বিদেশ ভ্রমণে আমার দুটি প্রিয় গন্তব্য হলো মিউজিয়াম ও আর্ট গ্যালারি। প্রত্নসম্ভার ও চিত্রকলা– দুটোই আমাকে প্রবলভাবে টানে। ফরাসি ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের ভুবনজোড়া নাম ও তাদের কিছু কিছু ভুবনবিখ্যাত চিত্রকলার প্রিন্ট দেখে আমি এতটাই মুগ্ধ যে আর্ট গ্যালারিতে তাদের ছবি দেখতে পেলে নিজেকে সৌভাগ্যের বরপুত্র বলে মনে হয়। মনে হবে না কেন? এসব ছবি দুর্লভ আর তাদের একেকটির দাম শুনলে চক্ষু চড়কগাছ হতে বাধ্য। এসব চিত্রকলা নিয়ে একেকটি জাদুঘর ও আর্ট গ্যালারি নিজেরাই ধনী হয়ে ওঠে।
উনিশ শতকের শেষভাগে প্যারিসে একদল ফরাসি চিত্রশিল্পীর স্বতন্ত্র চিত্র প্রদর্শনীতে ইমপ্রেশনিস্ট চিত্রকলার আন্দোলন বা ধারা গড়ে ওঠে। ইমপ্রেশনিস্ট চিত্রকলার বৈশিষ্ট্য হলো এসব চিত্রকলায় তুলির আঁচড় সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়, উন্মুক্ত ক্যানভাস, সাদামাটা বিষয়, অভিনব প্রেক্ষণবিন্দু, অঙ্কিত দৃশ্যে দিনের বা ঋতুর ভিন্নতার কারণে আলোর ভিন্ন ভিন্ন প্রতিফলন, মানব অবলোকন ও অভিজ্ঞতায় গতিকে ধরার চেষ্টা ইত্যাদি। ১৮৭২ সালে ক্লদ মনের আঁকা সূর্যাস্তের তৈলচিত্র Impression, Sunrise থেকে ইমপ্রেশনিস্ট আন্দোলনের নামকরণ হয়েছিল। ক্লদ মনেকে এ আন্দোলনের প্রধান চিত্রশিল্পী মনে করা হলেও ক্যামিল পিসারোকে মনে করা হয় ইমপ্রেশনিস্ট আন্দোলনের জনক, যার চিত্রকলা ক্লদ মনে, পল সেজানসহ অনেক শিল্পীর ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। যে কোনো নতুন আন্দোলনের মতোই ইমপ্রেশনিস্ট আন্দোলন প্রথমদিকে প্রাচীনপন্থিদের প্রবল প্রতিরোধ, তিক্ত সমালোচনা ও ঈর্ষাপ্রসূত বিদ্রুপের শিকার হয়েছিল। কিন্তু তা বেশিদিন টেকেনি, ইমপ্রেশনিস্ট আন্দোলন গোটা ইউরোপে ঢেউ তোলে এবং চিত্রকলা ছাড়িয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে চলচ্চিত্র, সংগীত ও শিল্পের অন্যান্য শাখায়।
গ্লাসগোর কেলভিনগ্রুভ আর্ট গ্যালারিতে
গ্লাসগোর কেলভিনগ্রুভ আর্ট গ্যালারি ও মিউজিয়ামটি গ্লাসগো ইউনিভার্সিটির সন্নিকটে। আমি যেখানে উঠেছি সেই ইয়ুথ হোস্টেল থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বে দুটোই। তাপমাত্রা বিজ্ঞানের জনক লর্ড কেলভিনের নামখচিত পার্কের পাশে ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্যকলার এক অনুপম নিদর্শন। এর একপাশে জাদুঘর, অন্যপাশে আর্ট গ্যালারি। আর্ট গ্যালারিতে বেশ কিছু বিখ্যাত ফরাসি ইমপ্রেশনিষ্ট চিত্রশিল্পী– যেমন ক্লদ মনে, এদগার দেগা, পিয়েরে-অগ্যুস্ত রেনোয়া, এদুয়ার্দ মানে প্রমুখের ছবি।
ক্লদ মনে একই বিষয়, যেমন সূর্যাস্ত বা পদ্মফুল, এর ওপরে সিরিজ ছবি এঁকেছেন, বিষয় এক হলেও ছবিগুলোর পার্থক্য ছিল অঙ্কিত ছবির ওপরে আলো ও পরিবেশের ভিন্নতা। এদগার দেগার ছবিতে ব্যালে নর্তকীর নাচ ও ঘোড়ার দৌড়ের গতি মূর্ত হয়েছে। এদুয়ার্দ মানে ইমপ্রেশনিস্ট চিত্রীদের কিছুটা অগ্রজ যাকে, ক্যামিল পিসারোর মতো এ আন্দোলনের পূর্বসূরি মনে করা হয়। এদুয়ার্দ মানের ছবির বিষয়বস্তু আধুনিক জীবন ও সামাজিক সম্পর্ক। এখানে রয়েছে কয়েকজন বিশ্বখ্যাত চিত্রশিল্পীর আঁকা চিত্রকর্ম; যাদের বলা হয় পোস্ট ইমপ্রেশনিস্ট পেইন্টার্স। তারা হলেন– পল গঁগ্যা, ভিনসেন্ট ভ্যান গগ ও হেনরি মাতিসে। কেবল ছবি নয়, দেয়ালে চিত্রশিল্পীদের কিছু বিখ্যাত উক্তি উদ্ধৃত। কেলভিনগ্রুভ মিউজিয়ামে আর্ট গ্যালারিতে আমি দেখেছি ক্যামিল পিসারোর বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘দ্য টুইলারিজ গার্ডেনস’, পল গঁগ্যার ‘অস্ত্রে আনলাগ পার্ক’, ভিনসেন্ট ভ্যান গগের ‘পোর্ট্রেট অব দ্য আর্ট ডিলার আলেক্সান্দার রিড’। এ গ্যালারিতে আমি দুজন জগদ্বিখ্যাত চিত্রশিল্পীর ছবি দেখার সুয়োগ পাই। তারা হলেন– সুররিয়ালিস্ট আন্দোলনের জনক জগদ্বিখ্যাত স্প্যানিশ চিত্রকর সালভাদর দালির একটি ও ডাচ চিত্রশিল্পের স্বর্ণযুগের সবচেয়ে প্রতিভাবান শিল্পী রেমব্রাঁ। মনে পড়ে দালির ‘ক্রাইস্ট অব সেন্ট জোন অব দ্য ক্রস’ ছবিটি বিশেষভাবে প্রদর্শিত হচ্ছিল এবং ঐ ছবিটিই ছিল মহামূল্যবান সব ছবির ভিড়ে অর্থমূল্যে সবচেয়ে দামি রেমব্রাঁর ছবি ‘এ ম্যান ইন আরমার’ রিয়ালিস্টিক ছবি হলেও যুদ্ধপোশাক পরিহিত যোদ্ধার শিরস্ত্রাণ ও বুকে আলোর যে প্রতিফলন দেখেছিলাম তা ইমপ্রেশনিস্ট চিত্রীদের মতোই।
এডিনবরা আর্ট গ্যালারিতে
এডিনবরা আর্ট গ্যালারিটি প্রিন্সেস স্ট্রিটের পাশেই একটি প্রাচীন ভবনে। স্কটিশ স্থপতি উইলিয়াম হেনরি প্লেফেয়ারের নিওক্লাসিক্যাল স্থাপত্য নকশায় এই আর্ট গ্যালারিটি ১৮৫৯ সালে উদ্বোধন করা হয়।
এর চূড়ায় স্কটল্যান্ডের পতাকা ও ব্রিটিশ পতাকা উড়ছে। সড়কের পাশে প্রথমে একটি ভবন, তার পেছনেই আর্ট গ্যালারিটি। এর কিছুটা নিচে পার্ক, আরও নিচে, দু’পাশের, এ পাশে প্রিন্সেস স্ট্রিট, ওপাশে রয়্যাল মাইল, পাথুরে পাহাড়ের উচ্চতা যে গিরিখাদ তৈরি করেছে তার ঢালুতে ট্রেন লাইন চলে গেছে। আর্ট গ্যালারিতে ঢুকে আমি বিস্ময়বিহ্বল! দেয়ালজুড়ে উজ্জ্বল রঙের বিশাল সব পেইন্টিং। অনেক প্রাচীন এই পেইন্টিংগুলো, একেকটির বয়স আমাদের প্রপিতামহদের (যদি তারা বেঁচে থাকতেন) বয়সের চেয়েও ঢের বেশি। অতীতে ফিগারেটিভ ছবিই বেশি আঁকা হতো, প্রতিটি ছবিতেই গল্প থাকত, বিশেষ করে যিশু খ্রিষ্টের জীবনের নানা ঘটনা নিয়ে কল্পিত ছবি আঁকা হয়েছে প্রচুর। শিল্পীরা যতটা সম্ভব বাস্তবে যেমন দেখা যায় তেমনটাই আঁকতেন, ফটোগ্রাফির কাছাকাছি নিখুঁত করাই ছিল দক্ষতা। রিয়ালিজমের সেই যুগের অনেক চিত্রে মধ্যযুগের অন্ধকার উঠে আসে। দলিত মানুষের দুর্দশা, কুসংস্কার ও ক্ষমতাবানদের নিষ্ঠুরতার অনেক চিত্র আঁকা রয়েছে। আরেকটি প্রিয় সাবজেক্ট ছিল নারী। নারীর সৌন্দর্য পুরুষ শিল্পীরা এঁকেছেন প্রেমের আবেগে। নগ্ন নারীর অতুলনীয় দেহসৌষ্ঠব তারা এঁকেছেন সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে। ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীরা, যাদের বেশির ভাগই ফরাসি, বিষয়ের বদল ঘটান, তারা তুলে আনেন প্রকৃতিকে, রাজার বদলে আঁকেন সাধারণ মানুষের প্রতিকৃতি, রূপকথাকে বিসর্জন দেন পার্থিব ও মানবিক বিষয়ের পক্ষে।
আমি অকাতরে ছবি তুলছি, কিন্তু কেউ নিষেধ করছে না। আমি হতবাক! জাদুঘরের লোকেরা আশপাশে সতর্ক দৃষ্টি রেখে ঘুরছে, কিন্তু ছবি তোলায় বাধা দিচ্ছেন না। আমি তো পারলে প্রতিটি ছবির প্রিন্ট তুলে রাখি, ক্যামেরার মেমোরি ও ব্যাটারিতে কুলোবে না ভেবে বাছাই করি কোনটা তুলব আর কোনটা তুলব না। তোলার দিকেই পাল্লা হেলে পড়ে, কম ছবিই বাদ যায় আমার চোখ ও ক্যামেরার দৃষ্টি থেকে। দোতলায় গিয়ে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা একটি ছবি দেখে আমি শিহরিত। উল্টো পাশের দেয়ালে আরেক বিখ্যাত ইতালিয়ান শিল্পী রাফায়েলের তিনটি পেইন্টিং দেখেও বাকরুদ্ধ। উত্তেজনা অনুভব করছি, নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবছি, চর্মচক্ষে গ্রেট মাস্টারদের আঁকা ছবি দেখতে পেয়ে।
রয়্যাল স্কটিশ একাডেমি ভবনের পুরোটা জায়গাজুড়ে ফরাসি ইমপ্রেশনিস্ট চিত্রশিল্পীদের প্রবল উপস্থিতি। তারা হলেন– হেনরি মাতিসে, ক্লদ মনে, এদগার দেগা, পল রেনোয়া, ভ্যান গগ, পল গঁগ্যা প্রমুখ। ভুবনবিখ্যাত শিল্পীদের ছবি দেখেছি আর শিহরিত বোধ করছি। কী করে রোমান্টিক পিরিয়ডের আসক্তি ছাড়িয়ে ইমপ্রেশনিজম একটি বিপ্লবী ধারা হয়ে ওঠে এবং হয়ে ওঠে চিত্রকলায় পূর্বের সমস্ত অকশনকে তুচ্ছ করে রেকর্ড ভাঙা দামে বেচাকনার ধারা সৃষ্টি– তার একটি ধারণা পাওয়া যায় এডিনবরা আর্ট গ্যালারিতে। ক্লদ মনের ‘খড়ের গাদা’ সাদামাটা ছবি, তুলনায় পল গঁগ্যার après le Sermon ছবিটি অনেক আকর্ষণীয়।
চিত্রশালায় ছবিই প্রধান, তবু কিছু ভাস্কর্য, তৈজসপত্র ও আসবাব দেখা যায়। সবই ঐতিহাসিক এবং অমূল্য। ভাবি এই গ্যালারিটির সকল দুর্লভ ছবি আর ভাস্কর্যের সামগ্রিক মূল্য কত হতে পারে। কল্পিত অঙ্কটি আমাকে শিহরিত করে। গ্যালারিটি একটি উঁচু ছাদের প্রাচীন ভবনে অবস্থিত হলেও এর ভেতরে আধুনিক লিফট রয়েছে, তাতে চড়ে লোয়ার গ্রাউন্ড ফ্লোরে গিয়ে স্কটিশ চিত্রকরদের আঁকা ছবি দেখি। ভেবেছিলাম আজই এডিনবরা জাদুঘরটি দেখব, কিন্তু চিত্রশালাতেই আমার এতটা সময় কেটে যায়, ছবিতেই আমি এত মুগ্ধ থাকি যে, দুপুর গড়িয়ে কখন বিকেল হয়ে গেছে খেয়াল করিনি। ততক্ষণে জাদুঘরটি বন্ধ হয়ে গেছে।
ম্যানচেস্টার আর্ট গ্যালারিতে
ম্যানচেস্টার আর্ট গ্যালারিতে যাওয়ার পথে ম্যানচেস্টার সিটি কাউন্সিলের প্রাচীন দর্শনীয় ভবনটি পড়ে। এর স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পার্ঘ্য রেখে গেছে অজানা ভক্তদল। সবগুলো স্তবকই গাঢ় লাল রঙের পপি ফুলের। স্মৃতিস্তম্ভটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সৈনিকদের জন্য নির্মিত। একজন পুলিশ সেটি পাহারা দিচ্ছে। আর্ট গ্যালারিটি দুটি দালান নিয়ে একটি কমপ্লেক্স, একটি পাটাতনের মতো সিঁড়ি দিয়ে ভবনদ্বয় যুক্ত। পাটাতন পেরোলে কাচের সিঁড়ি ও লিফট দুটোই আছে শিল্পসন্দর্শী রসিকদের বিভিন্ন ফ্লোরে তুলে নেওয়ার জন্য। প্রাচীন ভবনটিতে পুরাকালের চিত্রকরদের পেইন্টিং, নতুন ভবনটিতে আধুনিক যুগের শিল্পীদের চিত্রকলা। ধ্রুপদি শিল্পীরা ছবি আঁকত বড় ক্যানভাসে। মানুষ, ধর্মীয় চেতনা, প্রকৃতি, মিথ প্রভৃতি ছিল তাদের চিত্রকর্মের বিষয়বস্তু। বাস্তবের যতটা কাছাকাছি আনা যায় চিত্রকে, তাই ছিল তাদের অভিলাষ, এসব চিত্রে প্রচুর ডিটেলস দেখা যায়। মূলত রিয়ালিস্টিক এবং ফিগারেটিভ ছবিই তারা আঁকতেন। এর পরে আসেন impressionist-রা, যারা অবিকল বাস্তব নয়, বাস্তবতা মানব ইন্দ্রিয়ে যে প্রতিক্রিয়া জাগায় তাই আঁকতেন। এ প্রসঙ্গে Dega-র একটি উক্তি স্মরণযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘I do not paint the table.
এই গ্যালারিতে ৫ হাজারের অধিক চিত্রকলার এক বিপুল সংগ্রহ রয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার তৈলচিত্র এবং বাকি ৩ হাজার জলরং ও ড্রয়িং মিলিয়ে। ভাস্কর্যই রয়েছে প্রায় আড়াইশ। এই গ্যালারিটি ভিক্টোরিয়ান চিত্রকলার জন্য বিখ্যাত হলেও এখানে ইমপ্রেশনিস্ট চিত্রকলার সম্ভারও কম নয়। এখানে ফরাসি ইমপ্রেশনিস্ট চিত্রবিদ পিয়েরে এডলফ ভ্যালেটের বেশ কিছু কাজ রয়েছে। ভ্যালেট বিশ শতকের গোড়ার দিকে ম্যানচেস্টারে পড়াতেন ও ছবি আঁকতেন। তৎকালীন ম্যানচেস্টারের কুয়াশাচ্ছন্ন সড়ক ও খালের ছবি এঁকেছেন তিনি। ওই একই কক্ষে পল সিজানের যে ছবিটি রয়েছে, সেটি একটি ফরাসি নদীর ওপরে সেতুর চিত্রকলা। মজার বিষয়টি হলো, দুজনের বিষয় ও আঁকার রীতিতে একটা সাযুজ্য লক্ষ্য করা যায়। এখানেই ব্রিটিশ ইমপ্রেশনিস্ট পেইন্টার উইনফোর্ড ডিউহার্স্টের ‘দ্য পিকনিক’ ছবিটি রয়েছে। উল্লেখ্য, তিনি ম্যানচেস্টারেই জন্মগ্রহণ করেন।
ইমপ্রেশনিজম ছাড়িয়ে এক্সপ্রেশনিজম, কিউবিজম, সুররিয়ালিজম– বিভিন্ন শিল্পধারায় ছবি এঁকেছেন প্রখ্যাত শিল্পীরা। কিউবিজমের উদ্গাতা পাবলো পিকাসোর ছবি তুলনামূলক দুর্লভ, এখন পর্যন্ত আমি একটিও দেখিনি। গ্লাসগোর কেলভিনগ্রুভ মিউজিয়ামে দেখেছিলাম সুররিয়ালিজমের প্রবক্তা এবং সে আন্দোলনের সবচেয়ে প্রভাববিস্তারী শিল্পী সালভাদর দালির একটি ছবি। মাতিসে, মনে, দেগা, ভ্যান গগ, পল গগ্যাঁ প্রমুখ ইমপ্রেশনিস্ট ও এক্সপ্রেশনিস্ট মাস্টারদের কিছু গৌণ চিত্রকর্ম– সবগুলো চিত্রশালাতেই দেখেছি। গৌণ? হাত দিয়ে দেখুন, হাত পুড়ে যাবে আগুনে। কোনোটির দামই হান্ড্রেড থাউজেন্ড পাউন্ডের নিচে নয়। পকেটে মাত্র কয়েকশ পাউন্ড নিয়ে বিনে পয়সায় দেখে নিচ্ছি বিলিয়ন পাউন্ডের একেকটি চিত্রশালা, আমার স্পর্ধা তো কম নয়! আমি আসলে সৌভাগ্যবান। শিল্প আন্দোলনের অনেক ঢেউ পেরিয়ে আজকের চিত্রকলা অ্যাবস্ট্রাক্ট রূপ পরিগ্রহ করেছে, সে দেখায় না প্রায় কিছুই, বোরখায় ঢাকা রূপসীর মতো, সামান্য অবয়ব বের করে রাখে ভেতরের অসামান্য সৌন্দর্যের ইশারা (লোভ বলব? থাক, ইশারাই ভালো) জাগিয়ে। দর্শকের কল্পনার ওপরে সে নিজেকে ছেড়ে দেয়। রিয়ালিজম ও অ্যাবস্ট্রাক্ট– আর্টের দুই পর্বতমালার ভেতরে প্রসারিত উপত্যকায় আরও কত চিত্রকলা কত রূপ ধরেই না এলো! সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে অগ্রসর শতাব্দীটি একদিকে যেমন দেখেছে বিজ্ঞান ও জীবনযাত্রার বৈপ্লবিক পরিবর্তন, তেমনি বিক্ষত হয়েছে দু’দুটো মহাযুদ্ধের সন্ত্রাসে। শিল্পীরা আক্রান্ত হয়েছেন বিষাদে, বিভীষিকা ও মানবসৃষ্ট তাণ্ডব তাদের বিশ্বাসের ভিত্তিমূল টলিয়ে দিয়েছে, আশার বদলে তাদের গ্রাস করেছে হতাশা, আলোর বদলে তারা ভুবনে অন্ধকারের দৈত্যনাচন দেখেছেন বেশি। ছবিতে তারা উগরে দিয়েছেন বিবমিষা, ঘৃণাকে ছড়িয়ে দিয়েছেন ক্যানভাসে, অবিশ্বাসের রঙে এঁকেছেন পরাজিত, পর্যুদস্ত মানুষের বিকৃত, পচাগলা অবয়ব। দ্বিতীয় ভবনের চিত্রকলায় এসবই প্রধান। এসব ছবির ক্যানভাস বিরাট নয়, উজ্জ্বল রংসকল অপসৃত। কেবল রং নয়, এসেছে মিশ্র মিডিয়া, স্কেচ, ফর্ম নিয়ে নিরীক্ষা। রিয়ালিজম ও অ্যাবস্ট্রাক্ট।
আর্ট গ্যালারিতে একজন ভদ্রমহিলাকে দেখলাম, ওখানকারই কেউ হবেন, একদল শিল্পভক্তকে একটি বড় ধ্রুপদি চিত্রকলা নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন, অনেকক্ষণ ধরেই। এক চক্কর ঘুরে এসে দেখি তখনও লেকচার চলছে। বুঝলাম প্রতিটি চিত্রের দীর্ঘ ইতিহাস ও পটভূমি আছে, আছে শিল্পীর মুনশিয়ানা ও ঘরানার দিকটি, আছে তুলনামূলক আলোচনার অবকাশ, দুর্বলতার সমালোচনা, সবলতা ও অসাধারণত্বের উচ্ছ্বাসপূর্ণ প্রশংসা। আমি তো এক লহমায় দেখে নেই, কতটুকু বুঝি?
আর্ট গ্যালারি থেকে বেরিয়ে আমার বন্ধু ডা. মামুন সিরাজ ও আমি ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের দিকে যাই অক্সফোর্ড স্ট্রিট ধরে। পথের বাঁকে অর্ধবৃত্তাকার গণগ্রন্থাগারটির বাইরের অবয়ব দেখি। ভিক্টোরিয়ান যুগের এসব স্থাপত্যের বেশির ভাগ আঠারো ও উনিশ শতকে নির্মিত। ব্রিটেনে তখন বসন্তকাল। সারা পৃথিবীর রাজা সে, দু’হাতে লুণ্ঠন করছে উপনিবেশগুলোর সম্পদ, তা দিয়ে গড়ে তুলছে সুরম্য নগরী, দুর্ভেদ্য দুর্গ আর জমকালো রাজপ্রাসাদ। প্রকৃতি তার গর্ভ থেকে উগরে দিয়েছে গলন্ত লাভা, হাজার বছরে তা শীতল হয়ে রূপ নিয়েছে কঠিন আগ্নেয়শিলায়, সেই পাথর দিয়ে নির্মিত প্রকাণ্ড ও সুদৃশ্য ভবনসমূহের দিকে তাকাতে তাকাতে ভাবি সেসবে আমারও কিঞ্চিৎ অধিকার বুঝি রয়েছে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আর ট গ য ল র ট আর ট গ য ল র ত চ ত রকল র র চ ত রকল চ ত রকর ম পল গ গ য জ দ ঘর প ইন ট আ কত ন সবচ য় র ওপর ন ভবন র একট র বদল
এছাড়াও পড়ুন:
ইসলামে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের ধারা
নানা ধর্মের উৎস কী, কেমন করে সেগুলোর বিকাশ ঘটল, তাদের মূল নীতিমালাই–বা কী, কোথায় তাদের পরস্পরের সঙ্গে মিল, আর কোথায় অমিল—এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয় যে শাস্ত্রে, তার নাম তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব।
সহজ করে বললে, এটি ধর্মগুলোর ইতিহাস আর বিশ্বাসের ভিন্নতা নিয়ে কথা বলে। তাদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য, পারস্পরিক মিল আর অমিলের জায়গাগুলো তুলে ধরে। এই শাস্ত্র পাঠের উদ্দেশ্য একটাই—ধর্মের প্রকৃতিকে জানা, আর তার অনুসারীদের বোঝা।
ধর্মতত্ত্ব হলো বিভিন্ন ধর্মের বিশ্বাসগুলোকে দর্শনের ভাষায় প্রকাশ করার মাধ্যম। এর প্রয়োজন কেন? ধর্ম তো আসলে বিশ্বাসের বিষয়, একান্তই ব্যক্তিগত এক অনুভূতি।
কিন্তু এই অনুভূতি যখন সব মানুষের সামনে নিজেকে প্রকাশ করতে চায়, তখন তার একটি জাগতিক ও যৌক্তিক ভাষার দরকার হয়। এমন এক ভাষা, যার দাঁড়িপাল্লায় মানুষ সত্য-মিথ্যা পরখ করতে চায়। এই তাগিদ থেকেই প্রতিটি ধর্মের জ্ঞানীরা নিজ নিজ বিশ্বাসের এক দার্শনিক রূপ দিয়েছেন।
একেক শাস্ত্রে এর একেক নাম—ইলমুল কালাম, অধিবিদ্যা বা থিওলজি।
মুসলমানদের সামনে কোরআনই প্রথম ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম, বিশ্বাস আর সম্প্রদায়ের বস্তুনিষ্ঠ পাঠ তুলে ধরে তাদের দাবি ও যুক্তিগুলোকে সামনে এনেছে। আবার সেসব দাবির দুর্বলতা আর যুক্তির ফাঁকগুলোও উন্মোচন করেছে।কোরআনের আলোয় ভিন্ন মতএই শাস্ত্রের শিকড় প্রোথিত আছে পবিত্র কোরআনে। মুসলমানদের সামনে কোরআনই প্রথম ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম, বিশ্বাস আর সম্প্রদায়ের বস্তুনিষ্ঠ পাঠ তুলে ধরে তাদের দাবি ও যুক্তিগুলোকে সামনে এনেছে। আবার সেসব দাবির দুর্বলতা আর যুক্তির ফাঁকগুলোও উন্মোচন করেছে।
ইহুদি ও নাসারাদের কথা কোরআনে বহুবার এসেছে। তাদের দাবিগুলো উপস্থাপন করে কোরআন সেগুলো খণ্ডন করেছে। আহলে কিতাব বা গ্রন্থধারী জাতিদের নিয়ে কোরআনে বিশদ আলোচনা আছে। যেন সত্যের পথে আহ্বানের তারাই প্রথম হকদার। কোরআনের মতানুযায়ী, আহলে কিতাবদের তাদের কাছে পাঠানো ঐশীগ্রন্থকে বিকৃত করে ফেলেছে। অথচ বিকৃতির আগে ইসলাম ও তাদের ধর্মের মৌল নীতি ও বিশ্বাস ছিল এক।
কোরআনে তাই আহলে কিতাবদের প্রতি রয়েছে সঠিক পথে ফিরে আসার এক উদাত্ত আহ্বান। আল্লাহ বলেন, ‘বলে দাও যে হে আহলে কিতাব! তোমরা এমন এক কথার দিকে এসে যাও, যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে একই রকম। (আর তা এই যে) আমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করব না।
তাঁর সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করব না এবং আল্লাহকে ছেড়ে আমরা একে অন্যকে প্রভু বানাব না। তথাপি যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে বলে দাও, সাক্ষী থাক যে আমরা মুসলিম।’ (সুরা আলে-ইমরান, আয়াত: ৬৪)
কোরআন কেবল ইহুদি-নাসারাদের কথাই বলেনি, বলেছে আরও বহু ধর্ম ও বিশ্বাসের কথা। কিছু ছিল ঐশী, আর কিছু মানুষের গড়া। মূর্তি পূজারি থেকে শুরু করে ফেরেশতার উপাসনাকারীদের কথাও সেখানে এসেছে।
আরও পড়ুনসাপ্তাহিক ছুটির দিন সম্পর্কে ধর্ম কী বলে২১ অক্টোবর ২০২৫বস্তুবাদী দর্শনের মুখোমুখিপ্রাচীনকালে ‘দাহরিয়া’ নামে একটি গোষ্ঠীর কথা জানা যায়, যাদের দর্শনকে এখন বস্তুবাদ বলা হয়। তাদের বিষয়ে কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তারা বলে, জীবন বলতে যা কিছু, তা ব্যস আমাদের এই পার্থিব জীবনই। আমরা এখানেই মরি ও বাঁচি, আর আমাদেরকে কেবল কালই ধ্বংস করে, অথচ এ বিষয়ে তাদের কোনোই জ্ঞান নেই। তারা কেবল ধারণাই করে।’ (সুরা জাসিয়াহ, আয়াত: ২৪)
প্রাচীন আরবি গদ্য সাহিত্যিক জাহিয তাঁর হায়াওয়ান গ্রন্থে এই দাহরিয়াদের নিয়ে আলোচনা করেছেন। সেখান থেকে জানা যায়, তাদের বিশ্বাসের ভিত ছিল কেবল ইন্দ্রিয়ের ওপর। ইন্দ্রিয় দিয়ে যা বোঝা যায়, তার বাইরে তারা কিছুই বিশ্বাস করত না। চোখে দেখা বা অনুভব করার বাইরে কোনো সত্যে তাদের আস্থা ছিল না।
ইরানি বহুবিদ্যাবিশারদ আল-বেরুনিও দাহরিয়াদের মতামত তুলে ধরেছেন। নুহ (আ.)-এর মহাপ্লাবনের তারিখ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি এক দাহরিয়াবাদী জ্যোতির্বিদের মত উল্লেখ করেন। সেই জ্যোতির্বিদ প্রাচীন এক তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে প্রতি ১ লাখ ৮০ হাজার বছর পরপর পৃথিবীতে বন্যা হয় এবং ভবিষ্যতেও হবে। আল-বেরুনি একে অজ্ঞতাপ্রসূত ধারণা বলে চিহ্নিত করেছেন। (আল-আছারুল বাকিয়াহ আনিল কুরুনিল খালিয়াহ, পৃ. ২৫)
ধর্মতত্ত্ববিদ আবুল ফাতহ শাহরাস্তানি তাঁর বিখ্যাত আল-মিলাল ওয়ান-নিহাল গ্রন্থে অবিশ্বাসীদের দুটি ধারার কথা বলেছেন। একদল কেবল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ে বিশ্বাস করে, যুক্তিতে নয়। আরেক দল ইন্দ্রিয় ও যুক্তি দুটিতেই বিশ্বাস স্থাপন করে—তারাই দাহরিয়া। (আল-মিলাল ওয়ান-নিহাল, ২/৩০৭)
তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের অপ্রতুলতাইসলামের আগে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের কোনো সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। কারণ, এক ধর্ম সহজে অন্য ধর্মের ঐতিহাসিকতাকে স্বীকার করত না। ইহুদিরা ঈসা (আ.)–কে নবী মানে না। খ্রিষ্টানদেরও ইহুদিদের প্রতি ছিল একই মনোভাব। বৌদ্ধ ও হিন্দুধর্মেও পারস্পরিক বোঝাপড়ার এই সংকট ছিল।
ইহুদিরা বলে, খ্রিষ্টানদের (ধর্মের) কোনো ভিত্তি নেই এবং খ্রিষ্টানরা বলে, ইহুদিদের কোনো ভিত্তি নেই। অথচ এরা সকলে (আসমানি) কিতাব পড়ে।কোরআন, সুরা বাকারা, আয়াত: ১১৩কোরআন তাদের এই সংকটের কথা তুলে ধরে বলেছে, ‘ইহুদিরা বলে, খ্রিষ্টানদের (ধর্মের) কোনো ভিত্তি নেই এবং খ্রিষ্টানরা বলে, ইহুদিদের (ধর্মের) কোনো ভিত্তি নেই। অথচ এরা সকলে (আসমানি) কিতাব পড়ে। অনুরূপ (সেই মুশরিকগণ) যাদের কোনো (আসমানি) জ্ঞান নেই, তারাও এদের (কিতাবিদের) মতো কথা বলতে শুরু করে দিয়েছে। সুতরাং তারা যে বিষয়ে মতবিরোধ করছে আল্লাহই কিয়ামতের দিন তাদের মধ্যে সে বিষয়ে ফয়সালা করবেন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১১৩)
এটি ছিল তৎকালীন ধর্মগুলোর এক সাধারণ চিত্র। এক অপরের অস্তিত্বকে স্বীকার না করায় তুলনামূলক আলোচনার কোনো সুযোগই ছিল না। অথচ বহুত্বকে স্বীকার করে নেওয়ার মধ্যেই জ্ঞানচর্চার বিকাশ ঘটে।
মুসলিম মনীষীদের হাত ধরে নতুন দিগন্তআধুনিক কালে ‘তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব’ বলতে বিভিন্ন ধর্মের বিজ্ঞানভিত্তিক পাঠকে বোঝানো হয়, যার নির্দিষ্ট নীতিমালা ও উদ্দেশ্য রয়েছে। কিন্তু মুসলিম চিন্তাবিদদের মধ্যে হিজরি দ্বিতীয় শতক থেকেই বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ পাঠের আগ্রহ দেখা যায়। তারা একে গবেষণার এক স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে গণ্য করেছেন।
ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বা প্রচলিত ধ্যানধারণার ওপর নির্ভর না করে প্রতিটি ধর্মের মূল উৎস গ্রন্থ থেকে জ্ঞান আহরণ করেছেন তাঁরা। বিশ্বের নানা ধর্মের বর্ণনা, বিশ্লেষণ, তুলনা ও ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন।
ড. মুহাম্মদ শারকাভীর মতে, কোরআনের আলোচনার প্রভাবেই মুসলমানদের মধ্যে এই শাস্ত্রের আগ্রহ জন্মেছিল। এই শাস্ত্রে তাঁরা লিখেছেন বড়–ছোট বিভিন্ন ধরনের বই। (গাজ্জালির লেখা আর-রাদ্দুল জামিল গ্রন্থে ড. মুহাম্মদ শারকাভীর লেখা ভূমিকা দ্রষ্টব্য)
মুসলিম সমাজে ধর্মীয় বহুত্ববাদ ও ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার এক বুদ্ধিবৃত্তিক সহনশীলতার জন্ম দেয়। বিভিন্ন ধর্মের পণ্ডিতদের মধ্যে যোগাযোগ, আলোচনা, বিতর্ক ও সংলাপের এক চমৎকার পরিবেশ তৈরি হয়। এভাবেই শুরু হয় বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে তুলনামূলক গবেষণা। তখন এর নাম ছিল ‘ইলমুল মিলাল ওয়ান-নিহাল’। এর মানে ধর্ম ও মতবাদ বিদ্যা। (আল-হাযারাতুল ইসলামিয়্যাহ ফিল কারনিল রাবিইল হিজরি, ১/৩৮৪)
পশ্চিমা পণ্ডিত ফ্রাঞ্জ রোজেন্থাল বলেছেন, ‘তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব ইসলামি সভ্যতারই অন্যতম এক আবিষ্কার, যা মানবজাতির বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতিতে বিশাল অবদান রেখেছে।’ (গোলাম হায়দার আসি, মুসলিম কন্ট্রিবিউশনস টু দ্য হিস্ট্রি অব রিলিজিওনস)
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকাও স্বীকার করে, ‘এদিকে, ইসলামি ধর্মতত্ত্ব পশ্চিমা খ্রিষ্টীয় জগতের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল, বিশেষ করে মধ্যযুগের স্কলাস্টিক দর্শনে, যেখানে যুক্তি ও ঐশী বাণী উভয়ের মূল্যকেই অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছিল। অন্য ধর্মগুলো সম্পর্কে মুসলমানদের জ্ঞান ইউরোপীয়দের চেয়ে অনেক অগ্রগামী ছিল।’ (দ্য নিউ এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা: স্টাডি অব রিলিজিওন, ১৫/৬১৫)
কাজি আবদুল জব্বার (মৃত্যু ৪১৫ হিজরি) খ্রিষ্টধর্ম নিয়ে আত-তাছবিত নামে একটি গ্রন্থ লেখেন। পশ্চিমা গবেষকদের মতে, এই বইটিতে খ্রিষ্টধর্মের অনেক বিরল তথ্যের সন্ধান মেলে। ডেভিড সক্সের মতো পণ্ডিতেরা তার কাজ দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন।
আরও পড়ুনইসলাম কি কোনো ধর্ম নাকি জীবনবিধান?১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে মুসলিমদের অবদানঅনেকে মনে করেন, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের গবেষণা শুরু হয়েছে ফ্রিডরিখ ম্যাক্স মুলারের হাতে। এ ধারণা পুরোপুরি সত্য নয়। এর বহু আগেই মুসলিম গবেষকরা ধর্মের ইতিহাস ও তুলনা নিয়ে অসংখ্য কাজ করেছেন। (ড. মুহাম্মদ শারকাভী, মানাহিজু মুকারানাতিল আদইয়ান ফিল ফিকরিল ইসলামি, পৃ. ৫০৮)
তাঁদের মধ্যেই কে প্রথম, তা নিয়ে অবশ্য মতভেদ আছে। হেনরি পিনার্ড দে লা বুল্লের মতে, ইবনে হাযম আন্দালুসিই এই শাস্ত্রের জনক। (আদ-দিরাসাতুল মুকারানাতু লিল-আদইয়ান)
আবার জার্মান প্রাচ্যবিদ অ্যাডাম মেটজের মতে, এর সূচনা হয় আবু মুহাম্মদ নাওবাখতির আল-আরা ওয়াদ দিয়ানাত (মতবাদ ও ধর্মসমূহ) গ্রন্থের মাধ্যমে। (আল-হাযারাতুল ইসলামিয়্যাহ ফিল কারনিল রাবিইল হিজরী, ১/৩৮৫)
কারও মতে, শাহরাস্তানির আল-মিলাল ওয়ান-নিহাল গ্রন্থটিই এর ভিত্তি। আবার কেউ আবু ঈসা ওয়াররাকের প্রবন্ধগুলোকে এই ধারার প্রথম কাজ বলে মনে করেন। (কমপেরেটিভ রিলিজিওন আ হিস্ট্রি, পৃ. ১১)
তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব ইসলামি সভ্যতারই অন্যতম এক আবিষ্কার, যা মানবজাতির বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতিতে বিশাল অবদান রেখেছে।পশ্চিমা পণ্ডিত ফ্রাঞ্জ রোজেন্থালহাসান বিন মুসা নাওবাখতি, আবুল হাসান হুযালি, ইযযুল মুলক মিসবাহি এবং আবু মনসুর ইসফারায়েনির মতো অগণিত পণ্ডিত এই শাস্ত্রে অবদান রেখেছেন।
কেউ আবার মনে করেন, আবু ঈসা ওয়াররাক তাদেরও আগে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধ নিবন্ধ লিখেছিলেন। সেগুলো ‘মাকালাত’ (প্রবন্ধসমগ্র) নামে বই বানানো হয়েছিল। এই মতের পক্ষে আছেন ড. ইবরাহিম তুর্কি। (নাশআতু ইলমি মুকারানাতিল আদইয়ান ফিল ফিকরিল ইসলামিয়্যি, পৃ. ৬০০)
তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীর গবেষণার জন্যে পরিচিত হাসান বিন মুসা নাওবাখতি। তিনি ছিলেন দার্শনিক ও শীআ ফকিহ। তিনি লিখেছিলেন আল-আরা ওয়াদ দিয়ানাত (মতবাদ ও ধর্মসমূহ), আর-রাদ আলা আসহাবিত তানাসুখ ওয়াত তানাসুখিয়্যাহ (জন্মান্তর ও জন্মান্তরবাদীদের খণ্ডন) নামে দুটি বই। (ইবনে নাদিম, আল-ফিহরিস্ত, ৫/২২৫)
আবুল হাসান আলী বিন হুসাইন হুযালি (মৃত্যু ৩৪৬ হিজরি) লিখেছিলেন, আল-মাকালাত ফি উসুলিদ দিয়ানাত (বিভিন্ন ধর্মের মূলনীতিমালা)। এখানে বিভিন্ন ধর্মের মূলনীতিমালা নিয়ে তিনি তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেছেন।
ইযযুল মুলক মুহাম্মদ বিন আবিল কাসিম মিসবাহি (মৃ. ৪২০ হি.) লিখেছিলেন দারকুল বুগয়াহ ফি ওয়াসফিল আদইয়ান ওয়াল ইবাদাত। এটা তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে সাড়ে তিন হাজার পৃষ্ঠার একটা বিরাট গ্রন্থ।
আবু মানসুর ইসফারায়েনি (মৃ. ৪২৯ হি.) তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে লিখেছেন দুটি গ্রন্থ। এক. আল-মিলাল ওয়ান-নিহাল, দুই. আল-ফারক বাইনাল ফিরাক (বিভিন্ন গোষ্ঠীর মাঝে চিন্তার বৈচিত্র)। এই গ্রন্থের শুরুতে তিনি গ্রন্থ রচনার উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
তাঁর ছাত্র ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাঁর কাছে একটা হাদিসের ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছিল। সেটার ব্যাখ্যা করতে গিয়েই এই গ্রন্থ তিনি লিখে ফেলেছেন। হাদিসটি হলো, ‘ইহুদিরা বিভক্ত হয়ে গেছে একাত্তর দলে। খ্রিষ্টানরা বিভক্ত হয়ে গেছে বায়াত্তর দলে। আর আমার উম্মত বিভক্ত হয়ে যাবে তিয়াত্তর দলে। (আবু দাউদ, কিতাবুস সুন্নাহ, শারহুস সুন্নাহ)
তাঁর ছাত্ররা চেয়েছিল, তিনি এই হাদিসের ব্যাখ্যা এমনভাবে করবেন, যেন বিভিন্ন দলের পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যায়। পরিষ্কার হয়ে যায় নাজাতপ্রাপ্ত দলের বৈশিষ্ট্য। ইসফারায়েনি এই গ্রন্থ রচনায় অবলম্বন করেছেন অলংকারপূর্ণ খণ্ডনমূলক যুক্তিপদ্ধতি।
আল-বেরুনি তাঁর বইগুলোতে আলোচনা করেছেন ইহুদি, হিন্দু ও ভারতের অন্যান্য ধর্ম সম্পর্কে। তাঁর গবেষণায় ছিল সূক্ষ্মতা ও নিরপেক্ষতা।
ইবনে হাযম আন্দালুসি তাঁর আল-ফিসাল গ্রন্থে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। তাঁর গবেষণার কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল চোখে পড়ার মতো:
১. তিনি সমালোচনার জন্য বেছে নিতেন শুধু সেসব কথা, যার ভিন্ন কোনো অর্থ করার সুযোগ নেই। তিনি বলেছেন, ‘কোনো উক্তি বা উদ্ধৃতির ক্ষেত্রে যদি ভিন্ন কোনো ব্যাখ্যার—হোক তা দূরবর্তী—অবকাশ থাকে, তাহলে সেটার ওপর ভিত্তি করে আমি সমালোচনা করিনি।’ (আল-ফিসাল ফিল মিলালি ওয়াল আহওয়াই ওয়ান নিহাল, ১/২৩৬)
২. কোনো উদ্ধৃতি ব্যাখ্যার সময় তিনি তার আগের ও পরের প্রসঙ্গের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতেন। এটিই ছিল যৌক্তিক ব্যাখ্যার শ্রেষ্ঠ উপায়। পাঠ্যের সমালোচনার ক্ষেত্রে যদি পূর্বাপরের দিকে লক্ষ রাখা না হয়, তাহলে সে সমালোচনা গ্রহণযোগ্যতা হারায়। ড. আবদুর রহমান বাদাভী বলেছেন, ‘সার্বিক গ্রহণযোগ্যতার জন্য, শব্দ ও বাক্যকে সর্বদা পূর্বাপরের মধ্য দিয়ে অনুধাবন করতে হয়।’ (ড. আবদুর রহমান বাদাভি, মানাহিজুল বাহসিল ইলমিয়্যি, পৃ. ২০৭)
বর্তমান সময়ে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে বোঝাপড়া তৈরি করতে এবং নিজের আদর্শিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করতে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের পাঠ অপরিহার্য। মানুষের সবচেয়ে প্রভাবশালী অনুভূতি হলো তার ধার্মিকতা।৩. যাদের মত তিনি খণ্ডন করতেন, তাদের পক্ষে কী কী আপত্তি তোলা হতে পারে, তা–ও তিনি আগে থেকেই অনুমান করে জবাব দিয়ে যেতেন।
অন্যদিকে ইমাম শাহরাস্তানি ছিলেন আরও নির্মোহ এক পর্যবেক্ষক। তাঁর আল-মিলাল ওয়ান-নিহাল গ্রন্থে তিনি বিভিন্ন ধর্ম ও গোষ্ঠীর মতামত তুলে ধরেছেন একে অপরের পাশাপাশি। তাঁর লক্ষ্য ছিল তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা, তীব্র সমালোচনা নয়। (মুহাম্মদ বিন নাসের বিন সিহিবানি, মানহাজুশ শাহরাস্তানি ফি কিতাবিহ আল-মিলাল ওয়ান নিহাল, পৃ. ২৮৫)
এই পথ ধরেই এগিয়েছেন ইমাম ইবনে তাইমিয়া। লিখেছেন আল-জাওয়াবুস সহিহ লিমান বাদ্দালা দীনাল মাসিহ। এই গ্রন্থে তিনি কোরআনের সেসব আয়াতের বিস্তৃত ব্যাখ্যা পেশ করেছেন—যেগুলোকে খ্রিষ্টানরা নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করে যুক্তি পেশ করে। এই গ্রন্থ রচনায় তিনি অবলম্বন করেছেন তুলনামূলক বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতি।
তাঁর ছাত্র ইবনু কায়্যিমিল জাওযিয়াহ লিখেছেন হিদায়াতুল হায়ারা ফি আজওইবাতুল ইয়াহুদি ওয়ান নাসারা। গ্রন্থ রচনায় তাঁর পদ্ধতি ছিল বর্ণনামূলক, সমালোচনামূলক ও তুলনামূলক। বিভিন্ন বিষয়ের বিশ্লেষণে তিনি ব্যবহার করেছেন উসুলুল ফিকহ ও ভাষাতত্ত্বের নীতিমালা।
আরও অনেকেই আছেন পূর্ববর্তীদের মধ্যে, যাঁরা গভীরভাবে গবেষণা করেছিলেন তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে। তাঁদের সবার কথা এখানে তুলে ধরা সম্ভব নয়।
আধুনিক কাল: দুই ধারাসময়ের স্রোতে এই ধারা এসে পৌঁছেছে একালে। বর্তমানে মুসলিমদের মধ্যে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের চর্চা দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে।
একদিকে রয়েছে দাওয়াতি বা প্রচারমূলক ধারা। এই ধারার ব্যক্তিত্বরা গণমাধ্যমে কাজ করেন, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে বিতর্কে অংশ নেন। শাইখ আহমাদ দিদাত, ড. জাকির নায়েক, মুহাম্মদ হিজাব প্রমুখ এই ধারার সুপরিচিত মুখ।
অন্যদিকে রয়েছে গবেষণাধারা। বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কম্পারেটিভ রিলিজিয়ন’ বিভাগ এই ধারার নেতৃত্ব দিচ্ছে। সেখানে নিভৃতে কাজ করে চলেছেন অসংখ্য গবেষক। ড. আহমাদ শালাবী, ড. মুহাম্মদ শারকাভী, ইসমাইল রাজি আল-ফারুকির মতো পণ্ডিতেরা এই ধারার পথপ্রদর্শক।
বর্তমান সময়ে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে বোঝাপড়া তৈরি করতে এবং নিজের আদর্শিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করতে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের পাঠ অপরিহার্য। মানুষের সবচেয়ে প্রভাবশালী অনুভূতি হলো তার ধার্মিকতা। হজরত আলী (রা.) বলেছেন, ‘মানুষের সঙ্গে তাদের বোঝার মতো করে কথা বলো।’ (বুখারি, হাদিস নং: ১২৭)
মানুষের মন আর মনন বুঝতে হলে, তার বিশ্বাসের গভীরে পৌঁছাতে হয়। আর সেই পথের প্রথম সোপান হলো তার ধর্মকে জানা।
আরও পড়ুনধর্ম ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক: পশ্চিমা অনুকরণ থেকে মুক্তির পথ২২ আগস্ট ২০২৫