ঢাকার কেরানীগঞ্জে থাকেন মাজহারুল ইসলাম ও ইয়াসমিন আক্তার দম্পতি। মাজহারুল আসবাবের দোকানে রঙের কাজ করেন। গত সোমবার সন্ধ্যায় অন্তঃসত্ত্বা ইয়াসমিনের প্রসবব্যথা ওঠে। তাঁকে রাজধানীর ‘মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার এবং ১০০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশু হাসপাতালে’ ভর্তি করা হয়। রাত দেড়টার দিকে স্বাভাবিক প্রসবের মাধ্যমে তিনি সন্তানের জন্ম দেন। গতকাল মঙ্গলবার সকালে হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডে গিয়ে কথা হয় ইয়াসমিনের (২৫) সঙ্গে।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত এই হাসপাতালে স্বাভাবিক প্রসবের সময়ে জরুরি ওষুধ ও সরঞ্জাম বিনা মূল্যে দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। সেটা পেয়েছেন কি না, জানতে চাইলে ইয়াসমিনের পাশে বসে থাকা তাঁর মা রাহিমা বলেন, কী কী লাগবে সেটা নার্স এসে জানানোর পর তাঁর জামাতা মাজহারুল স্যালাইন, ওষুধ, স্যানিটারি ন্যাপকিন ইত্যাদি বাইরে থেকে কিনে এনেছিলেন।                                                

একই ওয়ার্ডে স্বাভাবিক প্রসবে সন্তান জন্ম দেওয়া মীম আক্তারের মা শাহিনূরও জানালেন তাঁরাও বাইরে থেকে ওষুধ-সরঞ্জাম কিনে এনেছিলেন।

হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বাভাবিক প্রসবের সময় ব্যবহার হওয়া বিনা মূল্যের ওষুধ ও সরঞ্জামের প্যাকেট ‘নরমাল ডেলিভারি কিট’ সরবরাহ এক বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে। মা ও শিশুস্বাস্থ্যের জন্য বিনা মূল্যের প্রয়োজনীয় ওষুধের প্যাকেট ‘ড্রাগ অ্যান্ড ডায়েটারি সাপ্লিমেন্ট (ডিডিএস) কিট’ সরবরাহও বন্ধ রয়েছে ছয় মাস ধরে।

জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক মো.

ফায়জুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এখন ডেলিভারি কিট ও ডিডিএস কিট সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে ফায়জুর রহমান বলেন, ‘সরবরাহ বন্ধ থাকার প্রভাব তো পড়ছেই। রোগী কিছু কমেও গেছে। কারণ, তাঁরা ওষুধের জন্য আসেন। আমরা সেটা দিতে পারছি না।’

ফায়জুর রহমান জানান, গতকাল মঙ্গলবার হাসপাতালটিতে ৫টি স্বাভাবিক প্রসব ও ১৩টি অস্ত্রোপচারে সন্তান প্রসব (সিজারিয়ান বা সি সেকশন) হয়েছে। এপ্রিল মাসে ১৭১টি স্বাভাবিক প্রসব ও ২৭৮টি সি সেকশন হয়েছে।                                    

মোহাম্মদপুরের শুধু এই হাসপাতালটিই নয়, সারা দেশে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর পরিচালিত হাসপাতালে প্রসব কিট ও ডিডিএস কিট সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় পণ্যাগার ও ২২টি আঞ্চলিক পণ্যাগারে এসব কিটের মজুত নেই। উপজেলা পর্যায়েও ডেলিভারি কিটের মজুত নেই, আর ডিডিএস কিটের মজুত নেই ৯৬ শতাংশ উপজেলায়। যে কর্মসূচির আওতায় এসব কিট কেনাকাটা করা হতো, তার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় ২০২৪ সালের শুরু থেকে এসব ওষুধ ও সরঞ্জামের সংকট দেখা দেয়। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়ে ওই কর্মসূচির অপারেশন প্ল্যান (ওপি) স্থগিত করে নতুন প্রকল্প নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে ৯ মাস ধরে মজুত কমতে কমতে শূন্যে নেমে আসে।

সারা দেশে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র রয়েছে ৩ হাজার ২৯১টি। মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র রয়েছে ২৮২টি, এর মধ্যে ইউনিয়ন পর্যায়ে পুরোনো ২৪ ও নতুন ১৫৯টি, উপজেলা পর্যায়ে ১২টি এবং জেলা পর্যায়ে ৬১টি। মোহাম্মদপুরের হাসপাতালটি ছাড়াও জাতীয় পর্যায়ে রাজধানীর আজিমপুরে ১৭৩ শয্যার ‘মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান’ এবং মিরপুরের লালকুঠিতে ‘২০০ শয্যাবিশিষ্ট মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য হাসপাতাল’ পরিচালিত হচ্ছে। কম খরচে সেবা ও বিনা মূল্যে ওষুধ পাওয়া যায় বলে এসব হাসপাতালে দরিদ্র পরিবারের মা ও শিশুরাই বেশি সেবা নিতে আসেন।    

সেবার এই সংকটের মধ্যে আজ ২৮ মে দেশজুড়ে পালিত হচ্ছে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। এবার দিবসটি পালনে আলাদা কোনো প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়নি। ‘জন্ম হোক সুরক্ষিত, ভবিষ্যৎ হোক আলোকিত’ ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের এই প্রতিপাদ্য ধরেই দিবসটি পালন করা হচ্ছে।        

কিটে যা থাকে, যত সরবরাহ হতো

নরমাল ডেলিভারি কিটের একটি প্যাকেটে ১০টি স্বাভাবিক প্রসবের সরঞ্জাম ও ওষুধ থাকে। দেহে প্রবেশ করানোর স্যালাইন, ট্যাবলেট, ক্যাপসুল, ইনজেকশন, বাটারফ্লাই সুচ, একবার ব্যবহারযোগ্য সিরিঞ্জ, জীবাণুমুক্ত সার্জিক্যাল গ্লাভস, তুলা, জীবাণুমুক্ত গজ, সার্জিক্যাল টেপ, স্যানিটারি ন্যাপকিনসহ ১৭ ধরনের ওষুধ ও সামগ্রী থাকে একেকটি কিটে।

ডিডিএস কিটে থাকে ২৫ ধরনের ওষুধ। আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড, ক্যালসিয়াম উইথ ভিটামিন ডি, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, প্যারাসিটামল, অ্যান্টাসিড, জিংক সালফেট মনোহাইড্রেট, সিপ্রোফ্লক্সাসিনসহ ১৭ ধরনের ট্যাবলেট, ২ ধরনের ক্যাপসুল, ২ ধরনের গুঁড়া ওষুধ, ২ ধরনের তরল ওষুধ, মুখে খাওয়ার স্যালাইন ও মলম।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, হাসপাতালগুলোর মধ্যে ইউনিয়ন পর্যায়ের হাসপাতালে শুধু স্বাভাবিক প্রসব হয়। উপজেলা, জেলা ও ঢাকার হাসপাতালগুলোতে স্বাভাবিক প্রসবের পাশাপাশি সি সেকশনও হয়।

হাসপাতালগুলোতে চাহিদার তুলনায় এসব সরঞ্জাম সরবরাহ কমই দেওয়া হয়। বছরে ৮০ থেকে ৯০ হাজার ডিডিএস কিট এবং ২০ হাজারের মতো ডেলিভারি কিট সরবরাহ করা হয়।                 

মজুত যেভাবে শূন্য হলো

জানা গেছে, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচির (এইচপিএনএসপি) আওতায় অন্যান্য কার্যক্রমের সঙ্গে ডেলিভারি কিট ও ডিডিএস কিট সরবরাহ কার্যক্রম পরিচালিত হতো। এই কার্যক্রম পরিচালনা হতো মাতৃ, শিশু, প্রজনন ও কৈশোর স্বাস্থ্য (এমসিআরএএইচ) শিরোনামের অপারেশন প্ল্যান বা ওপির মাধ্যমে। চতুর্থ এইচপিএনএসপির মেয়াদ ছিল ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের জুন মাস পর্যন্ত। এরপর ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত বরাদ্দ ছাড়া মেয়াদ বাড়িয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। কর্মসূচির যে উদ্বৃত্ত অর্থ ছিল, তা দিয়ে কেনাকাটা করে ওষুধ ও সরঞ্জাম সরবরাহ করা হতো। পরে প্রস্তাবিত পঞ্চম এইচপিএনএসপির আওতায় ২০২৫ থেকে ২০২৯ সাল পর্যন্ত কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সে লক্ষ্যে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভাও হয়েছিল। তবে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ওপি স্থগিত করে দেয় এবং ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত দুই বছর মেয়াদি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরির নির্দেশনা দেয়। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর সেই ডিপিপি তৈরি করে এই মাসে জমা দিয়েছে। নতুন প্রকল্প তৈরির এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যে ৯ মাস ধরে কেনাকাটা বন্ধ হয়ে মজুত–সংকট দেখা দিয়েছে।

একই ওপির মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা হতো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেও। ফলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও জরুরি ওষুধ ও সরঞ্জামের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তবে মজুত শূন্য হয়নি।   

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপজেলা হেলথকেয়ার বিভাগের লাইন ডিরেক্টর মোহাম্মদ একরাম উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, নতুন ডিপিপি তৈরির এই সময়ে সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্মসূচি ছাড়াও বিভিন্ন উৎস থেকে সরবরাহ পেয়ে থাকে। তাই সেখানে মা ও শিশুস্বাস্থ্য এবং প্রসবের সব ওষুধের মজুত শূন্য নয়।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাপ্লাই চেন ম্যানেজমেন্ট পোর্টালের তথ্য অনুযায়ী, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ঢাকার কেন্দ্রীয় পণ্যাগার এবং ভোলা, ফরিদপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, পটুয়াখালী, বরিশাল, টাঙ্গাইল, দিনাজপুর, পাবনা, রাজশাহী, রংপুর, বান্দরবান, কুমিল্লা, নোয়াখালী, রাঙামাটি, সিলেট, যশোর, কুষ্টিয়া, কক্সবাজার, বগুড়া, চট্টগ্রাম ও খুলনা, মোট ২২টি আঞ্চলিক পণ্যাগারে স্বাভাবিক প্রসব কিট, ডিডিএস কিট, প্রসবের সরঞ্জামাদি সেট, বারবার ব্যবহারযোগ্য ক্লিনিক্যাল প্রসব সহায়ক সরঞ্জামাদি, ক্লিনিক্যাল প্রসব সহায়ক ওষুধ ও একবার ব্যবহারযোগ্য সরঞ্জামাদির মজুত শূন্য। একেকটি আঞ্চলিক পণ্যাগার থেকে কয়েকটি উপজেলায় পণ্য সরবরাহ করা হয়। ৪৯৪টি উপজেলায় নরমাল ডেলিভারি কিট বা স্বাভাবিক প্রসব কিটের মজুত শূন্য। আর ডিডিএস কিট নেই ৪৭৪টি উপজেলায়। সম্ভাব্য মজুতশূন্যতা ১৭টি উপজেলায়, ২টিতে মজুত কম এবং মাত্র একটি উপজেলায় মজুত সন্তোষজনক।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উপকরণ ও সরবরাহ বিভাগের পরিচালক মার্জিয়া হক প্রথম আলোকে বলেন, চতুর্থ এইচপিএনএসপির মেয়াদ শেষে কিছু সিদ্ধান্তগত জটিলতার কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কেনাকাটা করা যায়নি। ফলে কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক পণ্যাগারে এখন ডিডিএস কিট, স্বাভাবিক প্রসব কিটসহ অন্যান্য জরুরি ওষুধ ও সরঞ্জামের মজুত নেই। কোনো কোনো উপজেলায় অল্প পরিমাণে ডিডিএস কিট থাকলেও স্বাভাবিক প্রসব কিটের মজুত নেই। রাজস্ব খাত থেকে জরুরি ওষুধ ও সরঞ্জাম কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জুন মাসের মধ্যে সরবরাহ শুরু করা যাবে। ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ে নতুন ডিপিপি জমা দেওয়া হয়েছে। ডিপিপি অনুমোদন হলে প্রকল্পের মাধ্যমে সরবরাহ করা হবে।

জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, একটি কর্মসূচির মেয়াদ শেষের সময়ে এই ধরনের পরিস্থিতি হতে পারে, সেটা বিবেচনায় নিয়ে কেনাকাটা করার দরকার ছিল। সরকারি কর্মকর্তারা তা না করে হাত-পা গুটিয়ে বসে ছিলেন। তাঁদের সদিচ্ছার অভাব ছিল। এ নিয়ে তাঁদের জবাবদিহি করা উচিত। কারণ, এসব হাসপাতাল থেকে সাধারণত দরিদ্র মানুষেরা সেবা নেন, তাঁরা সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন।   

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স ব ভ ব ক প রসব ক ট স ব ভ ব ক প রসব র ক ট সরবর হ প রথম আল ক ড ড এস ক ট সরবর হ ব সরবর হ ক পর চ ল ত উপজ ল য় প রকল প ব যবহ র পর য য় কল য ণ ধরন র

এছাড়াও পড়ুন:

২০২৬ সালে বিশ্ববাজারে জিনিসপত্রের দাম আরও ৭% কমতে পারে, বাংলাদেশে কেন কমছে না

চলতি বছরের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে দাম কমার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে, চলতি বছরে সামগ্রিকভাবে পণ্যমূল্য ৭ শতাংশ কমবে। আগামী বছর, অর্থাৎ ২০২৬ সালে পণ্যমূল্য আরও ৭ শতাংশ কমবে। এ দাম হবে ছয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।

কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে তার প্রভাব নেই। দেশে মূল্যস্ফীতির হার এখনো ৮ শতাংশের ঘরে। যদিও একসময় তা দুই অঙ্ক ছাড়িয়ে গিয়েছিল। গত সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ হয়েছে। দেশের মানুষকে এখনো বাড়তি দামেই পণ্য ও সেবা কিনতে হচ্ছে। আগামী বছর নিত্যপণ্যের দাম কমবে কি না, সেই নিশ্চয়তাও নেই। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমলেও দেশে এর প্রভাব কম।

বিশ্বব্যাংকের ‘কমোডিটি মার্কেটস আউটলুক অক্টোবর ২০২৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, ২০২৫ সালের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। যার মূল কারণ হিসেবে তারা চিহ্নিত করেছে জ্বালানির দাম কমে যাওয়া। সেই সঙ্গে আরও কিছু কারণ চিহ্নিত করেছে তারা। সেগুলো হলো চীনে তেলের চাহিদা বৃদ্ধির গতি কমে যাওয়া এবং বিশ্ববাজারে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় তেলের দামে বড় ধরনের পতন ঘটা। খাদ্যপণ্যের দাম বছরের শুরু থেকে ধীরে ধীরে কমতে থাকে, কিন্তু বছরের প্রথমার্ধে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে পানীয় পণ্যের দাম হঠাৎ অনেকটা বেড়ে যায়। এ ছাড়া বছরের দ্বিতীয়ার্ধে সোনার দাম রেকর্ড উচ্চতায় ওঠে। মূলত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে নিরাপদ বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে মানুষ সোনার দিকে ছুটেছেন।

বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য নির্ধারণে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে জ্বালানি তেলের দাম। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালে জ্বালানির দাম আগের বছরের তুলনায় ১২ শতাংশ এবং ২০২৬ সালে আরও ১০ শতাংশ কমবে। ২০২৭ সালে তা আবার প্রায় ৬ শতাংশ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস ২০২৬ সালে কৃষিপণ্য, খাদ্য ও কাঁচামালের দাম কমবে। চলতি বছরেও এসব পণ্যের দাম কমেছে।

জ্বালানি তেল

বিশ্বব্যাংকের ২০২৬ সালের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা বাড়ায় গ্যাসের দাম কিছুটা বাড়লেও তেলের দাম কমে যাবে এবং সেই প্রভাবকে ছাপিয়ে যাবে। ২০২৫ সালে ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম হতে পারে ব্যারেলপ্রতি গড়ে ৬৮ ডলার; ২০২৪ সালের ৮১ ডলারের তুলনায় যা বেশ কম। ২০২৬ সালে এই দাম আরও কমে ব্যারেলপ্রতি গড়ে ৬০ ডলারে নামতে পারে ধারণা করা হচ্ছে।

এই পূর্বাভাস অনুযায়ী, তেলের ব্যবহার বৃদ্ধির হার আরও কমবে—মূলত চীনের চাহিদা কমে যাওয়া, বৈদ্যুতিক ও হাইব্রিড গাড়ির দ্রুত প্রসার ও বৈশ্বিক তেল সরবরাহ বৃদ্ধির কারণে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।

২০২৫ সালে বৈশ্বিক তেলের বাজারে সরবরাহ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০২৬ সালে তা আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২০ সালের সর্বোচ্চ মাত্রার তুলনায় প্রায় ৬৫ শতাংশ বেশি হবে এ সরবরাহ।

কৃষিপণ্য

বিশ্বব্যাংক গ্রুপের পূর্বাভাস অনুযায়ী, কৃষিপণ্যের মূল্যসূচক ২০২৫ সালে স্থিতিশীল আছে। ২০২৬ সালে তা সামান্য ২ শতাংশ ও ২০২৭ সালে আরও ১ শতাংশ কমবে।

খাদ্যপণ্যের দাম, যেমন শস্য, তেল, প্রোটিনজাত খাবারসহ অন্যান্য খাদ্যের দাম সাম্প্রতিক সীমার কাছাকাছি থাকবে। তবে মাঝেমধ্যে সামান্য কিছুটা ওঠানামা থাকবে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, প্রধান ফসলগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধির হার আবার দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতায় ফিরে আসছে।

২০২৫ সালের বাকি সময়ে সয়াবিনের দাম কমবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের যে সয়াবিন সাধারণত চীনে রপ্তানি হয়, তা এবার কম দামে অন্য ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতে হতে পারে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্রে হচ্ছে এই সয়াবিন। চীন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সয়াবিন কিনছে না। ফলে ২০২৬ ও ২০২৭ সালে এই পণ্যের দাম তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বিশ্ববাজারে দাম কমে গেলে যুক্তরাষ্ট্রে সয়াবিন চাষের পরিমাণ কিছুটা কমতে পারে, তবে ব্রাজিল তার সয়াবিন আবাদ আরও বাড়ানোর পথে রয়েছে। পানীয় পণ্যের দাম ২০২৬ সালে ৭ শতাংশ ও ২০২৭ সালে প্রায় ৫ শতাংশ কমবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।

এদিকে চলতি বছর সারের দাম সামগ্রিকভাবে ২১ শতাংশ বাড়তি। চাহিদা বৃদ্ধি, বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতা ও কিছু অঞ্চলে সরবরাহ–ঘাটতির কারণে এ দাম বেড়ে যাওয়া। ২০২৬ ও ২০২৭ সালে দাম প্রায় ৫ শতাংশ কমতে পারে। তবু ২০১৫-১৯ সালের গড় দামের তুলনায় তা অনেক বেশি থাকবে। এর কারণ হলো উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, রপ্তানি সীমাবদ্ধতা ও চলমান আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা।

চীন ইতিমধ্যে নাইট্রোজেন ও ফসফেট সার রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। অন্যদিকে পটাশ সরবরাহকারী বড় দেশ বেলারুশ এখনো ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার আওতায় আছে। রাশিয়া ও বেলারুশ—উভয় দেশই সারের ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের আরোপিত নতুন শুল্কের সম্মুখীন।

দেশে কেন দাম বেশি

বিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশের বাজার দাম না কমার অন্যতম প্রধান কারণ ডলারের দামের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন। গত তিন বছরে ডলার দাম অনেকটা বেড়েছে। সেই সঙ্গে দেশের অনেক আমদানি পণ্যে শুল্ক বেশি বলে মনে করেন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে দাম কমছে না। বাজারে চাহিদা কত বা কখন কোন পণ্য আমদানি করতে হবে, সে বিষয়ে যথাযথ তথ্যের ঘাটতি আছে। ফলে সময়মতো পণ্য আমদানি হয় না।

আরেকটি বিষয় হলো দেশে যেসব পণ্য আমদানি করা হয়, তার অনেক কিছু উৎপাদিতও হয়। কিন্তু বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় এসব পণ্যের সরবরাহে টান পড়েছে। বাজারের পণ্যমূল্যে তার প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন মোস্তাফিজুর রহমান।

তিন বছর আগে দেশে ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। এখন তা বেড়ে ১২২ টাকা হয়েছে। এ ছাড়া কয়েক মাস ধরে আমদানির ঋণপত্র খোলাও কমেছে। এতে আমসদানিতে চাপ পড়ছে।

দেশের বাজার উচ্চ মূল্যের কারণ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক সেলিম রায়হান বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি, কৃষি ও খাদ্যপণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশের বাজারে তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। জ্বালানি ও পরিবহন ব্যয়, শুল্ক ও করের চাপ ও বাজার ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতার কারণে দাম কমছে না। পাইকারি থেকে খুচরা পর্যন্ত অতি মুনাফা ও অস্বচ্ছ বাণিজ্যিক শৃঙ্খলের কারণেও বাজারে কৃত্রিমভাবে উচ্চমূল্য বিরাজ করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে টাকার অবমূল্যায়ন। ফলে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে এবং আন্তর্জাতিক মূল্যহ্রাসের সুফল ভোক্তাপর্যায়ে পড়ছে না।

সেলিম রায়হান আরও বলেন, এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার কারণ ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে এসেছে। বিনিয়োগকারীরা নতুন ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। পণ্য পরিবহন ও আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সরবরাহ শৃঙ্খল দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে বাজারে পণ্যের ঘাটতি ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। এটি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

দেশে তিন বছর ধরেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। সম্প্রতি তা কিছুটা কমলেও সেপ্টেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গত আগস্ট মাসে এই হার ছিল ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • চলন্ত অবস্থায় বৈদ্যুতিক গাড়ি চার্জ করতে সক্ষম সড়ক চালু ফ্রান্সে
  • জ্বালানি খাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন
  • বাজারে আগাম সবজি আসতে দেরি, দাম চড়া
  • নির্বাচনের দিন অমোচনীয় কালি সরবরাহ না হলে ভোট গ্রহণ বন্ধ থাকবে: ছাত্রদল
  • যশোরে জিআই পণ্য খেজুর গুড় তৈরির রস সংগ্রহে গাছ প্রস্তুতির উদ্বোধন
  • টমাহক কত দূরে আঘাত হানতে পারে, রাডারে কেন ধরা পড়ে না
  • সামুদ্রিক মাছে ভরপুর আড়ত, দাম কেমন
  • ২০২৬ সালে বিশ্ববাজারে জিনিসপত্রের দাম আরও ৭% কমতে পারে, বাংলাদেশে কেন কমছে না
  • যুক্তরাষ্ট্রকে পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার নির্দেশে আতঙ্ক-উত্তেজনা, ট্রাম্প আসলে কী চান
  • ইউক্রেনকে টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র দিতে পেন্টাগনের সায়, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন ট্রাম্প