হজ শারীরিক, আর্থিক ও আত্মিক ইবাদত। হজে রয়েছে সামাজিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা, যা জীবনব্যাপী প্রতিফলিত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সুবিদিত মাসসমূহে হজব্রত সম্পাদিত হয়। অতঃপর যে কেউ এই মাসগুলোতে হজ করা স্থির করে, তার জন্য অশ্লীলতা, কুৎসা, অন্যায় আচরণ, ঝগড়া ও কলহ-বিবাদ বিধেয় নয়।’ (সুরা-২ বাকারা; আয়াত: ১৯৭) 

অনেকে সঠিকভাবে হজ সম্পন্ন করতে পারেন না। হজ করে এলেও অনেকে জীবনব্যাপী হজের শিক্ষা ধারণ ও পালন করতে পারেন না। 

হজ প্রকৃত অর্থে মানবতার প্রশিক্ষণ। হজ শেখায় পৃথিবীর সব মানুষ একই পিতা-মাতার সন্তান। মানুষে মানুষে কোনো ধরনের ভেদাভেদ নেই, সাদা-কালোয় কোনো প্রভেদ নেই। জিলহজ মাসের ৭ তারিখে সব হাজি মিনার তাঁবুতে গণবিছানায় গিয়ে একাত্মতার ঘোষণা দেন। 

৯ জিলহজ হাজিরা আরাফাতের ময়দানে গিয়ে ঐক্যের অনন্য দৃষ্টান্ত তৈরি করেন; মিলিত হন আন্তর্জাতিক মহাসম্মেলনে। এদিন সন্ধ্যায় (জিলহজের ১০ তারিখ রাতে) হাজিরা মুজদালিফায় গিয়ে সব কৃত্রিমতার অবসানের মাধ্যমে মানবতার পূর্ণতা ও আদি আসল প্রকৃত মানব রূপ প্রকাশ করেন। সবার পরনে একই সাদা কাপড়। পোশাকে বাহুল্য নেই, খোলা মাথা-পাগড়ি টুপি ও বাহারি চুলের আড়ম্বর নেই; সঙ্গে চাকর-কর্মচারী নেই, নিজের শক্তি-সামর্থ্য ও জ্ঞান-গরিমার প্রকাশ নেই, বুদ্ধিবিবেচনা ও কৌশল প্রয়োগের সুযোগ নেই; শুধুই আল্লাহর ওপর ভরসা। 

হজে প্রতীকীভাবে শয়তানকে পাথর মারা হয়। হজের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো কোরবানি। কোরবানির মূল প্রতিপাদ্য হলো রবের জন্য অন্য সবকিছু বিসর্জন দেওয়া। পশু কোরবানি একটি প্রতীকমাত্র। মনের মধ্যে যে পশুবৃত্তি বিদ্যমান, তাকে পরাভূত ও পরাজিত করাই হলো পশু জবাই বা পশু কোরবানির মূল শিক্ষা। 

হজে ভাষা, বর্ণ, শ্রেণি, দেশ, জাতি, মত, পথ ও পেশানির্বিশেষে সব দেশের সব মানুষ এক ইমামের পেছনে নামাজ আদায় করেন। এ হলো ‘ভিন্নমতসহ ঐক্য’-এর অনন্য দৃষ্টান্ত। বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ সহাবস্থান করেন বলে ভাষার দূরত্ব দূর হয়ে মনের নৈকট্য অর্জন হয় এবং প্রকৃত মানবিক অনুভূতি জাগ্রত হয়। 

মনের সংকীর্ণতা দূর হয়; দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত হয়, চিন্তার বিকাশ সাধিত হয়। একদেশদর্শী মনোভাব দূরীভূত হয়ে বহুদর্শিতা ও দূরদর্শিতা অর্জন হয়; যা বিশ্বশান্তির জন্য অপরিহার্য। 

হজের শিক্ষা আমাদের আজীবন লালন ও ধারণ করতে হবে। সর্বদা তর্কবিতর্ক ও ঝগড়া-বিবাদ পরিহার করতে হবে। কারও ব্যবহার পছন্দ না হলেও রাগ করা যাবে না বা কটু কথা বলা যাবে না, কারও মনে কষ্ট দেওয়া যাবে না। কারও দ্বারা যদি কারও কোনো ক্ষতি হয়, তবে সঙ্গে সঙ্গে তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। সব সময় অজুর সঙ্গে থাকার চেষ্টা করতে হবে এবং মনে সব সময় আল্লাহর স্মরণ রাখতে হবে। নিজের স্বার্থ উদ্ধারের মানসিকতা পরিহার করতে হবে। নিজের আগে অন্যকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কারও অধিকার খর্ব করা যাবে না। নফসকে নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলাবদ্ধতা, নম্রতা, ভদ্রতা ও উদারতা শিক্ষায়-দীক্ষায় ও উন্নীত করতে হবে। 

যাঁরা হজের শিক্ষা লাভে ধন্য হন, তাঁরাই প্রকৃত হাজি। যাঁরা হজকে জীবন পরিবর্তনের অপূর্ব সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং হজ-পরবর্তী জীবনে হজের শিক্ষা বজায় রেখে জীবন পরিচালনা করেন। এরূপ হাজির সংখ্যা বাড়লে দেশ ও জাতির মঙ্গল সাধিত হবে, জনমানুষের কল্যাণ হবে; অন্যথা অর্থের অপচয়, সময়ের অপচয়, শক্তি-সামর্থ্যের অপব্যবহার ও নফসের গোলামি বা আত্মপূজাই সার হবে। 

হজ একটি ফরজ ইবাদত, এটি কোনো সার্টিফিকেট কোর্স নয় এবং কোনো পদপদবি বা উপাধি নয়। হজ করার পর নিজ থেকেই নামের সঙ্গে হাজি বিশেষণ যোগ করা সমীচীন নয়। অন্য কেউ তা করলে দোষ নেই। 

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী, যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

[email protected]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: হজ র শ ক ষ ক রব ন প রক ত

এছাড়াও পড়ুন:

স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে চায় জামায়াত: আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের

ছবি: প্রথম আলো

সম্পর্কিত নিবন্ধ