বিদেশ ভ্রমণে আমার দুটি প্রিয় গন্তব্য হলো মিউজিয়াম ও আর্ট গ্যালারি। প্রত্নসম্ভার ও চিত্রকলা– দুটোই আমাকে প্রবলভাবে টানে। ফরাসি ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের ভুবনজোড়া নাম ও তাদের কিছু কিছু ভুবনবিখ্যাত চিত্রকলার প্রিন্ট দেখে আমি এতটাই মুগ্ধ যে আর্ট গ্যালারিতে তাদের ছবি দেখতে পেলে নিজেকে সৌভাগ্যের বরপুত্র বলে মনে হয়। মনে হবে না কেন? এসব ছবি দুর্লভ আর তাদের একেকটির দাম শুনলে চক্ষু চড়কগাছ হতে বাধ্য। এসব চিত্রকলা নিয়ে একেকটি জাদুঘর ও আর্ট গ্যালারি নিজেরাই ধনী হয়ে ওঠে।
উনিশ শতকের শেষভাগে প্যারিসে একদল ফরাসি চিত্রশিল্পীর স্বতন্ত্র চিত্র প্রদর্শনীতে ইমপ্রেশনিস্ট চিত্রকলার আন্দোলন বা ধারা গড়ে ওঠে। ইমপ্রেশনিস্ট চিত্রকলার বৈশিষ্ট্য হলো এসব চিত্রকলায় তুলির আঁচড় সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়, উন্মুক্ত ক্যানভাস, সাদামাটা বিষয়, অভিনব প্রেক্ষণবিন্দু, অঙ্কিত দৃশ্যে দিনের বা ঋতুর ভিন্নতার কারণে আলোর ভিন্ন ভিন্ন প্রতিফলন, মানব অবলোকন ও অভিজ্ঞতায় গতিকে ধরার চেষ্টা ইত্যাদি। ১৮৭২ সালে ক্লদ মনের আঁকা সূর্যাস্তের তৈলচিত্র Impression, Sunrise থেকে ইমপ্রেশনিস্ট আন্দোলনের নামকরণ হয়েছিল। ক্লদ মনেকে এ আন্দোলনের প্রধান চিত্রশিল্পী মনে করা হলেও ক্যামিল পিসারোকে মনে করা হয় ইমপ্রেশনিস্ট আন্দোলনের জনক, যার চিত্রকলা ক্লদ মনে, পল সেজানসহ অনেক শিল্পীর ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। যে কোনো নতুন আন্দোলনের মতোই ইমপ্রেশনিস্ট আন্দোলন প্রথমদিকে প্রাচীনপন্থিদের প্রবল প্রতিরোধ, তিক্ত সমালোচনা ও ঈর্ষাপ্রসূত বিদ্রুপের শিকার হয়েছিল। কিন্তু তা বেশিদিন টেকেনি, ইমপ্রেশনিস্ট আন্দোলন গোটা ইউরোপে ঢেউ তোলে এবং চিত্রকলা ছাড়িয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে চলচ্চিত্র, সংগীত ও শিল্পের অন্যান্য শাখায়।
গ্লাসগোর কেলভিনগ্রুভ আর্ট গ্যালারিতে
গ্লাসগোর কেলভিনগ্রুভ আর্ট গ্যালারি ও মিউজিয়ামটি গ্লাসগো ইউনিভার্সিটির সন্নিকটে। আমি যেখানে উঠেছি সেই ইয়ুথ হোস্টেল থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বে দুটোই। তাপমাত্রা বিজ্ঞানের জনক লর্ড কেলভিনের নামখচিত পার্কের পাশে ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্যকলার এক অনুপম নিদর্শন। এর একপাশে জাদুঘর, অন্যপাশে আর্ট গ্যালারি। আর্ট গ্যালারিতে বেশ কিছু বিখ্যাত ফরাসি ইমপ্রেশনিষ্ট চিত্রশিল্পী– যেমন ক্লদ মনে, এদগার দেগা, পিয়েরে-অগ্যুস্ত রেনোয়া, এদুয়ার্দ মানে প্রমুখের ছবি।
ক্লদ মনে একই বিষয়, যেমন সূর্যাস্ত বা পদ্মফুল, এর ওপরে সিরিজ ছবি এঁকেছেন, বিষয় এক হলেও ছবিগুলোর পার্থক্য ছিল অঙ্কিত ছবির ওপরে আলো ও পরিবেশের ভিন্নতা। এদগার দেগার ছবিতে ব্যালে নর্তকীর নাচ ও ঘোড়ার দৌড়ের গতি মূর্ত হয়েছে। এদুয়ার্দ মানে ইমপ্রেশনিস্ট চিত্রীদের কিছুটা অগ্রজ যাকে, ক্যামিল পিসারোর মতো এ আন্দোলনের পূর্বসূরি মনে করা হয়। এদুয়ার্দ মানের ছবির বিষয়বস্তু আধুনিক জীবন ও সামাজিক সম্পর্ক। এখানে রয়েছে কয়েকজন বিশ্বখ্যাত চিত্রশিল্পীর আঁকা চিত্রকর্ম; যাদের বলা হয় পোস্ট ইমপ্রেশনিস্ট পেইন্টার্স। তারা হলেন– পল গঁগ্যা, ভিনসেন্ট ভ্যান গগ ও হেনরি মাতিসে। কেবল ছবি নয়, দেয়ালে চিত্রশিল্পীদের কিছু বিখ্যাত উক্তি উদ্ধৃত। কেলভিনগ্রুভ মিউজিয়ামে আর্ট গ্যালারিতে আমি দেখেছি ক্যামিল পিসারোর বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘দ্য টুইলারিজ গার্ডেনস’, পল গঁগ্যার ‘অস্ত্রে আনলাগ পার্ক’, ভিনসেন্ট ভ্যান গগের ‘পোর্ট্রেট অব দ্য আর্ট ডিলার আলেক্সান্দার রিড’। এ গ্যালারিতে আমি দুজন জগদ্বিখ্যাত চিত্রশিল্পীর ছবি দেখার সুয়োগ পাই। তারা হলেন– সুররিয়ালিস্ট আন্দোলনের জনক জগদ্বিখ্যাত স্প্যানিশ চিত্রকর সালভাদর দালির একটি ও ডাচ চিত্রশিল্পের স্বর্ণযুগের সবচেয়ে প্রতিভাবান শিল্পী রেমব্রাঁ। মনে পড়ে দালির ‘ক্রাইস্ট অব সেন্ট জোন অব দ্য ক্রস’ ছবিটি বিশেষভাবে প্রদর্শিত হচ্ছিল এবং ঐ ছবিটিই ছিল মহামূল্যবান সব ছবির ভিড়ে অর্থমূল্যে সবচেয়ে দামি রেমব্রাঁর ছবি ‘এ ম্যান ইন আরমার’ রিয়ালিস্টিক ছবি হলেও যুদ্ধপোশাক পরিহিত যোদ্ধার শিরস্ত্রাণ ও বুকে আলোর যে প্রতিফলন দেখেছিলাম তা ইমপ্রেশনিস্ট চিত্রীদের মতোই।
এডিনবরা আর্ট গ্যালারিতে
এডিনবরা আর্ট গ্যালারিটি প্রিন্সেস স্ট্রিটের পাশেই একটি প্রাচীন ভবনে। স্কটিশ স্থপতি উইলিয়াম হেনরি প্লেফেয়ারের নিওক্লাসিক্যাল স্থাপত্য নকশায় এই আর্ট গ্যালারিটি ১৮৫৯ সালে উদ্বোধন করা হয়।
এর চূড়ায় স্কটল্যান্ডের পতাকা ও ব্রিটিশ পতাকা উড়ছে। সড়কের পাশে প্রথমে একটি ভবন, তার পেছনেই আর্ট গ্যালারিটি। এর কিছুটা নিচে পার্ক, আরও নিচে, দু’পাশের, এ পাশে প্রিন্সেস স্ট্রিট, ওপাশে রয়্যাল মাইল, পাথুরে পাহাড়ের উচ্চতা যে গিরিখাদ তৈরি করেছে তার ঢালুতে ট্রেন লাইন চলে গেছে। আর্ট গ্যালারিতে ঢুকে আমি বিস্ময়বিহ্বল! দেয়ালজুড়ে উজ্জ্বল রঙের বিশাল সব পেইন্টিং। অনেক প্রাচীন এই পেইন্টিংগুলো, একেকটির বয়স আমাদের প্রপিতামহদের (যদি তারা বেঁচে থাকতেন) বয়সের চেয়েও ঢের বেশি। অতীতে ফিগারেটিভ ছবিই বেশি আঁকা হতো, প্রতিটি ছবিতেই গল্প থাকত, বিশেষ করে যিশু খ্রিষ্টের জীবনের নানা ঘটনা নিয়ে কল্পিত ছবি আঁকা হয়েছে প্রচুর। শিল্পীরা যতটা সম্ভব বাস্তবে যেমন দেখা যায় তেমনটাই আঁকতেন, ফটোগ্রাফির কাছাকাছি নিখুঁত করাই ছিল দক্ষতা। রিয়ালিজমের সেই যুগের অনেক চিত্রে মধ্যযুগের অন্ধকার উঠে আসে। দলিত মানুষের দুর্দশা, কুসংস্কার ও ক্ষমতাবানদের নিষ্ঠুরতার অনেক চিত্র আঁকা রয়েছে। আরেকটি প্রিয় সাবজেক্ট ছিল নারী। নারীর সৌন্দর্য পুরুষ শিল্পীরা এঁকেছেন প্রেমের আবেগে। নগ্ন নারীর অতুলনীয় দেহসৌষ্ঠব তারা এঁকেছেন সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে। ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীরা, যাদের বেশির ভাগই ফরাসি, বিষয়ের বদল ঘটান, তারা তুলে আনেন প্রকৃতিকে, রাজার বদলে আঁকেন সাধারণ মানুষের প্রতিকৃতি, রূপকথাকে বিসর্জন দেন পার্থিব ও মানবিক বিষয়ের পক্ষে।
আমি অকাতরে ছবি তুলছি, কিন্তু কেউ নিষেধ করছে না। আমি হতবাক! জাদুঘরের লোকেরা আশপাশে সতর্ক দৃষ্টি রেখে ঘুরছে, কিন্তু ছবি তোলায় বাধা দিচ্ছেন না। আমি তো পারলে প্রতিটি ছবির প্রিন্ট তুলে রাখি, ক্যামেরার মেমোরি ও ব্যাটারিতে কুলোবে না ভেবে বাছাই করি কোনটা তুলব আর কোনটা তুলব না। তোলার দিকেই পাল্লা হেলে পড়ে, কম ছবিই বাদ যায় আমার চোখ ও ক্যামেরার দৃষ্টি থেকে। দোতলায় গিয়ে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা একটি ছবি দেখে আমি শিহরিত। উল্টো পাশের দেয়ালে আরেক বিখ্যাত ইতালিয়ান শিল্পী রাফায়েলের তিনটি পেইন্টিং দেখেও বাকরুদ্ধ। উত্তেজনা অনুভব করছি, নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবছি, চর্মচক্ষে গ্রেট মাস্টারদের আঁকা ছবি দেখতে পেয়ে।
রয়্যাল স্কটিশ একাডেমি ভবনের পুরোটা জায়গাজুড়ে ফরাসি ইমপ্রেশনিস্ট চিত্রশিল্পীদের প্রবল উপস্থিতি। তারা হলেন– হেনরি মাতিসে, ক্লদ মনে, এদগার দেগা, পল রেনোয়া, ভ্যান গগ, পল গঁগ্যা প্রমুখ। ভুবনবিখ্যাত শিল্পীদের ছবি দেখেছি আর শিহরিত বোধ করছি। কী করে রোমান্টিক পিরিয়ডের আসক্তি ছাড়িয়ে ইমপ্রেশনিজম একটি বিপ্লবী ধারা হয়ে ওঠে এবং হয়ে ওঠে চিত্রকলায় পূর্বের সমস্ত অকশনকে তুচ্ছ করে রেকর্ড ভাঙা দামে বেচাকনার ধারা সৃষ্টি– তার একটি ধারণা পাওয়া যায় এডিনবরা আর্ট গ্যালারিতে। ক্লদ মনের ‘খড়ের গাদা’ সাদামাটা ছবি, তুলনায় পল গঁগ্যার après le Sermon ছবিটি অনেক আকর্ষণীয়।
চিত্রশালায় ছবিই প্রধান, তবু কিছু ভাস্কর্য, তৈজসপত্র ও আসবাব দেখা যায়। সবই ঐতিহাসিক এবং অমূল্য। ভাবি এই গ্যালারিটির সকল দুর্লভ ছবি আর ভাস্কর্যের সামগ্রিক মূল্য কত হতে পারে। কল্পিত অঙ্কটি আমাকে শিহরিত করে। গ্যালারিটি একটি উঁচু ছাদের প্রাচীন ভবনে অবস্থিত হলেও এর ভেতরে আধুনিক লিফট রয়েছে, তাতে চড়ে লোয়ার গ্রাউন্ড ফ্লোরে গিয়ে স্কটিশ চিত্রকরদের আঁকা ছবি দেখি। ভেবেছিলাম আজই এডিনবরা জাদুঘরটি দেখব, কিন্তু চিত্রশালাতেই আমার এতটা সময় কেটে যায়, ছবিতেই আমি এত মুগ্ধ থাকি যে, দুপুর গড়িয়ে কখন বিকেল হয়ে গেছে খেয়াল করিনি। ততক্ষণে জাদুঘরটি বন্ধ হয়ে গেছে।
ম্যানচেস্টার আর্ট গ্যালারিতে
ম্যানচেস্টার আর্ট গ্যালারিতে যাওয়ার পথে ম্যানচেস্টার সিটি কাউন্সিলের প্রাচীন দর্শনীয় ভবনটি পড়ে। এর স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পার্ঘ্য রেখে গেছে অজানা ভক্তদল। সবগুলো স্তবকই গাঢ় লাল রঙের পপি ফুলের। স্মৃতিস্তম্ভটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সৈনিকদের জন্য নির্মিত। একজন পুলিশ সেটি পাহারা দিচ্ছে। আর্ট গ্যালারিটি দুটি দালান নিয়ে একটি কমপ্লেক্স, একটি পাটাতনের মতো সিঁড়ি দিয়ে ভবনদ্বয় যুক্ত। পাটাতন পেরোলে কাচের সিঁড়ি ও লিফট দুটোই আছে শিল্পসন্দর্শী রসিকদের বিভিন্ন ফ্লোরে তুলে নেওয়ার জন্য। প্রাচীন ভবনটিতে পুরাকালের চিত্রকরদের পেইন্টিং, নতুন ভবনটিতে আধুনিক যুগের শিল্পীদের চিত্রকলা। ধ্রুপদি শিল্পীরা ছবি আঁকত বড় ক্যানভাসে। মানুষ, ধর্মীয় চেতনা, প্রকৃতি, মিথ প্রভৃতি ছিল তাদের চিত্রকর্মের বিষয়বস্তু। বাস্তবের যতটা কাছাকাছি আনা যায় চিত্রকে, তাই ছিল তাদের অভিলাষ, এসব চিত্রে প্রচুর ডিটেলস দেখা যায়। মূলত রিয়ালিস্টিক এবং ফিগারেটিভ ছবিই তারা আঁকতেন। এর পরে আসেন impressionist-রা, যারা অবিকল বাস্তব নয়, বাস্তবতা মানব ইন্দ্রিয়ে যে প্রতিক্রিয়া জাগায় তাই আঁকতেন। এ প্রসঙ্গে Dega-র একটি উক্তি স্মরণযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘I do not paint the table.
এই গ্যালারিতে ৫ হাজারের অধিক চিত্রকলার এক বিপুল সংগ্রহ রয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার তৈলচিত্র এবং বাকি ৩ হাজার জলরং ও ড্রয়িং মিলিয়ে। ভাস্কর্যই রয়েছে প্রায় আড়াইশ। এই গ্যালারিটি ভিক্টোরিয়ান চিত্রকলার জন্য বিখ্যাত হলেও এখানে ইমপ্রেশনিস্ট চিত্রকলার সম্ভারও কম নয়। এখানে ফরাসি ইমপ্রেশনিস্ট চিত্রবিদ পিয়েরে এডলফ ভ্যালেটের বেশ কিছু কাজ রয়েছে। ভ্যালেট বিশ শতকের গোড়ার দিকে ম্যানচেস্টারে পড়াতেন ও ছবি আঁকতেন। তৎকালীন ম্যানচেস্টারের কুয়াশাচ্ছন্ন সড়ক ও খালের ছবি এঁকেছেন তিনি। ওই একই কক্ষে পল সিজানের যে ছবিটি রয়েছে, সেটি একটি ফরাসি নদীর ওপরে সেতুর চিত্রকলা। মজার বিষয়টি হলো, দুজনের বিষয় ও আঁকার রীতিতে একটা সাযুজ্য লক্ষ্য করা যায়। এখানেই ব্রিটিশ ইমপ্রেশনিস্ট পেইন্টার উইনফোর্ড ডিউহার্স্টের ‘দ্য পিকনিক’ ছবিটি রয়েছে। উল্লেখ্য, তিনি ম্যানচেস্টারেই জন্মগ্রহণ করেন।
ইমপ্রেশনিজম ছাড়িয়ে এক্সপ্রেশনিজম, কিউবিজম, সুররিয়ালিজম– বিভিন্ন শিল্পধারায় ছবি এঁকেছেন প্রখ্যাত শিল্পীরা। কিউবিজমের উদ্গাতা পাবলো পিকাসোর ছবি তুলনামূলক দুর্লভ, এখন পর্যন্ত আমি একটিও দেখিনি। গ্লাসগোর কেলভিনগ্রুভ মিউজিয়ামে দেখেছিলাম সুররিয়ালিজমের প্রবক্তা এবং সে আন্দোলনের সবচেয়ে প্রভাববিস্তারী শিল্পী সালভাদর দালির একটি ছবি। মাতিসে, মনে, দেগা, ভ্যান গগ, পল গগ্যাঁ প্রমুখ ইমপ্রেশনিস্ট ও এক্সপ্রেশনিস্ট মাস্টারদের কিছু গৌণ চিত্রকর্ম– সবগুলো চিত্রশালাতেই দেখেছি। গৌণ? হাত দিয়ে দেখুন, হাত পুড়ে যাবে আগুনে। কোনোটির দামই হান্ড্রেড থাউজেন্ড পাউন্ডের নিচে নয়। পকেটে মাত্র কয়েকশ পাউন্ড নিয়ে বিনে পয়সায় দেখে নিচ্ছি বিলিয়ন পাউন্ডের একেকটি চিত্রশালা, আমার স্পর্ধা তো কম নয়! আমি আসলে সৌভাগ্যবান। শিল্প আন্দোলনের অনেক ঢেউ পেরিয়ে আজকের চিত্রকলা অ্যাবস্ট্রাক্ট রূপ পরিগ্রহ করেছে, সে দেখায় না প্রায় কিছুই, বোরখায় ঢাকা রূপসীর মতো, সামান্য অবয়ব বের করে রাখে ভেতরের অসামান্য সৌন্দর্যের ইশারা (লোভ বলব? থাক, ইশারাই ভালো) জাগিয়ে। দর্শকের কল্পনার ওপরে সে নিজেকে ছেড়ে দেয়। রিয়ালিজম ও অ্যাবস্ট্রাক্ট– আর্টের দুই পর্বতমালার ভেতরে প্রসারিত উপত্যকায় আরও কত চিত্রকলা কত রূপ ধরেই না এলো! সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে অগ্রসর শতাব্দীটি একদিকে যেমন দেখেছে বিজ্ঞান ও জীবনযাত্রার বৈপ্লবিক পরিবর্তন, তেমনি বিক্ষত হয়েছে দু’দুটো মহাযুদ্ধের সন্ত্রাসে। শিল্পীরা আক্রান্ত হয়েছেন বিষাদে, বিভীষিকা ও মানবসৃষ্ট তাণ্ডব তাদের বিশ্বাসের ভিত্তিমূল টলিয়ে দিয়েছে, আশার বদলে তাদের গ্রাস করেছে হতাশা, আলোর বদলে তারা ভুবনে অন্ধকারের দৈত্যনাচন দেখেছেন বেশি। ছবিতে তারা উগরে দিয়েছেন বিবমিষা, ঘৃণাকে ছড়িয়ে দিয়েছেন ক্যানভাসে, অবিশ্বাসের রঙে এঁকেছেন পরাজিত, পর্যুদস্ত মানুষের বিকৃত, পচাগলা অবয়ব। দ্বিতীয় ভবনের চিত্রকলায় এসবই প্রধান। এসব ছবির ক্যানভাস বিরাট নয়, উজ্জ্বল রংসকল অপসৃত। কেবল রং নয়, এসেছে মিশ্র মিডিয়া, স্কেচ, ফর্ম নিয়ে নিরীক্ষা। রিয়ালিজম ও অ্যাবস্ট্রাক্ট।
আর্ট গ্যালারিতে একজন ভদ্রমহিলাকে দেখলাম, ওখানকারই কেউ হবেন, একদল শিল্পভক্তকে একটি বড় ধ্রুপদি চিত্রকলা নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন, অনেকক্ষণ ধরেই। এক চক্কর ঘুরে এসে দেখি তখনও লেকচার চলছে। বুঝলাম প্রতিটি চিত্রের দীর্ঘ ইতিহাস ও পটভূমি আছে, আছে শিল্পীর মুনশিয়ানা ও ঘরানার দিকটি, আছে তুলনামূলক আলোচনার অবকাশ, দুর্বলতার সমালোচনা, সবলতা ও অসাধারণত্বের উচ্ছ্বাসপূর্ণ প্রশংসা। আমি তো এক লহমায় দেখে নেই, কতটুকু বুঝি?
আর্ট গ্যালারি থেকে বেরিয়ে আমার বন্ধু ডা. মামুন সিরাজ ও আমি ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের দিকে যাই অক্সফোর্ড স্ট্রিট ধরে। পথের বাঁকে অর্ধবৃত্তাকার গণগ্রন্থাগারটির বাইরের অবয়ব দেখি। ভিক্টোরিয়ান যুগের এসব স্থাপত্যের বেশির ভাগ আঠারো ও উনিশ শতকে নির্মিত। ব্রিটেনে তখন বসন্তকাল। সারা পৃথিবীর রাজা সে, দু’হাতে লুণ্ঠন করছে উপনিবেশগুলোর সম্পদ, তা দিয়ে গড়ে তুলছে সুরম্য নগরী, দুর্ভেদ্য দুর্গ আর জমকালো রাজপ্রাসাদ। প্রকৃতি তার গর্ভ থেকে উগরে দিয়েছে গলন্ত লাভা, হাজার বছরে তা শীতল হয়ে রূপ নিয়েছে কঠিন আগ্নেয়শিলায়, সেই পাথর দিয়ে নির্মিত প্রকাণ্ড ও সুদৃশ্য ভবনসমূহের দিকে তাকাতে তাকাতে ভাবি সেসবে আমারও কিঞ্চিৎ অধিকার বুঝি রয়েছে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আর ট গ য ল র ট আর ট গ য ল র ত চ ত রকল র র চ ত রকল চ ত রকর ম পল গ গ য জ দ ঘর প ইন ট আ কত ন সবচ য় র ওপর ন ভবন র একট র বদল
এছাড়াও পড়ুন:
মিরাজে দুর্দান্ত জয় বাংলাদেশের
এমন পারফরম্যান্সই তো চাওয়ার থাকে ভালো দলের কাছে। মেহেদী হাসান মিরাজের অলরাউন্ড নৈপুণ্য, সাদমান ইসলামের সেঞ্চুরি, তাইজুল ইসলামের ৯ উইকেট শিকারে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ইনিংস ও ১০৬ রানের বিশাল জয় এনে দেয় বাংলাদেশকে। প্রথম টেস্ট হারের পর যে সমালোচনা হয়েছিল, তার জবাবটা বোধ হয় দ্বিতীয় টেস্ট তিন দিনে জিতে দিয়ে দিলেন নাজমুল হোসেন শান্তরা। ‘বাউন্স ব্যাক’ করে সিরিজ ড্র ১-১-এ।
চট্টগ্রামের বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান স্টেডিয়ামে বীরোচিত পারফরম্যান্স ছিল টাইগারদের। এটি সম্ভব হয়েছে পছন্দের উইকেটে খেলা হওয়ায়। স্পিন ভুবনে উইকেট উৎসব করেছেন তাইজুল, মিরাজ গাঁটছড়া বেঁধে। সিরিজ নির্ধারণী টেস্টে দুটি সেঞ্চুরি দারুণ অর্জন অধারাবাহিক ব্যাটিং লাইনআপের। এই টেস্টে ওপেনিং জুটি ভালো করেছে। লম্বা সময় পর টেস্ট খেলার সুযোগ পাওয়া এনামুল হক বিজয় ভালোই সঙ্গ দেন সাদমানকে। লোয়ার মিডলঅর্ডারে মিরাজের লড়াই ছিল দেখার মতো।
টেলএন্ডারদের নিয়ে রীতিমতো বাজিমাত করেছেন তিনি। শেষ ৩ উইকেটে তৃতীয় দিন ১৫৩ রান যোগ করেন। বাংলাদেশকে পৌঁছে দেন ৪৪৪ রানে। ২১৭ রানের লিড থাকায় ইনিংস ব্যবধানে জয়ের স্বপ্ন দেখায়। মিরাজের অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে সে স্বপ্ন পূরণ হয়। সাকিব আল হাসান ও সোহাগ গাজীর পর তৃতীয় বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট শিকার তাঁর।
গত বছর দেশের মাটিতে টেস্টে ভালো করতে পারেনি বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার পর দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হোয়াইটওয়াশ হয়েছে। ২০২৫ সালের শুরুটাও ভালো ছিল না। সিলেটে জিম্বাবুয়ের কাছে হেরেছে। সিরিজ বাঁচাতে চট্টগ্রামে জিততেই হতো। লক্ষ্যে পৌঁছাতে কন্ডিশনেও পরিবর্তন আনা হয়। চট্টগ্রামের উইকেটে খেলা হয় দ্বিতীয় টেস্ট। যেখানে শাসন ছিল স্পিনারদের। পছন্দের উইকেট পাওয়ায় তিন স্পিনার নিয়ে খেলে বাংলাদেশ। তিনজনই দারুণ বোলিং করেন প্রথম থেকে।
দীর্ঘ বিরতির পর টেস্ট খেলার সুযোগ পাওয়া অফস্পিনার নাঈম হাসান চ্যালেঞ্জ নিয়ে বোলিং করে গেছেন। বেশি উইকেট না পেলেও এক প্রান্তে ব্যাটারদের চাপে ফেলেছেন। যার সুফল তাইজুল ও মিরাজ পেয়েছেন অন্য প্রান্তে। প্রথম দিন শেষ সেশনে ব্রেক থ্রু দেন তিনি। বাঁহাতি স্পিনার পরে পিক করে ৬ উইকেট শিকার করেন। জিম্বাবুয়ে ৯ উইকেটে ২২৭ রানে প্রথম দিন শেষ করে। পরের দিন এক বল খেলে ওই রানেই অলআউট হয়। বাংলাদেশ ব্যাটিং শুরু করে বড় লক্ষ্য নিয়ে। সাদমান ইসলাম ও এনামুল হক বিজয় ১১৮ রানের ওপেনিং জুটি করায় প্রতিপক্ষকে ছাড়িয়ে যাওয়া সহজ হয়। সাদমানের সেঞ্চুরি ও মুমিনুল হক, মুশফিকুর রহিম কিছু রান করায় ৭ উইকেটে ২৯১ রানে দ্বিতীয় দিন শেষ করে বাংলাদেশ।
সেদিন সংবাদ সম্মেলনে সাদমান আশা প্রকাশ করেন, মিরাজ ও তাইজুল জুটি করবেন। অষ্টম উইকেটে ৬৪ রানের জুটি দু’জনের। বেশি ভালো করেছেন পেসার তানজিম হাসান সাকিব। মিরাজের সঙ্গে ১৫৬ বলে ৯৬ রানের জুটি। অভিষেক টেস্টে সাকিবের ব্যাটিং দারুণ লেগেছে অধিনায়ক শান্তর কাছে। ৮০ বলে ৪১ রান করেন তিনি। সবচেয়ে বড় কথা, মাথায় বল লাগার পরও বিচলিত হননি তিনি। মিরাজ ছাড়া চট্টগ্রাম টেস্টের প্রাপ্তি হিসেবে ওপেনিং জুটির ভালো খেলা, সাদমানের সেঞ্চুরি, তাইজুলের ৫ উইকেট শিকার ও সাকিবের রান করাকে মনে করেন শান্ত।
শেষের তিন উইকেটে তৃতীয় দিন প্রায় দুই সেশন ব্যাট করে বাংলাদেশ। তাইজুল, সাকিব ও হাসানকে নিয়ে ১৫৩ রান যোগ করে। মিরাজ ১০৪ রান করে ওয়েলিংটন মাসাকাদজাকে উইকেট দেন। নার্ভাস নাইটির ঘরে প্রবেশ করে কিছুটা ঝুঁকির মুখে ছিলেন মিরাজ। ৯৮ রানে পৌঁছানোর পর সেঞ্চুরি ছুঁতে দুই রান নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফিল্ডারের কাছে বল চলে যাওয়ায় এক রানে থামতে হয়। তখন স্ট্রাইকে হাসান থাকায় দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল সবাই। ড্রেসিংরুমে খেলোয়াড় ও কোচিং স্টাফের সবাই দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। কখন হাসান আউট হয়ে যায়, সে ভয় কাজ করছিল হয়তো। কিন্তু হাসান ছিলেন দৃঢ়চেতা। মাসাকাদজাকে ডিফেন্স করে স্বস্তি দেন।
মিরাজ স্ট্রাইকে এসে মেদেভেরের প্রথম দুই বলে ঝুঁকি নেননি। তৃতীয় বলে এক রান নিয়ে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্ট সেঞ্চুরির স্বাদ নেন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ ও দ্বিতীয় টেস্টের সেরা খেলোয়াড় মিরাজ। প্রথম ম্যাচের উভয় ইনিংসে ৫ উইকেট করে ছিল তাঁর। চট্টগ্রামে অতীতের সব পারফরম্যান্স ছাড়িয়ে গেছেন। সেঞ্চুরির সঙ্গে ৫ উইকেটপ্রাপ্তি, দুই হাজার রানের মাইলফলক পেয়েছেন। ২০২১ সালে এই চট্টগ্রামেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি। ২১৭ রানে পিছিয়ে থাকা জিম্বাবুয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে অলআউট হয় ১১১ রানে। ফ্লাডলাইটের আলো জ্বেলে নির্ধারিত সময়ের বেশি খেলান আম্পায়াররা। প্রায় সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খেলা হয়। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটাররা তাতে আপত্তি করেননি। তাইজুল ৩, নাঈম ১ ও মিরাজ ৫ উইকেট নিলে ম্যাচ শেষ হয়।
সিলেটে প্রথম টেস্ট হারের পর চট্টগ্রামে প্রভাব বিস্তার করে খেলে ম্যাচ জেতার পরও খুশি নন অধিনায়ক শান্ত, ‘আমি টেস্ট সিরিজ ড্র করে খুশি না। কারণ, প্রথম টেস্টে আমরা একেবারেই ভালো খেলিনি। এই টেস্টে একপেশে খেলে জিতলেও সিরিজে আরও ভালো খেলা উচিত ছিল। সিরিজটি জিততে হতো।’ টাইগার দলপতি জানান, এই পারফরম্যান্স শ্রীলঙ্কা সফরে কাজে দেবে। দেশের মাটিতে স্পোর্টিং উইকেট বানিয়ে বিদেশে খেলার পরিবেশ তৈরি করছিল বিসিবি। ২০২৩ সালে নিউজিল্যান্ড সিরিজ থেকে স্পোর্টিং উইকেটে খেলা হচ্ছে। কিউইদের বিপক্ষে সিলেটে ঐতিহাসিক জয় পেলেও মিরপুর থেকে হারতে শুরু করে। দেশের মাটিতে টানা ছয় হারের পর জয়ের দেখা পেল বাংলাদেশ।