বারবার অভিযান, থামছে না বালু-পাথর চোরাচালান
Published: 18th, April 2025 GMT
সিলেটে একের পর এক হামলা হচ্ছে অভিযানকারী দলের ওপর। বালু, পাথর বা চোরাচালানের পণ্য আটক করতে গিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটসহ হামলার শিকার হচ্ছেন বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ সদস্যরা। সম্প্রতি জৈন্তাপুরে চোরাই মহিষ আটককে কেন্দ্র করে সেনাবাহিনীর ওপরও হামলা করা হয়। গত ৮ মাসে কম হলেও ১০টি হামলার ঘটনা ঘটে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজিবি ও পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, লোকজন আগের মতো ভয় পায় না। কিছু হলেই প্রতিক্রিয়া দেখায়। এ অবস্থার জন্য তারা অভিযানে উৎসাহ হারিয়েছেন।
গত ৮ মাসে বালু-পাথর উত্তোলন রোধে প্রশাসন ও পুলিশ পৃথক ৫০-৬০টি অভিযান চালিয়েছে। এসব ঘটনায় ১৯টির মতো মামলা করা হয়েছে। বিজিবি প্রায় প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার ভারতীয় পণ্য উদ্ধার করছে। লুটপাট হয়েছে হাজার কোটি টাকার বালু ও পাথর। সীমান্তবর্তী কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলার বিভিন্ন পাথর কোয়ারি ও বালুমহাল থেকে এসব প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করা হচ্ছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটছে। এমনকি সীমান্তে চোরাচালানের পণ্য উদ্ধার করতে গিয়েও হামলার শিকার হচ্ছে বিজিবি। সবচেয়ে বেশি হামলার ঘটনা ঘটে কোম্পানীগঞ্জে। এ উপজেলার ধলাই নদীর বালুমহাল, ভোলাগঞ্জ ও শারফিন টিলা পাথর কোয়ারি ও ভোলাগঞ্জ বাঙ্কার এলাকাকে কেন্দ্র করে বালু ও পাথর লুটেরা শ্রেণি তৎপর হয়ে উঠেছে। শারফিন ও বাঙ্কার এলাকা বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত বুধবার ধলাই নদীর তীরে কোম্পানীগঞ্জের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ আবুল হাসনাতের নেতৃত্বে বালুমহালে অভিযান চালানো হয়। এ সময় অভিযানকারীদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে শ্রমিকরা। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে। আটক করা হয়েছে দু’জনকে। এ ছাড়া পৃথক ঘটনায় আরও ৯টি মামলা করা হয়েছে।
এ বিষয়ে সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবুল হাসনাত জানিয়েছেন, অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলনের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে তারা বারবার অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছেন। একাধিক দিন অভিযানিক দলের ওপর হামলা করা হয়েছে। তার পরও প্রশাসন অভিযান অব্যাহত রেখেছে।
গত মঙ্গলবার ভোলাগঞ্জ বাঙ্কার এলাকায় বিজিবির সদস্যদের মারধর করে পাথর শ্রমিকরা। এর একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। গত রোববার বিকেলে বিমানবন্দর এলাকার ধোপাগুলে সড়কের পাশের পাথর ভাঙার মেশিন উচ্ছেদের সময় শ্রমিকদের হামলায় আহত হয়েছেন পুলিশ, আনসার ও র্যাবের তিন সদস্য। জেলা প্রশাসনের একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে এ অভিযান চালানো হয়েছিল।
এয়ারপোর্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈয়দ আনিসুর রহমান জানান, শিগগিরই জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গত ২৭ মার্চ রাতে জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুর বাজারে সেনাসদস্যদের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় থানায় ৭০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।
১৫ মার্চ রাতে টিপরাখলা সীমান্তে বিজিবি সদস্যদের ওপর হামলা করে গরু ছিনিয়ে নেয় চোরাকারবারিরা। ওই সময় আহত হন বিজিবি সদস্য হারুনুর রশিদ ও জমশেদ হোসেন।
৬ মার্চ গোয়াইনঘাটের বাইপাস সড়কে ছিনতাইর খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গেলে পুলিশের ওপর হামলা করে দুর্বৃত্তরা। এ ছাড়া গত
কয়েক মাসে শারফিন সড়ক, জাফলংসহ কয়েকটি স্থানে অভিযানকালে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। তিন উপজেলা ছাড়াও ২৮ ফেব্রুয়ারি
নগরীর জিন্দাবাজার এলাকায় পুলিশের ওপর হামলা করে হকাররা।
৭ জানুয়ারি গোয়াইনঘাটের বিছনাকান্দির দমদমিয়া ভিতরগুল এলাকায় ৪০-৫০ জন চোরাকারবারি বিজিবি সদস্যদের ওপর অতর্কিত হামলা করে। হামলায় আহত হন বিজিবি সদস্য মাসুম বিল্লাহ।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, যারা সরকারি কাজে বাধা ও অভিযানে হামলা করছে তাদের পেছনে কেউ না কেউ মদদ দিচ্ছে। এখন আমরা একটা ভিন্ন পরিস্থিতির মধ্যে বাস করছি। সরকারকে শক্ত হাতে তাদের দমন না করলে এসব চলতেই থাকবে।
জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদ বলেন, দুষ্কৃতকারীরা এসব করছে। প্রশাসন তাদের কাজ অব্যাহত রেখেছে। অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে একটা পরিবর্তন আসবে। তখন পুলিশ, বিজিবি কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর কেউ হামলার সাহস পাবে না।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র এল ক সদস য উপজ ল ঘটন য়
এছাড়াও পড়ুন:
অনশনের পর ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পেলেন ছয় সমন্বয়ক
নিরাপত্তার অজুহাতে গোয়েন্দা (ডিবি) কার্যালয়ে আটকে রাখা হয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মুখসারির ছয়জন সমন্বয়ককে। আটক থাকার এক পর্যায়ে তাঁরা অনশন শুরু করেন। ৩২ ঘণ্টা অনশনের পর ১ আগস্ট (২০২৪ সাল) দুপুরে ছয় সমন্বয়ককে ডিবি কার্যালয় থেকে কালো রঙের দুটি গাড়িতে করে যাঁর যাঁর ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া হয়।
সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ও আবু বাকের মজুমদারকে ছয় দিন; সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহকে পাঁচ দিন এবং নুসরাত তাবাসসুমকে চার দিন ডিবি কার্যালয়ে তখন আটক রাখা হয়েছিল। এই ছয় সমন্বয়কের মধ্যে নাহিদ এখন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক। আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা। সারজিস, হাসনাত ও নুসরাত এনসিপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা। আবু বাকের এখন গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের আহ্বায়ক।
ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পাওয়ার সেই ঘটনা সম্পর্কে সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আমার বোনের বাসার লোকেশন (ঠিকানা) দিয়েছিলাম ডিবিকে। ১ আগস্ট (২০২৪ সাল) ডিবি তাদের তত্ত্বাবধানেই আমাদের ছয়জনকে যার যার গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। বোনের বাসায় পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পর আমি প্রথমে আসিফ ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে মানিকনগরের একটা জায়গায় দেখা করি। আমরা পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করি। কীভাবে এক দফার (সরকার পতনের) ঘোষণায় যাওয়া যায়, সে বিষয়েও সেদিন আমরা চিন্তা করি।’
সেদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণ ও হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি পালিত হয়। এ কর্মসূচির আওতায় গণসংগীত, পথনাটক, দেয়াললিখন, স্মৃতিচারণা ও বিক্ষোভ সমাবেশ হয় রাজধানী ঢাকাসহ অন্তত ১৬টি জেলা ও মহানগরে। এসব কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি কিছু জায়গায় শিক্ষক ও আইনজীবীরা অংশ নেন। তবে কোথাও কোথাও কর্মসূচিতে বাধা দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কোথাও কোথাও পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। অনেক জায়গায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আটক করা হয়।
প্রতিবাদ, বিক্ষোভসেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের উদ্যোগে পৃথক সমাবেশ-মানববন্ধন ও মিছিল করা হয়। পাশাপাশি সেদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক ও মহাসড়ক অবরোধ করে ছাত্র-জনতা।
‘কোটা সংস্কার আন্দোলনে সরকারের কঠোর দমনপ্রক্রিয়া ও গুলিতে ছাত্র-জনতা হত্যা’র প্রতিবাদে ১ আগস্ট বেলা ১১টায় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে জাতীয় সংসদের সামনে সমাবেশের কর্মসূচি ছিল শিল্পী ও কলাকুশলীদের। ‘দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজ’-এর ব্যানারে তাঁরা প্রথমে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ–সংলগ্ন ইন্দিরা রোডের প্রান্তে সমবেত হন। সেদিন সকাল থেকেই প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টি উপেক্ষা করে শিল্পীরা ব্যানার-পোস্টার নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে পুলিশের বাধার মুখে পড়েন।
পরে শিল্পীরা ইন্দিরা রোড দিয়ে শোভাযাত্রা করে ফার্মগেটে আনন্দ সিনেমা হলের কাছে সমবেত হন। প্রবল বৃষ্টির মধ্যেই তাঁরা সেখানে সড়কের পাশে ব্যানার-পোস্টার নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। শিল্পী, নির্মাতা ও কলাকুশলীরা ছাত্র-জনতার হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে বক্তব্য দেন। তাঁরা বলেন, যে বর্বর পন্থায় শিক্ষার্থীদের ন্যায়সংগত আন্দোলনকে দমন করা হচ্ছে, তা কোনো গণতান্ত্রিক সভ্য সমাজে ঘটতে পারে না।
দৃশ্যমাধ্যমের শিল্পীদের সমাবেশ থেকে সেদিন শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো হয়। একই সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের বিচার, গণগ্রেপ্তার, মামলা ও হয়রানি বন্ধের দাবি করা হয়। সমাবেশ থেকে আরও জানানো হয়, শিল্পীরা তাঁদের প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত রাখবেন।
সেদিন বিকেলে ঢাকায় ডিবি কার্যালয়ের সামনে ‘বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ’–এর ব্যানারে মানববন্ধন করেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। মানববন্ধনে অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছিলেন, গুলি করে শিশুসহ নির্বিচার মানুষ হত্যার তদন্ত জাতিসংঘের অধীনে করতে হবে।
সেই মানববন্ধনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুল (এখন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা) বলেন, হত্যার বিচার করতে হবে। হুকুমদাতাদেরও বিচার করতে হবে।
কূটনীতিকদের ‘ব্রিফ’জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করে ১ আগস্ট বিকেলে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। সেদিন বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের ব্রিফ করা হয়। সেই ব্রিফিংয়ে বিদেশি কূটনীতিকেরা সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের দাবি জানান।