২ এপ্রিল প্রথম আলো অনলাইনে ‘জুলাই হত্যাকাণ্ড কি জেনোসাইডের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। লেখক আরিফ রহমান প্রবন্ধটিতে দাবি করছেন, ‘বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট সময়ে সংঘটিত সহিংস নিধনযজ্ঞকে রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত গণহত্যা বলাই অধিক যুক্তিযুক্ত’...বা ‘একাডেমিক ও নৈতিক যুক্তিতে এ ঘটনা যে গণহত্যা, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।’

লেখক জেনোসাইড কনভেনশনের সংজ্ঞার কথা উল্লেখ করলেও নামজাদা কয়েকজন গবেষকের সংজ্ঞা ও মডেল ব্যবহার করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। আরিফের লেখার মূল যে স্পিরিট—‘রাষ্ট্র পরিচালিত নিষ্ঠুর বলপ্রয়োগ যে কতটা ভয়ংকর রূপ নিতে পারে, বাংলাদেশে ২০২৪ সালের ঘটনাই তার এক গভীর শিক্ষা’-এর সঙ্গে পরিপূর্ণ একমত হয়েও তাঁর অবস্থানের আইনি/যৌক্তিক দুর্বলতা ও এর সম্ভাব্য পরিণতির আশঙ্কা থেকে এই লেখার অবতারণা।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে ‘গণহত্যা’ শব্দের দুই ধরনের ব্যবহার রয়েছে। প্রথমত, রাজনৈতিক রেটরিক অর্থে ‘গণহত্যা’ দিয়ে আসলে বোঝানো হয়ে থাকে একসঙ্গে একের অধিক মানুষকে হত্যা করা; সেখানে ইংরেজি ‘ম্যাসাকার’ বা ‘মাসকিলিং’ অর্থে এটা ব্যবহৃত হয়।

ষাটের দশক থেকে আজতক এ ভূখণ্ডে যেকোনো ধরনের রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, যেখানে একের অধিক লোক মারা গেছেন, সব কটাকেই রাজনৈতিক পরিসরের জনপ্রিয় বুলিতে ‘গণহত্যা’ বলা হয়ে থাকে। মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যা সংঘটনের বহু আগেও যেমন রাষ্ট্রীয় সহিংসতা/হত্যাযজ্ঞ বোঝাতে ‘গণহত্যা’ শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায়, তেমনি বর্তমানে পিলখানা বা শাপলার রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞের ক্ষেত্রে ‘গণহত্যা’ সম্বোধনও বহুল প্রচলিত। এখানে গণহত্যা ও মাসকিলিং আসলে সমার্থক।

 এর বাইরে দ্বিতীয় আরেক ধরনের ব্যবহার রয়েছে: ‘জেনোসাইড’ অর্থে। ‘জেনোসাইড’–এর অর্থ ও সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক আইন বা জেনোসাইড কনভেনশনে খুবই নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের অভিধান থেকে শুরু করে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় ‘জেনোসাইড’–এর পরিভাষা হিসেবেও ‘গণহত্যা’ ব্যবহারের চল রয়েছে।

কিন্তু আইনে জেনোসাইডের সংজ্ঞায় যে কয়েকটা অপরাধমূলক কাজ বা অ্যাক্টকে জেনোসাইড হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে, তাতে হত্যা বা মাসকিলিং আরও অনেকগুলো অপরাধের একটি। সেখানে দেখা যায়, কাউকে ‘হত্যা’ না করেও আসলে ‘জেনোসাইড’ চালানো সম্ভব, কেননা সেখানে হত্যার বাইরে আরও কিছু অপরাধমূলক কাজের উল্লেখ রয়েছে, যেমন, শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিসাধন বা জোরপূর্বক জন্মদানে বাধা প্রদান বা এক গোষ্ঠীর শিশুদের অন্য গোষ্ঠীতে স্থানান্তর।

কিন্তু ‘গণহত্যা’ ব্যবহার করলে কেবল ‘হত্যা’কেই প্রাধান্য দেওয়া হয়, ফলে বাংলাদেশের অনেকেই জেনোসাইডের পরিভাষা হিসেবে গণহত্যা ব্যবহার না করে সরাসরি জেনোসাইড বা গোষ্ঠীনিধন/বা জাতিনিধন বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।

আরিফ রহমান তাঁর কলামে চব্বিশের হত্যাকাণ্ডকে যে ‘গণহত্যা’ বলতে চান, সেটা আসলে ‘জেনোসাইড’ অর্থে। রাজনৈতিক রেটরিক অর্থে ইতিমধ্যে এটা ‘গণহত্যা’ হিসেবে বহুল প্রচলিত হয়ে গেছে। কিন্তু ‘জেনোসাইড’ অর্থে একে ‘গণহত্যা’ বলাটা বিভ্রান্তিকর। কেন, সেটা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করা যাক।

প্রথমত, ‘জেনোসাইড’ হচ্ছে গোষ্ঠীকেন্দ্রিক অপরাধ। আরিফ রহমানও বলছেন, ‘একটি গোষ্ঠীর অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পিত অভিযান’। ‘জেনোসাইড’ শব্দের প্রবর্তক রাফায়েল লেমকিন থেকে শুরু করে জেনোসাইড কনভেনশন হয়ে প্রায় প্রত্যেক গবেষক পর্যন্ত এ বিষয়ে একমত।

১৯৪৮ সালে জেনোসাইড কনভেনশনে যখন এই আইন চূড়ান্ত হচ্ছে, তখন বহু বাহাসের পর গোষ্ঠীর চারটি বর্গকে ‘সুরক্ষিত গোষ্ঠী’ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে: জাতীয়, নৃগোষ্ঠী, জাতিগত ও ধর্মীয় গোষ্ঠী; অর্থাৎ, এই চার বর্গের কোনো গোষ্ঠীকে আংশিক বা পূর্ণ ধ্বংস করার নিয়তে (ইনটেনশন) যদি কিছু নির্দিষ্ট অপরাধমূলক কাজ করা হয়, তাহলে সেটা জেনোসাইড হবে।

এই ‘গোষ্ঠী পরিচয়’–এর নির্দিষ্টতাই অপরাপর অপরাধ থেকে একে পৃথক করে। আন্তর্জাতিক আইনে কেন ‘রাজনৈতিক’ বর্গ নেই, সেটা নিয়ে পরবর্তীকালে বহু গবেষক প্রশ্ন তুলেছেন, সমালোচনা করেছেন। কিন্তু, লিও কুপারসহ সবাই বাস্তবিক কারণেই এই আইনকে আলাপের রেফারেন্স পয়েন্ট হিসেবে নিয়ে থাকেন।

এখন চব্বিশের ঘটনায় ভিকটিমরা (ভুক্তভোগী) আন্তর্জাতিক আইনের সংজ্ঞার আওতায় পড়েন না। অর্থাৎ, কেবল জাতীয়, নৃগোষ্ঠী, জাতিগত বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর সদস্য হওয়ার কারণে কেউ হত্যাযজ্ঞ বা ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হননি। আরিফ রহমান সে কারণে আন্তর্জাতিক আইন ধরে আলাপ না করে বিভিন্ন গবেষকের মারফতে আলোচনা করেছেন, যাঁরা ‘রাজনৈতিক’ বর্গের অনুপস্থিতির কারণে জেনোসাইডের সংজ্ঞার সমালোচনাও করেছেন বা তাদের আলোচনার সুবিধার্থে সংজ্ঞাকে খুবই শিথিল আকারে ব্যবহার করেছেন।

আরিফ যে গ্রেগরি স্ট্যান্টনের ৮টি (পরে স্ট্যান্টন আরও দুটো ধাপ বাড়িয়েছিলেন) ধাপের মডেল ব্যবহার করেছেন, সেই গ্রেগরি স্ট্যান্টনও কিন্তু কনভেনশনের সংজ্ঞা ও পরিচয়ের ওই চারটি বর্গকে কবুল করেই আলোচনা করেছেন। তিনি কেবল জেনোসাইডকে একটা প্রক্রিয়া হিসেবে কিছু ধাপে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, যেন এটা আগে থেকে মোকাবিলা করা যায়।

অন্যদিকে, আরিফ যদি গবেষকদের বরাত দিয়ে ‘রাজনৈতিক’ বর্গকে অন্তর্ভুক্ত করতেও চান, তাহলেও চব্বিশের সহিংসতাকে এটাতে আটানো সম্ভব হবে না। কারণ, কোনো নির্দিষ্ট ‘রাজনৈতিক’ দল বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ছিল না।

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্যই ছিল, কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল বা ব্যানারের বাইরে গিয়ে এটা সংঘটিত হয়েছে। তাদের নানা ধরনের রাজনৈতিক মতামত থাকলেও, বা একটা বিশেষ মুহূর্তে একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে সমাবেশ তৈরি হলেও, এটাকে নির্দিষ্ট ‘রাজনৈতিক’ গোষ্ঠী বলা সম্ভব হবে না।

প্রথমত, এখানে যেকোনো সুরক্ষিত গ্রুপ বা গোষ্ঠী হওয়ার জন্য সেটাকে স্থায়ী (পারমানেন্ট) ও স্থিতিশীল (স্টেবল) হতে হবে; রুয়ান্ডা ও যুগোস্লাভিয়ার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলাগুলোয় গোষ্ঠী প্রসঙ্গে এ কথা বলা হয়েছিল। অর্থাৎ, এই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিরা সাধারণত জন্মসূত্রে নির্ধারিত হবেন যা সহজে পরিবর্তনযোগ্য নয়।

দ্বিতীয়ত, আরিফ যেভাবে শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে জনতাকে ‘রাজনৈতিক’ গোষ্ঠী হিসেবে তুলে ধরতে চান, সেটা করতে গেলে ‘রাজনৈতিক’ বর্গ এতই শিথিল হয়ে পড়ে যে আইনের দিক থেকে এটা আর অর্থবহ থাকে না। যেকোনো দলবদ্ধ গোষ্ঠীকে আসলে সে অর্থে ‘রাজনৈতিক’ বলা সম্ভব, এমনকি অনেক জাতীয় বা নৃগোষ্ঠীকেও কেউ কেউ রাজনৈতিক নির্মাণ বলেও সাব্যস্ত করতে পারবেন।

এটাও উল্লেখ করা জরুরি যে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সংজ্ঞায় পূর্বে ‘রাজনৈতিক’ বর্গ অন্তর্ভুক্ত ছিল, সেটা অভ্যুত্থানের পর আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সংশোধনীর মাধ্যমে বাদ দেওয়া হয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই বলার চেষ্টা করেছেন, এটা বাদ না দিলে আমাদের আইন অনুযায়ী চব্বিশের সহিংসতাকে ‘জেনোসাইড’ বলা যেতে পারত! কিন্তু, ওপরে এটাই বলার চেষ্টা করা হলো যে ‘রাজনৈতিক’ বর্গ থাকলেও চব্বিশের সহিংসতাকে ‘জেনোসাইড’ বা জেনোসাইড অর্থে গণহত্যা বলা সম্ভব নয়।

তৃতীয়ত, চব্বিশের সহিংসতাকে ‘জেনোসাইড’ না বললে কি অপরাধকে লঘু করা হয়? আমাদের উত্তর হচ্ছে, না। জেনোসাইডকে ‘ক্রাইম অব অল ক্রাইমস’ বলে সাব্যস্ত করার যে বহুল রেওয়াজ রয়েছে, তাতে মনে হয়, আইনে বুঝি একধরনের অপরাধের ক্রমবিন্যাস বা হায়ার্কি রয়েছে!

এটা ঠিক যে আন্তর্জাতিক আইনে জেনোসাইড প্রমাণের মানদণ্ড খুব উঁচু, কোনো ঘটনাকে জেনোসাইড প্রমাণ করতে খুব কসরত করতে
হয়। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যেকোনো হত্যাযজ্ঞকে ‘জেনোসাইড’–এর খোপে ঢোকানোর প্রয়াস খুব লক্ষণীয়।

সম্প্রতি গবেষকেরা (যেমন ডার্ক মোজেস) বলছেন, এই মনোভাব মানে এটাই সবচেয়ে বড় অপরাধ এবং সবকিছু এটাতে অন্তর্ভুক্ত করার যে প্রবণতা, তা আদতে ক্ষতিকর। এটা বিভিন্ন সহিংসতা ও অপরাধের বিবিধ মাত্রাকে কাটছাঁট করে, তার ধরন ও প্রকৃতিকে ঠিকঠাকমতো বুঝতে দেয় না।

ফলে হত্যাযজ্ঞমাত্রই ‘জেনোসাইড’ বা সে অর্থে গণহত্যা বলে দাবি করলে, একদিকে যেমন গণহত্যা/জেনোসাইড বর্গ হিসেবে অর্থহীন হয়ে উঠে, তেমনি যেসব ঘটনা আসলেই জেনোসাইড, সেগুলো লঘু হয়ে পড়ে। এ কারণে অনেকেই হরেদরে ঘটনাকে জেনোসাইড ব্যবহার করতে সতর্ক করেন।

চব্বিশের ঘটনাকে যদি জেনোসাইড অর্থে গণহত্যা না বলি, তাহলে অপরাধের কোন ব্যানারে আলোচনা করা যেতে পারে? আরিফ নিজেও তাঁর লেখায় যেসব প্রতিবেদনের কথা বলছেন, সেখানেও এর স্পষ্ট ইঙ্গিত দেওয়া আছে। যেমন জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, এই ঘটনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ বলার যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ রয়েছে এবং পুরো প্রতিবেদনে নানা কায়দায় সেটাকেই প্রমাণ করা হয়েছে। চব্বিশের সহিংসতাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করাই যৌক্তিক ও সঠিক। এটাকে জেনোসাইড অর্থে গণহত্যা বললে মারাত্মক আইনি বিভ্রান্তি তৈরি হবে।

তাই আমরা মনে করি যে আন্তর্জাতিক আইনে কোনোভাবেই চব্বিশের সহিংসতাকে ‘জেনোসাইড’ বলে প্রমাণ করা যাবে না। এটাকে জোর করে যদি ‘জেনোসাইড’ অর্থে গণহত্যা বলা হয়ে থাকে, তাহলে কিছুদিন পর মূল অপরাধীরাই বলতে শুরু করবেন যে এটাকে গণহত্যা হিসেবে প্রমাণ করা যাবে না; ফলে নৈতিকভাবে দায়মুক্তি ঘটেছে বলে প্রচারণার সুযোগ পাবেন।

এ রকম তৎপরতা থেকে এ ধরনের ‘ভুল’ চিহ্নায়ন দুই তরিকার বিপদ ঘটাবে। এক.

খোদ চব্বিশের সহিংসতাকে পুরোপুরি বুঝতে সহায়ক হবে না এবং অপরাধীদের প্রচারণার সুযোগ করে দেবে; দুই. যেগুলো আসলেই ‘জেনোসাইড’মূলক ঘটনা, সেগুলোকে লঘু করে তুলবে।

সহুল আহমদ লেখক ও গবেষক

উম্মে ওয়ারা সহযোগী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবহ র কর আর ফ রহম ন র জন ত ক অপর ধ র গণহত য কর ছ ন আর ফ র ধরন র ঘটন ক

এছাড়াও পড়ুন:

যে ‘ধর্মীয় অনুপ্রেরণায়’ ইরানে এই হামলা চালাল ইসরায়েল

ইসরায়েল আবারও ইরানে বড় রকমের হামলা করেছে। হামলায় ইরানের বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণুবিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। হামলা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি ও আবাসিক এলাকায়। একদিন পর পাল্টা হামলা চালায় ইরান। এতে কয়েকজন ইসরায়েলি নিহত হয়। ধ্বংস হয় তেলআবিবের কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।

ইসরায়েল তার ইরানবিরোধী এ হামলার নাম দিয়েছে ‘রাইজিং লায়ন’। এ নাম রাখা হয়েছে হিব্রু বাইবেলের একটি চরণ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। যে নাম ইসরায়েলের একটি শক্তিশালী ও বিজয়দীপ্ত ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি দেয়।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বৃহস্পতিবার ইহুদিদের সবচেয়ে পবিত্র উপাসনাস্থল জেরুজালেমের ওয়েস্টার্ন ওয়ালের একটি ফাটলে হাতে লেখা একটি চিরকুট রেখে আসার সময় ছবি তোলেন। এটি ছিল মূলত ইরানে ইসরায়েলের হামলার ইঙ্গিত।

শুক্রবার তার অফিস থেকে সেই চিরকুটে একটি ছবি প্রকাশ করা হয়। সেখানে লেখা ছিল: ‘জনগণ সিংহের মতো উঠে দাঁড়াবে।’

এই বাক্যাংশটি হিব্রু বাইবেলের গ্রন্থ বুক অব নাম্বারস (গণনা পুস্তক) ২৩:২৪ পদ থেকে এসেছে। যেখানে বলা হয়েছে: ‘দেখো, এই জাতি একটি মহান সিংহের মতো উঠে দাঁড়াবে এবং একটি তরুণ সিংহের মতো নিজেকে উদ্দীপ্ত করবে; সে শিকার না খাওয়া পর্যন্ত বিশ্রাম নেবে না এবং নিহতদের রক্ত না পান করা পর্যন্ত থামবে না।’

এই চরণটি হিব্রু বাইবেলের অ-ইসরায়েলীয় একজন নবী ও ভবিষ্যদ্বক্তা বালামের প্রথম ভবিষ্যদ্বাণীর অংশ। সেখানে তিনি ইসরায়েলের শক্তি ও ক্ষমতার কথা বলেন। তাদের এমন এক সিংহের সঙ্গে তুলনা করেন যে নিজের ক্ষুধা না মেটানো পর্যন্ত বিশ্রামে যায় না।

অনেকেই মনে করেন, এই অভিযানের নাম ইরানের শেষ শাহ-এর পুত্রের প্রতি ইঙ্গিত হতে পারে। কারণ পারস্য রাজপরিবারের প্রতীক হিসেবেও সিংহ ব্যবহৃত হতো।

ইসরায়েলের ঐশ্বরিক অধিকারের দাবি

ইসরায়েল প্রায়শই তার সামরিক অভিযানের নাম হিব্রু বাইবেল বা ওল্ড টেস্টেমেন্ট থেকে নেয় বা ধর্মীয় অনুপ্রেরণা থেকে গ্রহণ করে। ফিলিস্তিনি ভূমির উপর ইহুদিদের তথাকথিত ঐশ্বরিক অধিকারের দাবি এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের যুদ্ধকে ন্যায্যতা দিতে ইসরায়েল এসব ধর্মীয় বিষয় ব্যবহৃত করে বলে অনেকে মনে করে থাকেন।

উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সিরিয়ার সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে চালানো এক অভিযানের নাম দিয়েছিল, ‘অ্যারো অব বাশান।’ ‘বাশান’ শব্দটি ইসরায়েলিদের ধর্মগ্রন্থ ওল্ড টেস্টামেন্টে ব্যবহৃত হয়েছে। এটি দিয়ে মূলত সিরিয়ার দক্ষিণ ও জর্ডান নদীর পূর্বে অবস্থিত একটি অঞ্চলকে নির্দেশ করা হয়। বাশানের রাজাকে পরাজিত করে ইসরায়েলিরা সেই অঞ্চলকে দখল করেছিল।

গাজা উপত্যকার ওপর হামলা চালাতেও অস্ত্র ও অভিযানের জন্য হিব্রু বাইবেলীয় প্রতীক বা অনুষঙ্গ ব্যবহার করছে ইসরায়েল। নেতানিয়াহু অন্তত তিনবার গাজায় আক্রমণের জন্য হিব্রু বাইবেলীয় আমালেক কাহিনি ব্যবহার করেছেন।

২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর এক বিবৃতিতে নেতানিয়াহু হিব্রু বাইবেল ও ওল্ড টেস্টামেন্টের গ্রন্থ ‘বুক অব ডিউটেরনমি’(২৫:১৭) এর থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন:

‘আমালেক তোমার সঙ্গে যা করেছিল তা মনে রেখো, আমরা মনে রাখি এবং আমরা যুদ্ধ করি।’

এর মধ্য দিয়ে গাজাবাসীদের উপর পূর্ণাঙ্গ হামলা করা উচিত বলে নেতানিয়াহু ইঙ্গিত করেন। কারণ ডিউটেরনমির এই উদ্ধৃতি বাইবেলের স্যামুয়েল গ্রন্থে বর্ণিত আমালেকীয়দের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ ধ্বংসের আহ্বান হিসেবে বিবেচিত হয়।

বাইবেলের এ কাহিনিতে ইসরায়েলিদের ওপর আক্রমণকারীদের সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার আহ্বান জানানো হয়েছে। গাজার গোটা জনসংখ্যাকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দিতে বাইবেলের এ কাহিনিকে হাজির করেছেন নেতানিয়াহু।

গণহত্যার মামলায় নেতানিয়াহুর বক্তব্য

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার দায়ের করা গণহত্যার মামলায় আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) প্রথম শুনানিতে দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষের আইনজীবী হিব্রু বাইবেলের উদ্ধৃতির মাধ্যমে নেতানিয়াহুর এই বক্তব্যকে গাজার জনগণের বিরুদ্ধে গণহত্যায় প্ররোচনা হিসেবে তুলে ধরেন।

আইনজীবী আরও জানান, নেতানিয়াহু ৩ নভেম্বর সেনাদের উদ্দেশ্যে লেখা আরেকটি চিঠিতে একই আমালেকীয় গল্প পুনরাবৃত্তি করেন।

ধর্মীয় নাম ব্যবহার করে সামরিক প্রযুক্তি

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি গাজায় বোমাবর্ষণে সহায়তা করছে, তাদের নাম ‘ল্যাভেন্ডার’ এবং ‘দ্য গসপেল’, যা উভয়ই হিব্রু বাইবেলীয় ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে।

টিআরটি ওয়ার্ল্ডের বিশ্লেষক রাভালে মহিদিনের মতে, প্রায়ই ধর্মীয় ধর্মগ্রন্থ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ইসরায়েলের অস্ত্রের নামকরণ করা হয়। যেমন, স্যামসন রিমোট কন্ট্রোলড ওয়েপন স্টেশন।

জেরিকো ব্যালিস্টিক মিসাইল-এর নাম রাখা হয়েছে জেরিকো শহরের নামে। হিব্রু বাইবেল ও ওল্ড টেস্টামেন্টের একটি গ্রন্থ ‘বুক অব যশুয়া’ অনুসারে ইসরায়েলিরা এই শহর ফিলিস্তিনিদের কাছ দখল করেছিল।

ডেভিড’স স্লিং নামক আরেকটি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার নাম রাখা হয়েছে বাইবেলের মেষপালক ডেভিড ও বিশাল যোদ্ধা গোলিয়াথের মধ্যকার বিখ্যাত সেই লড়াইয়ের স্মরণে, যেখানে ডেভিডের বিজয় হয়েছিল। এই কাহিনী আছে হিব্রু বাইবেল ও ওল্ট টেস্টামেন্টের একটি গ্রন্থ ‘বুক অব স্যামুয়েল’-এ।

*দ্য নিউ আরব, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা বিষয়ক লন্ডনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম। টিআরটি ওয়ার্ল্ডের বিশ্লেষক ও হার্ভার্ডের গবেষক রাভালে মহিদিনের একটি লেখার অবলম্বনে দ্য নিউ আরব এ বিশ্লেষণটি প্রকাশ করেছে। অনুবাদ করেছেন: রাফসান গালিব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, ভালো উদ্যোগ নিলেও বিরোধিতা আসে
  • যে ‘ধর্মীয় অনুপ্রেরণায়’ ইরানে এই হামলা চালাল ইসরায়েল
  • তেহরানে ইসরায়েলের বিমান হামলার নিন্দা জানিয়েছে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল