স্ত্রীসহ সাবেক এমপি আতিউর রহমানের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
Published: 24th, May 2025 GMT
জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ ও শেরপুর-১ আসনের সাবেক এমপি আতিউর রহমান আতিক ও তাঁর স্ত্রী শান্তনা বেগমের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। শনিবার ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ জাকির হোসেন গালিবের আদালত দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ দেন। জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের অনুসন্ধান চলমান থাকায় এ আদেশ দেওয়া হয়।
দুদকের পক্ষে উপপরিচালক মোজাম্মিল হোসেন নিষেধাজ্ঞার আবেদন করেন। দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা আকতারুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
নিষেধাজ্ঞার আবেদনে বলা হয়েছে, সাবেক সংসদ সদস্য আতিউর রহমান আতিকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাত এবং নিজ ও পরিবারের সদস্যদের নামে জ্ঞাত আয় বর্হিভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগটির অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দেশ ছেড়ে বিদেশে পালাতে পারে বলে জানা গেছে। অভিযোগের সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে তাদের বিদেশ গমন বন্ধ করা প্রয়োজন।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: দ শত য গ ন ষ ধ জ ঞ
এছাড়াও পড়ুন:
খণ্ডিত নয়, পূর্ণাঙ্গ নজরুলকে চাই
শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির জনসম্পৃক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ব্যক্তি বা সমষ্টির ব্যাখ্যা, প্রতিক্রিয়া, উপলব্ধি, উপভোগ ও একাত্ম হওয়ার সক্ষমতার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। তাদের সামগ্রিক মূল্যবোধ ও বিশ্বাস তার একটি অবয়ব নির্মাণ করে, তবে তা কখনোই সর্বজনীন হয় না। একটি বৈচিত্র্যধর্মী সমাজে তা সম্ভবও নয়। একজন শিল্প বা সাহিত্য স্রষ্টা নিজস্ব অভিজ্ঞতা, সাংস্কৃতিক উওরাধিকার, ঐতিহাসিক ও সামাজিক পরম্পরার ওপর নির্ভর করেই সবকিছু সৃষ্টি করেন। কিন্তু জনগণ স্রষ্টার মতো করে সবকিছু গ্রহণ করে না। তাদের মাঝে গ্রহণ- বর্জনের এক মনস্তাত্বিক সংকট চলতে থাকে। এর মাঝ দিয়েই তৈরি হয় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীচেতনা। মানা, না মানা ও মানানোর মত একটি জবরদস্তিমূলক অবস্থান তৈরি হয়। ফলে একজন শিল্প ও সাহিত্যস্রষ্টা খণ্ডিত হয়ে পড়েন। তার মূল্যায়নও হয় খণ্ডিত। এই সীমিত-চর্চার মাঝে মতলবাজি ও সুবিধাবাদী বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কবি কাজী নজরুল ইসলামের শিল্প ও সাহিত্য সৃষ্টির বহুমাত্রিকতার বিপরীতে চর্চার সীমিত ও খণ্ডিত রূপটি অত্যন্ত মর্ম পীড়াদায়ক।
শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে বছরের পর বছর চেনা পরিচিত কিছু রচনা পাঠ্যসূচিভুক্ত হয়ে আছে। প্রচার মাধ্যমে, জন্মতিথি উদযাপনের সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আয়োজিত প্রাতিষ্ঠানিক বা উন্মুক্ত অনুষ্ঠানমালায় ঘুরে ফিরেই পরিবেশিত হয় পরিচিত কিছু গান-কবিতা আর কথামালার চর্বিত-চর্বণ। নজরুল-রচিত অজস্র গান ও কবিতা এখনো রয়ে গেল শ্রোতাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। পরিচয় ঘটলো না তাঁর গল্প-নাটক-উপন্যাস-শিশুতোষ রচনার সমৃদ্ধ ভাণ্ডারের সাথে। আর সব থেকে উপেক্ষিত বোধহয় তাঁর প্রবন্ধসমূহ। কিন্তু কেন? কী আছে তাঁর প্রবন্ধে? সাহিত্যের যত শাখা আছে প্রবন্ধ তার মধ্যে বেশিমাত্রায় ’মন্ময়’। একজন ব্যক্তির নিজস্ব অভিজ্ঞতা, ভালো-মন্দ অনুভূতি, কোনো বিষয় সম্পর্কে অনুকূল বা প্রতিকূল অভিমত প্রবন্ধের মাধ্যমে যত সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রকাশ করা যায়, সাহিত্যের অন্য কোনো মাধ্যমে তা সম্ভব নয়। প্রবন্ধের ক্ষেত্রেই লেখক সবথেকে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে থাকেন। আর এসব কারণেই কি প্রবন্ধ উপেক্ষিত? এ প্রসঙ্গে নানা মত রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন প্রবন্ধ বেশিমাত্রায় শিক্ষায়তনিক বৈশিষ্ট্যের, বড্ড কাঠখোট্টা। আবার কারো কারো ধারণা লেখকের মতের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা কঠিন, আর বেশিমাত্রায় চ্যালেঞ্জিং। আবার সমাজে গড়ে ওঠা নানা গোষ্ঠীচেতনার সাথে লেখকের অভিমত সাংঘর্ষিক হলেও তার চর্চা খণ্ডিত হয়ে পড়ে। সাহিত্যিকদের ক্ষেত্রে হামেশাই তা ঘটে থাকে। কাজী নজরুল ইসলাম তার ব্যতিক্রম নন।
আমরা এমন এক সমাজে বসবাস করি যেখানে সাম্প্রদায়িকতা এক পরম্পরাগত বৈশিষ্ট্য। আর সম্প্রদায়িকতা একপাক্ষিকও নয়, বহুপাক্ষিক। এই বহুপাক্ষিকতার দ্বন্দ্ব থেকে জন্ম নেয় উগ্রবাদ। সমাজে সবসময়ই অসাম্প্রদায়িক মানুষেরা ছিলেন বটে, তবে তারাই প্রকৃত সংখ্যালঘু। সে দলে কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকেরা অধিক। এই লড়াইয়ে তারা অনেক বড় বিজয় অর্জন করেছেন এমন নয়, তবে সবসময় সেই সংগ্রামটা চালিয়ে গেছেন, তাদের উত্তরসূরিরাও চালিয়ে যাচ্ছেন। একটি মোমের আলো তীব্র ঝলসানো না হলেও কিছু জায়গা আলোকিত করার ক্ষমতা তার আছে, যার মূল্য অসীম।
নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনাটি বুঝতে গেলে তাঁর প্রবন্ধ পাঠ জরুরি। সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে বিভেদ, একই সম্প্রদায়ের মধ্যে শ্রেণি-বিভাজন ও নিম্নবর্গের মানুষের প্রতি অবহেলাকে তিনি অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছেন। সমাজ-রাষ্ট্র সকলের, সেখানে সবার অধিকার সমান, একথা তিনি বারংবার বলেছেন, ’যাহারা অন্য ধর্মকে ও অন্য মানুষকে ঘৃণা করে বা নীচ ভাবে, তাহারা, নিজেরাই অন্তরে নীচ, তাহাদের নিজেদেরও কোনো ধর্ম নাই। তবে ধর্মের যে ঘটাটা দেখো, তাহা অন্তরের দীনতা-হীনতা ঢাকিবারই ব্যর্থ প্রয়াস মাত্র’ (ছুঁৎমার্গ, ন. র. ১ম খণ্ড, ৩৯৩)। একটি সর্বজনীন সমাজ গড়ার স্বপ্ন তাঁকে সবসময় জাগিয়ে রেখেছে। সমাজে সব মানুষের সমান অধিকার ও গুরুত্বের ওপর তিনি জোর দিয়েছেন। অন্ত্যজ শ্রেণি হিসেবে যাদের অবজ্ঞা করা হয় তাদের হয়ে প্রশ্ন রেখেছেন, 'কিসের পতিত ইহারা? ইহাদের প্রাণ যত উন্মুক্ত, ইহাদের অন্তর যেমন সরল, তুমি কি সেরকম হইতে পার? হইতে পারে অশিক্ষিত সে, কিন্তু ইহার প্রাণ তোমার চেয়ে অনেক বড়, সে প্রাণে বিরাট বিপুল শক্তি সিংহ হইয়া সুপ্ত হইয়া রহিয়াছে, যদি পারো সেই শক্তিকে জাগাও’ (উপেক্ষিত শক্তির উদ্বোধন, ন. র, ১ম খও, ৩৯৭)। কিন্তু নজরুলের এই দৃষ্টিভঙ্গি সব মতলবাজ গোষ্ঠীর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তারা মুসলিম নজরুলকে যতটা চান, অসাম্প্রদায়িক নজরুলকে সেভাবে চান না, তাই তাঁর ইসলামি সঙ্গীতের পক্ষে থাকলেও শ্যামাসঙ্গীত রচনার বিষয়টি মানতে পারেন না। তাদের এই গোঁড়ামি তিনিও মানতে পারেননি।
'শুধু গুণ্ডামি, ভণ্ডামি আর গোঁড়ামি ধর্ম নয়,
এই গোঁড়াদের সর্বশাস্ত্রে শয়তানি চেলা কয়।’ (কবিতা: গোঁড়ামি ধর্ম নয়)
তিনি প্রশ্ন করেছেন, ’মানুষকে মানুষ হইয়া ঘৃণা করিবার তোমার কি অধিকার আছে? ইহাতো আত্মার ধর্ম নয়। তাহার আত্মা তোমার আত্মার মতোই ভাস্বর, আর একই মহা আত্মার অংশ। তোমার জন্মগত অধিকারটাই কি এতো বড়? (উপেক্ষিত শক্তির উদ্বোধন, ন. র, ১ম খণ্ড, ৩৯৫) তিনি প্রতিটি সম্প্রদায়ের প্রতিটি মানুষের ধর্মীয় পরিচয়কে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। সবাই তার অধিকার নিয়ে আত্মসম্মানের সাথে বেঁচে থাক সেই প্রত্যাশা তিনি ব্যক্ত করেছেন, 'হিন্দু হিন্দু থাক, মুসলমান মুসলমান থাক, শুধু একবার এই মহাগগনতলের সীমাহারা মুক্তির মাঝে দাঁড়াইয়া--মানব!--তোমার কণ্ঠে সেই সৃষ্টির আদিম বাণী ফুটাও দেখি! বলো দেখি, আমার মানুষ ধর্ম' (ছুঁৎমার্গ, ন. র, ১ম খণ্ড. ৩৯৩)।
মনুষ্যত্ব বাঙালির চরিত্রে কেন অনুপস্থিত তা ভেবে তার আক্ষেপ ছিল, 'আমরা কেন এমন দিন দিন মনুষ্যত্ব বর্জিত হইয়া পড়িতেছি? কেন ভণ্ডামি, অসত্য, ভীরুতা আমাদের পেশা হইয়া পড়িয়াছে?’ (আমাদের শক্তি স্থায়ী হয়না কেন? ন. র. ১ম খণ্ড, ৪০৮)। আমরাও ভাবতে বাধ্য হই যে, শতবর্ষ আগে রচিত প্রবন্ধে যে আফসোস প্রকাশিত হয়েছে, এখন তার থেকে আশা জাগানিয়া তেমন কিছু ঘটছে না।
আজকের উত্তরাধুনিক সমাজে বিজ্ঞানের পঠন-পাঠন যেমন বেড়েছে, ঠিক ততটাই কমেছে বিজ্ঞানমনষ্কতা। একটি সমাজ বিজ্ঞানের হাজারো সুবিধা ভোগ করে, কিন্তু প্রতিনিয়ত বিজ্ঞান-বিরোধিতা করে। এই অদ্ভুত বৈপরিত্য সমাজকে পিছিয়ে দেয়। মানুষ জড়বুদ্ধি সম্পন্ন হয়ে ওঠে। কুতর্কে জয়ী হতে চায়। তাই নজরুলের বিজ্ঞানমনষ্কতার স্বরূপটি সেভাবে আমাদের জানা হয়ে ওঠেনা। উপলব্ধি করা হয়না বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কেমন ছিল। কিন্তু দেখা যায়, শতবর্ষ আগে বিজ্ঞানের প্রাসঙ্গিক প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে তিনি অবগত ছিলেন। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে দক্ষিণ মেরুর বরফ গলে মহাপ্লাবন তৈরি হলে তা মানব জাতির জন্য কতটা হুমকি বয়ে আনবে; ধূমকেতু নিয়ে মানুষের কুসংস্কারের বিপরীতে জ্যোতির্বিদ পণ্ডিত ক্যামিল্লি ফ্লামারিয়নের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা; বাতাসে অম্লজান ও যবজ্ঞারজান উভয়ের প্রয়োজনীয়তা; কয়লাযুগে পৃথিবীতে কেবল মৎস্য ও সরিসৃপ জাতীয় প্রাণীর টিকে থাকার রহস্য; বায়ুমণ্ডলে ক্রমান্বয়ে অক্সিজেন নিঃশেষের ফলে মানুষের ক্ষুদ্র ও দুর্বল হওয়ার সম্ভাবনা; বজ্রপাতের সংখ্যা ও তীব্রতা বৃদ্ধির কারণ; প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় সূর্যের ভূমিকা; প্রফেসর বার্নস জোরের গবেষণাসূত্র অনুযায়ী সূর্যের ধীরে ধীরে ছোট হয়ে যাওয়ার কারণ ইত্যাদি বিষয়াবলী একটি মাত্র প্রবন্ধে তিনি চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। নজরুল-চর্চায় এই বিজ্ঞান মনষ্কতার খোঁজ পাঠক খুব একটা করেননি তা খুব সহজেই অনুমেয়।
বাঙালির বিজ্ঞানমনষ্কতার দুর্বলতা যেমন তিনি চিহ্নিত করেছেন, তেমনি তার ব্যবসায় করার সততা ও সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। ব্যবসাদার বাঙালি প্রবঞ্চক, তা তিনি মুক্তকণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন। আমাদের চারপাশে তার ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত দেখতে পাই। ‘সত্যের উপর ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত না করিলে বাণিজ্যে পতন আবার তেমনি অবশ্যম্ভাবী। মদকে মদ বলিয়া খাওয়ানো তত দোষের নয়, যত দোষ হয় মদকে দুধ বলিয়া খাওয়ানোতে। দুধের সঙ্গে জল মিশাইয়া বিক্রি করিলে লাভ হয় যত, প্রবঞ্চনা করার পাপটা হয় তার চেয়ে অনেক বেশি। একটা জাতি ব্যবসা-বাণিজ্য দ্বারা যত বড় হয় হউক, কিন্তু প্রবঞ্চনা বা মিথ্যার বিনিময়ে যেন তাহার জাতীয় বিশ্বস্ততা আর সুনাম বিক্রি করিয়া সে ছোট না হইয়া বসে।' (বাঙালির ব্যবসাদারি, ন. র. ১ম খণ্ড, ৪০৫)। শতবর্ষ আগে বাঙালির যে চরিত্র নিয়ে তিনি আক্ষেপ করেছিলেন, আজকের সমাজে বাঙালির ব্যবসায়ের চেহারা দেখলে তিনি লজ্জায় মরে যেতেন, কারণ ব্যবসায়ী বাঙালির পতন ও পচন দুটোই আজ অধোগতির সর্বনিম্নে পৌঁছে গেছে।
আজকের স্বাধীন দেশে আমলাতন্ত্র এক ঔপনিবেশিক পরম্পরা। ‘ধর্মঘট' ও ‘মুখবন্ধ’ প্রবন্ধে তিনি আমলতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে যা বলেছেন আজও তা প্রাসঙ্গিক। আমাদের সমাজে সবসময়ই এক শ্রেণির কপট ভণ্ড বুদ্ধিজীবীর দল থাকে। তারা প্রতিটি বক্তব্যের ভিন্ন ব্যাখ্যার মাধ্যমে অসৎ প্রচারণা চালায়, মানুষকে উসকায়, বিপথে পরিচালনা করে। নজরুল নিজেই তার শিকার। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, 'আমাদের লেখা, আমাদের সাহিত্য-সৃষ্টি আবার তেমনি সংকীর্ণ, ভণ্ডামি, অসত্য, রোগের বীজাণু প্রভৃতিতে ভরা... যেখানে লেখক সত্য, তাঁহার লেখাতেও সে-সত্য সত্যভাবেই ফুটিয়া উঠিবে; যেখানে লেখক মিথ্যা, সেখানে সেই মিথ্যাকে তিনি হাজার চেষ্টা করিলেও লুকাইতে পারিবেন না... সাহিত্যিকের, কবির, লেখকের প্রাণ হইবে আকাশের মতো উন্মুক্ত উদার, তাহাতে কোনো ধর্মবিদ্বেষ, জাতিবিদ্বেষ, বড়-ছোট জ্ঞান থাকিবে না' (বাংলা সাহিত্যে মুসলমান, ন. র. ১ম খণ্ড, ৩৮৯)। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য এইযে বাস্তবতা সম্পূর্ণ উল্টো। আজ লেখক-সাহিত্যিকরা নানা দলে বিভক্ত, গোষ্ঠী চেতনা তাদের লেখার মূল অস্ত্র। তারা বিদ্বেষ ছড়ান, নানা বিভাজন তৈরি করেন। মানুষকে বিভক্ত করে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন। উদারবাদী শিক্ষা তাই কোণঠাসা হয়ে পড়ে।
আমাদের সমাজের অতি পুরানো রোগ সাম্প্রদায়িকতা নিরাময়ে জনসাহিত্যের একটি ভূমিকা আছে বলে নজরুল মনে করতেন। 'জনসাহিত্যের উদ্দেশ্য হলো জনগণের মতবাদ সৃষ্টি করা এবং তাদের জন্য রসের পরিবেশন করা। আজকাল সাম্প্রদায়িক ব্যাপারটা জনগণের একটা মস্ত বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে: এর সমাধানও জনসাহিত্যের একটা দিক। সাময়িক পত্রিকাগুলোর দ্বারা আর তাদের সম্পাদকীয় প্রবন্ধ দ্বারা কিছুই হবেনা। সম্পাদকীয় মত উপর থেকে উপদেশের শিলাবৃষ্টির মতো শোনায় যাতে জনগণের মনের ওপর কোনো ছাপ পড়েনা--জনমতও সৃষ্টি হয় না’ (অভিভাষণ, জন-সাহিত্য, ন. র. ৮ম খণ্ড, ২৮)। আজকাল ’সাম্প্রদায়িকতা' শব্দটি ব্যবহারের পাশাপাশি ’ধর্মীয় সন্ত্রাস'ও সমানভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক অনূভূতির উগ্র প্রকাশ বোঝাতে নতুন শব্দ সৃষ্টির অর্থ হলো আমাদের আরো অধোগতি হয়েছে, মনে হয় আলো ক্ষীণ হয়ে আসছে।
নজরুলের জন্ম হয়েছিল ১২৬ বছর আগে। গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলোর বয়স ১০০ বছরের ওপরে। তখন যে সংকট নিয়ে লিখেছেন আজো সেই সংকটমোচনতো দূরের কথা, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা আরো গভীর হয়েছে। তাঁর প্রত্যাশা, আহবান, পরামর্শ-- কোনেকিছুকে আমরা তেমন মূল্য দেইনি। সীমিত ব্যতিক্রম বাদে, নজরুল-চর্চার আবরণে তাঁর খণ্ডিত ও বিকৃত চর্চাকে অব্যাহত রেখেছি। যেটুকু নিলে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর লাভ হয় সেটুকু নিয়েছি, রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছি। কিন্তু লেখক হিসেবে তাঁর প্রত্যাশা কি এমন ছিল?
নিজের সম্পর্কে নজরুল বলেছেন, 'কাব্যে ও সাহিত্যে আমি কি দিয়েছি জানিনা। আমার আবেগে যা এসেছিল, তাই আমি সহজভাবে বলেছি, আমি যা অনুভব করেছি, তাই আমি বলেছি। ওতে আমার কৃত্রিমতা ছিলনা। কিন্তু সঙ্গীতে যা দিয়েছি, সে সম্বন্ধে আজ কোনো আলোচনা না হলেও ভবিষ্যতে যখন আলোচনা হবে, ইতিহাস লেখা হবে, তখন আমার কথা সবাই স্মরণ করবে, এ বিশ্বাস আমার আছে। সাহিত্যে দান আমার কতটুকু তা আমার জানা নেই। তবে এইটুকু মনে আছে সঙ্গীতে আমি কিছু দিতে পেরেছি ‘ (অভিভাষণ, জন-সাহিত্য, ন. র, ৮ম খণ্ড ২)। শুধু সঙ্গীত নয়, সাহিত্যেও তিনি অনেক কিছুই দিতে পেরেছেন, কিন্তু আমরা ঠিকঠাক নিতে পেরেছি কি? সমগ্রতাকে ধারণ করতে পেরেছি কি? পারার জন্য যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা জরুরি, তা ছিল কি? এই উত্তরগুলো নেতিবাচক। এগুলো যখন প্রকৃত অর্থে ইতিবাচক হবে, কেবল তখনই আমরা পূর্ণাঙ্গ নজরুলকে পাব! তার আগে নয়।
তারা//