিষয়টা তার অপর পুত্র মুনতাসির বিল্লাহ সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। ফলে পিতা পুত্রের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। এক সময় সামরিক নেতাদের সঙ্গে আঁতাত করে মুনতারিস পিতাকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে নেয়। (বারা নাজ্জার রাইয়ান, মা জা তারিফু আনিল-ইহতিফাল বিল-খিররিজিন ফির হাজারাতিল ইসলামিয়্যাহ, আল জাজিরা।)
পাঠ সমাপ্তির পরে শিক্ষার্থীদের সম্মাননা প্রদানের অন্যতম মাধ্যম ছিল শাস্ত্রভেদে বিভিন্ন উপাধি ও লকব প্রদান। এই সব উপাধি সামাজিক পরিমণ্ডলে একজন শিক্ষার্থীর সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধির পেছনের বিরাট ভূমিকা পালন করতো। উপাধির মাধ্যমে লোকে জ্ঞানের জগতে একজন শিক্ষার্থীর অবস্থানের অনুমান করে নিতে পারতো।
পাঠ সমাপ্তির পরে শিক্ষার্থীদের সম্মাননা প্রদানের অন্যতম মাধ্যম ছিল শাস্ত্রভেদে বিভিন্ন উপাধি ও লকব প্রদান। উপাধির মাধ্যমে লোকে জ্ঞানের জগতে একজন শিক্ষার্থীর অবস্থানের অনুমান করে নিতে পারতো।নির্দিষ্ট শাস্ত্রে অর্জিত জ্ঞানের পরিধি বিবেচনা করে এই সব উপাধি প্রদান করা হতো। শাস্ত্র ভেদে উপাধিও ভিন্ন রকমের হতো। হাদিসশাস্ত্রে বরেণ্যদের দেয়া হতো, ‘মুসনিদ’, ‘হাফেজ’, ‘হাকেম’ জাতীয় উপাধি।
ফিক্হ ও আইন শাস্ত্রের জন্য বরাদ্দ ছিল, ‘ইমাম’, ‘মুজতাহিদ, ‘শাইখুল ইসলাম’ উপাধি। চিকিৎসা শাস্ত্রের উপাধি হতো, ‘শায়খ’ ও ‘রাইস’ ইত্যাদি। আর বরেণ্য অভিজ্ঞ ও উস্তাদ চিকিৎসকদের বলা হতো, আশ শাইখুর রাইস!
মুসলিম সভ্যতায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের সম্মাননা প্রদানের জন্য পোশাক প্রদানের রেওয়াজও ছিল। ইমাম আবু হানিফার প্রধানতম শিষ্য ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) প্রথম পোশাক প্রদানের প্রচলন করেন। তারপর থেকে ‘পোশাক’ প্রদানের ধারাবাহিকতা শহরে শহরে ছড়িয়ে পড়ে। এবং উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীকে সংবর্ধনা প্রদানের জন্য ‘তাইলাসান’ ব্যবহার হতে থাকে।
তাইলাসান হল এক ধরনের উলের বৃত্তাকার সবুজ পোশাক, যার নিচের দিক খোলা থাকে। কেউ কেউ বলেছেন, তাইলাসান কাঁধের ওপর ঝুলিয়ে রাখা হয়। এটা শরীর আবৃত করে নেয়। তবে এতে সেলাই বা কাটছাঁটের কোনো কাজ থাকে না। (রজম আবদুল জাব্বার ইবরাহিম, আল মুজামুল আরাবি লি-আসমায়িল মালাবিস, ‘তাইলাসান’ ভুক্তি দ্রষ্টব্য)
কোনো কোনো অঞ্চলে উস্তাদ নিজের পরনের পোশাক খুলে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীকে পরিয়ে দিতেন এবং মাথায় তুলে দিতেন ‘কালিস’ টুপি।
আরও পড়ুনজ্ঞানচর্চায় বৃত্তি পেতেন সব ধর্মের মানুষ১৬ আগস্ট ২০২৫কৃতী শিক্ষার্থীদের সম্মাননা প্রদানের আরেকটি মাধ্যম ছিল ‘শাহাদাতুল ইজাজাহ’ বা সনদপত্র প্রদান। সনদে পঠিত বিষয়, উস্তাদের নাম, জ্ঞানার্জনে তার যোগ্যতা ও দক্ষতার বিষয় উল্লেখ করা থাকতো। এর পাশাপাশি থাকতো শাস্ত্রীয় শিক্ষকদের নাম সম্বলিত ধারাবাহিক সনদ।
এই সনদ সমাজে তাদের জ্ঞানার্জনের স্বীকৃতির পেছনে ভূমিকা পালন করতো। এর মাধ্যমে শাস্ত্রীয় জ্ঞানে অভিজ্ঞ একজন শিক্ষার্থী পাঠদানের অনুমতি পেতো। এবং তার কাছে শিক্ষা গ্রহণ করা শিক্ষার্থীদের সনদ প্রদানের যোগ্যতা অর্জন করতো।
আব্বাসি খলিফা আল-মুকতাদির বিল্লাহর নির্দেশে চিকিৎসা শাস্ত্রে সনদ প্রদান ও অনুমোদন গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়।অন্যান্য শাস্ত্রে পাশাপাশি চিকিৎসা শাস্ত্রে সনদ গ্রহণ ও উস্তাদের অনুমতি অর্জনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হতো। প্রাথমিক যুগে মুসলিম সমাজে চিকিৎসাশাস্ত্র অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে চর্চা করা হতো। পরবর্তীতে তা ধীরে ধীরে পাঠ-গ্রহণ, নিরীক্ষণ এবং অনুমোদনের মাধ্যমে একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার আওতায় আসে। (আল মুসতাশফায়াতুল ইসলামিয়্যাহ ফিল আসিমাতির মিসরিয়্যাহ, আল হিলাল-২০০৯, পৃষ্ঠা: ৭১)
আব্বাসি খলিফা আল-মুকতাদির বিল্লাহর নির্দেশে চিকিৎসা শাস্ত্রে সনদ প্রদান ও অনুমোদন গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়। তখন থেকেই পাঠ সমাপ্ত করে একজন নবীন চিকিৎসককে পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্যতার প্রমাণ করে সনদ অর্জনের ধারাবাহিকতার সূচনা হয় এবং চিকিৎসাশাস্ত্রের এই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা একটি প্রতিষ্ঠিত রীতিতে পরিণত হয়। (ড. আমের নাজ্জার, ফি তারিখিত তিব্বি ফিদ দাওলাতিল ইসলামিয়্যাহ, পৃষ্ঠা: ৮৮-৮৯।)
ইসলাম জ্ঞানার্জনকে সকলের জন্য আবশ্যক করেছে। মুসলিম সমাজে সর্বদা শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি একজন যোগ্য শিক্ষার্থীকে যথাযথ স্বীকৃতি প্রদান ও সংবর্ধনা দানেও কখনো কসুর করেনি।
আরও পড়ুনযেভাবে গড়ল ইসলামি জ্ঞানচর্চার অর্থনৈতিক ভিত্তি১০ আগস্ট ২০২৫