বাংলাদেশ বিমান ১৭ বছর পর ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে টোকিও ফ্লাইট আবার চালু করে। এর পর থেকে জাপানে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মধ্যে দেশে ভ্রমণ করা নিয়ে স্বস্তি ফিরে এসেছিল।

এর আগে দুই দফায় বিমান টোকিও ফ্লাইট চালু করলেও অল্প দিনের ব্যবধানে কর্তৃপক্ষ তা বন্ধ করে দেয়। এ সিদ্ধান্তের কারণ হিসেবে যাত্রীর স্বল্পতার ফলে দেখা দেওয়া আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু কোনোবারই যাত্রী আকৃষ্ট করতে হলে ঠিক কী করা দরকার এবং কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করলে সেই পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হবে, সেসব বিষয়ে গভীর কোনো চিন্তাভাবনা বিমানের পক্ষ থেকে করা হয়েছে বলে মনে হয় না।

তা সত্ত্বেও দীর্ঘ বিরতির পর ফ্লাইট আবার চালু হওয়ায় জাপানপ্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছিল এবং বিমানের টোকিও আগমনকে সবাই স্বাগত জানিয়েছিলেন।

টোকিও ফ্লাইট চালু হয়ে যাওয়ার পর বিমানে বাংলাদেশের উদ্দেশে যাত্রা করার বেশ কিছু বাড়তি সুবিধা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। এতে ফ্লাইট যেন আবারও বন্ধ হয়ে না যায়, সেই কামনা সবাই করতে শুরু করেছিলেন। এসব বাড়তি সুবিধার মধ্যে সর্বাগ্রে ছিল অর্থ আর সময়ের সাশ্রয়। মাত্র ছয় থেকে সাত ঘণ্টায় ঢাকা পৌঁছানো এবং অনেকটা একই সময়ে টোকিও ফিরে আসার অর্থ হচ্ছে দেশে অতিরিক্ত কিছুটা সময় আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে কাটানোর সুযোগ পাওয়া এবং ট্রানজিটবিহীন ঝামেলামুক্ত ভ্রমণের সুবিধা ভোগ করা।

এ ছাড়া সরাসরি ফ্লাইট থাকায় টিকিটের মূল্যের দিক থেকেও বাড়তি কিছু সুবিধা প্রবাসী বাংলাদেশিরা পেয়ে আসছিলেন। এখন হঠাৎ বিমানের কাঙ্ক্ষিত সেই ফ্লাইট আবারও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রবাসীদের মধ্যে হতাশা লক্ষ করা যাচ্ছে। তাঁদের অনেকেই বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রতিবাদ জানানো ছাড়াও প্রবাসীদের সুবিধা মাথায় রেখে ফ্লাইট যেন একেবারেই বন্ধ করে দেওয়া না হয়, সেই দাবি দূতাবাসের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের কাছে জানাচ্ছেন।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস গত মাসে জাপান সফরে এসে টোকিওতে অবস্থান করার সময় প্রবাসী বাংলাদেশিদের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধিদল তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। তারা বিমানের ফ্লাইট চালু রাখার দাবি–সংবলিত একটি স্মারকলিপি মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে তুলে দিয়েছিল। বিমান তখনো পর্যন্ত ফ্লাইট চালু রাখায় অধ্যাপক ইউনূস কথা দিয়েছিলেন, বিষয়টি তিনি খতিয়ে দেখবেন। তবে অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানের সেই প্রতিশ্রুতিও বিমানের সিদ্ধান্ত পাল্টাতে পারেনি এবং চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহেই টোকিও ফ্লাইট তৃতীয়বারের মতো অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে জানতে পারছি।

বাংলাদেশের একদল তরুণ উদ্যমী ব্যবসায়ী কৃষিপণ্যের পাশাপাশি বাংলাদেশের ফল জাপানে নিয়ে এসে কেবল যে নিজেদের ব্যবসাই সম্প্রসারিত করে যাচ্ছিলেন তা–ই নয়, গার্মেন্ট আর রিকন্ডিশন্ড গাড়ির সনাতন ব্যবসার বাইরেও জাপানের বাজারে দেখা দেওয়া সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশের কল্যাণে অবদান রেখে যাচ্ছিলেন।

কেন বিমানের এ সিদ্ধান্ত, তা নিয়ে প্রবাসীদের মধ্যে নানা গুঞ্জন বিরাজমান। বিমানের পক্ষ থেকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা বলা হলেও বিমানের ফ্লাইটে বিগত দিনগুলোতে যাঁরা বাংলাদেশে গিয়েছেন, তাঁরা প্রায় সবাই বলছেন, ফ্লাইট যাত্রীবিহীন থাকা তাঁদের চোখে পড়েনি। অনেকে বরং বলছেন, ফুল বোর্ড না হলেও খালি আসন কখনোই লোকসান হওয়ার মতো বেশি ছিল না। এ কারণেই নানা প্রশ্ন এখন প্রবাসীদের মনে দেখা দিচ্ছে।

আমি নিজে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ফ্লাইট চালু হওয়ার পর অন্তত তিনবার বিমানের যাত্রী হিসেবে দেশে ভ্রমণ করেছি। ফলে সরাসরি ফ্লাইটের সুবিধাগুলো বলা যায় আমার নিজের চোখে দেখা। ট্রানজিট বিড়ম্বনা থেকে মুক্ত থাকা তো আছেই, এর বাইরে বিমানে একবার প্রবেশ করার পর থেকেই দেশের সুবাতাস পাওয়ার অনুভূতিটাও কম নয়। সঙ্গে নিতে পারা মালামাল নিয়েও অন্যান্য বিমান কোম্পানির তুলনায় অতিরিক্ত কিছু সুবিধা বিমান দিয়ে আসছিল। তারপরও বলতে হয়, ফ্লাইট বন্ধ করে দেওয়ার পেছনের যে কারণ বিমান দেখাচ্ছে, সেটাও মনে হয় একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়।

তৃতীয়বারের মতো টোকিও ফ্লাইট চালু হওয়ার সময় জাপানে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংখ্যা জাপানের অভিবাসন ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী ছিল ২০ হাজারের একটু ওপরে। প্রবাসী নাগরিকদের সে রকম স্বল্পসংখ্যার উপস্থিতিকে হিসাবের মধ্যে রেখে সপ্তাহে তিনটি ফ্লাইট চালু করা এক অর্থে ছিল নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক।

বিমানের পক্ষ থেকে তখন অবশ্য বলা হয়েছিল, তাদের টার্গেট যাত্রী কেবল বাংলাদেশিরাই নন, একই সঙ্গে নেপাল ও ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো থেকে জাপানে যাঁরা এসেছেন, তাঁরাও। তাঁদের আকৃষ্ট করার পাশাপাশি জাপানের ব্যবসায়ীদের যাত্রী হিসেবে টানতে হলে সপ্তাহে একাধিক ফ্লাইট চালু রাখার বাইরে কোনো বিকল্প নেই। কেননা, তাঁদের অনেকেই বাংলাদেশে কাজ যত দ্রুত সম্ভব শেষ করে জাপানে ফিরে যান। বিষয়টির ওপর গুরুত্ব আরোপ করায় সপ্তাহে একাধিক ফ্লাইট থাকা তাদের কাছে আবশ্যকীয় বিবেচিত হয়।

অন্যদিকে জাপানে স্থায়ীভাবে বসবাসরত নেপালিদের সংখ্যা এখন দেড় লাখ ছাড়িয়ে গেছে, ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো থেকে আসা আইটি বিশেষজ্ঞদের সংখ্যাও প্রবাসী বাংলাদেশিদের থেকে বেশি। ফলে যাত্রী হিসেবে তাঁদের মধ্যে থেকে সংখ্যাধিক্যকে পেতে হলে সপ্তাহে একাধিক ফ্লাইটের বিকল্প সম্ভবত নেই।
ভারতের এয়ার ইন্ডিয়া ছাড়াও জাপানের প্রধান দুটি বাণিজ্যিক বিমান কোম্পানি জাপান এয়ারলাইনস ও অল নিপ্পন এয়ারওয়েজ নয়াদিল্লি ছাড়াও চেন্নাই, হায়দরাবাদ ও মুম্বাইয়ের গন্তব্যে নিয়মিত ফ্লাইট চালু রাখলেও সেসব গন্তব্যের কোনোটাই পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর মতো ঢাকার কাছাকাছি দূরত্বে অবস্থিত নয়।

অন্যদিকে নেপালিদের জন্য সুবিধা ছিল আরও বেশি। টোকিও ফ্লাইটের সঙ্গে সংগতি রেখে ঢাকা থেকে কাঠমান্ডু যাওয়ার ফ্লাইট বিমান চালু রাখায় নেপালি যাত্রীরাও কম সময় আর কম খরচে ভ্রমণসুবিধা ভোগ করছিলেন। ফলে শুরুর দিকে বিমানের টোকিও ফ্লাইটের অধিকাংশ যাত্রী ছিলেন নেপালি। ভারতের পূর্বাঞ্চলের যাত্রীর সংখ্যাও একেবারে কম ছিল না। বিমান অবশ্য খুব বেশি দিন ভারতীয় ও নেপালি যাত্রীদের ধরে রাখতে পারেনি। কেন পারেনি, সেই বিশ্লেষণে না গিয়ে বলতে হয়, বিদেশি যাত্রীদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরতা হিসাবের মধ্যে ধরে নিয়ে সপ্তাহে তিনটি ফ্লাইট নিয়ে যাত্রা শুরু করা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ, যার ফল আমাদের এখন দেখতে হচ্ছে।

বিমান অবশ্য অল্প দিনে সেই ভুল বুঝতে পেরে ফ্লাইটের সংখ্যা সপ্তাহে দুটিতে নামিয়ে আনলেও শেষ রক্ষা করা যায়নি।

তবে এত কিছুর পরও বলতে হয়, জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের সংযোগ এখন নতুন এক সন্ধিক্ষণে অবস্থান করছে। জাপানে বাংলাদেশিদের উপস্থিতি বৃদ্ধি পেয়ে চলার পাশাপাশি বাংলাদেশেও জাপানি ব্যবসায়ী, গবেষক ও উন্নয়নকর্মীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অদূর ভবিষ্যতে তা আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সুস্পষ্ট অনেক চিহ্ন এখন অনেক বেশি পরিষ্কার হয়ে উঠছে।

ফলে বাংলাদেশিদের পাশাপাশি এ রকম জাপানিদের আকৃষ্ট করতে হলে বিমানের সেবার মান আরও উন্নত করার বাইরে কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না।

এ ছাড়া আরও বলতে হয়, জাপানে বাংলাদেশি পণ্যের বিস্তারেও বিমানের টোকিও ফ্লাইট যথেষ্ট অবদান স্বল্প সময়ের মধ্যে রাখতে পেরেছিল। এসব পণ্যের মধ্যে পোশাকশিল্পের সনাতন পণ্যের বাইরে আরও আছে বাংলাদেশের কৃষিপণ্য, বিশেষ করে টাটকা শাকসবজি জাপানের বাজারে সহজে প্রবেশের সুযোগ করে দিয়ে আমাদের রপ্তানি পণ্য বহুমুখী করে তুলতেও বিমান অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছিল।

বাংলাদেশের একদল তরুণ উদ্যমী ব্যবসায়ী কৃষিপণ্যের পাশাপাশি বাংলাদেশের ফল জাপানে নিয়ে এসে কেবল যে নিজেদের ব্যবসাই সম্প্রসারিত করে যাচ্ছিলেন তা–ই নয়, গার্মেন্ট আর রিকন্ডিশন্ড গাড়ির সনাতন ব্যবসার বাইরেও জাপানের বাজারে দেখা দেওয়া সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশের কল্যাণে অবদান রেখে যাচ্ছিলেন।

বিমানের টোকিও ফ্লাইট পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়া, সে রকম ব্যবসা আরও সম্প্রসারিত হওয়ার সুযোগও বলা যায় বন্ধ করে দিচ্ছে।

এ রকম বিভিন্ন হিসাব–নিকাশ ধর্তব্যের মধ্যে রেখে বলতে হয়, সপ্তাহে অন্তত একটি হলেও বিমানের টোকিও ফ্লাইট চালু রাখা হলে একদিকে যেমন প্রবাসীদের যথেষ্ট উপকার হবে, অন্যদিকে একই সঙ্গে দুই দেশের মধ্যে বিকাশমান বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও বিস্তৃত হওয়ার সুযোগও সেটা করে দেবে।

বাংলাদেশ সরকার ও বিমান কর্তৃপক্ষ এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে দেখলে সব পক্ষই মনে হয় এর থেকে লাভবান হবে।

মনজুরুল হক জাপানপ্রবাসী সাংবাদিক ও লেখক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব ম ন র ট ক ও ফ ল ইট ট ক ও ফ ল ইট চ ল প রব স দ র ফ ল ইট র র ফ ল ইট ফ ল ইট য ব যবস য় সরক র অবদ ন হওয় র আরও ব

এছাড়াও পড়ুন:

তত্ত্বাবধায়ক সরকারে একমত, গঠন প্রক্রিয়ায় ভিন্নমত

নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে একমত সংস্কারের সংলাপে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো। তবে গঠন পদ্ধতি নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। গতকাল বুধবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে দলগুলো সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে বিশেষায়িত সাংবিধানিক কমিটি গঠনেও একমত হয়েছে।

বিএনপি চায়, সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে গঠন পদ্ধতি, তা ফিরিয়ে আনা হোক। অর্থাৎ সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। তবে দলটি জানিয়েছে, বিচার বিভাগকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে দূরে রাখতে কোনো উত্তম প্রস্তাব এলে আলোচনা করবে। এ ব্যাপারে বিএনপিরও নিজস্ব প্রস্তাবনা রয়েছে।

জামায়াতে ইসলামী জানিয়েছে, তারাও চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হবেন সাবেক প্রধান বিচারপতি। তবে ২০০৬ সালের অভিজ্ঞতার কারণে রাষ্ট্রপতিকে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বে চায় না দলটি। জামায়াত স্থানীয় নির্বাচনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে চায়।

এনসিপিও নির্বাচনকালীন সরকার চায়। দলটির প্রস্তাব, সংসদের নিম্নকক্ষে সরকারি ও বিরোধী দলের সমন্বয়ে গঠিত ১১ সদস্যের কমিটি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে প্রাপ্ত নাম বিবেচনা করে প্রধান উপদেষ্টা বাছাই করবে। কমিটির আট সদস্য যে নাম সমর্থন করবেন, তিনি হবেন প্রধান উপদেষ্টা। তা সম্ভব না হলে উচ্চকক্ষ ‘র‌্যাঙ্কড চয়েজ’ পদ্ধতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাবিত নাম থেকে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচিত করবে।

গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অষ্টম দিনের সংলাপে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, যতটা অগ্রসর হওয়ার কথা ছিল, ততটা না হলেও হতাশ নই। সবাই মিলে চেষ্টা করলে চলতি মাসেই জুলাই সনদ সইয়ের পর্যায়ে যেতে পারব। 

তত্ত্বাবধায়কের মেয়াদ, আসনের সীমানায় একমত

সংলাপের পর আলী রীয়াজ বলেছেন, সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে সাংবিধানিক বিশেষায়িত কমিটি গঠন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনে ঐকমত্য হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন, ক্ষমতা ও মেয়াদ নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রস্তাব করেছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ হবে ১২০ দিন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, তত্ত্বাবধায়কের মেয়াদ ৯০ দিনে সীমাবদ্ধ রাখতে সবাই মোটামুটি একমত। এ সময়ের মধ্যে যদি দৈব দুর্বিপাকে নির্বাচন না হয়, সে ক্ষেত্রে ৩০ দিন বাড়তি রাখা যেতে পারে। 

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রস্তাব করেছিল, সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে গঠন করা হবে স্বতন্ত্র কমিশন। যদিও সংবিধান অনুযায়ী এ দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের (ইসি)। স্বতন্ত্র কমিশন গঠনে আপত্তি ছিল বিএনপির। তবে দলটি সাংবিধানিক কমিটি গঠনে রাজি হয়েছে। একমত হয়েছে জামায়াত, এনসিপিসহ অন্য দলগুলোও। 

আলী রীয়াজ বলেন, আদমশুমারি বা প্রতি ১০ বছর অন্তর সীমানা নির্ধারণে বিশেষায়িত কমিটি গঠনে সংবিধানের ১১৯(১) অনুচ্ছেদের ‘ঘ’-এর শেষে আইনের বিধান যোগ করা হবে। সীমানা নির্ধারণ আইনে ২০২৫ সালে যে সংশোধন এসেছে, তাতে কমিটির বিধান যুক্ত করতে ৮(৩) ধারা সংশোধনে সরকার ও ইসিকে জানানো হবে।
সংলাপে সিদ্ধান্ত হয়েছে, আগামী নির্বাচনে ইসিকে সহায়তায় যথাযথ দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে বিশেষায়িত কমিটি গঠন করা হবে। 

সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সীমানা নির্ধারণে কমিটি গঠনের প্রস্তাব তিনিই দিয়েছেন। তাতে সবাই একমত হয়েছে। এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাভেদ রাসিন বলেছেন, তাদের দলের প্রস্তাব ছিল স্বতন্ত্র কমিশন গঠন। কিন্তু ঐকমত্যের স্বার্থে কমিটি গঠনের প্রস্তাব মেনে নিয়েছেন। 

তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেমন হবে

১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকার সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা করে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিধান করে। এ জন্য সংবিধান সংশোধনে ৫৮(ক) অনুচ্ছেদ যোগ করা হয়। 

২০১০ সালে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। যদিও আদালতের পর্যবেক্ষণ ছিল, শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য পরবর্তী দুইবার তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা থাকতে পারবে। তবে বিচারপতিদের দূরে রাখতে হবে এ ব্যবস্থা থেকে। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাই বিলোপ করে দেয়। গত বছরের ডিসেম্বরে হাইকোর্ট এই সংশোধনী বাতিল করে। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফেরাতে ত্রয়োদশ সংশোধনী পুনর্বহালে আপিল বিভাগে রিভিউ করেছে বিএনপি ও জামায়াত। সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, আশা করছেন আদালতের রায়ে ফিরবে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা। 

২০০৬ সালে সর্বশেষ প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে বিএনপিপন্থি আখ্যা দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের বিরোধিতায় আন্দোলন করেছিল আওয়ামী লীগ। এতে কে এম হাসান সরে দাঁড়ালে, পরবর্তী সময়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিজেই প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন। 

জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেছেন, তাদের দল চায় সাবেক প্রধান বিচারপতিদের একজন হবেন প্রধান উপদেষ্টা। যদি সাবেক প্রধান বিচারপতিদের মধ্যে গ্রহণযোগ্য কাউকে না পাওয়া যায়, তাহলে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি প্রধান উপদেষ্টা পদে গ্রহণযোগ্য কাউকে নিয়োগ করবেন। তবে ২০০৬ সালের অভিজ্ঞতায় রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে চান না তারা। ডা. তাহের বলেন, জামায়াতের দাবি, স্থানীয় সরকার নির্বাচনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে হতে হবে। 

এ প্রস্তাব নাকচ করে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, তাহলে তত্ত্বাবধায়ক পাঁচ বছর হতে হবে। স্বচ্ছতা নিশ্চিতে বিচার বিভাগকে তত্ত্বাবধায়ক থেকে দূরে রাখার বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘জুডিশিয়ারিকে বাদ রেখে আরও দু-একটি পথ যদি রাখা যায়, যাতে সবার গ্রহণযোগ্যতায় প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ হয়, আলোচনা হতে পারে।’ তিনি জানান, বিএনপিরও প্রস্তাব রয়েছে। তবে এক্ষুণি প্রকাশ করা হবে না। আশা করছেন, ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায় জনগণের পক্ষে আসবে। অতীত অভিজ্ঞায় রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়কে না রাখার প্রস্তাবের বিষয়ে সালাহউদ্দিন বলছেন, সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসেবে রাষ্ট্রপতির কথা বলা হয়েছে। এটা শুধুই রাখার জন্য রাখা। 

এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদিব বলেছেন, যখনই ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় হয়, তখনই দেশে সংঘাত হয়। শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরে এনসিপি নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা দিয়েছে। 

রূপরেখা তুলে ধরে জাবেদ রাসিন বলেন, তত্ত্বাবধায়কে প্রধান বিচারপতিকে রেখে বিচারালয়ের রাজনীতিকরণ করা হয়েছিল। তাই নিম্নকক্ষের সর্বদলীয় কমিটির মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা বাছাইয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। তা ব্যর্থ হলে ভোটের অনুপাতে (পিআর) গঠিত উচ্চকক্ষ প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন করবে। 

বিএনপির অবস্থা জানাল

সামাজিক এবং সংবাদমাধ্যমে বিএনপিকে সংস্কারবিরোধী বলে প্রচার করা হচ্ছে বলে ক্ষোভ জানিয়েছেন সালাহউদ্দিন। তিনি বলেছেন, বিএনপিই সংস্কারে সবচেয়ে সহযোগিতা করছে। অথচ বিএনপিকে সংস্কারবিরোধী হিসেবে দেখানোর একটি চেষ্টা চলছে। পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি বলেছেন, ৯০ শতাংশের বেশি সংস্কার প্রস্তাবে বিএনপি একমত। যদি শতভাগ প্রস্তাবে একমত হতে জোর করা হয়, তাহলে আলোচনা কীসের জন্য। এই দলই প্রস্তাব করেছে, কেউ যাতে স্বৈরাচার না হতে পারে, সে জন্য প্রধানমন্ত্রীর পদের মেয়াদ হবে সর্বোচ্চ ১০ বছর। 

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় সংলাপে উপস্থিত ছিলেন ঐকমত্য কশিনের সদস্য সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. আইয়ুব মিয়া। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ