ঘনকালো মেঘে ঢাকা আকাশ। বৃষ্টি কখনও নামছে ঝুমঝুমিয়ে, কখনও গুঁড়িগুঁড়ি। এরই মধ্যে বিরামহীন বয়ে চলছিল দমকা হাওয়া। তবে এসব কিছুই বাধা হতে পারেনি হাজারো মানুষের জন্য। পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টে লাল-সবুজের পতাকা ওড়ানো ইকরামুল হাসান শাকিলের জন্মভিটায় ফেরার সংবাদে তারা ভিড় করেন। 
গতকাল শনিবার দুপুরে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার ফুলবাড়িয়া ইউনিয়নের বাগচালা গ্রামে দেখা যায় এ দৃশ্য। আশপাশের সব গ্রামের মানুষের গন্তব্য ছিল শাকিলের বাড়ির দিকে। তাদের কারও হাতে তাজা ফুলের তোড়া, কারও হাতে মালা। কেউ আবার নিয়ে এসেছিলেন নানা জাতের মৌসুমি ফল। অগণিত মানুষের সঙ্গে জ্যৈষ্ঠের প্রকৃতিও যেন ছুটে এসেছিল শাকিলকে স্বাগত জানাতে। মানুষের এই ভালোবাসার সামনে এভারেস্ট জয়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে আপ্লুত হয়ে ওঠেন তিনি। 
ইকরামুল হাসান শাকিল বলেন, ‘এভারেস্টের চূড়ায় দাঁড়িয়ে লাল-সবুজের পাতাকা হাতে নিয়ে আমি কেঁদেছি। এই কান্না ছিল কৃতজ্ঞতার, আনন্দের আর দায়িত্ববোধের। এই পথ সহজ ছিল না।’
বাগচালা গ্রামের প্রয়াত খবির উদ্দিন ও শিরিন আক্তার দম্পতির তিন ছেলে। সবার বড় ইকরামুল হাসান শাকিলকে বিদ্যালয়জীবনেই আকর্ষণ করে কবিতাচর্চা। পরবর্তী সময়ে পাহাড়-পর্বতের চূড়া ছোঁয়ার নেশায় পেয়ে বসে তাঁকে। ভারতের নেহেরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিংয়ে পর্বতারোহণের প্রাথমিক ও উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন। পরে আরোহণ করেছেন গ্রেট হিমালয়, ৬ হাজার ১৮৬ মিটার উঁচুর মাউন্ট কায়াজো রি পর্বত, ৭ হাজার ১২৭ মিটার উঁচু হিমলুং, ৬ হাজার ৩৩২ মিটারের দোলমা খাংসহ বেশ কিছু পর্বত। 
তবে এভারেস্টের শীর্ষ ছোঁয়ার আগে তাঁকে পাড়ি দিতে হয় দুর্গম পথ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তাঁর এই যাত্রা শুরু হয় গত ২৫ ফেব্রুয়ারি। এদিন দুপুরে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের ইনানী থেকে হাঁটতে শুরু করেন। হেঁটে ৮৪ দিনে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছান গত ১৯ মে নেপালের স্থানীয় সময় সকাল ৬টা ৩০ মিনিটে। সেখান থেকে শাকিল দেশে ফিরেছেন বৃহস্পতিবার বিকেলে। ঢাকায় দু’দিন বিশ্রামের পর শনিবার সকালে জন্মভিটায় ছুটে যান।
ঢাকা থেকে মাওনা চৌরাস্তা, ফুলবাড়িয়া রোড হয়ে শালদহ সেতু পেরিয়ে বাগচালা গ্রামের ভিটায় পৌঁছান। শুরুতেই মা শিরিন আক্তারকে জড়িয়ে ধরেন। এ সময় বৃষ্টির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চারদিক ফুলের বৃষ্টিতে তাঁকে স্বাগত জানায় এলাকাবাসী। এ অনুভূতি বর্ণনা করতে গিয়ে শাকিল সমকালকে বলেন, ‘গ্রামের মানুষ আমাকে বিরল ভালোবাসা দিয়েছে। আমাকে আপ্লুত করেছে। আমাকে ঋণী করে ফেলেছে। আমাকে দায়বদ্ধ করে ফেলেছে। কৃতজ্ঞতা জানানো ছাড়া আমার আর কিছুই দেওয়ার নেই। বাবা বেঁচে থাকলে আজকে অনেক খুশি হতেন। তাঁকে খুব মিস করছি।’
এভারেস্ট অভিযানের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শাকিল বলেন, ‘হিমালয়ের অতল গভীর বরফের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে আমাদের জীবনবিন্দু। প্রতিটি পদক্ষেপে মৃত্যু আর জীবনের মাঝখানে এক সূক্ষ্ম ভারসাম্য ছিল। যমুনা নদীর উত্তাল খরস্রোতা ঢেউ, অনিশ্চয়তার দীর্ঘ পথ, খুম্বু আইসফল, লোৎসে ফেস, সাউথ কল, হিলারি স্টেপ– একেকটা জায়গা যেন একেকটা মানসিক যুদ্ধক্ষেত্র ও মৃত্যুর চোখ রাঙানি।’
অক্সিজেনশূন্য উচ্চতা উঠে কৃত্রিম অক্সিজেনের মাস্ক মুখে তাঁর প্রতিবারই মনে হয়েছে, ‘আর পেরে উঠবো না।’ কিন্তু হৃদয়ে বাজতে থাকা বাংলাদেশের নাম আর ‘সি টু সামিট’ অভিযানের অঙ্গীকার তাঁকে এগিয়ে যেতে প্রেরণা জুগিয়েছে। শাকিল বলেন, ‘আমি তখন দাঁড়িয়ে পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিন্দুতে। মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায়। মাথার ওপরে বিশুদ্ধ নীল আকাশ থাকার কথা ছিল, কিন্তু প্রকৃতি সেটা চায়নি। চেয়েছিল চরম পরীক্ষা। পায়ের নিচে ছিল অসীম শূন্যতা। ৮৮৪৮.

৮৬ মিটার ওপরে দাঁড়িয়ে আমি শুধু একজন পর্বতারোহী নই– আমি তখন হাজারো আবেগ, ত্যাগ, সংগ্রাম আর স্বপ্নের প্রতিনিধি।’

উৎস: Samakal

এছাড়াও পড়ুন:

এক দিনের ঘোরাঘুরিতে কাপ্তাই

ভ্যাপসা গরম। কখনও আচমকা বৃষ্টি। হুট করেই বয়ে যায় দমকা হাওয়া। কখনও আবার লাল টকটকে লিচু ঝুলে থাকা গাছের ছায়ায় জিরানো। দিগন্ত বিস্তৃত নীলাভ জল, পৌরাণিক কাহিনিসমৃদ্ধ নদীর ধার, সারি সারি পাম গাছের ফাঁক গলে হেঁটে যাওয়া, সড়কপথের কলিজা কাঁপানো বাঁক– এসব মিলিয়ে স্বল্প সময়ে ঘুরে আসার মতো এক স্থান প্রকৃতিকন্যা কাপ্তাই। 
তারিখটা ছিল ৩০ এপ্রিল। পরপর তিন দিন ছুটি। ছুটি মানে ভ্রমণে বের হওয়ার জন্য মন থাকে পাগলপারা। রাত ১১টায় বাস। দে-ছুট ভ্রমণসংঘের সঙ্গী সবাই বাস কাউন্টারে। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে ১০টা ছুঁইছুঁই করলেও আমার তখনও যাওয়া হয়নি। পরদিন ১ মে শ্রমিক দিবসে অনুষ্ঠান ছিল। পরে নানা ঝুট-ঝামেলা পেরিয়ে শেষ মুহূর্তে জনপথ মোড়ে পৌঁছাই। প্রচণ্ড জ্যামের কারণে বাস একটু দেরিতে ছাড়ল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে সিটে বসলাম বেশ আয়েশ করে। ভোরে পৌঁছাই কাপ্তাই। বন্ধু রতনের কল্যাণে সরকারি এক বিশ্রামাগারে আগেভাগে রুম ঠিক করা ছিল। রুমে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় গেলাম আসাম বস্তির দিকে। যেতে যেতে বাঙাল হালিয়া পাহাড়ি বাজারে ব্রেক। কর্ণফুলী নদী ও কাপ্তাই লেকের মাছ আর ফলের পসরা মেলে রেখেছেন পাহাড়িরা। টক-মিষ্টি লিচুর স্বাদ নিই। পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ি হাটবাজারের ভিন্নমাত্রার বৈশিষ্ট্য থাকে, যা ভ্রমণপিপাসুকে বেশ আকৃষ্ট করে। তরতাজা মাছ কেনার ইচ্ছা দমিয়ে ছুটলাম মূল গন্তব্যে। পাহাড়ের বুক চিরে এঁকেবেঁকে চলা সড়ক। উঁচু-নিচু, ঢালু। এক পাশে পাহাড়, অন্য পাশে কাপ্তাই লেকের নীলাভ জলরাশি। বয়ে চলা পানির বুকে ছোট্ট করে মাথা জাগিয়ে রাখা মাটি। সেই মাটি ভেদ করে শিরদাঁড়া উঁচু করে রয়েছে বৃক্ষরাজি। চমৎকার সব প্রাকৃতিক দৃশ্য। এমন নৈসর্গিক পরিবেশে মুগ্ধ নয়নে যেতে যেতে হঠাৎ লাল টসটসে লিচু বাগান দেখে চোখ আটকায়। গাড়ি থামিয়ে চলল ফটোশুট। কোথাও কোথাও পথের ধারে কৃত্রিম ও প্রকৃতির সম্মিলনে পর্যটকদের জন্য সাজগোজ করে রাখা হয়েছে নানা স্থাপনা। কোথাওবা সড়কের পাশে কংক্রিটের বেঞ্চ। তবে কাঠ-বাঁশের হলে প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে যেত বেশ। ব্রিজ পর্যন্ত যেতে আরও কয়েকবার থেমেছি। পথের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য আমাদের থামতে বাধ্য করেছে। জুমের কলা, পেঁপে, আনারসের ছিল সেই স্বাদ। যেতে যেতে কাঙ্ক্ষিত ব্রিজ। সত্যিই অসাধারণ সৌন্দর্যে ঘেরা সর্পিল আসাম বস্তি ব্রিজ। মাথার ওপরে নীল আসমান। ডানে-বামে কাপ্তাই লেকের টলটলে পানি। সামনে তাকালে এঁকেবেঁকে যাওয়া ব্রিজটি চলে গেছে বহুদূর। তপ্ত রোদেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিমুগ্ধ নয়নে ব্রিজের রেলিং ধরে তাকিয়ে থাকা যাবে লেকের জলে। ১৯৫৬ সালে কর্ণফুলী নদীর ওপর কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এটি একটি কৃত্রিম হ্রদ। বর্তমানে এই হ্রদ দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে অন্যতম দর্শনীয় স্থান। অথচ এর পেছনের ইতিহাস অত্যন্ত করুণ। বাঁধটি নির্মাণের সময় রাঙামাটি জেলার প্রায় ৫৪ হাজার একর কৃষিজমি পানিতে ডুবে সৃষ্টি হয় হ্রদ। বাদ যায়নি রাঙামাটির রাজবাড়িটিও। এক রাতের মধ্যে বহু বসতবাড়ি পানির তোড়ে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। সব সুন্দরের পেছনের ইতিহাস হয়তো অনেকটা এ রকমই হয়ে থাকে। বর্তমানে কাপ্তাই হ্রদ দেশের সবচেয়ে বড় মানবসৃষ্ট হ্রদ। এর গভীরতা ১০০ ফুট থেকে কোথাও কোথাও প্রায় ১৭৫ ফুট পর্যন্ত। সবুজের সঙ্গে মিতালি করা কাপ্তাই লেকের আয়তন ৪ হাজার ২৯৪ বর্গমাইল। এই লেকের মাছ বেশ সুস্বাদু। রাঙামাটির স্থানীয় বাসিন্দাসহ ভ্রমণে যাওয়া পর্যটকদের রসনা মেটানোর পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ হয়ে থাকে এ মাছ। বিশেষ করে, রুই ও চাপিলা মাছের জুড়ি মেলা ভার। 
বেশ মজা করে দুপুরের খাবার সারলাম এক রেস্তোরাঁয়। এরপর নামমাত্র বিশ্রাম নিয়ে ছুটলাম শীলছড়ির পথে। কাপ্তাই বাজার থেকে সড়কের রোমাঞ্চকর বাঁকগুলো পেরিয়ে ২৫ মিনিটে হাজির হলাম কর্ণফুলী নদীর তীরে লুসাই পাহাড়ের সন্নিকটে, শীলছড়ি ৩৫ আনসার ব্যাটালিয়ন ক্যাম্পের মূল ফটকে। এক বন্ধু সেখানকার কর্মকর্তা। সে এসে অভ্যর্থনা জানায়। এতে যারপরনাই আন্দোলিত হই। গেস্টরুমে গিয়ে তাঁর সঙ্গে ক্যাম্পাসের সোনালি অতীতের স্মৃতিচারণ চলে। এরই মধ্যে মৌসুমি নানা ফল আর শরবতের গ্লাস দিয়ে ডাইনিং সয়লাব। এত কিছু খেতে গেলে সুন্দর বিকেলটাই হারিয়ে যাবে। সেই ভয়ে সেলিমকে তাড়া দিতে আমাদের নিয়ে গেল কর্ণফুলীর কূলে। জায়গাটা এত বেশি নয়নাভিরাম ও পরিচ্ছন্ন, প্রথম দেখাতে মনে হবে না যে এটি আমাদের দেশ। সারি সারি পাম গাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। দৃষ্টিসীমায় মাথা উঁচু করা লুসাই পাহাড়। সবুজের গালিচা দিয়ে মোড়ানো। সেই পাহাড়ে বসবাস করে নানা আদিবাসী গোষ্ঠী। পাহাড়ি নদীর বয়ে চলা পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, ঝিরঝির বাতাসের দোল, জুম ঘরের আদলে তৈরি ছাউনিতে বসে চায়ের আড্ডা– সব মিলিয়ে সুন্দর একটি বিকেলের সাক্ষী হলাম। সময়ের পরিক্রমায় লাল টকটকে সূর্যটা লুসাইর বুকে থাকা গহিন অরণ্যে হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে আমরাও ওই দিনের স্মরণীয় ভ্রমণের ইতি টেনে বিশ্রামাগারে ফিরি। চাইলে কেউ এক দিন ঘোরাঘুরি করে রাতের বাসে ঢাকায় ফিরতে পারেন। ঈদের ছুটিতেও কাপ্তাইয়ে হতে পারে দু-এক দিনের একটি ভ্রমণ।
আমরা পরদিন সকালে গিয়েছিলাম কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে। পরিচিত একজনের মাধ্যমে প্রবেশের অনুমতি মেলে। চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশ। হাঁটতে হাঁটতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সামনে এসে হাজির। পাশাপাশি দুটো ভবন। স্কুলটির প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৫৪ সাল। এর পুরোনা ভবনে আশির দশকে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘ছুটির ঘণ্টা’ ছবির শুটিং হয়েছিল। ভ্রমণ বিনোদনের পাশাপাশি শিক্ষা লাভেরও একটি বড় মাধ্যম। পুরো পৃথিবীই একটি আদর্শ বই, যা ভ্রমণের দ্বারা পাঠ করা সম্ভব। v
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • এবার জিন্দা পার্কে কৃষকের ঈদ আনন্দ
  • আশির দশকের বিনোদন
  • দিনে মুরগির খোপে, রাতে ঘরে
  • এভারেস্ট চূড়ায় লাল-সবুজ পাতাকা হাতে কেঁদেছি: শাকিল
  • তামাকে শুধু ক্যানসার নয়, ধোঁয়ায় কিডনিও নষ্ট হয়
  • এক দিনের ঘোরাঘুরিতে কাপ্তাই