ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ফল গড়াবে বহুদূরে
Published: 2nd, May 2025 GMT
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার উত্তেজনা সরাসরি সামরিক সংঘাতে রূপ দেওয়ার পারস্পরিক হুমকির কারণে বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব আমাদের ভাবনার চেয়ে গভীর ও দ্রুত হতে পারে।
কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর ভয়াবহ হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মোহাম্মদ আসিফ সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে পাকিস্তানে ভারতের সামরিক অনুপ্রবেশ ‘আসন্ন’।
সীমান্তে এরই মধ্যে সামরিক শক্তি বাড়িয়েছে ভারত। একই সময়ে নয়াদিল্লি এই হামলার দায় স্বীকারকারী সশস্ত্র গোষ্ঠীর জন্য ইসলামাবাদের যোগসূত্র আছে বলে দাবি করার পর বিকল্পগুলো খুঁজছে। যদিও এই হামলায় নিজেদের যোগসূত্র অস্বীকার করেছে ইসলামাবাদ।
যেহেতু কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেহেতু পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশের মধ্যে অস্থিতিশীল সংঘাতের ঝুঁকি প্রতি ঘণ্টায়ই বাড়ছে। বাজার অনিশ্চয়তাকে ঘৃণা করে। আর সর্বশেষ এই উত্তেজনার ঢেউ দেখা দিয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল একটি অর্থনৈতিক অঞ্চলে।
আরও পড়ুনভারত-পাকিস্তান কি যুদ্ধের একেবারে কিনারায়৩০ এপ্রিল ২০২৫ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর সব সময়ই উত্তেজনার কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল। কিন্তু, বর্তমান অচলাবস্থাটা তৈরি হলো আরও অনেক বেশি অনিশ্চিত এক সময়ে। বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি এখন ভঙ্গুর। প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর তাগিদ ক্রমেই হ্রাস পাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। বড় অর্থনীতিগুলো সুরক্ষাবাদের দিকে ক্রমেই পিছু হটছে।
এরই মধ্যে বিনিয়োগকারীরা নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছেন। মুদ্রা ব্যবসায়ীরা এরই মধ্যে ভারতীয় রুপি ও পাকিস্তানি রুপির বাজারে বড় ধরনের অস্থিরতার কথা বিবেচনায় নিয়ে নিজেদের ব্যবসা সুরক্ষিত করার পথ খুঁজছেন। বন্ড বাজারগুলোতেও ভূরাজনৈতিক নতুন ঝুঁকি বিবেচনায় মূল্য নির্ধারণের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক পুঁজিবাজার এরই মধ্যে টালমাটাল। নতুন যুদ্ধ শুরু হলে এই সব বাজারে আরেক দফা বড় ধাক্কা লাগবে। বিশেষ করে জ্বালানি সরবরাহ ও প্রধান আঞ্চলিক বাণিজ্যপথের ওপর হুমকি তৈরি হলে বড় ধাক্কা লাগবে।
আরও পড়ুনভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধলে ক্ষতি হবে কার২৯ এপ্রিল ২০২৫বিনিয়োগকারীদের কাছে ভারত খুবই আকর্ষণীয় স্থান। ভারত এখন বিশ্বের পঞ্চম বড় অর্থনীতি। উদীয়মান বাজারটি বিশ্বের অন্যতম পাওয়ার হাউস, যেখানে বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলারের প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হচ্ছে। বড় কোনো সংঘাত হলে ভারতের অবকাঠামোগত বিনিয়োগ পরিকল্পনা লাইনচ্যুত হতে পারে, সরবরাহশৃঙ্খলায় ব্যাঘাতের সৃষ্টি হতে পারে এবং ব্যবসার পরিবেশের ওপর আস্থাহীনতা তৈরি হতে পারে।
ফলে ভারতের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর (প্রযুক্তি জায়ান্ট থেকে শুরু করে জ্বালানি খাতের প্রধান) ব্যবসার ওপরও ধারাবাহিক প্রভাব পড়তে পারে।
অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতি, রুপির দুর্বল মান ও ক্রমবর্ধমান ঋণের চাপে পাকিস্তানের অর্থনীতি এমনিতেই বড় চাপের মধ্যে আছে। বড় কোনো সংঘাত হলে সেটা গভীরতর অস্থিতিশীলতার মধ্যে পড়বে। সংঘাত টেনে নিয়ে যেতে হলে পাকিস্তানকে অবশ্যই বাইরের আর্থিক সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হবে। সেই অর্থ তাদের সম্ভব হলে আইএমএফ, না হয় চীনের মতো মিত্রদের কাছ থেকে নিতে হবে।
ফলে, আঞ্চলিক জোটের হিসাব-নিকাশ বদলে যাবে। দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষমতার ভারসাম্যে বড় পরিবর্তন আসবে।
আরও পড়ুনভারতের সেনাবাহিনী যুদ্ধের জন্য কতটা সক্ষম২৮ এপ্রিল ২০২৫ভারত ও পাকিস্তানের কেউই প্রথম সারির তেল উৎপাদনকারী দেশ নয়। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় যুদ্ধের দামামা বাজলে সেটা জ্বালানির সরবরাহ পথগুলো এবং জাহাজ চলাচলের রুটগুলোয় বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। তাতে যেমন ইনস্যুরেন্স খরচ বাড়বে এবং এরই মধ্যে নাজুক অবস্থায় থাকা সরবরাহ ব্যবস্থায়ও খরচ বাড়বে। অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়ার বিষয়টি বাস্তব।ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হলে যা ভাবা হচ্ছে, তার চেয়ে অনেক বেশি বৈশ্বিক প্রভাব পড়তে পারে। আগেরবার ওয়াশিংটন ও বেইজিং হস্তক্ষেপ করে উত্তেজনা প্রশমিত করেছিল। কিন্তু এখন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা আরও অনেক বেশি নাজুক।
যুক্তরাষ্ট্রের ঘরের ভেতর সংঘাত গ্রাস করছে। চীন আন্তর্জাতিকভাবে কঠোর অবস্থান নিচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা এত দিন যে কূটনৈতিক সুরক্ষা পেতেন, সেটা ক্রমেই পথহারা হচ্ছে।
জ্বালানির বাজার বিশেষ করে উন্মুক্ত হয়ে পড়ছে। ভারত ও পাকিস্তানের কেউই প্রথম সারির তেল উৎপাদনকারী দেশ নয়। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় যুদ্ধের দামামা বাজলে সেটা জ্বালানির সরবরাহ পথগুলো এবং জাহাজ চলাচলের রুটগুলোয় বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। তাতে যেমন ইনস্যুরেন্স খরচ বাড়বে এবং এরই মধ্যে নাজুক অবস্থায় থাকা সরবরাহ ব্যবস্থায়ও খরচ বাড়বে। অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়ার বিষয়টি বাস্তব।
আরও পড়ুনভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ লাগলে যুক্তরাষ্ট্র কী করবে২৭ এপ্রিল ২০২৫বিনিয়োগকারীরা অবশ্যই এই সংঘাতের অপ্রত্যক্ষ প্রভাবও বিবেচনা করবেন। ভারতের দিক থেকে সিন্ধুর পানি চুক্তি স্থগিত এবং ভারতীয় বিমানের জন্য পাকিস্তানের আকাশসীমা বন্ধ করার ঘটনা শুধু প্রতীকী কর্মকাণ্ড নয়। এসব পদক্ষেপে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও ব্যাহত হতে পারে।
কৃষি উৎপাদন অঞ্চলে পানির ঘাটতি হলে পাকিস্তানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে। আর বিমান চলাচলের ওপর বিধিনিষেধে পর্যটন ও মালামাল পরিবহনে ভারতের খরচ বাড়বে।
আঞ্চলিক এই উত্তেজনা প্রযুক্তি খাতের ওপরও প্রভাব ফেলবে। ভারতের প্রযুক্তিশিল্প উদীয়মান। প্রযুক্তি খাতে বৈশ্বিক যৌথ মূলধনী উদ্যোগ, আউটসোর্সিং চুক্তির বিশাল ক্ষেত্র ভারত। ফলে প্রযুক্তি খাতের ব্যবসা ভারতে স্থিতিশীলতা চায়।
নিরাপত্তা পরিস্থিতির যদি বড় অবনতি হয়, তাহলে প্রযুক্তি খাতের কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ করতে বিলম্ব করতে পারে অথবা অন্য কোথাও বিনিয়োগ সরিয়ে নিতে পারে।
এই উচ্চতর ঝুঁকির মধ্যেও যাঁরা সঠিকভাবে অবস্থান ঠিক করতে পারবেন, তাঁদের জন্য সুযোগ থাকবে। প্রতিরক্ষা খাতের প্রতিষ্ঠান ও সাইবার নিরাপত্তার প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য চাহিদা বাড়তে দেখা যাচ্ছে।
নাইজেল গ্রিন বিশ্লেষক ও লেখক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরবর হ র জন য ব যবস অবস থ র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
বাগ্দানে হীরার আংটির প্রচলন কীভাবে হলো, এটি কেন এত দামি
ছেলেরা বাগ্দানের জন্য একটি হীরার আংটি কিনতে দশকের পর দশক ধরে বেশ অর্থ ব্যয় করেন। সামাজিক এ মানদণ্ড বা হীরার এই বিশেষ মর্যাদা, এটা কিন্তু হঠাৎ করেই হয়নি।
বরং এ গল্পের শুরু সেই ১৮৭০ সালে। ওই বছর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে নিজের ভাগ্য পরীক্ষার জন্য সিসিল রোডস রওনা দেন কেপ কলোনিতে। ব্রিটিশ উপনিবেশ থাকার সময় বর্তমান দক্ষিণ আফ্রিকার নাম ছিল কেপ কলোনি।
কেপ কলোনিতে তখন খনি থেকে হীরা উত্তোলন ব্যবসা সবে ফুলেফেঁপে উঠতে শুরু করেছে। রোডস সেখানে গিয়ে হীরার খনির মালিকদের কাছে পানি সেচার পাম্প ভাড়া দেওয়া শুরু করেন। হীরা অনুসন্ধানের সময় খনি যাতে প্লাবিত না হয়, সে জন্য খনির ভেতর থেকে পাম্প দিয়ে পানি সেচা হয়।
পরবর্তী ২০ বছরে রোডস ও তাঁর সহযোগী চার্লস রাড শত শত, পরে হাজার হাজার ছোট ছোট খনি ও ‘ক্লেইম’ কেনা বা অধিগ্রহণ করতে শুরু করেন। ‘ক্লেইম’ বলতে ওই জমিকে বোঝানো হয়, যেখানে হীরা পাওয়া যেতে পারে বলে ধারণা করা হয়। খনির মালিকেরা যখন দেউলিয়া হওয়ার মুখে পড়তেন, তখন অনেকটা নামমাত্র মূল্যে খনি বিক্রি করে দিতেন।
সেখানে অধিকাংশ খনি ছোট ছোট মালিকানায় ছিল। তাঁদের হাতে তেমন অর্থ থাকত না। অন্যদিকে রোডস ও রাডের হাতে বড় অঙ্কের পুঁজির জোগান ছিল। বিশেষ করে লন্ডনে তাঁদের যোগাযোগ থাকার সুবাদে রথসচাইল্ড ব্যাংকিং সাম্রাজ্যের সহায়তা তাঁরা পেতেন।
রোডস ও রাড তাঁদের কেনা জমিগুলো একত্র করে বড় খনিতে রূপান্তর করতে থাকেন। এতে খরচ কমে যায় এবং হীরা উত্তোলন কার্যক্রম আরও লাভজনক হয়ে ওঠে।
রোডস ও রাড তাঁদের কেনা জমিগুলো একত্র করে বড় খনিতে রূপান্তর করতে থাকেন। এতে খরচ কমে যায় এবং হীরা উত্তোলন কার্যক্রম আরও লাভজনক হয়ে ওঠে।দুজন ‘ডি বিয়ার্স কনসোলিডেটেড মাইনস’ নামে একটি কোম্পানি গঠন করেন। ডি বিয়ার্স নামটি এসেছিল তাঁদের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া একটি খনির নাম থেকে।
১৮৮৮ সালের মধ্যে কোম্পানিটি দক্ষিণ আফ্রিকার হীরার খনি ও ক্লেইমগুলোতে প্রায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ নেয়।
১৯০০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার মোট রপ্তানি আয়ের ২৫ শতাংশের বেশি আসত হীরা রপ্তানি থেকে। সে সময় ডি বিয়ার্স দেশটির অর্থনীতির অন্যতম মূল চালিকা শক্তিতে পরিণত হয়। কোম্পানিটি তখন বিশ্বে হীরার মোট সরবরাহের প্রায় ৯০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ করত।
রোডস নিজেই সে সময় একজন উল্লেখযোগ্য সাম্রাজ্যবাদী নেতায় পরিণত হন। ১৮৯০ সাল থেকে ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি কেপ কলোনির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ডি বিয়ার্স প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী নীতির ওপর ভর করে। দেশটিতে সে সময়ে শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘুদের শাসন জারি ছিল।
নামমাত্র মজুরিতে হীরার খনিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন কৃষ্ণাঙ্গরা। আর ডি বিয়ার্সের শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয় বিনিয়োগকারীরা মুনাফা ভোগ করতেন।
১৯০২ সালে রোডসের মৃত্যুর পর ডি বিয়ার্সের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় জার্মান বংশোদ্ভূত উদ্যোক্তা আর্নেস্ট ওপেনহেইমারের হাতে।
ওপেনহেইমার আর্থিক প্রণোদনা, কৌশলগত চাপ ও কূটনীতির সমন্বয় ব্যবহার করে অন্যান্য দেশের হীরা সরবরাহকারীদের শুধু লন্ডনভিত্তিক ডি বিয়ার্সের মালিকানাধীন সেন্ট্রাল সেলিং অর্গানাইজেশনের (সিএসও) মাধ্যমে হীরা বিক্রয় করতে রাজি করান।
ডি বিয়ার্সের প্রচারণার জোরে যুক্তরাষ্ট্রে বিয়ের কনেদের হীরার আংটি পরার প্রবণতা ১৯৪০ সালে ১০ শতাংশ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশে পৌঁছে যায়। জাপানে এই সংখ্যা ১৯৬০ সালে ৫ শতাংশের কম ছিল, ১৯৮১ সালে তা বেড়ে ৬০ শতাংশে পৌঁছে।১৯৩০–এর দশকে সিএসও কাটা হয়নি, এমন হীরা বিক্রির একক চ্যানেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
ফলে ডি বিয়ার্স হীরার বিশাল মজুত গড়ে তুলতে সক্ষম হয় এবং বিশ্ব বাজারে হীরা সরবরাহের ওপর প্রায় একক ও কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে প্রতিষ্ঠানটি। এই নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তারা বিশ্বব্যাপী হীরার কৃত্রিম সংকট তৈরি করে।
হীরার ঘাটতি নিয়ে বিভ্রম তৈরির পাশাপাশি ডি বিয়ার্স এই রত্নের প্রতি বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধির চেষ্টা করে যেতে থাকে। ১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠানটি ফিলাডেলফিয়াভিত্তিক বিজ্ঞাপন সংস্থা এনডব্লিউ আয়ারকে এ কাজে নিয়োগ দেয়।
এক বছর পর হীরা নিয়ে প্রায় কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া স্লোগানটি চালু হয়। সেটি হলো, ‘আ ডায়মন্ড ইজ ফরএভার’ (হীরা চিরস্থায়ী)।
ব্যাপক বিজ্ঞাপন, চলচ্চিত্রে প্রদর্শন ও তারকাদের ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানটি হীরাকে বিশেষ করে হিরার বাগ্দানের আংটিকে ‘চিরস্থায়ী ভালোবাসার’ প্রতীক হিসেবে নতুনভাবে উপস্থাপন করে। যেমন তারা বড় অনুষ্ঠানে পরে যাওয়ার জন্য তারকাদের হীরার গয়না ধার দিত। এই প্রচার যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও জাপানের হীরার বাজারকে পুরোপুরি পাল্টে দেয়।
১৯৯০–এর দশকের শেষ দিকে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে আরও বড় অভিযোগ ওঠে। ওইসব অভিযোগে বলা হয়, হীরা বাণিজ্যের মাধ্যমে অ্যাঙ্গোলা, সিয়েরা লিওন ও কঙ্গোয় রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের অর্থায়ন হচ্ছে, যা হীরার ওপর ভোক্তাদের মনোভাব আরও খারাপ করে তোলে।২০১১ সাল পর্যন্ত প্রায় ৬৪ বছর ধরে চলা এই বিজ্ঞাপন বিশ্বব্যাপী অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। ‘অ্যাড এজ’ সাময়িকী ‘আ ডায়মন্ড ইজ ফরএভার’–কে ২০ শতকের সেরা বিজ্ঞাপনী স্লোগান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
ডি বিয়ার্স এমন একটি সামাজিক মানদণ্ড তৈরি করেছিল, যেখানে বিয়ে বা বাগ্দানে হীরার আংটি প্রতিটি আধুনিক সমাজব্যবস্থায় প্রায় অপরিহার্য অংশ হয়ে ওঠে।
অথচ ডি বিয়ার্সের এই প্রচারের আগে, একজন প্রেমিক তাঁর ভবিষ্যৎ কনের জন্য লকেট, মুক্তার মালা বা পারিবারিক ঐতিহ্যবাহী গয়না দিতেন।
ডি বিয়ার্সের প্রচারের জোরে যুক্তরাষ্ট্রে বিয়ের কনেদের হীরার আংটি পরার প্রবণতা ১৯৪০ সালে ১০ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৮০ সালের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশে পৌঁছে যায়। জাপানে এই সংখ্যা ১৯৬০ সালে ৫ শতাংশের কম ছিল, ১৯৮১ সালে তা বেড়ে ৬০ শতাংশে পৌঁছে।
১৯৫০–এর দশকের শুরুতে একটি হীরার আংটির দাম সাধারণত ১৭০ ডলারের মতো ছিল। ডলারের বর্তমান মূল্য হিসাবে যা প্রায় ২ হাজার ৩০০ ডলারের মতো।
গবেষণাগারে উৎপাদিত হীরা ও হীরার মতো দেখতে অন্যান্য অনেক সস্তা পাথরে এখন বাজার সয়লাব। সেসব পাথর দেখতে এতটাই হীরার মতো যে জহুরির চোখ দিয়ে বিশেষ যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে কেবল সেগুলোর পার্থক্য ধরা সম্ভব।শুরুতে ডি বিয়ার্সের বিজ্ঞাপনগুলোতে বাগ্দানের আংটির জন্য এক মাসের বেতন খরচ করার পরামর্শ দিত। কিন্তু ১৯৮০–এর দশকে তারা নতুন স্লোগান তোলে। বিজ্ঞাপনে ভোক্তাদের দিকেই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলা হতে থাকে, কীভাবে আপনি দুই মাসের বেতন চিরকাল স্থায়ী করতে পারেন।
অথচ হীরা আবার বিক্রি করতে গেলে তার দাম অর্ধেক হয়ে যায়। সেখানে সোনার বেলায় পুরো উল্টো ঘটনা ঘটে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় ডি বিয়ার্সের একটি হীরার খনি। ৩ মে, ২০১৭