মাতৃস্বাস্থ্যের বিনা মূল্যের ওষুধ ও সরঞ্জাম সরবরাহ বন্ধ
Published: 28th, May 2025 GMT
ঢাকার কেরানীগঞ্জে থাকেন মাজহারুল ইসলাম ও ইয়াসমিন আক্তার দম্পতি। মাজহারুল আসবাবের দোকানে রঙের কাজ করেন। গত সোমবার সন্ধ্যায় অন্তঃসত্ত্বা ইয়াসমিনের প্রসবব্যথা ওঠে। তাঁকে রাজধানীর ‘মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার এবং ১০০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশু হাসপাতালে’ ভর্তি করা হয়। রাত দেড়টার দিকে স্বাভাবিক প্রসবের মাধ্যমে তিনি সন্তানের জন্ম দেন। গতকাল মঙ্গলবার সকালে হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডে গিয়ে কথা হয় ইয়াসমিনের (২৫) সঙ্গে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত এই হাসপাতালে স্বাভাবিক প্রসবের সময়ে জরুরি ওষুধ ও সরঞ্জাম বিনা মূল্যে দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। সেটা পেয়েছেন কি না, জানতে চাইলে ইয়াসমিনের পাশে বসে থাকা তাঁর মা রাহিমা বলেন, কী কী লাগবে সেটা নার্স এসে জানানোর পর তাঁর জামাতা মাজহারুল স্যালাইন, ওষুধ, স্যানিটারি ন্যাপকিন ইত্যাদি বাইরে থেকে কিনে এনেছিলেন।
একই ওয়ার্ডে স্বাভাবিক প্রসবে সন্তান জন্ম দেওয়া মীম আক্তারের মা শাহিনূরও জানালেন তাঁরাও বাইরে থেকে ওষুধ-সরঞ্জাম কিনে এনেছিলেন।
হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বাভাবিক প্রসবের সময় ব্যবহার হওয়া বিনা মূল্যের ওষুধ ও সরঞ্জামের প্যাকেট ‘নরমাল ডেলিভারি কিট’ সরবরাহ এক বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে। মা ও শিশুস্বাস্থ্যের জন্য বিনা মূল্যের প্রয়োজনীয় ওষুধের প্যাকেট ‘ড্রাগ অ্যান্ড ডায়েটারি সাপ্লিমেন্ট (ডিডিএস) কিট’ সরবরাহও বন্ধ রয়েছে ছয় মাস ধরে।
জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক মো.
এক প্রশ্নের জবাবে ফায়জুর রহমান বলেন, ‘সরবরাহ বন্ধ থাকার প্রভাব তো পড়ছেই। রোগী কিছু কমেও গেছে। কারণ, তাঁরা ওষুধের জন্য আসেন। আমরা সেটা দিতে পারছি না।’
ফায়জুর রহমান জানান, গতকাল মঙ্গলবার হাসপাতালটিতে ৫টি স্বাভাবিক প্রসব ও ১৩টি অস্ত্রোপচারে সন্তান প্রসব (সিজারিয়ান বা সি সেকশন) হয়েছে। এপ্রিল মাসে ১৭১টি স্বাভাবিক প্রসব ও ২৭৮টি সি সেকশন হয়েছে।
মোহাম্মদপুরের শুধু এই হাসপাতালটিই নয়, সারা দেশে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর পরিচালিত হাসপাতালে প্রসব কিট ও ডিডিএস কিট সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় পণ্যাগার ও ২২টি আঞ্চলিক পণ্যাগারে এসব কিটের মজুত নেই। উপজেলা পর্যায়েও ডেলিভারি কিটের মজুত নেই, আর ডিডিএস কিটের মজুত নেই ৯৬ শতাংশ উপজেলায়। যে কর্মসূচির আওতায় এসব কিট কেনাকাটা করা হতো, তার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় ২০২৪ সালের শুরু থেকে এসব ওষুধ ও সরঞ্জামের সংকট দেখা দেয়। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়ে ওই কর্মসূচির অপারেশন প্ল্যান (ওপি) স্থগিত করে নতুন প্রকল্প নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে ৯ মাস ধরে মজুত কমতে কমতে শূন্যে নেমে আসে।
সারা দেশে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র রয়েছে ৩ হাজার ২৯১টি। মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র রয়েছে ২৮২টি, এর মধ্যে ইউনিয়ন পর্যায়ে পুরোনো ২৪ ও নতুন ১৫৯টি, উপজেলা পর্যায়ে ১২টি এবং জেলা পর্যায়ে ৬১টি। মোহাম্মদপুরের হাসপাতালটি ছাড়াও জাতীয় পর্যায়ে রাজধানীর আজিমপুরে ১৭৩ শয্যার ‘মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান’ এবং মিরপুরের লালকুঠিতে ‘২০০ শয্যাবিশিষ্ট মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য হাসপাতাল’ পরিচালিত হচ্ছে। কম খরচে সেবা ও বিনা মূল্যে ওষুধ পাওয়া যায় বলে এসব হাসপাতালে দরিদ্র পরিবারের মা ও শিশুরাই বেশি সেবা নিতে আসেন।
সেবার এই সংকটের মধ্যে আজ ২৮ মে দেশজুড়ে পালিত হচ্ছে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। এবার দিবসটি পালনে আলাদা কোনো প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়নি। ‘জন্ম হোক সুরক্ষিত, ভবিষ্যৎ হোক আলোকিত’ ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের এই প্রতিপাদ্য ধরেই দিবসটি পালন করা হচ্ছে।
কিটে যা থাকে, যত সরবরাহ হতোনরমাল ডেলিভারি কিটের একটি প্যাকেটে ১০টি স্বাভাবিক প্রসবের সরঞ্জাম ও ওষুধ থাকে। দেহে প্রবেশ করানোর স্যালাইন, ট্যাবলেট, ক্যাপসুল, ইনজেকশন, বাটারফ্লাই সুচ, একবার ব্যবহারযোগ্য সিরিঞ্জ, জীবাণুমুক্ত সার্জিক্যাল গ্লাভস, তুলা, জীবাণুমুক্ত গজ, সার্জিক্যাল টেপ, স্যানিটারি ন্যাপকিনসহ ১৭ ধরনের ওষুধ ও সামগ্রী থাকে একেকটি কিটে।
ডিডিএস কিটে থাকে ২৫ ধরনের ওষুধ। আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড, ক্যালসিয়াম উইথ ভিটামিন ডি, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, প্যারাসিটামল, অ্যান্টাসিড, জিংক সালফেট মনোহাইড্রেট, সিপ্রোফ্লক্সাসিনসহ ১৭ ধরনের ট্যাবলেট, ২ ধরনের ক্যাপসুল, ২ ধরনের গুঁড়া ওষুধ, ২ ধরনের তরল ওষুধ, মুখে খাওয়ার স্যালাইন ও মলম।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, হাসপাতালগুলোর মধ্যে ইউনিয়ন পর্যায়ের হাসপাতালে শুধু স্বাভাবিক প্রসব হয়। উপজেলা, জেলা ও ঢাকার হাসপাতালগুলোতে স্বাভাবিক প্রসবের পাশাপাশি সি সেকশনও হয়।
হাসপাতালগুলোতে চাহিদার তুলনায় এসব সরঞ্জাম সরবরাহ কমই দেওয়া হয়। বছরে ৮০ থেকে ৯০ হাজার ডিডিএস কিট এবং ২০ হাজারের মতো ডেলিভারি কিট সরবরাহ করা হয়।
মজুত যেভাবে শূন্য হলোজানা গেছে, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচির (এইচপিএনএসপি) আওতায় অন্যান্য কার্যক্রমের সঙ্গে ডেলিভারি কিট ও ডিডিএস কিট সরবরাহ কার্যক্রম পরিচালিত হতো। এই কার্যক্রম পরিচালনা হতো মাতৃ, শিশু, প্রজনন ও কৈশোর স্বাস্থ্য (এমসিআরএএইচ) শিরোনামের অপারেশন প্ল্যান বা ওপির মাধ্যমে। চতুর্থ এইচপিএনএসপির মেয়াদ ছিল ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের জুন মাস পর্যন্ত। এরপর ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত বরাদ্দ ছাড়া মেয়াদ বাড়িয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। কর্মসূচির যে উদ্বৃত্ত অর্থ ছিল, তা দিয়ে কেনাকাটা করে ওষুধ ও সরঞ্জাম সরবরাহ করা হতো। পরে প্রস্তাবিত পঞ্চম এইচপিএনএসপির আওতায় ২০২৫ থেকে ২০২৯ সাল পর্যন্ত কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সে লক্ষ্যে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভাও হয়েছিল। তবে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ওপি স্থগিত করে দেয় এবং ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত দুই বছর মেয়াদি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরির নির্দেশনা দেয়। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর সেই ডিপিপি তৈরি করে এই মাসে জমা দিয়েছে। নতুন প্রকল্প তৈরির এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যে ৯ মাস ধরে কেনাকাটা বন্ধ হয়ে মজুত–সংকট দেখা দিয়েছে।
একই ওপির মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা হতো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেও। ফলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও জরুরি ওষুধ ও সরঞ্জামের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তবে মজুত শূন্য হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপজেলা হেলথকেয়ার বিভাগের লাইন ডিরেক্টর মোহাম্মদ একরাম উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, নতুন ডিপিপি তৈরির এই সময়ে সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্মসূচি ছাড়াও বিভিন্ন উৎস থেকে সরবরাহ পেয়ে থাকে। তাই সেখানে মা ও শিশুস্বাস্থ্য এবং প্রসবের সব ওষুধের মজুত শূন্য নয়।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাপ্লাই চেন ম্যানেজমেন্ট পোর্টালের তথ্য অনুযায়ী, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ঢাকার কেন্দ্রীয় পণ্যাগার এবং ভোলা, ফরিদপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, পটুয়াখালী, বরিশাল, টাঙ্গাইল, দিনাজপুর, পাবনা, রাজশাহী, রংপুর, বান্দরবান, কুমিল্লা, নোয়াখালী, রাঙামাটি, সিলেট, যশোর, কুষ্টিয়া, কক্সবাজার, বগুড়া, চট্টগ্রাম ও খুলনা, মোট ২২টি আঞ্চলিক পণ্যাগারে স্বাভাবিক প্রসব কিট, ডিডিএস কিট, প্রসবের সরঞ্জামাদি সেট, বারবার ব্যবহারযোগ্য ক্লিনিক্যাল প্রসব সহায়ক সরঞ্জামাদি, ক্লিনিক্যাল প্রসব সহায়ক ওষুধ ও একবার ব্যবহারযোগ্য সরঞ্জামাদির মজুত শূন্য। একেকটি আঞ্চলিক পণ্যাগার থেকে কয়েকটি উপজেলায় পণ্য সরবরাহ করা হয়। ৪৯৪টি উপজেলায় নরমাল ডেলিভারি কিট বা স্বাভাবিক প্রসব কিটের মজুত শূন্য। আর ডিডিএস কিট নেই ৪৭৪টি উপজেলায়। সম্ভাব্য মজুতশূন্যতা ১৭টি উপজেলায়, ২টিতে মজুত কম এবং মাত্র একটি উপজেলায় মজুত সন্তোষজনক।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উপকরণ ও সরবরাহ বিভাগের পরিচালক মার্জিয়া হক প্রথম আলোকে বলেন, চতুর্থ এইচপিএনএসপির মেয়াদ শেষে কিছু সিদ্ধান্তগত জটিলতার কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কেনাকাটা করা যায়নি। ফলে কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক পণ্যাগারে এখন ডিডিএস কিট, স্বাভাবিক প্রসব কিটসহ অন্যান্য জরুরি ওষুধ ও সরঞ্জামের মজুত নেই। কোনো কোনো উপজেলায় অল্প পরিমাণে ডিডিএস কিট থাকলেও স্বাভাবিক প্রসব কিটের মজুত নেই। রাজস্ব খাত থেকে জরুরি ওষুধ ও সরঞ্জাম কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জুন মাসের মধ্যে সরবরাহ শুরু করা যাবে। ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ে নতুন ডিপিপি জমা দেওয়া হয়েছে। ডিপিপি অনুমোদন হলে প্রকল্পের মাধ্যমে সরবরাহ করা হবে।
জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, একটি কর্মসূচির মেয়াদ শেষের সময়ে এই ধরনের পরিস্থিতি হতে পারে, সেটা বিবেচনায় নিয়ে কেনাকাটা করার দরকার ছিল। সরকারি কর্মকর্তারা তা না করে হাত-পা গুটিয়ে বসে ছিলেন। তাঁদের সদিচ্ছার অভাব ছিল। এ নিয়ে তাঁদের জবাবদিহি করা উচিত। কারণ, এসব হাসপাতাল থেকে সাধারণত দরিদ্র মানুষেরা সেবা নেন, তাঁরা সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ব ভ ব ক প রসব ক ট স ব ভ ব ক প রসব র ক ট সরবর হ প রথম আল ক ড ড এস ক ট সরবর হ ব সরবর হ ক পর চ ল ত উপজ ল য় প রকল প ব যবহ র পর য য় কল য ণ ধরন র
এছাড়াও পড়ুন:
৭৭ মেট্রিক টন চাল তুলে নিয়েছেন ডিলার, উপকারভোগীরা জানেন ‘বরাদ্দ হয়নি’
মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলায় গত জুলাই মাসে ট্রেডিং করপোরেশন বাংলাদেশের (টিসিবি) উপকারভোগীদের জন্য ৭৭ দশমিক ৮ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছিল। প্রক্রিয়া অনুযায়ী উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে এ চাল খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির (ওএমএস) একজন ডিলার (পরিবেশক) তুলেও নেন। তবে ওই মাসে টিসিবির অন্য পণ্য পেলেও চাল পাননি বলে অভিযোগ করেছেন উপকারভোগীরা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মহম্মদপুরের ৮ ইউনিয়নে টিসিবির উপকারভোগী কার্ডধারী আছেন ১৫ হাজার ৫৬৭ জন। এসব উপকারভোগী নিজেদের কার্ড দেখিয়ে প্রতি মাসে একবার ইউনিয়নের টিসিবির নিয়োগ করা ডিলারের কাছ থেকে বাজারের চেয়ে কম মূল্যে তেল, চিনি, ডাল ও চাল কিনতে পারেন। গত জুলাইয়ে ডিলারদের কাছ থেকে তেল, চিনি ও ডালের একটি প্যাকেজ কিনতে পেরেছেন তাঁরা। ওই মাসে চালের বরাদ্দ আসেনি বলে জানানো হয় কার্ডধারীদের।
মহম্মদপুর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে পাওয়া নথিতে দেখা গেছে, গত ৩০ জুলাই উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. মজনুর রহমান স্বাক্ষরিত দুইটি বিলি আদেশে (ডিও) উপজেলার হোসেনিয়া কান্তা ঋতু নামে একজন ওএমএস ডিলারের অনুকূলে ৭৭ দশমিক ৮৩৫ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওই দিনই মহম্মদপুর ও বিনোদপুর খাদ্যগুদাম থেকে এ চাল তুলেও নেওয়া হয়।
সেখানে ৩০ টাকা কেজিতে চাল পাওয়া যায়। বাজার থেকে ওই চাল কিনতে কেজিতে প্রায় ৫০ টাকা লাগে। জুলাই মাসে চাল না পাওয়ায় কিছুটা কষ্টই হইছে।শরিফা, টিসিবির কার্ডধারী, রাজাপুর ইউনিয়নটিসিবি ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন টিসিবি উপকারভোগীদের চাল ছাড়া অন্য পণ্য সরাসরি তাঁদের নিয়োগ করা ডিলারদের কাছে সরবরাহ করে। চালের বরাদ্দ দেওয়া হয় খাদ্য বিভাগ থেকে। এ অনুযায়ী উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে প্রথমে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগ করা ওএমএস বা খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ডিলারদের অনুকূলে ২৬ টাকা কেজি দরে চাল বরাদ্দ দেয়। সেই চাল ওই ডিলারদের কাছ থেকে ২৮ টাকা কেজি দরে নেন টিসিবির ডিলাররা। এরপর তাঁরা ৩০ টাকা কেজি দরে ওই চাল উপকারভোগীদের কাছে বিক্রি করেন।
উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের পারুল নামে টিসিবির এক উপকারভোগী ১ সেপ্টেম্বর জানান, আগস্ট মাসে চাল, ডাল, তেল ও চিনির প্যাকেজ পেলেও জুলাই মাসে তাঁদের চাল ছাড়া অন্য তিন ধরনের পণ্যের প্যাকেজ দেওয়া হয়েছিল। জুলাই মাসে তাঁদের জানানো হয় চাল বরাদ্দ হয়নি।
বিষয়টি জানতে উপজেলার ৮ ইউনিয়নে টিসিবির নিয়োগ করা ৮ জন ডিলারের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তাঁদের মধ্যে মহম্মদপুর সদর, নহাটা, পলাশবাড়ীয়া, বালিদিয়া, রাজাপুর ও বাবুখালী ইউনিয়নের ডিলার জানিয়েছেন, জুলাই মাসে তাঁদেরকে চাল দেওয়া হয়নি। নহাটা ও রাজাপুর ইউনিয়নের ডিলার মিলন ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মিলন ঘোষ ৪ সেপ্টেম্বর বলেন, ‘জুলাই মাসে আমাদের বলা হইছিল চাল বরাদ্দ নেই। এ কারণে চাল ছাড়া অন্য পণ্যগুলো বিক্রি করেছি। তবে অ্যাপে দেখাইছিল চাল। কিন্তু আমরা পাইনি।’
হোসনিয়া কান্তা উপজেলার বিনোদপুর এলাকার ওএমএস ডিলার। গত ২৫ জুলাই লটারির মাধ্যমে তিনিসহ তিনজন উপজেলায় ওএমএস ডিলার হিসেবে নিয়োগ পানঅবশ্য বিনোদপুর ও দীঘা ইউনিয়নের দুই ডিলার দাবি করেছেন তাঁরা অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে চালও কার্ডধারীদের কাছে বিক্রি করেছেন। তবে দুই ইউনিয়নের অন্তত ১০ জন উপকারভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তাঁরা কেউই চাল পাননি। এর মধ্যে বিনোদপুর বাজারের একজন ফল ব্যাবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘জুলাই মাসে ডিলার জানাইছিল চাল ফুরায় গেছে।’
হোসনিয়া কান্তা উপজেলার বিনোদপুর এলাকার ওএমএস ডিলার। গত ২৫ জুলাই লটারির মাধ্যমে তিনিসহ তিনজন উপজেলায় ওএমএস ডিলার হিসেবে নিয়োগ পান বলে খাদ্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে। এ বিষয়ে জানতে হোসেনিয়া কান্তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও পাওয়া যায়নি। উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে সরবরাহ করা তাঁর মুঠোফোনে সোমবার যোগাযোগ করা হলে একজন ধরে জানান, ওই নম্বর হোসেনিয়া কান্তা ঋতু নামে কেউ ব্যবহার করেন না।
জানতে চাইলে টিসিবির ঝিনাইদহ ক্যাম্প অফিসের উপপরিচালক আকরাম হোসেন সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিসিবির চাল খাদ্য বিভাগ থেকে সরবরাহ করা হয়। আর বিতরণ কার্যক্রম তদারকির জন্য প্রতিটি উপজেলায় নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি কমিটি রয়েছে। যেখানে প্রতি ইউনিয়নে একজন ট্যাগ অফিসার আছেন, যিনি এগুলো তদারকি করেন।’
জেলার কয়েকজন চাল ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২৬ টাকা কেজি দরে কেনা এসব চাল বাজারে প্রায় ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। উপকারভোগীদের কাছে তা ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করার কথা। এ হিসাবে উপকারভোগীদের ফাঁকি দিয়ে এ চাল বাজারে বিক্রি করতে পারলে কেজিতে ২২ থেকে ২৪ টাকা লাভ হয়।
চাল না পাওয়ার বিষয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করেননি বলে জানিয়েছেন মহম্মদপুরের ইউএনও শাহীনুর আক্তার। সোমবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাল দেওয়া হয়নি এখন পর্যন্ত এমন অভিযোগ কেউ দেয়নি। খাদ্য অফিস থেকে আমি যত দূর জানতে পেরেছি তাতে সবকিছু দেওয়া হয়ে গেছে। বরাদ্দ থাকলে তা আটকে রাখার সুযোগ নেই। তারপরও কোনো অভিযোগ থাকলে খতিয়ে দেখব।’
হঠাৎ এক মাসে চাল না পাওয়ায় বিপাকে পড়েন উপকারভোগীরা। রাজাপুর ইউনিয়নের শরিফা নামের টিসিবি কার্ডধারী এক নারী বলেন, ‘সেখানে ৩০ টাকা কেজিতে চাল পাওয়া যায়। বাজার থেকে ওই চাল কিনতে কেজিতে প্রায় ৫০ টাকা লাগে। জুলাই মাসে চাল না পাওয়ায় কিছুটা কষ্টই হইছে।’