তামাকে শুধু ক্যানসার নয়, ধোঁয়ায় কিডনিও নষ্ট হয়
Published: 31st, May 2025 GMT
তামাক এখন আর অভ্যাস নয়, এটি মারাত্মক নীরব ঘাতক। যা ধীরে ধীরে গ্রাস করছে আমাদের শরীর, সমাজ এবং ভবিষ্যৎ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরেই তামাককে হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যানসার কিংবা শ্বাসতন্ত্রের অসুখের জন্য দায়ী করে আসছেন। তবে সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা বলছে, তামাকজনিত ধোঁয়া কিডনির জন্যও ক্ষতিকর।
এ বছর বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের প্রতিপাদ্য ‘তামাক কোম্পানির কূটকৌশল উন্মোচন করি, তামাক ও নিকোটিনমুক্ত বাংলাদেশ গড়ি’—এ যেন সময়োপযোগী এক জাগরণ।
তামাক কোম্পানির ছলচাতুরি
জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল (এনটিসিসি) সূত্রে জানা যায়, ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসকে কেন্দ্র করে দেশের ৬৪টি জেলায় র্যালি, সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন, আলোচনা সভা, গণমাধ্যম প্রচারণা ও স্কুল-কলেজে পোস্টার প্রদর্শনীসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্যখাতের বিশেষজ্ঞদের মতে, তামাক কোম্পানিগুলো বিভিন্ন পদ্ধতিতে নতুন প্রজন্মকে আসক্ত করছে। কখনও ফ্লেভার্ড ই-সিগারেট, কখনও রঙিন মোড়কে বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপন, আবার কখনও কর ফাঁকির ফাঁদ। সব কিছুই এক সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবসায়িক পরিকল্পনার অংশ।
জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা.
বাংলাদেশের চিত্র
গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোবাকো সার্ভে (জিএটিএস) ২০১৭ অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৫.৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করেন। এর মধ্যে ধূমপায়ী প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ। বাকিরা ধোঁয়াবিহীন তামাক যেমন জর্দা, গুল বা খয়ের ব্যবহার করেন। প্রতি বছর তামাকজনিত রোগে মারা যান প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ। এ ছাড়া আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা, যা সরাসরি স্বাস্থ্যখাতে বোঝা হয়ে পড়ে।
ধূমপান কিডনির জন্যও নীরব ঘাতক
ধূমপান যে শুধু ফুসফুসের জন্য ক্ষতিকর তা বহুদিনের জানা। তবে সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, এই ধোঁয়া ধীরে ধীরে নষ্ট করছে কিডনির স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা। ব্রিটেনের কিডনি রিসার্চ সংস্থা ‘কিডনি রিসার্চ ইউকে’ এক প্রতিবেদনে জানায়, ধূমপান কিডনির রক্তনালীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত করে, রক্তচাপ বাড়ায় এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ সৃষ্টি করে। এসবের সম্মিলিত প্রভাবে কিডনি ফেইলিওরের মতো মারাত্মক অবস্থা তৈরি হতে পারে।
ন্যাচার নামক আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত ধূমপানকারীদের কিডনির কার্যক্ষমতা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়। যাদের ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকির মাত্রা বহুগুণ বেড়ে যায়। গবেষণা বলছে, ধূমপান কিডনির জন্য নীরব ঘাতক। রোগীরা বুঝতেই পারেন না, কীভাবে কিডনি নষ্ট হচ্ছে। তবে আশার খবর হলো, ধূমপান বন্ধ করলে কিডনি কোষগুলো পুনরায় সচল হয়ে উঠতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা সংস্থা ডা. ভিটার তথ্যমতে, ধূমপান ছাড়ার এক বছরের মধ্যেই রক্তচাপ স্বাভাবিক হতে শুরু করে এবং কিডনিতে রক্তপ্রবাহ বাড়ে।
আইন, বাস্তবতা ও নাগরিক দায়িত্ব
জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের প্রধান সমন্বয়কারী ডা. সৈয়দ মাহফুজুল হক বলেন, ‘‘তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের কাজ প্রায় শেষ। এতে পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ, তামাক পণ্যের প্রদর্শন নিষিদ্ধ এবং কর কাঠামো আরও শক্তিশালী করার বিধান রাখা হয়েছে।’’
তবে বাস্তবতা বলছে, আইন যতই কঠিন হোক, বাস্তবায়নে রয়েছে দুর্বলতা। স্থানীয় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা, রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি এবং তামাক কোম্পানির প্রভাব বলয়ের কারণে এই মহৎ উদ্যোগ অনেক সময় বাধাগ্রস্ত হয়।
স্বাস্থ্য আন্দোলনের সদস্য ডা. রাশেদা বেগম বলেন, ‘‘যে শিশুটি আজ ই-সিগারেট নিচ্ছে, সেই ভবিষ্যতে ক্যানসার রোগী হবে। এটা শুধু স্বাস্থ্য নয়, সামাজিক ও নৈতিক সংকট।’’
ঢাকা/এএএম//
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ক ডন র র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
ঢাকা কি কখনও আর পাল্টাবে না
অন্তর্বর্তী সরকার চাইলেই যে খাতটিতে সংস্কার আনতে পারত, তার মধ্যে এগিয়ে থাকবে সড়ক পরিবহন। জুলাই অভ্যুত্থান যে ছাত্রদের হাত ধরে সূচনা হয়েছিল এবং কোটা সংস্কার আন্দোলনকে যাঁরা ধাপে ধাপে গণ–অভ্যুত্থানের দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের বড় একটা অংশ ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে মার খাওয়া প্রজন্ম। ঢাকায় দুই বাসের রেষারেষিতে একাদশ শ্রেণির দুই শিক্ষার্থীর প্রাণহানির ঘটনায় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা দেশজুড়ে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, সেটা ছিল নজিরবিহীন। ২০১৮ সালে সত্যি সত্যি এ দেশের বুকে আঠারো নেমে এসেছিল।
কিন্তু শিশু-কিশোরদের সেই আন্দোলনকে ছাত্রলীগ, যুবলীগের পেটোয়া হেলমেট বাহিনী আর পুলিশ দিয়ে যেভাবে নির্মমভাবে পিটিয়ে দমন করেছিল হাসিনা সরকার, সেটাও ছিল নজিরবিহীন। সেটা ছিল নিজ দেশের শিশু–কিশোরদের বিরুদ্ধে দমনে শক্তিশালী হয়ে ওঠা একটি রাষ্ট্রের যথেচ্ছ বলপ্রয়োগের দৃষ্টান্ত। ঠিক ছয় বছর পর ২০২৪ সালে এসে সব শ্রেণির জনতার অংশগ্রহণে রাষ্ট্রের সেই শক্তিশালী দামনযন্ত্রটিকে রুখে দিয়ে ইতিহাসের চাকাটি পাল্টে দিয়েছিল সেদিনের সেই কিশোর থেকে সদ্য তরুণ হয়ে ওঠা প্রজন্মটি।
আওয়ামী লীগ সরকার সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কোনো কাজ করেনি। তার কারণ পুরোপুরি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক। কর্তৃত্ববাদী শাসনের সঙ্গে যে স্বজনতোষী অর্থনীতি তারা গড়ে তুলেছিল, তার প্রধান একটা জায়গা ছিল যোগাযোগ অবকাঠামো খাত। বাজেটে এ খাতেই সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয়েছে, একের পর এক মেগা প্রকল্প হয়েছে। তাতে ক্ষমতার একেবারে প্রথম বৃত্তে থাকা লোকদের সম্পদ বেড়েছে আলাদিনের চেরাগের মতো। সেই সম্পদের একটা বড় অংশই পাচার হয়ে গেছে।
এ বাস্তবতার বিপরীতে চরম দুর্নীতিনির্ভর পরিবহন খাত বর্গা দেওয়া হয়েছে দলীয় মাফিয়া ও মাস্তানদের হাতে। বলা চলে, সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক দুর্বৃত্তকে পুনর্বাসন করা হয়েছিল এ খাতেই। ফলে সড়কে নৈরাজ্য আর অরাজকতার যে বিষচক্র তৈরি হয়েছে, তার নিষ্ঠুর বলি হতে হয়েছে নাগরিকদের।
ফলে সবাই আশা করেছিলেন, অভ্যুত্থানের পর সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে। ঢাকার মানুষেরা একটা সুশৃঙ্খল বাসব্যবস্থা পাবে। অভ্যুত্থানের পর প্রথম কয়েক দিন যখন পুলিশ ছিল না, তখন ছাত্ররাই ঢাকার সড়কগুলোতে শৃঙ্খলার নজির তৈরি করেছিলেন। বাসসহ অন্য যানবাহগুলো লেন মেনে চলাচল করতে শুরু করেছিল। সবার মধ্যেই আইন মানার একটি আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু কেন জানি শিক্ষার মতো পরিবহন খাত সংস্কারে সরকারের উদ্যোগ নিতে অনীহা দেখা গেল।
অন্তর্বর্তী সরকার বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পের আওতায় ঢাকায় বৈদ্যুতিক বাস সেবা চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঢাকার বায়ুদূষণ ও পরিবেশের কথা মাথায় রেখে এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। সুইডেন থেকে চড়া দামে নিয়ে আসা বিআরটিসির ভলভো বাস পরিণতি কি হয়েছিল সেটা আমরা সবাই জানি। ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থার গোষ্ঠীস্বার্থের তৈরি করা রাজনৈতিক–অর্থনীতির জাল কাটতে না পারলে যত আধুনিক বাস আনা যাক না কেন, সেটা টেকসই হবে কি?এ সুযোগে ঢাকার পরিবহনব্যবস্থায় সুনামির মতো ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা যুক্ত হলো। গত কয়েক বছরে বিশেষ করে গত এক বছরে কর্মসংস্থানে যে ভাটার টান, নিঃসন্দেহে সেই বাস্তবতা পরিস্থিতিকে উসকে দিয়েছে। কিন্তু সড়ক পরিবহনব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা যায়, এমন কোনো পরিকল্পনা না থাকার কারণে এমন বিশৃঙ্খলার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ।
সব মিলিয়ে ঢাকার সড়ক গত এক বছরে আরও বেশি নৈরাজ্যিক আর বিশৃঙ্খল হয়ে উঠেছে। সারা দেশে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে। মোটরসাইকেল ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা গণপরিবহনের বিকল্প হয়ে ওঠায় হতাহতের সংখ্যা কমানো যাচ্ছে না। ঢাকার সড়কগুলো দাবড়ে বেড়াচ্ছে, সেই একই রংচটা ও লক্কড়ঝক্কড় বাস, নোংরা সিট ও শ্বাস বন্ধ করে দেওয় কালো ধোঁয়া আর কানে তালা লাগা হাইড্রোলিক হর্ন। রেষারেষি, দুর্ঘটনা, যাত্রীদের সঙ্গে বচসা, মারামারি—পুরোনো সেই সবই চলছে দিব্যি।
ট্রাফিক পুলিশের অবর্তমানে শিক্ষার্থীরা যখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে সড়কে শৃঙ্খলার কাজে নেমেছিলেন, তখন ঢাকার সড়কে শৃঙ্খলা ও আইন মেনে চলার একটা চিত্র আমরা দেখতে পেয়েছিলাম। ২০১৮ সালের সড়ক আন্দোলনের সময়ও শিশু-কিশোরেরা সৃজনশীল সব পথ বের করে দেখিয়ে দিয়েছিল, সড়কে কীভাবে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা যায়, আর আইন যিনিই ভঙ্গ করেন, তাঁকে কীভাবে জবাবদিহি করা যায়। কিন্তু ছাত্রদের আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রাফিক সহায়তাকারী হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার পর সেই স্বতঃস্ফূর্ততা আর বেশি দিন চোখে পড়েনি। বরং তাঁদের পুরোনো ট্রাফিক ব্যবস্থার অংশ করে তোলা হয়েছে।
সবচেয়ে বড় কথা, গোটা পরিবহন খাতে রাজনৈতিক আঁচড় এক বড় গণ–অভ্যুত্থানের পরও এক দিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। শুধু পুরোনো মুখের জায়গায় নতুন মুখ এসেছে। আওয়ামী লীগের জায়গায় এসেছে বিএনপি। আমাদের প্রথাগত ও বড় রাজনৈতিক দলগুলোর বিপুলসংখ্যক নেতা–কর্মীর পুনর্বাসন ও আয়ের জায়গা এটি। সেই কায়েমি স্বার্থের কারণে রাজনৈতিক সরকারের আমলে এ খাতে কাঠামোগত সংস্কার করা খুবই কঠিন।
অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে সেই সুযোগ ছিল। বাসকে কেন্দ্রে রেখে একটা সুশৃঙ্খল গণপরিবহনব্যবস্থা গড়ে তোলা এমন কী কঠিন কোনো কাজ ছিল! চাইলে যে করা যায়, সেটা আমরা গত কয়েক মাসে ঢাকার ভাঙাচোরা ও হাঁটার জন্য অযোগ্য অনেকগুলো ফুটপাতের চিরচেনা চেহারা যেভাবে বদলে যাচ্ছে, সেই উদাহরণ দিতে পারি। যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল গত ১৫ মে দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত এক কলামে দেখিয়েছেন, একটি ডেডিকেটেড সিটি বাস সার্ভিস কীভাবে ঢাকার চেহারা বদলে দিতে পারে। তিনি মনে করেন, ঢাকায় দুই হাজার নতুন বাস নামানো গেলেই সেটা সম্ভব।
বুয়েটের বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান গত বছরের অক্টোবরে বলেছিলেন, মাত্র ছয় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা গেলেই ঢাকার গণপরিবহনব্যবস্থার খোলনলচে বদলে দেওয়া সম্ভব। একই ছাতার নিচে একটা সিটি বাস সার্ভিস চালু করতে হবে, যেখানে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকবে।
অন্তর্বর্তী সরকার বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পের আওতায় ঢাকায় বৈদ্যুতিক বাস সেবা চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঢাকার বায়ুদূষণ ও পরিবেশের কথা মাথায় রেখে এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। সুইডেন থেকে চড়া দামে নিয়ে আসা বিআরটিসির ভলভো বাস পরিণতি কি হয়েছিল সেটা আমরা সবাই জানি। ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থার গোষ্ঠীস্বার্থের তৈরি করা রাজনৈতিক–অর্থনীতির জাল কাটতে না পারলে যত আধুনিক বাস আনা যাক না কেন, সেটা টেকসই হবে কি?
মনোজ দে, প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী