কোনো গণ-আন্দোলনই নারীর অংশগ্রহণ ছাড়া পূর্ণতা পায় না। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান কিংবা ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন—প্রতিটি সংগ্রামে নারীদের রয়েছে সাহসিকতা ও নেতৃত্বের ভূমিকা; কিন্তু তাঁদের ভূমিকা প্রধানত সেবাদাত্রী, সম্ভ্রমহারা কিংবা বীরের মা হিসেবে চিত্রিত হয়েছে। ২০২৪-এর আন্দোলনেও নারীদের সাহসিকতা অন্য সবকিছু ছাপিয়ে গিয়েছিল।

২০২৪-এর ছাত্র আন্দোলন ছিল দীর্ঘদিনের অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে একটি গণবিস্ফোরণ। যেমন ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৯০-এর মতো সময়গুলোতে জনগণ শিকল ভেঙে অধিকার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন, তেমনই ২০২৪ সালেও ঘটে নতুন এক জাগরণ। এর সূচনা হয়েছিল ৬ জুন; ওই দিন আমরা কয়েকজন শিক্ষার্থী কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে ‘কোটা পুনর্বহাল চাই না’ ব্যানারে একটি ছোট মিছিল করি। শুরুতে আন্দোলনটি কোটা বাতিলের দাবি নিয়ে শুরু হলেও পরে সংস্কারের দাবিতে রূপ নেয়। ধীরে ধীরে এর ব্যাপকতা বাড়তে থাকে এবং ক্রমে একটি ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়।

আন্দোলনে নারীদের সম্পৃক্ত করা সব সময়ই একটি চ্যালেঞ্জ। ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের শুরুর দিকে পুরুষ শিক্ষার্থীদের তুলনায় নারী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ছিল অনেক কম। পরবর্তী সময়ে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। আমরা চেষ্টা করেছিলাম যতটা সংগঠিত করা যায়। নারীদের উপস্থিতিই এই আন্দোলনকে একটি যৌক্তিক ও নৈতিক অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ নামক এই আন্দোলনের অন্যতম মূল চালিকাশক্তিতে পরিণত হয় নারী শিক্ষার্থীরা।

’২৪-এর অভ্যুত্থানের এক অভিনব কর্মসূচি ছিল—‘বাংলা ব্লকেড’। দাবি আদায় না হলে আমরা রাস্তা অবরোধ করব, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রখর রোদে অনেক নারী শিক্ষার্থী বসে থেকেছেন, যেখানে অনেক পুরুষ শিক্ষার্থীরও ধৈর্য ছিল না। এমনকি একদিন প্রবল বৃষ্টিতে রাস্তায় কাদা ও নোংরা পানি চলে আসছিল; সেই বৃষ্টি, কাদা ও নোংরা পানি উপেক্ষা করেও আমরা রাজপথ ছাড়িনি। আন্দোলনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে নারীরা হয়ে উঠেছিলেন সাহসের প্রতীক।

১৪ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের রাজাকারের সঙ্গে তুলনা করেন। এই অপমান নারীরা মেনে নিতে পারেননি। তাঁরা সবার আগে হলের গেট ভেঙে রাস্তায় নামেন এবং রাজু ভাস্কর্যে অবস্থান নেন।

২৪-এর আন্দোলনে নারীরা যেমন দাবি আদায়ের জন্য এবং তাঁদের ভাই, বন্ধু বা সহপাঠীদের রক্ষা করতে রাস্তায় নেমেছিলেন, এখন তাঁরা নিজেদের রক্ষার জন্যই আন্দোলন করতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু এবার তাঁদের পাশে সেই ভাই, বন্ধু বা সহপাঠীদের সেভাবে দেখা যাচ্ছে না; যাদের জন্য একসময় নারীরা সবকিছু উপেক্ষা করে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন।

পরদিন খবর আসে যে ছাত্রলীগের নেতারা হলের ছেলেদের আন্দোলনে নামতে দিচ্ছেন না, তাঁদের মারধর করছেন। এ কথা শুনেই নারী শিক্ষার্থীরা তাঁদের রক্ষা করতে ছুটে যান। সম্ভাব্য আক্রমণের শিকার হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে তাঁদের বাঁচাতে গেলে, সেখানে নারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা অমানবিকভাবে নির্যাতন চালায়। এটা পুরো দেশের মানুষের হৃদয়ে দাগ কেটে যায়। এই নির্মমতার প্রতিবাদে পরদিনই দেশজুড়ে শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে আসেন।

নারীদের জন্য আন্দোলন সব সময় অনেক কঠিন। নানা সামাজিক ও শারীরিক বাধা অতিক্রম করেই সামনে এসে দাঁড়ায়। ২০২৪-এর আন্দোলনে তাঁরা শুধু সংগঠক ও নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন না; বরং পুরুষ শিক্ষার্থীদের সামনে মিছিলের ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ছাত্রলীগ-যুবলীগের হামলার ভয়, এমনকি পুলিশের গুলি উপেক্ষা করে মায়েরা তাদের সন্তানদের আন্দোলনে নামিয়ে দিয়েছিলেন। এই সংগ্রাম একসময় গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয় এবং ৫ আগস্ট বিজয়ের মাধ্যমে ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে।

কিন্তু বিজয়ের উচ্ছ্বাসের পর নারীদের জন্য বাস্তবতা দ্রুত পাল্টে যায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও সংস্কার কমিশনগুলোতে নারীদের যথাযথ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়নি, যদিও আন্দোলনের অন্যতম অংশীদার ছিলেন নারীরা। সবচেয়ে দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, স্বৈরাচারের পতনের পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ে আর তার প্রধান শিকার হয় নারী ও শিশু।

দেশে ধর্ষণ ও নারী নিপীড়নের মাত্রা বেড়ে গেছে। নারীদের ‘মোরাল পুলিশিং’ ও যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, উপদেষ্টা হিসেবে সরকারে যে নারীদের নেওয়া হয়েছে, নারীর নিরাপত্তা ইস্যুতে তাঁদেরও তেমন কার্যকর কোনো ভূমিকা নিতে দেখা যাচ্ছে না।  

২৪-এর আন্দোলনে নারীরা যেমন দাবি আদায়ের জন্য এবং তাঁদের ভাই, বন্ধু বা সহপাঠীদের রক্ষা করতে রাস্তায় নেমেছিলেন, এখন তাঁরা নিজেদের রক্ষার জন্যই আন্দোলন করতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু এবার তাঁদের পাশে সেই ভাই, বন্ধু বা সহপাঠীদের সেভাবে দেখা যাচ্ছে না; যাদের জন্য একসময় নারীরা সবকিছু উপেক্ষা করে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন।

একটি ‘বৈষম্যহীন’ রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন দেখানো আন্দোলন এবং সফল গণ-অভ্যুত্থানের পর শুধু নারী হওয়ার কারণেই নারীরা আজ নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন কেন, এই প্রশ্নের জবাব আমাদের পেতেই হবে। নারীরা যদি সুরক্ষিত না থাকেন, এই বিজয় কতটুকু অর্থবহ? তাই আমাদের দাবি, যেকোনো মূল্যে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

সীমা আক্তার সদস্য, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সহপ ঠ দ র দ র জন য উপ ক ষ

এছাড়াও পড়ুন:

সুদ পরিশোধে ব্যয় বাড়ছে

সুদ পরিশোধে সরকারের ব্যয় বাড়ছে। এ ব্যয় বহন করতে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাজেটে সরকারের সুদ পরিশোধ সংক্রান্ত পূর্বাভাসে দেখা যাচ্ছে, আগামী বছরগুলোতে সুদ ব্যয় ক্রমাগত বৃদ্ধি পাবে।

পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের প্রায় ১৫ ভাগ অর্থই সুদ খাতে খরচ করতে হচ্ছে এখন। এ পরিস্থিতিতে আগামী তিন অর্থবছরে সুদ খাতেই ব্যয় করতে হবে চার লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। পাঁচ অর্থবছরের ব্যবধানে সুদ ব্যয় বাড়ছে ৩৩ শতাংশ। এর মধ্যে শতাংশের হিসাবে বৈদেশিক ঋণের সুদ ব্যয় সবচেয়ে বেশি বাড়বে।

অর্থ বিভাগের করা ‘মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি-২০২৫-২০২৬ থেকে ২০২৭-২০২৮’ এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয় হয়েছিল এক লাখ  ১৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ খাতে সুদ ব্যয় ছিল ৯৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় গেছে ১৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা।

চলতি ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে (যা চলতি জুনের ৩০ তারিখে শেষ হয়ে যাবে) মূল বাজেটে সুদ খাতে ব্যয় বরাদ্দ ছিল এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বছর শেষে এই সীমায় সুদ ব্যয় ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। ফলে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয়েছে এক লাখ ২১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এ হিসাবের মধ্যে ছিল অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ব্যয় ৯৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং বিদেশী ঋণের ২২ হাজার কোটি টাকা।

একইভাবে আগামী তিন অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয়েরও একটি প্রক্ষেপণ করেছে অর্থ বিভাগ। এই হিসেবে দেখা যায় আগামী ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয় হবে এক লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা (অভ্যন্তরীণ এক লাখ কোটি টাকা , বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় ২২ হাজার কোটি টাকা)। একইভাবে এর পরের অর্থবছর ২০২৬-২০২৭ অর্থবছরে একলাখ ৩৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা(অভ্যন্তরীণ এক লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের ২৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা) এবং ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয়ের  প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ১ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। 

অর্থ বিভাগ থেকে বলা হয়েছে,  মোট সুদ ব্যয়ের সিংহভাগই অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ। অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে  ৯৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে এক লাখ ২৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা গিয়ে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু মোট বাজেটের অনুপাতে অভ্যন্তরীণ সুদ পরিশোধের হার ২০২৩ -২০২৪ অর্থবছরে ১৬ দশমিক ২৯ শতাংশ থেকে কমে ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে ১২ দশমিক ৭৫ শতাংশে হ্রাস পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ মোট সুদ ব্যয়ের তুলনায় কম, তবে এটি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। ফলে এটি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ১৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে ২৭ হাজার ১০০ কোটি টাকায় উন্নীত হতে পারে। মোট বাজেটের অনুপাতে বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ এ সময়কালে ২ দশমিক ৪৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২ দশমিক ৭৬ শতাংশে উন্নীত হতে পারে।

বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে অর্থ বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধের কার্যকর ব্যবস্থাপনা শুধু আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্যই নয়, বরং এটি সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রক্ষা, টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা, আন্তর্জাতিক ঋণমান বজায় রাখা এবং ভবিষ্যতের উন্নয়ন সম্ভাবনা সুরক্ষিত রাখার জন্য অপরিহার্য।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • খেলাপি ঋণ ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে
  • সুদ পরিশোধে ব্যয় বাড়ছে
  • সংশোধিত সাইবার অধ্যাদেশও আন্তর্জাতিক মানের হয়নি
  • জার্মানির ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনা মূল্যে পড়াশোনা, জেনে নিন সব তথ্য
  • ২০২৪ সালে মেটার কাছে ৩৭৭১ অ্যাকাউন্টের তথ্য চেয়েছে সরকার
  • কয়েক দশকের ছায়াযুদ্ধ থেকে এবার প্রকাশ্য সংঘাতে ইরান-ইসরায়েল
  • তিন চ্যাম্পিয়ন দলসহ যেসব তারকাকে দেখা যাবে না ক্লাব বিশ্বকাপে
  • ৫ বছরে ঋণের স্থিতি বাড়বে ৫৩.৭৭ শতাংশ: অর্থবিভাগ