বাংলাদেশ বিমান ১৭ বছর পর ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে টোকিও ফ্লাইট আবার চালু করে। এর পর থেকে জাপানে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মধ্যে দেশে ভ্রমণ করা নিয়ে স্বস্তি ফিরে এসেছিল।

এর আগে দুই দফায় বিমান টোকিও ফ্লাইট চালু করলেও অল্প দিনের ব্যবধানে কর্তৃপক্ষ তা বন্ধ করে দেয়। এ সিদ্ধান্তের কারণ হিসেবে যাত্রীর স্বল্পতার ফলে দেখা দেওয়া আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু কোনোবারই যাত্রী আকৃষ্ট করতে হলে ঠিক কী করা দরকার এবং কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করলে সেই পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হবে, সেসব বিষয়ে গভীর কোনো চিন্তাভাবনা বিমানের পক্ষ থেকে করা হয়েছে বলে মনে হয় না।

তা সত্ত্বেও দীর্ঘ বিরতির পর ফ্লাইট আবার চালু হওয়ায় জাপানপ্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছিল এবং বিমানের টোকিও আগমনকে সবাই স্বাগত জানিয়েছিলেন।

টোকিও ফ্লাইট চালু হয়ে যাওয়ার পর বিমানে বাংলাদেশের উদ্দেশে যাত্রা করার বেশ কিছু বাড়তি সুবিধা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। এতে ফ্লাইট যেন আবারও বন্ধ হয়ে না যায়, সেই কামনা সবাই করতে শুরু করেছিলেন। এসব বাড়তি সুবিধার মধ্যে সর্বাগ্রে ছিল অর্থ আর সময়ের সাশ্রয়। মাত্র ছয় থেকে সাত ঘণ্টায় ঢাকা পৌঁছানো এবং অনেকটা একই সময়ে টোকিও ফিরে আসার অর্থ হচ্ছে দেশে অতিরিক্ত কিছুটা সময় আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে কাটানোর সুযোগ পাওয়া এবং ট্রানজিটবিহীন ঝামেলামুক্ত ভ্রমণের সুবিধা ভোগ করা।

এ ছাড়া সরাসরি ফ্লাইট থাকায় টিকিটের মূল্যের দিক থেকেও বাড়তি কিছু সুবিধা প্রবাসী বাংলাদেশিরা পেয়ে আসছিলেন। এখন হঠাৎ বিমানের কাঙ্ক্ষিত সেই ফ্লাইট আবারও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রবাসীদের মধ্যে হতাশা লক্ষ করা যাচ্ছে। তাঁদের অনেকেই বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রতিবাদ জানানো ছাড়াও প্রবাসীদের সুবিধা মাথায় রেখে ফ্লাইট যেন একেবারেই বন্ধ করে দেওয়া না হয়, সেই দাবি দূতাবাসের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের কাছে জানাচ্ছেন।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস গত মাসে জাপান সফরে এসে টোকিওতে অবস্থান করার সময় প্রবাসী বাংলাদেশিদের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধিদল তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। তারা বিমানের ফ্লাইট চালু রাখার দাবি–সংবলিত একটি স্মারকলিপি মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে তুলে দিয়েছিল। বিমান তখনো পর্যন্ত ফ্লাইট চালু রাখায় অধ্যাপক ইউনূস কথা দিয়েছিলেন, বিষয়টি তিনি খতিয়ে দেখবেন। তবে অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানের সেই প্রতিশ্রুতিও বিমানের সিদ্ধান্ত পাল্টাতে পারেনি এবং চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহেই টোকিও ফ্লাইট তৃতীয়বারের মতো অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে জানতে পারছি।

বাংলাদেশের একদল তরুণ উদ্যমী ব্যবসায়ী কৃষিপণ্যের পাশাপাশি বাংলাদেশের ফল জাপানে নিয়ে এসে কেবল যে নিজেদের ব্যবসাই সম্প্রসারিত করে যাচ্ছিলেন তা–ই নয়, গার্মেন্ট আর রিকন্ডিশন্ড গাড়ির সনাতন ব্যবসার বাইরেও জাপানের বাজারে দেখা দেওয়া সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশের কল্যাণে অবদান রেখে যাচ্ছিলেন।

কেন বিমানের এ সিদ্ধান্ত, তা নিয়ে প্রবাসীদের মধ্যে নানা গুঞ্জন বিরাজমান। বিমানের পক্ষ থেকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা বলা হলেও বিমানের ফ্লাইটে বিগত দিনগুলোতে যাঁরা বাংলাদেশে গিয়েছেন, তাঁরা প্রায় সবাই বলছেন, ফ্লাইট যাত্রীবিহীন থাকা তাঁদের চোখে পড়েনি। অনেকে বরং বলছেন, ফুল বোর্ড না হলেও খালি আসন কখনোই লোকসান হওয়ার মতো বেশি ছিল না। এ কারণেই নানা প্রশ্ন এখন প্রবাসীদের মনে দেখা দিচ্ছে।

আমি নিজে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ফ্লাইট চালু হওয়ার পর অন্তত তিনবার বিমানের যাত্রী হিসেবে দেশে ভ্রমণ করেছি। ফলে সরাসরি ফ্লাইটের সুবিধাগুলো বলা যায় আমার নিজের চোখে দেখা। ট্রানজিট বিড়ম্বনা থেকে মুক্ত থাকা তো আছেই, এর বাইরে বিমানে একবার প্রবেশ করার পর থেকেই দেশের সুবাতাস পাওয়ার অনুভূতিটাও কম নয়। সঙ্গে নিতে পারা মালামাল নিয়েও অন্যান্য বিমান কোম্পানির তুলনায় অতিরিক্ত কিছু সুবিধা বিমান দিয়ে আসছিল। তারপরও বলতে হয়, ফ্লাইট বন্ধ করে দেওয়ার পেছনের যে কারণ বিমান দেখাচ্ছে, সেটাও মনে হয় একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়।

তৃতীয়বারের মতো টোকিও ফ্লাইট চালু হওয়ার সময় জাপানে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংখ্যা জাপানের অভিবাসন ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী ছিল ২০ হাজারের একটু ওপরে। প্রবাসী নাগরিকদের সে রকম স্বল্পসংখ্যার উপস্থিতিকে হিসাবের মধ্যে রেখে সপ্তাহে তিনটি ফ্লাইট চালু করা এক অর্থে ছিল নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক।

বিমানের পক্ষ থেকে তখন অবশ্য বলা হয়েছিল, তাদের টার্গেট যাত্রী কেবল বাংলাদেশিরাই নন, একই সঙ্গে নেপাল ও ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো থেকে জাপানে যাঁরা এসেছেন, তাঁরাও। তাঁদের আকৃষ্ট করার পাশাপাশি জাপানের ব্যবসায়ীদের যাত্রী হিসেবে টানতে হলে সপ্তাহে একাধিক ফ্লাইট চালু রাখার বাইরে কোনো বিকল্প নেই। কেননা, তাঁদের অনেকেই বাংলাদেশে কাজ যত দ্রুত সম্ভব শেষ করে জাপানে ফিরে যান। বিষয়টির ওপর গুরুত্ব আরোপ করায় সপ্তাহে একাধিক ফ্লাইট থাকা তাদের কাছে আবশ্যকীয় বিবেচিত হয়।

অন্যদিকে জাপানে স্থায়ীভাবে বসবাসরত নেপালিদের সংখ্যা এখন দেড় লাখ ছাড়িয়ে গেছে, ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো থেকে আসা আইটি বিশেষজ্ঞদের সংখ্যাও প্রবাসী বাংলাদেশিদের থেকে বেশি। ফলে যাত্রী হিসেবে তাঁদের মধ্যে থেকে সংখ্যাধিক্যকে পেতে হলে সপ্তাহে একাধিক ফ্লাইটের বিকল্প সম্ভবত নেই।
ভারতের এয়ার ইন্ডিয়া ছাড়াও জাপানের প্রধান দুটি বাণিজ্যিক বিমান কোম্পানি জাপান এয়ারলাইনস ও অল নিপ্পন এয়ারওয়েজ নয়াদিল্লি ছাড়াও চেন্নাই, হায়দরাবাদ ও মুম্বাইয়ের গন্তব্যে নিয়মিত ফ্লাইট চালু রাখলেও সেসব গন্তব্যের কোনোটাই পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর মতো ঢাকার কাছাকাছি দূরত্বে অবস্থিত নয়।

অন্যদিকে নেপালিদের জন্য সুবিধা ছিল আরও বেশি। টোকিও ফ্লাইটের সঙ্গে সংগতি রেখে ঢাকা থেকে কাঠমান্ডু যাওয়ার ফ্লাইট বিমান চালু রাখায় নেপালি যাত্রীরাও কম সময় আর কম খরচে ভ্রমণসুবিধা ভোগ করছিলেন। ফলে শুরুর দিকে বিমানের টোকিও ফ্লাইটের অধিকাংশ যাত্রী ছিলেন নেপালি। ভারতের পূর্বাঞ্চলের যাত্রীর সংখ্যাও একেবারে কম ছিল না। বিমান অবশ্য খুব বেশি দিন ভারতীয় ও নেপালি যাত্রীদের ধরে রাখতে পারেনি। কেন পারেনি, সেই বিশ্লেষণে না গিয়ে বলতে হয়, বিদেশি যাত্রীদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরতা হিসাবের মধ্যে ধরে নিয়ে সপ্তাহে তিনটি ফ্লাইট নিয়ে যাত্রা শুরু করা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ, যার ফল আমাদের এখন দেখতে হচ্ছে।

বিমান অবশ্য অল্প দিনে সেই ভুল বুঝতে পেরে ফ্লাইটের সংখ্যা সপ্তাহে দুটিতে নামিয়ে আনলেও শেষ রক্ষা করা যায়নি।

তবে এত কিছুর পরও বলতে হয়, জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের সংযোগ এখন নতুন এক সন্ধিক্ষণে অবস্থান করছে। জাপানে বাংলাদেশিদের উপস্থিতি বৃদ্ধি পেয়ে চলার পাশাপাশি বাংলাদেশেও জাপানি ব্যবসায়ী, গবেষক ও উন্নয়নকর্মীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অদূর ভবিষ্যতে তা আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সুস্পষ্ট অনেক চিহ্ন এখন অনেক বেশি পরিষ্কার হয়ে উঠছে।

ফলে বাংলাদেশিদের পাশাপাশি এ রকম জাপানিদের আকৃষ্ট করতে হলে বিমানের সেবার মান আরও উন্নত করার বাইরে কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না।

এ ছাড়া আরও বলতে হয়, জাপানে বাংলাদেশি পণ্যের বিস্তারেও বিমানের টোকিও ফ্লাইট যথেষ্ট অবদান স্বল্প সময়ের মধ্যে রাখতে পেরেছিল। এসব পণ্যের মধ্যে পোশাকশিল্পের সনাতন পণ্যের বাইরে আরও আছে বাংলাদেশের কৃষিপণ্য, বিশেষ করে টাটকা শাকসবজি জাপানের বাজারে সহজে প্রবেশের সুযোগ করে দিয়ে আমাদের রপ্তানি পণ্য বহুমুখী করে তুলতেও বিমান অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছিল।

বাংলাদেশের একদল তরুণ উদ্যমী ব্যবসায়ী কৃষিপণ্যের পাশাপাশি বাংলাদেশের ফল জাপানে নিয়ে এসে কেবল যে নিজেদের ব্যবসাই সম্প্রসারিত করে যাচ্ছিলেন তা–ই নয়, গার্মেন্ট আর রিকন্ডিশন্ড গাড়ির সনাতন ব্যবসার বাইরেও জাপানের বাজারে দেখা দেওয়া সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশের কল্যাণে অবদান রেখে যাচ্ছিলেন।

বিমানের টোকিও ফ্লাইট পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়া, সে রকম ব্যবসা আরও সম্প্রসারিত হওয়ার সুযোগও বলা যায় বন্ধ করে দিচ্ছে।

এ রকম বিভিন্ন হিসাব–নিকাশ ধর্তব্যের মধ্যে রেখে বলতে হয়, সপ্তাহে অন্তত একটি হলেও বিমানের টোকিও ফ্লাইট চালু রাখা হলে একদিকে যেমন প্রবাসীদের যথেষ্ট উপকার হবে, অন্যদিকে একই সঙ্গে দুই দেশের মধ্যে বিকাশমান বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও বিস্তৃত হওয়ার সুযোগও সেটা করে দেবে।

বাংলাদেশ সরকার ও বিমান কর্তৃপক্ষ এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে দেখলে সব পক্ষই মনে হয় এর থেকে লাভবান হবে।

মনজুরুল হক জাপানপ্রবাসী সাংবাদিক ও লেখক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব ম ন র ট ক ও ফ ল ইট ট ক ও ফ ল ইট চ ল প রব স দ র ফ ল ইট র র ফ ল ইট ফ ল ইট য ব যবস য় সরক র অবদ ন হওয় র আরও ব

এছাড়াও পড়ুন:

শ্রমিকদের দাবির প্রেক্ষিতে খুলছে ৪ বন্ধ কারখানা

নয় দিন বন্ধ থাকার পর আগামীকাল মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) থেকে নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডের চারটি কারখানায় চালু হচ্ছে। 

বেতন, বোনাসসহ বিভিন্ন দাবি বাস্তবায়নে আন্দোলনের মুখে গত ২৫ অক্টোবর বিকেলে চারটি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।

আরো পড়ুন:

ঝিনাইদহে গাছ থেকে পড়ে শ্রমিকের মৃত্যু 

বরিশালে অপসো ফার্মার ৫০০ শ্রমিক ছাঁটাইয়ের অভিযোগ

কারখানাগুলো হলো দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিল লিমিটেড, সেকশন সেভেন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, মেইগো বাংলাদেশ লিমিটেড ও ইপিএফ প্রিন্টিং লিমিটেড।

সেকশন সেভেন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের পরিচালক আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘‘২৬ অক্টোবর থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারখানা বন্ধ রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে শ্রমিকেরা কারখানা চালুর দাবি জানান। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে কারখানা চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমাদের কারখানায় সাড়ে ৩ হাজার শ্রমিক রয়েছে।’’ 

ইপিজেড সূত্র জানিয়েছে, বন্ধ চারটি কারখানায় সাড়ে ৬ হাজার শ্রমিক রয়েছে। 

উত্তরা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার জানান, শ্রমিকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) থেকে বন্ধ থাকা চার কারখানা চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

এ দিন থেকে স্বাভাবিকভাবে কার্যক্রম শুরু হবে এবং শ্রমিকদের যথাসময়ে কারখানায় আসার আহ্বান জানানো হয়েছে।

উত্তরা ইপিজেডের ২৭টি কারখানায় ৩৫ হাজার শ্রমিক কর্মরত রয়েছে।

ঢাকা/সিথুন/বকুল

সম্পর্কিত নিবন্ধ