পেশায় তিনি চিকিৎসক। গাছের সঙ্গে সখ্য বেশি। বাড়ির আঙিনা, ছাদ, সিঁড়ি, বারান্দা—এমনকি শোবার ঘরেও তাঁর গাছ আর গাছ। গাছের সঙ্গেই তাঁর বাস। পরিচিত সব গাছের সঙ্গে বাড়িজুড়ে ছড়িয়ে আছে বিরল ও দুষ্প্রাপ্য প্রজাতির সব বৃক্ষ। দূর থেকে দেখলে বাড়িটিকে উদ্ভিদ উদ্যান বলে ভ্রম হয়।
দুষ্প্রাপ্য গাছ শুধু নিজের কাছেই রাখেন না, ছড়িয়ে দেন পরিচিতজন ও বৃক্ষপ্রেমীদের মধ্যেও। তাঁর নাম আবু মোহাম্মদ নাঈম (৩৬)। বাড়ি কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার গুণানন্দী গ্রামে। তাঁর বাড়িটির নাম ‘আরণ্যক’। তিনি একজন অবেদনবিদ (অ্যানেসথেসিয়া বিশেষজ্ঞ)। কুমিল্লার একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত আছেন।
চিকিৎসকদের অনেকেই যখন হাসপাতালের দায়িত্ব পালন শেষে ব্যক্তিগত চেম্বার বা বেসরকারি হাসপাতালে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তখন চারদিক সবুজে সাজাতে নিজেকে বিলিয়ে দেন নাঈম। তাঁর হিসাবে, বাড়িটিতে কয়েক শ প্রজাতির অন্তত ২ হাজার গাছ আছে।
জাতীয় পরিবেশ পদকপ্রাপ্ত কুমিল্লার পরিবেশ ও কৃষি সংগঠক মতিন সৈকত প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের প্রতিটি উপজেলায় অন্তত একজন করে হলেও এমন ‘গাছপাগল’ মানুষ দরকার। তাহলে গোটা দেশ সবুজে ভরে যাবে। চিকিৎসক নাঈমের সংগ্রহে থাকা বৃক্ষ সরকারি কোনো উদ্ভিদ উদ্যানের চেয়েও কম নয়।
নাঈমের বাড়িতে মিঠাপানির স্পর্শে বেড়ে উঠছে সুন্দরবনের সুন্দরীগাছ ও গোলপাতা বৃক্ষ। বাংলাদেশের সংরক্ষিত উদ্ভিদ তালিকায় থাকা কুঁচ, লতাবট, বাঁশপাতা, রিঠা ফলগাছ, বৈলামের দেখাও পাওয়া যাবে ‘আরণ্যকে’।‘আরণ্যকে’ একদিন
সম্প্রতি গুণানন্দী গ্রামে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই ৯-১০ বছরের এক শিশু নাঈমের বাড়ি দেখিয়ে বলল, ‘ওইটাই গাছ ডাক্তারের বাড়ি।’ ফটক থেকে বাড়িতে ঢুকতেই প্রশান্তিতে ভরে গেল মন। প্রায় ৩০ শতকের বসতভিটার পুরোটায় হরেক রকম গাছের মেলা। ফটক থেকেই শুরু ঝুমকোলতা, নীলমণিলতা, যবনিকা লতা আর বাগানবিলাসগাছের সারি। একের পর এক গাছ সাজাতে বিভিন্ন রকম স্টিলের র্যাক, দোলনা, পাথর ইত্যাদির ব্যবহার নজর কাড়বে যে কারও।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশে বিলুপ্তপ্রায় খাসি কলসি উদ্ভিদ ছাদের শোভা বাড়িয়েছে। ৬৫০-এর বেশি ছোট-বড় টবে রয়েছে ডুলিচাঁপা, কুসুমচাঁপা, ভুইচাঁপা, উদয়পদ্ম, হৈমন্তী, দোলনচাঁপাসহ নানা ফুল। কিছু বিদেশি গাছও আছে নাঈমের সংগ্রহে।
বাগানের বয়স এক যুগের বেশি
ছেলেবেলা থেকেই গাছের প্রতি ভালোবাসা আবু নাঈমের। তিনি জানান, এই বাগানের বয়স এক যুগের বেশি। একাই হাজারো গাছের যত্ন নেন তিনি। যত ব্যস্ততাই থাকুক, মধ্যরাত হলেও হাসপাতাল থেকে ফিরে গাছের যত্ন নেন। নিজের আয়ের বেশির ভাগ অংশও তিনি ব্যয় করেন গাছের পেছনে। খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, কক্সবাজার, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জেলা এমনকি ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশ থেকেও গাছ সংগ্রহ করেছেন তিনি। কখনো পরিচিতজন ও আত্মীয়স্বজনদের মাধ্যমে বিদেশ থেকে গাছ এনেছেন।
নাঈমের বাড়িতে মিঠাপানির স্পর্শে বেড়ে উঠছে সুন্দরবনের সুন্দরীগাছ ও গোলপাতা বৃক্ষ। বাংলাদেশের সংরক্ষিত উদ্ভিদ তালিকায় থাকা কুঁচ, লতাবট, বাঁশপাতা, রিঠা ফলগাছ, বৈলামের দেখাও পাওয়া যাবে ‘আরণ্যকে’।
কোনো কোনো সময় দেখা যায়, বেতনের চেয়ে বেশি টাকা গাছের পেছনে ব্যয় হয়ে গেছে। আমার বাবা এখনো একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। সংসারে বাবার সাপোর্ট থাকায় সমস্যা হচ্ছে না।আবু নাঈমছড়িয়ে যাচ্ছে চারা
আবু নাঈম এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকভিত্তিক ছাদকৃষি, বাগান ও পরিবেশ সংরক্ষণবিষয়ক প্ল্যাটফর্ম ‘কুমিল্লা গার্ডেনার্স সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই গ্রুপের বর্তমান সদস্য ৫৬ হাজার। সেখানে দেওয়া আছে বিরল ও দুষ্প্রাপ্য বিভিন্ন বৃক্ষের পরিচিতি। বাগান করার নানা সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেন সদস্যরা। আবু নাঈম চান শহরের ইট-ক্রংক্রিটের জঞ্জালের ভেতরেও নতুন নতুন ছাদবাগান সৃষ্টি হোক। এ জন্য মানুষকে বিনা মূল্যে গাছের চারা, বীজ উপহার দেন। তবে শর্ত থাকে গ্রহীতাকেও অন্যদের গাছ উপহার দিতে হবে।
চারদিকটা বৃক্ষে সাজাতে চান উল্লেখ করে আবু নাঈম প্রথম আলোকে বলেন, বাগানের গাছের বীজ, চারা, কাটিং সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার বাগানিদের দেওয়া হয়। এরই মধ্যে ‘কুমিল্লা গার্ডেনার্স সোসাইটি’র মাধ্যমে বিনা মূল্যে ৭০ হাজারের বেশি বীজ, চারা, কাটিং গাছ বিভিন্ন স্থানে রোপণ করা হয়েছে। যার বেশির ভাগ গাছ, চারা, বীজ তাঁর বাগানের। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রোপণ করা হয়েছে আরণ্যক থেকে উৎপাদিত চারা। এর মধ্যে কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজ, কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ, এমনকি প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিনের বি এন ইসলামিক স্কুল অ্যান্ড কলেজেও বৃক্ষরোপণ করেছেন। সামাজিক বনায়নের অংশ হিসেবে বিভিন্ন সড়কের পাশে ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও গাছ রোপণ করেন তিনি।
আবু নাঈম বললেন, ‘কোনো কোনো সময় দেখা যায়, বেতনের চেয়ে বেশি টাকা গাছের পেছনে ব্যয় হয়ে গেছে। আমার বাবা এখনো একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। সংসারে বাবার সাপোর্ট থাকায় সমস্যা হচ্ছে না।’
গর্বিত পরিবার
আবু নাঈমের স্ত্রী কানিজ ফাতেমা একজন গৃহিণী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিন বছরের একমাত্র কন্যাসন্তান আনায়াহ নাওমিকে নিয়ে আমাদের সংসার। বিয়ের পর থেকে দেখছি আমাদের চেয়ে গাছের প্রতি বেশি ভালোবাসা তাঁর। যত ব্যস্তই থাকুন, দিনে অন্তত একবার হলেও গাছগুলোর পরিচর্যা করেন তিনি। প্রথমে অন্য রকম লাগলেও এখন আমিও স্বামীর এমন কাজকে ভালোবাসি।’
নাঈম ছোটবেলা থেকেই গাছের জন্য পাগল বলে জানালেন তাঁর মা নাসরিন আক্তার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাড়িতে এক ইঞ্চি খালি জায়গা রাখতে পারি না। কয়েক বছর আগে বাড়ির পেছনের ছোট্ট একটু জায়গায় মাটি ফেলেছিলাম। সেটিও এখন তাঁর গাছের দখলে চলে গেছে। বাড়ির ছাদ, বারান্দা তো বটেই, বেডরুমও গাছ দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে ছেলেটা। আমার ছেলেটা আসলেই গাছপাগল। ছেলের এমন পাগলামিতে আমরাও গর্বিত।’
আবু নাঈমের কাজকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), কুমিল্লার সাধারণ সম্পাদক আলী আকবার প্রথম আলোকে বলেন, এই কাজগুলো সামাজিকভাবে আরও ছড়িয়ে দেওয়া উচিত। তাহলে পুরো সমাজই আলোকিত হবে। নিঃসন্দেহে তিনি একজন বড় মনের মানুষ। সেটা না হলে এভাবে বৃক্ষকে ভালোবাসতে পারতেন না।
বাড়িতে এক ইঞ্চি খালি জায়গা রাখতে পারি না। কয়েক বছর আগে বাড়ির পেছনের ছোট্ট একটু জায়গায় মাটি ফেলেছিলাম। সেটিও এখন তাঁর গাছের দখলে চলে গেছে। বাড়ির ছাদ, বারান্দা তো বটেই, বেডরুমও গাছ দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে ছেলেটা। আমার ছেলেটা আসলেই গাছপাগল। ছেলের এমন পাগলামিতে আমরাও গর্বিত।মা নাসরিন আক্তার.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রথম আল ক ব সরক র পর চ ত পর ব শ
এছাড়াও পড়ুন:
সব্যসাচী কাজী মোতাহার হোসেন বিজ্ঞান ও শিল্পের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন
প্রথিতযশা অধ্যাপক ও পরিসংখ্যানবিদ কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন একজন সব্যসাচী মানুষ। তিনি নিজের কাজের মাধ্যমে বিজ্ঞান ও শিল্পের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। তাঁর ঐতিহ্য শিক্ষার্থীদের ধারণ করতে হবে।
জ্ঞানতাপস কাজী মোতাহার হোসেনের ১২৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আজ বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তারা এ কথাগুলো বলেন।
অনুষ্ঠানে স্মারক বক্তৃতা, বৃত্তি, পদক, পুরস্কার ও সনদ দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানের যৌথ আয়োজক কাজী মোতাহার হোসেন ফাউন্ডেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ এবং পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউট।
অনুষ্ঠানে ‘যুগলের বন্ধন: কাজী নজরুল ইসলাম-কাজী মোতাহার হোসেন’ শীর্ষক স্মারক বক্তৃতা দেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী। তিনি দুই বন্ধুর সম্পর্কের রসায়নের নানা দিক তুলে ধরেন।
প্রধান অতিথি বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, এই অনুষ্ঠানের দুটো প্রাপ্তি আছে। প্রথমত, মানুষের অবদান ও মেধাকে স্বীকার করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এই উপমহাদেশের একজন প্রথিতযশা সব্যসাচী মানুষের ঋণ স্বীকার করা হচ্ছে।
কাজী মোতাহার হোসেন যেকোনো বিবেচনায় একজন দার্শনিক বলে উল্লেখ করেন নিয়াজ আহমেদ খান। তিনি বলেন, কাজী মোতাহার হোসেন বিজ্ঞান ও শিল্পের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। প্রথম সারির পরিসংখ্যানবিদ, বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ছাড়াও তিনি অনেকগুলো সামাজিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, প্রভাব বিস্তার করেছেন। একজন মানুষের ছোট জীবদ্দশায় এত গুণ সন্নিবেশিত করা কঠিন। কিন্তু তিনি তা করে দেখিয়েছেন।
সবাইকে নিয়ে চলা, প্রতিষ্ঠান তৈরি করা, নিজের জগতের বাইরে নানা কিছুতে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মতো ঐতিহ্য কাজী মোতাহার হোসেন করে গেছেন বলে উল্লেখ করেন নিয়াজ আহমেদ খান। তিনি বলেন, তাঁর সম্মানে যাঁরা আজ স্বীকৃতি পেলেন, তাঁরা এই ঐতিহ্যকে ধারণ করবেন। এটা (বিশ্ববিদ্যালয়) যে সামাজিক প্রতিষ্ঠান, সে বার্তা দেবেন। যেসব শিক্ষার্থী সম্মাননা পাচ্ছেন, তাঁদের ছোট প্রোফাইল তৈরি করে ওয়েবসাইটে তুলে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
কাজী মোতাহার হোসেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল মাজেদ বলেন, কাজী মোতাহার হোসেন একজন সব্যসাচী মানুষ ছিলেন। বিজ্ঞানের এমন কোনো দিক নেই, যেখানে তাঁর পদচারণা ছিল না। তিনি দাবা খুব পছন্দ করতেন। দাবা খেলার কথা শুনলে তিনি ছুটে যেতেন। কাজী মোতাহার হোসেনকে নিয়ে তাঁর শোনা নানা গল্প তিনি স্মৃতিচারণা করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জাফর আহমেদ খান বলেন, কাজী মোতাহার হোসেন পরিসংখ্যান চর্চার পথিকৃৎ ছিলেন। বিজ্ঞান, দাবাচর্চারও পথিকৃৎ ছিলেন। এমন কোনো পুরস্কার নেই যে, তিনি পাননি। তাঁর দেখানো পথে যেন শিক্ষার্থীরা নিজেদের আলোকিত করতে পারেন।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন কাজী মোতাহার হোসেন ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী রওনাক হোসেন। এই আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের সেরা শিক্ষার্থীদের বই, নগদ অর্থ ও সনদ তুলে দেওয়া হয়। এ ছাড়া কাজী মোতাহার হোসেনকে নিয়ে আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।