রক্তাক্ত ৪ আগস্ট: ফেনীতে গুলিতে ঝরে যায় ৭ তরুণের প্রাণ
Published: 4th, August 2025 GMT
৪ আগস্ট ২০২৪, শ্রাবণের শেষ বিকেল। ফেনীর মহিপাল ফ্লাইওভারের নিচে শান্তিপূর্ণ অবস্থান করছিলেন হাজারো ছাত্র-জনতা। তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের এক দফা আন্দোলনের কর্মসূচিতে তারা জড়ো হয়েছিলেন। হাতে ছিল লাল-সবুজের পতাকা, চোখে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন।
ফ্লাইওভার এলাকায় উত্তেজনা বাড়তে থাকে। হঠাৎ বিকট শব্দে গর্জে ওঠে মহিপাল এলাকা। গুলিতে লুটিয়ে পড়েন ইসতিয়াক আহমেদ শ্রাবণ, সরওয়ার জাহান মাসুদ, মো.
মহিপাল এলাকায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সব স্তব্ধ হয়ে যায়। বাতাসে বারুদের গন্ধ, রাস্তায় রক্ত আর পড়ে থাকা জুতা-স্যান্ডেল হয়ে ওঠে নৃশংসতার নীরব সাক্ষ্য।
আরো পড়ুন:
‘এখন আমার মোবাইলে ওর ফোন আসে না’
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু
শহীদ ইসতিয়াক আহমেদ শ্রাবণের মা ফাতেমা আক্তার বলেন, ‘‘ও মাথায় আমার ওড়না পেঁচিয়ে আন্দোলনে গিয়েছিল। এক বছর পরও আমরা তার মৃত্যু মেনে নিতে পারছি না। মেয়েটা (শ্রাবণের বোন) ভাইয়ের শোকে কারো সঙ্গে কথাও বলে না।’’
শহীদ ছাইদুল ইসলাম শাহীর মা রাহেনা বেগম বলেন, ‘‘শাহী বাসা থেকে বের হওয়ার আগে ২৫ টাকা চেয়েছিল। বলেছিল শহর থেকে ফেরার ভাড়া লাগবে। কিন্তু আর ফেরেনি।’’
শহীদ ওয়াকিল আহম্মদ শিহাবের মা মাহফুজা আক্তার বলেন, ‘‘চুল কাটবে বলে ঘর থেকে বের হয়েছিল। হয়ত বুঝেছিল, এবারই শেষ দেখা। বুকের মধ্যে তিনটা গুলি লেগে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল আমার সন্তান।’’
মাহবুবুল হাসান মাসুমের ভাই মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘‘মামলায় কোনো অগ্রগতি নেই। যারা জামিনে বের হয়ে আসে, তাদের অনেকে প্রভাবশালীদের সহায়তায় বারবার পার পেয়ে যাচ্ছে।’’
আহতদের একজন নূর হোসেন, তখন ফেনী ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আমি হাসপাতালে গিয়েও চিকিৎসা পাইনি। উল্টো হামলার মুখে পড়তে হয়।’’
ঘটনার দিন ফেনী শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে নিষেধ করা হয়। ফেনী জেনারেল হাসপাতালে প্রথমে নেয়া হয় শ্রাবণের মরদেহ। একে একে আসতে থাকে অন্যদের মরদেহও। হাসপাতালে কান্নার রোল পড়ে যায়। মহিপালের হামলা ও হত্যার ঘটনায় মোট ২২টি মামলা হয়েছে। তার মধ্যে ৭টি হত্যা ও ১৫টি হত্যাচেষ্টার মামলা। এ সব মামলায় ২ হাজার ১৯৯ জনের নাম রয়েছে। আরো ৪ হাজার অজ্ঞাতনামা আসামির কথা উল্লেখ আছে। একমাত্র মাসুম হত্যা মামলায় ২২১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ফেনীর দুই সাবেক সংসদ সদস্য।
পুলিশ বলছে, ১৬৪ ধারায় ১১ জন আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। অনেকে এখনো পলাতক। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
৪ আগস্টে ফেনীর মহিপালে গুলি করার দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। একাধিক ভিডিওতে দেখা গেছে, একজন যুবক মহিপাল প্লাজার সামনে রিকশা থেকে নেমে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। তার আশপাশে অনেকের হাতে তখন দেশীয় অস্ত্র ছিল। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা পিছু হটলেও গুলিবর্ষণ বন্ধ হয়নি। নিহতদের মধ্যে অধিকাংশ ছিল গুলিবিদ্ধ।
সেদিন সংবাদ সংগ্রহে গিয়ে অনেক সাংবাদিকও মারধর ও লাঞ্ছিত হয়েছেন। অনেককে মোটরসাইকেল থামিয়ে মারধর করা হয়। ছিনিয়ে নেয়া হয় পরিচয়পত্র ও মোবাইল। এ দিন অন্তত ১০ জন সাংবাদিককে ব্যাংক ভবনের দ্বিতীয় তলায় অবরুদ্ধ করে রাখার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ফেনী জেলা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক মুহাইমিন তাজিম বলেন, ‘‘শহীদদের রক্তের ওপর এ সরকার গঠিত। অথচ এখনো বিচার হয়নি। আমরা দাবি করছি, বিচার দ্রুত সম্পন্ন হোক।’’
ফেনীর পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান জানান, জুলাই-আগস্টের ঘটনায় ২২টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৪ আগস্টে ফেনীর মহিপালে নিহত মাহবুবুল হাসান মাসুম হত্যার ঘটনায় ২২১ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও এমপি নিজাম হাজারীকে নির্দেশদাতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, তদন্তে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে, তারাই চার্জশিটে আছেন। এখানে কোনো রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনায় আনা হয়নি। অনেক আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যারা বিদেশে আছে, তাদের ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাওয়া হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘‘ফেনীতে হতাহতের সংখ্যা অন্য জেলার তুলনায় বেশি ছিল। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সহায়তা দিতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। এখন পর্যন্ত সাড়ে ৫ কোটি টাকার সহায়তা দেয়া হয়েছে।’’
ঢাকা/সাহাব/বকুল
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর গণঅভ য ত থ ন ৪ আগস ট
এছাড়াও পড়ুন:
রাবি প্রোভিসির ফেসবুক স্টোরি, শিক্ষক নিয়োগে জামায়াত নেতার সুপারিশ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দীন খানের ফেসবুক স্টোরিতে শিক্ষক নিয়োগে জামায়াতের সাবেক এমপির সুপারিশ করা প্রবেশপত্র দেখা গেছে। স্টোরি ১৫ মিনিট পরেই ডিলিট করে দেন অধ্যাপক ফরিদ। তবে এটুকু সময়ের মধ্যেই সেই স্টোরির স্ক্রিনশট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে শুরু হয় ব্যাপক সমালোচনা।
শনিবার (২ আগস্ট) রাত ১২টার দিকে প্রকাশ করা ওই স্টোরিতে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রপ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগে প্রভাষক নিয়োগের প্রবেশপত্রে জামায়াত সমর্থিত চাঁপাইনবাবগঞ্জের সাবেক এমপি মো. লতিফুর রহমান সুপারিশ করেছেন। তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসন থেকে ১৯৮৬ ও ১৯৯১ সালে দুই বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
এদিকে ওই প্রার্থীর প্রবেশপত্র ভুলভাবে স্টোরিতে চলে এসেছে উল্লেখ করে অধ্যাপক ফরিদ খান ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘‘আমার ফেসবুক স্টোরিতে একজন আবেদনকারীর প্রবেশপত্র কীভাবে আপলোড হয়েছে বুঝতে পারিনি। তবে মোবাইল ফোনটি নিয়ে আমার ছেলে বেশ কিছু সময় গেম খেলছিল। তখন হয়তো ভুলবশত স্টোরিতে এসে গেছে।’’
তিনি আরো লিখেছেন, ‘‘প্রতিদিনই কোনো না কোনো আবেদনকারী বা তাদের পক্ষে বিভিন্ন সূত্রে সাক্ষাৎ করতে এসে সিভি, প্রবেশপত্র দিয়ে যায়, আবার অনেকে ফোন করে আবেদনকারীর প্রবেশপত্র হোয়াটসঅ্যাপে সেন্ড করে, কেউ টেক্সট করে সুপারিশ পাঠায়। রুয়ার নির্বাচনের সময় একজন অ্যালামনাস যিনি সাবেক এমপি ছিলেন উনার সাথে পরিচয় হয়। কয়েকদিন আগে উনি ফোন করে উনার এলাকার একজন আবেদনকারীর কথা বলেন এবং তার প্রবেশপত্র সেন্ড করেন।’’
শুধু জামায়াত নেতা নন, বিভিন্ন সূত্রে এমন সুপারিশ করা হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘পরিচিত অনেকেই এরকম সুপারিশ করেন। তাদের মধ্যে ছাত্র, শিক্ষক, বন্ধু, সহকর্মী, রাজনীতিক অনেকেই আছেন। এই মুহূর্তে আমার অফিসে এবং মোবাইল ফোনে ডজনখানিক এরকম সুপারিশ আছে। তবে এগুলো কোনোভাবেই লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষায় প্রভাব ফেলে না।’’
বিষয়টির জন্য অধ্যাপক ড. ফরিদ পোস্টে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘‘আশাকরি বিষয়টি নিয়ে কেউ ভুল বুঝবেন না।’’
সুপারিশ করার বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াতের সাবেক সংসদ সদস্য লতিফুর রহমান বলেন, ‘‘চাকরিপ্রার্থীর প্রবেশপত্রে সুপারিশ করা হয়েছে এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। তবে ওই প্রার্থীর বিষয়ে উপ-উপাচার্যকে ফোন করেছিলাম। আমি তাকে বলেছিলাম, ‘বিগত দিনে ভাইবাগুলোতে অনেক বাজে চর্চা হয়েছে। তবে বর্তমান সময়ে আমরা এটা চাই না।’’
প্রবেশপত্রে করা সুপারিশ এবং স্বাক্ষর কার জানতে চাইলে অধ্যাপক ফরিদ খান বলেন, ‘‘যেভাবে স্টোরিতে থাকা ওই প্রবেশপত্র দেখা গেছে, আমার কাছে ওভাবেই এসেছিল। যিনি পাঠিয়েছেন তার লেখা কি না আমি নিশ্চিত নই।’’
রাজশাহী/ফাহিম//