প্রতিদিনের মতো দাদি রেখা বিশ্বাসের হাত ধরে বিদ্যালয় থেকে বাসায় ফিরছিল রশনি পাল (৭)। দাদি-নাতনি নানান বিষয়ে গল্প করতে করতে হাঁটছিল। এক সময় সড়ক পার হওয়ার জন্য রশনির বাঁ হাত ধরেন রেখা বিশ্বাস। সে একটু আগে আগে হাঁটছিল। ঠিক তখন কিছু বুঝে ওঠার আগেই ডান দিক থেকে বিআরটিসির বাস এসে শিশুটিকে ধাক্কা দেয়। এতে সড়কে ছিটকে পড়ে ছটফট করতে থাকে রশনি। তাকে তুলে রিকশায় উঠিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেন এক ব্যক্তি। সেখানে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
গতকাল সোমবার সকালে কমলাপুর মোড়ে মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনা ঘটে। মেয়ের মৃত্যুর খবর শুনে হাসপাতালে ছুটে যান চৈত্রী বিশ্বাস। তিনি গুলশানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। রশনি মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী। মা ও দাদির সঙ্গে সে মুগদার মান্ডা এলাকায় থাকত। তাদের গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের টংগীবাড়ি উপজেলার পাটগাঁও গ্রামে। রশনির বাবার নাম পলাশ পাল। তিনি বিদেশে থাকেন। মেয়ের চিকিৎসার জন্য সম্প্রতি দেশে এসেছেন।
বেলা ১১টার দিকে ঢামেক হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, রশনির রক্তমাখা স্কুলব্যাগ বুকে জড়িয়ে আহাজারি করছেন মা চৈত্রী বিশ্বাস। পাশেই অন্যান্য স্বজন বসে কাঁদছেন। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে পাগলপ্রায় চৈত্রী বলতে থাকেন, ‘তোর (রশনি) অসুস্থতার জন্য ভারতে চিকিৎসা করানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আর তুই চিকিৎসা না নিয়েই আমার বুকটা খালি করে চলে গেলি! এখন আমি কী নিয়ে বাঁচব?’
রশনির মায়ের পাশে কাঁদছিলেন দাদি রেখা বিশ্বাস। তিনি আহাজারি করতে করতে বলেন, ‘গতকাল আমি ওর কাঁধ থেকে স্কুলব্যাগ নিতে চাইলাম। কিন্তু সে বলল, আমার ব্যাগ আমি নেব। এখন আমি কাকে স্কুলে নিয়ে যাব? কাকে গল্প শোনাব?’ রশনির শ্রেণিশিক্ষক সালমা আক্তার বলেন, এ বছর মর্নিং শিফটে গোলাপ শাখায় প্রথম শ্রেণিতে নতুন ভর্তি হয় রশনি।
বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ চৌধুরী এমদাদুল করিম আক্ষেপ করে বলেন, ‘স্কুলের আশপাশে এত বাসের ডিপো! হাঁটা-চলা করা যায় না। অনেকবার স্কুলের সামনে স্পিড ব্রেকার ও ট্রাফিক পুলিশ দেওয়ার কথা বলেছি। কিন্তু কাজ হয়নি।’
ঘটনাস্থল এলাকায় দায়িত্বরত ট্রাফিক পরিদর্শক মাহবুব হোসেন বলেন, ‘সকাল সাড়ে ৯টার দিকে রাস্তায় গাড়ির চাপ অনেক কম ছিল। ট্রাফিক বক্সের মধ্যে বসে বিভিন্ন পয়েন্টের ট্রাফিক ব্যবস্থার খোঁজখবর নিচ্ছিলাম। এ সময় বাইরে চিৎকার শুনে বক্স থেকে বেরিয়ে দেখি একটি শিশু রক্তাক্ত পড়ে আছে। আর বিআরটিসির একটি বাস দ্রুতগতিতে রাজারবাগের দিকে ছুটছে। সঙ্গে সঙ্গে সার্জেন্ট ইমাম উদ্দিন পিছু নিয়ে চালকসহ বাসটি আটক করে।’
মতিঝিল থানার ওসি মেজবাহ উদ্দিন বলেন, শিশুর বাবা সড়ক দুর্ঘটনা আইনে মামলা করেছেন। এ মামলায় বাসচালককে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
মানুষ কি আসলেই স্বার্থপর
বিজ্ঞান বলছে, আমরা জন্মগতভাবে পরোপকারী। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি সত্যিই সব সময় অন্যদের কথা ভাবতে বাধ্য?
উড়োজাহাজ উড়াল দেওয়ার আগমুহূর্তে যাত্রীদের সচেতন করার জন্য নিরাপত্তাবিষয়ক কিছু ঘোষণা দেওয়া হয়। যেমন ‘স্বাগতম’ এবং ‘এই বাঁশিটি বাজিয়ে সাহায্য চান’। এসবের মাঝখানে বলা হয়, ‘আগে নিজের অক্সিজেন মাস্ক পরুন, তারপর অন্যকে সাহায্য করুন।’
এই কথাকে বলা চলে ‘স্বার্থপরতা’ দেখানোর একরকম আনুষ্ঠানিক নির্দেশনা। যদি আপনি আকাশে ৩৩ হাজার ফুট উচ্চতায় এবং ঘণ্টায় ৫৫০ মাইল গতিতে থাকা অবস্থায় কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে পড়েন, তাহলে এ নির্দেশনা ভালো কাজে দেবে।
ধরুন, পরিস্থিতি এমন হলো যে হঠাৎ করে কেবিনের ভেতরে চাপ কমে গেল। এই পরিস্থিতিতে যদি আপনি আগে নিজের অক্সিজেন মাস্ক না পরেন, তাহলে হয়তো জ্ঞান হারিয়ে ফেলবেন। আর তখন আপনি আর কাউকে সাহায্য করার মতো অবস্থাতেই থাকবেন না।
বিজ্ঞান বলছে, আমাদের বেশির ভাগের মধ্যেই নিঃস্বার্থ হওয়ার স্বাভাবিক ক্ষমতা আছে। কখনো কখনো তা আশ্চর্য রকমের বেশি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমরা সব সময় নিঃস্বার্থ হতে পারি বা হওয়া উচিত।কিন্তু অন্যভাবে ভেবে দেখলে, এই কথাটাতে অনেকে ভুল বার্তাও পেতে পারেন। আজকের দুনিয়ায় যেখানে আত্মকেন্দ্রিক মানুষদেরই অনেক সময় বেশি সফল বলে মনে হয়, সেখানে এই লাইন যেন বলছে, সব সময় আগে নিজের কথা ভাবো আর নিজের স্বার্থই সবচেয়ে বড়।
সামাজিক মনোবিজ্ঞানী গির্ট হফস্টেডের মতে, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা হলো মানুষ কতটা নিজেকে স্বাধীন মনে করে, সেটির পরিমাপ। অর্থাৎ বড় একটি গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে একে অপরের ওপর নির্ভরশীল থাকার বিপরীত দৃশ্য এটি।
বিশ্বের অনেক জায়গায়, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোতে এই ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রবণতা দিন দিন প্রবল হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি ভালো, না খারাপ?
লিডস বেকেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক স্টিভ টেলর বলেন, ‘শুধু সেলফিশ জিন’ ও ‘নিও-ডারউইনিজম’ তত্ত্বই নয়; মনোবিজ্ঞান, অর্থনীতি ও জীববিজ্ঞানের বেশ কিছু তত্ত্ব এই বিশ্বাসকে স্বাভাবিক করে তুলেছে যে প্রতিযোগিতা মানেই মানুষ স্বভাবতই নিষ্ঠুর, নির্মম বা স্বার্থপর।
তবে টেলর এটাও মনে করেন যে মানুষ অবশ্যই স্বার্থপর হতে পারেন। কারণ, আমাদের মস্তিষ্কের প্রথম কাজই হলো আমাদের বাঁচিয়ে রাখা। তবে সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো আরও আশাব্যঞ্জক কথা বলছে। এসব গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ যে সব সময় নিজের কথাই আগে ভাবেন, এই ধারণা পুরোপুরি ঠিক নয়।
আমরা কখন নিজের কথা আগে ভাবি আর কখন অন্যের কথা আগে ভাবি, তা অনেকটাই পরিস্থিতি, আমাদের আগের অভিজ্ঞতা এবং সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করে।১৯৬০-এর দশকে ‘বাইস্ট্যান্ডার ইফেক্ট’ নামের একটি তত্ত্ব আলোচনায় আসে। এই তত্ত্বে বলা হয়, কেউ বিপদে পড়লে আশপাশের মানুষেরা খুব কমই এগিয়ে যান। ১৯৬৪ সালে নিউইয়র্কে কিটি জেনোভেস নামের ২৮ বছরের এক নারী বারকর্মীকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার পর তত্ত্বটি দেওয়া হয়েছিল। তত্ত্ব অনুসারে, কিটি জেনোভেসকে হত্যার দৃশ্যটি প্রায় ৪০ জন মানুষ দেখেছেন, কিন্তু কেউই তাঁকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেননি।
‘বাইস্ট্যান্ডার ইফেক্ট’-এর পেছনের ঘটনাটি নিয়ে যে গল্প সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে, তার শেষাংশ এখন অনেকটাই বিতর্কিত বলে ধরা হয়। হ্যাঁ, কিটি জেনোভেসকে যে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়েছিল, এটা সত্যি এবং তা মর্মান্তিক। তবে তদন্তে দেখা গেছে, ৩৮ জন নির্লিপ্ত প্রত্যক্ষদর্শীর কথাটি সত্য নয়। ২০০৭ সালের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, জেনোভেসের হত্যাকাণ্ড যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা কেউই কিছু করেননি, এমন কোনো প্রমাণ মেলেনি।
গবেষকেরা মনে করেন, এই গল্প একধরনের আধুনিক উপকথা হয়ে গেছে। তাঁদের মতে, এ ধারণা আসলে জরুরি পরিস্থিতিতে মানুষের সহানুভূতি বা সাহায্য নিয়ে আরও গভীরভাবে গবেষণার সুযোগকে সীমিত করে দিয়েছে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক পরিস্থিতিতে মানুষ আসলে নিজের নিরাপত্তার চেয়েও অন্যের নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিতে প্রস্তুত থাকে।
কিছু নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা যায়, যাঁরা এখনো আমাদের পূর্বসূরিদের মতো করে জীবন যাপন করেন, তাঁরা সম্পদ ভাগাভাগিতে সমতা বজায় রাখেন