জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার মদতে জড়িত শিক্ষকদের বিচারের জন্য প্রশাসন একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তবে কমিটিতে আওয়ামীপন্থি শিক্ষকরা অন্তর্ভুক্ত থাকায় তদন্তের নিরপেক্ষতা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সূত্রে জানা গেছে, গত ১৭ মার্চ সিন্ডিকেট সভায় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় মদদ দেওয়ার অভিযোগে প্রাথমিকভাবে নয়জন শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করে মোট ১৯ শিক্ষকের বিরুদ্ধে ‘স্ট্রাকচার্ড কমিটি’ গঠন করা হয়। এই কমিটি গঠিত হয়েছে ‘কর্মচারী দক্ষতা ও শৃঙ্খলা অধ্যাদেশ, ১৯৮০’ এর ৫(ক)(২) ধারা অনুসারে।

এর সদস্যরা হলেন– উপাচার্য (সভাপতি), অভিযুক্ত শিক্ষকের অনুষদের ডিন, সংশ্লিষ্ট বিভাগের চেয়ারম্যান, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকে একজনসহ দুইজন সিন্ডিকেট সদস্য এবং রেজিস্ট্রার।

আরো পড়ুন:

স্থায়ী ক্যাম্পাসের দাবিতে মহাসড়কে রবি শিক্ষার্থীদের পথনাটক

‘সেপ্টেম্বরের মধ্যে ১৬৫ উপজেলায় স্কুল ফিডিং কার্যক্রম শুরু হবে’

যদিও এই কমিটি গঠন প্রক্রিয়া নিয়ম অনুযায়ী হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে অধিকাংশ অনুষদ ডিন ও বিভাগীয় চেয়ারম্যান আওয়ামী মতাদর্শে বিশ্বাসী হওয়ায় স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিচারপ্রার্থীদের অভিযোগ, এদের অনেকেই বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের সদস্য এবং তদন্ত পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে। এছাড়া অভিযুক্তদের দায় এড়াতে এসব শিক্ষক পর্দার আড়ালে তৎপর।

জানা গেছে, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সাময়িক বরখাস্ত সহযোগী অধ্যাপক মেহেদী ইকবালের তদন্ত কমিটিতে রয়েছেন তার বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো.

শাহেদুর রশিদ। তিনি মেহেদী ইকবালের থিসিস সুপারভাইজর ছিলেন।

অভিযোগ রয়েছে, ১৫ জুলাই রাতে উপাচার্যের বাসভবনে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ হামলার আগে মেহেদী ইকবাল বন্দুক বের করে ফাঁকা গুলি ছোড়েন এবং হামলার সময় শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করেও গুলি করেন। তাকে রক্ষায় চেয়ারম্যান শাহেদুর রশিদ ও অন্যান্য আওয়ামীঘনিষ্ঠ শিক্ষকরা নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। একইসঙ্গে তিনি ছাত্রলীগের কয়েকজন হামলাকারী শিক্ষার্থীকে বাঁচাতেও চেষ্টা করছেন। এছাড়া মেহেদী ইকবাল বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষদর্শী কর্মচারীদের সাক্ষ্য না দিতে বলেছিলেন।

আইবিএ’র সহকারী অধ্যাপক পলাশ সাহার তদন্ত কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক আইরীন আক্তার। তিনি বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের হয়ে শিক্ষক নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ইস্রাফিল আহমেদ, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক হোসনে আরা, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক নাজমুল হাসান তালুকদার ও নাট্যতত্ত্বের সহকারী অধ্যাপক মহিবুর রৌফ শৈবালের বিরুদ্ধে হওয়া তদন্ত কমিটির সদস্য হিসেবে রয়েছেন কলা ও মানবিকী অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোজাম্মেল হক।

অভিযোগ রয়েছে, ড. মোজাম্মেল হামলাকারী শিক্ষকদের পক্ষে শিক্ষক সমিতির কাছে চিঠি দিয়েছেন এবং অভিযুক্ত সাবেক উপ–উপাচার্য মোস্তফা ফিরোজের এনওসি দিতে উপাচার্যের ওপর চাপ প্রয়োগ করেছেন। এছাড়া সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক বশির আহমেদ ও সহযোগী অধ্যাপক আ স ম ফিরোজ উল হাসানকে বাঁচাতে জীববিজ্ঞান অনুষদ এবং কলা ও মানবিকী অনুষদের প্রভাবশালী দুই শিক্ষক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, আওয়ামীপন্থিরা থাকায় এসব তদন্ত কমিটি থেকে নিরপেক্ষতা আশা করা কঠিন। কারণ, সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা রাজনৈতিকভাবে অভিযুক্তদের ঘনিষ্ঠ।

বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের জাবি শাখার আহ্বায়ক আরিফুজ্জামান উজ্জ্বল বলেন, “অভিযুক্তরা সবাই আওয়ামী মতাদর্শে বিশ্বাসী এবং তদন্ত কমিটির অনেক সদস্যও একই ঘরানার হওয়ায় তদন্ত প্রভাবিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। যেসব বিভাগের চেয়ারম্যান আওয়ামীঘনিষ্ঠ, তাদের কমিটি থেকে বাদ দিতে হবে এবং নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে।

শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি মুহিবুর রহমান মুহিব বলেন, “আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তির কারণে এই তদন্ত কখনোই নিরপেক্ষ হতে পারে না। সুষ্ঠু বিচারের স্বার্থে অবিলম্বে এসব সদস্যদের বাদ দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।”

আন্দোলন চলাকালে পুলিশের গুলিতে আহত ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক খোন্দকার লুৎফুল এলাহী বলেন, “যখন অভিযুক্ত শিক্ষকের বিচারক হিসেবে থাকেন তার রাজনৈতিকভাবে ঘনিষ্ঠ কেউ, তখন ন্যায্যতা আশা করা যায় না। এ অবস্থায় বিতর্কিতদের তদন্ত থেকে সরে দাঁড়ানো উচিত।”

এ বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও বক্তব্য নেওয়া‌ সম্ভব হয়নি‌।

সাময়িক বরখাস্ত হওয়া শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন- মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ (সাবেক উপ-উপাচার্য), অধ্যাপক আলমগীর কবির (সাবেক প্রক্টর), সহযোগী অধ্যাপক আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান (সরকার ও রাজনীতি বিভাগ), অধ্যাপক বশির আহমেদ (সাবেক ডিন, সমাজবিজ্ঞান অনুষদ), অধ্যাপক ইস্রাফিল আহমেদ (নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ), সহযোগী অধ্যাপক মেহেদী ইকবাল (ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ), অধ্যাপক হোসনে আরা (ইতিহাস বিভাগ), অধ্যাপক নাজমুল হাসান তালুকদার (বাংলা বিভাগ) ও অধ্যাপক মোহাম্মদ তাজউদ্দীন সিকদার (পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগ)।

এছাড়া তদন্তের আওতায় থাকা অন্যান্য শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন— কানন কুমার সেন (হিসাববিজ্ঞান),পলাশ সাহা (আইবিএ), শফি মোহাম্মদ তারেক (পরিবেশ বিজ্ঞান), জহিরুল ইসলাম খোন্দকার (পদার্থবিজ্ঞান), মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম (অর্থনীতি), মনির উদ্দিন শিকদার ও মোহাম্মদ ছায়েদুর রহমান (লোকপ্রশাসন), আনোয়ার খসরু পারভেজ (মাইক্রোবায়োলজি), মহিবুর রৌফ শৈবাল (নাট্যতত্ত্ব) ও এ এ মামুন (পদার্থবিজ্ঞান)।

ঢাকা/আহসান/মেহেদী

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর শ ক ষ র থ দ র ওপর ন ট যতত ত ব শ ক ষকদ র উপ চ র য র তদন ত ঘন ষ ঠ র জন ত আহম দ ইকব ল সহয গ সদস য

এছাড়াও পড়ুন:

আরপিওর বিধানের বৈধতার রায় রিভিউর জন্য হলফনামার অনুমতি

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার ১ শতাংশ ভোটারের সমর্থনসংবলিত স্বাক্ষরযুক্ত তালিকা মনোনয়নের সঙ্গে যুক্ত করাসংক্রান্ত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের বিধানের বৈধতা দিয়ে ১৪ বছর আগে রায় দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ। এই রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে আবেদনের জন্য হলফনামার অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছেন দুজন আইনজীবীসহ সাত ব্যক্তি। শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি ফারাহ মাহবুব আজ সোমবার হলফনামা করার অনুমতি দিয়েছেন।

আবেদনকারী সাত ব্যক্তি হলেন ব্যারিস্টার এম সারোয়ার হোসেন, মেজর (অব.) এস এম হারুনুর রশীদ, কাজী জাহেদুল ইসলাম, আইনজীবী এস এম আজমল হোসেন, মেজর (অব.) নিয়াজ আহমেদ জাবের, মেজর (অব.) মো. জিয়াউল আহসান ও সালাহ উদ্দিন।

আদালতে আবেদনকারীদের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ওমর ফারুক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ মামলায় আবেদনকারীরা পক্ষ ছিলেন না। যে কারণে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন দায়েরের জন্য হলফনামা করার অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন তাঁরা। চেম্বার আদালত হলফনামা দায়ের করার অনুমতি দিয়েছেন। আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া শেষে শিগগিরই রিভিউ আবেদন করা হবে।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ১২(৩ক)(ক) বিধান অনুযায়ী নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার ১ শতাংশ ভোটারের সমর্থনসংবলিত স্বাক্ষরযুক্ত তালিকা মনোনয়নপত্রের সঙ্গে যুক্ত করে দিতে হবে। তবে শর্ত থাকে যে কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী ইতিপূর্বে জাতীয় সংসদের কোনো নির্বাচনে সদস্য নির্বাচিত হয়ে থাকলে ওই তালিকা প্রদানের প্রয়োজন হবে না।

আইনজীবীর তথ্য অনুসারে, ঢাকার একটি আসন থেকে ২০০৭ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাহবুব আহমেদ চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি মনোনয়নপত্র নেন। পরে নির্বাচনের ওই তারিখ পিছিয়ে যায়। অন্যদিকে ২০০৮ সালে আরপিও দফা ১২(৩ক)–তে সংশোধনী আনা হয়। এই বিধান সংবিধানের কয়েকটি অনুচ্ছেদ ও আরপিওর ১২(১) ধারার পরিপন্থী উল্লেখ করে মাহবুব আহমেদ চৌধুরী ২০১০ সালে হাইকোর্ট রিট করেন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুল দেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১০ সালের ১৬ আগস্ট হাইকোর্ট রুল ডিসচার্জ (খারিজ) করে রায় দেন। দফা (৩ক) সংবিধান পরিপন্থী নয় বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়।

হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ২০১০ সালে লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করেন রিট আবেদনকারী। শুনানি শেষে আপিল বিভাগ ২০১১ সালের ২৩ জানুয়ারি লিভ টু আপিল খারিজ করে রায় দেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার ১ শতাংশ ভোটারের সমর্থনসংবলিত স্বাক্ষরযুক্ত তালিকা মনোনয়নের সঙ্গে যুক্ত করাসংক্রান্ত আরপিওর ১২(৩ক)–তে বেআইনি কিছু পাননি বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়।

ওই রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে দুই আইনজীবীসহ সাত ব্যক্তি আবেদন করতে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন তাঁদের আইনজীবী ওমর ফারুক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে ভোটারের গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে। ভোটার কোন প্রার্থীকে ভোট দেবেন বা দেবেন না, এটি একান্তই তাঁর চিন্তা ও মতপ্রকাশের অধিকার। সিক্রেট ব্যালটে হামলা হলে ভোট বাতিলও হয়। সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে প্রার্থীর যোগ্যতা নির্ধারণ করা আছে। রাজনৈতিক দল হলে ১ শতাংশ ভোটারের সমর্থন লাগবে না, অথচ স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে গেলে লাগবে অর্থাৎ একই মনোনয়নপত্র ঘিরে দ্বৈত বিধান। ১ শতাংশ ভোটারের সমর্থন থাকার ওই বিধানের মাধ্যমে স্বতন্ত্র প্রার্থীকে নির্বাচন থেকে বিরত রাখার সুযোগ তৈরি হয়েছে, যা সংবিধান সমর্থন করে না এবং ভোটারের গোপনীয়তারও লঙ্ঘন—এসব যুক্তি তুলে ধরে আবেদনটি করা হয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ