প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমছে সংবিধান সংশোধনের আগেই
Published: 21st, January 2025 GMT
প্রধানমন্ত্রীর সর্বময় ক্ষমতা থাকছে না। সংবিধান সংশোধনের আগেই উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন সরকারপ্রধান। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারক নিয়োগে ইতোমধ্যে অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়া সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের একচেটিয়া ক্ষমতাও হারাবেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে দলীয়প্রধান ও সংসদ নেতা হতে না পারলে ক্ষমতাসীন দল এবং সংসদে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ হারাবেন প্রধানমন্ত্রী।
স্বাধীনতার পর সংসদীয় গণতন্ত্র গ্রহণ করে বাংলাদেশ। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা চালু করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতিকে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়। রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভ– আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগ রাষ্ট্রপতির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়।
১৯৯১ সালে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন হলে রাষ্ট্রপতির সব ক্ষমতা চলে যায় প্রধানমন্ত্রীর হাতে। সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া কিছুই রাষ্ট্রপতি স্বাধীনভাবে করতে পারেন না। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে চলতে হয়। ৫৬ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদীয় দলের সমর্থিত নেতাকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগে রাষ্ট্রপতি বাধ্য।
শুধুমাত্র ৯৫(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করতে পারেন রাষ্ট্রপতি। এ অনুচ্ছেদে আরও বলা হয়েছে, ‘প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগ করবেন’। কিন্তু ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত’ রাষ্টপতি কিছুই প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া করতে না পারায় অন্যান্য বিচারক নিয়োগ হয় প্রধানমন্ত্রীর পছন্দে। এর মাধ্যমে বিচার বিভাগে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়েছে।
আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারককে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের রেওয়াজ থাকলেও তা না মানার নজির রয়েছে। বিচারাঙ্গনে প্রচলিত রয়েছে, রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি নিয়োগে স্বাধীন হলেও তা প্রধানমন্ত্রীর পছন্দেই নিয়োগ হয়।
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা যাচ্ছে বিচার বিভাগে
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতনের পর সংস্কারের দাবিতে রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানো। সংবিধান সংস্কার কমিশন সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে স্বাধীন বিচার বিভাগীয় নিয়োগ কমিশন (জেএসি) গঠনের সুপারিশ করেছে। এর সদস্যরা হবেন প্রধান বিচারপতি, আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম দুই বিচারপতি, হাইকোর্ট বিভাগের জ্যেষ্ঠতম দু’জন বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং সংসদের উচ্চ কক্ষের মনোনীত একজন নাগরিক। জেএসি বিচারক নিয়োগে সুপারিশ করবে।
এ সুপারিশ বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। তা এড়াতে অন্তর্বর্তী ৯৪(৪) অনুচ্ছেদ কার্যকরে প্রধান বিচারপতির পরামর্শে বিচারক নিয়োগে ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ’ জারি করতে যাচ্ছে ড.
এর খসড়ায় বলা হয়েছে, বিচারক নিয়োগে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল’ গঠন করা হবে। প্রধান বিচারপতি হবেন এর চেয়ারম্যান। সদস্য হবেন আপিল বিভাগ, হাইকোর্ট এবং বিচার কর্ম-বিভাগের জ্যেষ্ঠ তিন বিচারক, অ্যাটর্নি জেনারেল, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি, চেয়ারম্যান মনোনীত আপিল বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের একজন অধ্যাপক। কাউন্সিল গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে যোগ্য প্রার্থীকে বিচারক নিয়োগে সুপারিশ করবে।
সরকারি সূত্র জানিয়েছে, শিগগির এ অধ্যাদেশ জারি হবে। এর পর বিচারক নিয়োগে সরকারপ্রধানের ক্ষমতা থাকবে না সংবিধান সংশোধন ছাড়াই।
সাংবিধানিক নিয়োগে ক্ষমতা খর্বের সুপারিশ
বিদ্যমান আইনে সার্চ কমিটির সুপারিশে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্য কমিশনার নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি। একই প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান এবং কমিশনার নিয়োগ হয়। তবে ৪৮(৩) অনুচ্ছেদের কারণে, সার্চ কমিটির প্রস্তাবিত নাম প্রথমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যায়। শেষ পর্যন্ত তাঁর পছন্দে নিয়োগ করা হয়।
৬৪(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি। এ পদের মেয়াদ রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টির ওপর নির্ভর করে। ১৩৮ (১) অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি সরকারি কর্ম-কমিশনের (পিএসসি) সভাপতি ও অন্যান্য সদস্যদের, ১২৭ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি। স্পিকারের নেতৃত্বাধীন বাছাই কমিটির মাধ্যমে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি। বাছাই কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আইনমন্ত্রী এবং সরকারের বিভিন্ন কমিশন এবং সংস্থার কর্মকর্তারা। ফলে এসব নিয়োগও হয় প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায়।
তা রোধে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের মাধ্যমে নিয়োগের সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। এতে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত ৯ সদস্যের কাউন্সিলের সদস্য হবেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, নিম্ন ও উচ্চকক্ষের স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, বিরোধী দল মনোনীত দুই কক্ষের ডেপুটি স্পিকার, সংসদের অন্যান্য দল থেকে একজন সদস্য।
এনসিসির পাঠানো নাম থেকে নির্বাচন কমিশনার, দুদক চেয়ারম্যান ও কমিশনার, অ্যাটর্নি জেনারেল, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য, পিএসসির চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগ করবেন রাষ্ট্রপতি।
সশস্ত্র বাহিনীতে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানোর সুপারিশ
২০১৮ সালে প্রণীত ‘প্রতিরক্ষা বাহিনীসমূহের প্রধানদের নিয়োগ’ আইনানুযায়ী সেনা, নৌ এবং বিমান বাহিনীর প্রধান নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি। ৪৮(৩) অনুচ্ছেদের কারণে এসব নিয়োগও আসলে হয় প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায়। সশস্ত্র বাহিনীতে প্রধানমন্ত্রী প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর প্রধান প্রস্তাবিত এনসিসির মাধ্যমে নিয়োগের সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন।
অন্যান্য নিয়োগেও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমাতে এনসিসির সুপারিশে নিয়োগের কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবে। প্রতিরক্ষা এবং অন্যান্য বিভাগ নির্বাহীর অধীনে। প্রধানমন্ত্রী নির্বাহী প্রধান। তাঁর হাতে নির্বাহী বিভাগের নিয়োগের ক্ষমতা না থাকলে কীভাবে সরকার পরিচালনা করবেন– এ প্রশ্নে কমিশনের একজন সদস্য জানিয়েছেন, এগুলো শুধু সুপারিশ। সাংবিধানিক পদে নিয়োগে প্রধানমন্ত্রী একচ্ছত্র না থাকলেও নির্বাহী বিভাগে থাকবে।
বিএনপির ৩১ দফায় ক্ষমতার ভারসাম্য তথা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানোর প্রতিশ্রুতি রয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতাহীন করাকে সমর্থন করছে না দলটি। তবে জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতা কমানোর পক্ষে। দল দুটির নেতারা এ বিষয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তারা আগের মতোই জানিয়েছে, সুপারিশ পর্যালোচনা চলছে।
কমিশনের মেয়াদ বাড়ল
ছয় সংস্কার কমিশনের মেয়াদ আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়িয়ে গতকাল সোমবার এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। কমিশনগুলো হলো– জনপ্রশাসন, পুলিশ, নির্বাচন ব্যবস্থা, দুদক, সংবিধান এবং বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। গত ৩ এবং ৬ অক্টোবর গঠিত কমিশনগুলোর মেয়াদ ছিল ৯০ দিন।
গত ১৫ জানুয়ারি সংবিধান, পুলিশ, দুদক এবং নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন সুপারিশ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কাছে। গতকাল সংসদ ভবনে সংবিধান সংস্কার কমিশনের কার্যালয়ে কমিশন প্রধানরা মতবিনিময় সভা করেছেন। এতে সুপারিশ পর্যালোচনা করা হয়। এক কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে আরেক কমিশনের সুপারিশে ভিন্নতা, বৈপরিত্য আছে কিনা, তা চিহ্নিতের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সভায় ছিলেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. আলী রীয়াজ, নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান এবং বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান বিচারপতি এমদাদুল হক।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র ন র ষ ট রপত স প র শ কর ব যবস থ কম ট র রপত র সরক র এনস স সদস য
এছাড়াও পড়ুন:
ব্যালটে মামদানি, অদৃশ্য ‘প্রার্থী’ ট্রাম্প
নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচন আগামীকাল মঙ্গলবার। ‘বিশ্বের রাজধানী’ হিসেবে পরিচিত এই শহরে প্রথমবার এমন একজন মেয়র পদে নির্বাচিত হতে পারেন, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির চলতি ধারার একদম বিপরীতমুখী। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর রিপাবলিকান পার্টি এক ‘শ্বেতকায়, খ্রিষ্টান ও রক্ষণশীল’ আমেরিকার কথা বলছেন।
জোহরান মামদানি শ্বেতকায় নন, তিনি বাদামি রঙের দক্ষিণ এশীয়। তিনি খ্রিষ্টান নন, একজন মুসলিম। তিনি অবশ্যই রক্ষণশীল নন, তিনি খোলামেলাভাবে একজন প্রগতিশীল, যিনি নিজেকে সমাজতন্ত্রী বলতে দ্বিধা করেন না।
‘মামদানি একজন ভয়ানক মানুষ’, সাবধান করে বলেছেন অ্যান্ড্রু কুমো, মঙ্গলবারের নির্বাচনে যিনি মামদানির প্রতিদ্বন্দ্বী। সারা জীবন ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য থাকলেও বাছাইপর্বে পরাজিত হয়ে তিনি এখন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন।
ব্যালটে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নাম না থাকলেও এই নির্বাচনে তিনি একজন অদৃশ্য প্রার্থী। কুমোর পক্ষ নিয়ে তিনিও এই নির্বাচনের একজন অংশগ্রহণকারী। বড় ব্যবধানে মামদানির বিজয় হলে অনেকেই তা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অনাস্থা হিসেবেই দেখবেন।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিউইয়র্কের আদি বাসিন্দা। তিনি কোনোভাবেই চান না মামদানি এই শহরের মেয়র নির্বাচিত হোন। তাঁর বিবেচনায় মামদানি শুধু একজন পাক্কা কমিউনিস্টই নন, রীতিমতো উন্মাদ। এমন একজনকে নির্বাচিত করা হলে তিনি নিউইয়র্ক সিটির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল আটকে দেবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, মামদানি একজন অবৈধ অভিবাসী। তা প্রমাণিত হলে তাঁকে বহিষ্কার করা হবে। মেয়র নির্বাচিত হয়ে মামদানি যদি অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের চলতি অভিযানে বাধা দেন, তাহলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে, এমন হুমকিও দিয়েছেন ট্রাম্প।
শহরের প্রতিটি প্রধান কেন্দ্র হেঁটে জনসংযোগ সেরেছেন মামদানি। ৫০ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক, যাঁদের অধিকাংশই নবীন, শহরের প্রতিটি বাসায় কড়া নেড়েছেন। টিকটক ও ইউটিউবে তাঁর উপস্থিতি অভূতপূর্ব। মামদানির এই ‘মাঠপর্যায়ের খেলা’ ঠেকাতে কুমো বেছে নিয়েছেন একদিকে ঘৃণা, অন্যদিকে ভীতি।ট্রাম্পের ব্যাপারে জনরায়
শুধু নিউইয়র্কে নয়, যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে আরও অন্তত তিনটি রাজ্যে নির্বাচন হবে আগামীকাল, যার ফলাফল ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের ব্যাপারে একটি রেফারেন্ডাম বা জনরায় হবে ভাবা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে নিউ জার্সি ও ভার্জিনিয়ায় গভর্নর পদে নির্বাচন। এই দুই রাজ্যে প্রতিনিধি পরিষদ ও উচ্চ পরিষদেও ভোট গ্রহণ করা হবে। উভয় রাজ্যই ডেমোক্রেটিক রাজনীতির সমর্থক, বা ‘ব্লু স্টেট’। গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই দুই রাজ্যেই ট্রাম্পের হার হয়, কিন্তু ২০১৬ সালের তুলনায় তিনি অনেক ভালো ফল করেন। দেখার বিষয়, দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে এই দুই রাজ্যে ট্রাম্পের জনসমর্থন এখন কোন পর্যায়ে রয়েছে।
এ ছাড়া ক্যালিফোর্নিয়ায় গভর্নর গেভিন ন্যুসাম নির্বাচনী ম্যাপ পরিবর্তনের অনুমতি চেয়ে একটি গণভোটের আয়োজন করেছেন। আগামী বছরের নভেম্বরে মধ্যবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল হিসেবে রিপাবলিকান পার্টি বড় রকমের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে। তা ঠেকাতেই ট্রাম্পের নির্দেশে টেক্সাসের নির্বাচনী ম্যাপ ঢেলে সাজানো হয়েছে, যার ফলে রিপাবলিকান দল কংগ্রেসে আরও পাঁচটি আসন নিজেদের দখলে আনতে সক্ষম হবে ভাবা হচ্ছে। এই সিদ্ধান্তের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ‘ব্লু স্টেট’ ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর ন্যুসামের নির্দেশে নির্বাচনী ম্যাপ বদলানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যার ফলে সেখানে ডেমোক্রেটিক পার্টির জন্য কংগ্রেসে পাঁচটি আসনে বিজয়ের সম্ভাবনা তৈরি হবে।
এই তিনটি নির্বাচনের প্রতিটিতেই ভোটারদের মনে থাকবেন ট্রাম্প, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে আইনি বাধা উপেক্ষা করে বিভিন্ন ডেমোক্রেটিক শহরে অবৈধ অভিবাসনবিরোধী অভিযানের নামে সেনাসদস্যদের পাঠাচ্ছেন তিনি। যেসব ডেমোক্রেটিক নেতাকে শত্রু মনে করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছেন। কোনো যুক্তি বা কারণ ছাড়াই ২০২৪ সালের নির্বাচনে তাঁর পক্ষে ভোট দেয়নি এমন ডেমোক্রেটিক রাজ্যের কেন্দ্রীয় অনুদান বাতিল করছেন। কংগ্রেসের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ছাড়াই একাধিক সরকারি দপ্তর আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছেন। প্রচলিত আইনের তোয়াক্কা না করে মাদক পাচার বন্ধের নামে ভেনেজুয়েলার সমুদ্রসীমায় সামরিক হামলা চালাচ্ছেন। আমদানি শুল্কের নামে যে বাণিজ্যযুদ্ধ তিনি শুরু করেছেন, তার ফলে নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের দাম বাড়া শুরু হয়েছে।
গ্যালপ জানাচ্ছে, ২০২১ সালে দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ ধনতন্ত্রের সমর্থক ছিল, তা এখন কমে ৫৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই যে পরিবর্তিত আমেরিকা, ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতারা সে কথা জানেন না বা জানতে চান না। গাজা প্রশ্নে তাঁদের রক্ষণশীল অবস্থান দলটির প্রতি নবীন প্রজন্মের ভোটারদের অবজ্ঞার জন্ম দিয়েছে।এসব কার্যকলাপের ফলে সারা দেশে ট্রাম্পের জনসমর্থন কমেছে। অধিকাংশ জনমত জরিপে তাঁর প্রতি সমর্থন ৪২ থেকে ৪৫ শতাংশের বেশি নয়। সাম্প্রতিক সময়ে মাত্র ১০ মাসের মাথায় অন্য আর কোনো প্রেসিডেন্টের জনসমর্থনে এমন ধস নামেনি।
এবারের নির্বাচনে ট্রাম্প কোনো রাজ্যেই ব্যক্তিগতভাবে সরাসরি প্রচারে আসেননি। এমনকি রিপাবলিকান প্রার্থীদের পক্ষে সরব সমর্থনও জানাননি। এর একটা সম্ভাব্য কারণ, জয়ী হবেন এমন প্রার্থীর সমর্থন দিতেই ট্রাম্প ভালোবাসেন। আগামীকালের নির্বাচনে তেমন সম্ভাবনা কম।
এই নির্বাচন যে ট্রাম্পের ব্যাপারে জনরায়, তার আরেক প্রমাণ নির্বাচনী প্রচারণায় সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অংশগ্রহণ। ডেমোক্রেটিক পার্টিতে জাতীয় নেতা বলতে তিনিই সবেধন নীলমণি। শনিবার নিউ জার্সির ডেমোক্রেটিক গভর্নর পদপ্রার্থী মাইকি শেরিলকে পাশে নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন তিনি। একই দিন ভার্জিনিয়ায় ডেমোক্রেটিক গভর্নর পদপ্রার্থী এবিগেইল স্প্যানবার্গারের পক্ষেও প্রচারণায় অংশ নেন তিনি। উভয় রাজ্যেই ওবামা কঠোর ভাষায় ট্রাম্পের সমালোচনা করে বলেন, ট্রাম্পের কর্তৃত্ববাদী নীতির কারণেই আমেরিকা আজ এক দুঃসময়ের মুখোমুখি।
জনমতে এগিয়ে মামদানি
ওবামা মামদানিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন দেননি। তবে তিনি যে মামদানির পাশে আছেন, সে কথাও গোপন রাখেননি। মামদানির ক্যাম্পেইন থেকে জানানো হয়েছে, সম্প্রতি ওবামা নিজেই ফোন করে জানিয়েছেন, তাঁর (মামদানির) বিজয়ের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। তিনি বলেছেন, মামদানির নির্বাচনী প্রচার ‘ইম্প্রেসিভ’ বা নজরে পড়ার মতো।
কুমো ক্যাম্প থেকে অহোরাত্রি তাঁকে ‘কমিউনিস্ট’ ও ‘ইহুদিবিদ্বেষী’ হিসেবে প্রচার সত্ত্বেও মামদানি যেসব জনমত জরিপে এগিয়ে, তার একটি বড় কারণ মাঠপর্যায়ে তাঁর এই ‘ইম্প্রেসিভ’ প্রচারণা। শহরের প্রতিটি প্রধান কেন্দ্র হেঁটে জনসংযোগ সেরেছেন মামদানি। ৫০ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক, যাঁদের অধিকাংশই নবীন, শহরের প্রতিটি বাসায় কড়া নেড়েছেন। টিকটক ও ইউটিউবে তাঁর উপস্থিতি অভূতপূর্ব। মামদানির এই ‘মাঠপর্যায়ের খেলা’ ঠেকাতে কুমো বেছে নিয়েছেন একদিকে ঘৃণা, অন্যদিকে ভীতি। এতে তিনি ফল পাচ্ছেন, গত দুই সপ্তাহে মামদানির সঙ্গে তাঁর ব্যবধান ১০ শতাংশের মতো কমে এসেছে। নিউইয়র্কের চলতি মেয়র নির্বাচন থেকে এরিক অ্যাডামস সরে দাঁড়ানোয় কুমোর লাভ হয়েছে সন্দেহ নেই, তবে এখনো মামদানির সঙ্গে যে ১৬-১৭ পয়েন্টের ব্যবধান রয়েছে, তা অতিক্রম করা কার্যত অসম্ভব, এই মত অধিকাংশ পর্যবেক্ষকের।
ভূমিধস পরিবর্তন
একটা বিষয় স্পষ্ট। মেয়র নির্বাচনে মামদানি জয়ী হলে তা মার্কিন রাজনীতিতে প্রজন্মগত ও নীতিগত পরিবর্তনের সূচনা করবে। ভূমিধস পরিবর্তন আসবে ডেমোক্রেটিক পার্টির রাজনীতিতে। মধ্যপন্থী ও ডানঘেঁষা রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণে এই দল অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে কম জনপ্রিয়। এই দলে যাঁরা নেতৃত্বে, তাঁদের অধিকাংশই বয়োবৃদ্ধ, করপোরেট আমেরিকার কাছে এদের হাত-পা বাঁধা। ইসরায়েল প্রশ্নে তাদের সমর্থন এখনো আগের মতো নতজানু।
পিউ রিসার্চের তথ্য অনুসারে, ইসরায়েল প্রশ্নে এখন নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে এমন আমেরিকানের সংখ্যা ৫৩ শতাংশ, যা তিন বছর আগের তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি। একইভাবে ধনতন্ত্রের প্রতিও আমেরিকানদের সমর্থন নিম্নগামী। গ্যালপ জানাচ্ছে, ২০২১ সালে দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ ধনতন্ত্রের সমর্থক ছিল, তা এখন কমে ৫৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই যে পরিবর্তিত আমেরিকা, ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতারা সে কথা জানেন না বা জানতে চান না। গাজা প্রশ্নে তাঁদের রক্ষণশীল অবস্থান দলটির প্রতি নবীন প্রজন্মের ভোটারদের অবজ্ঞার জন্ম দিয়েছে।
অন্যদিকে ট্রাম্পের নেতৃত্বে রিপাবলিকান পার্টি খোলামেলাভাবে অভিবাসনবিরোধী, দক্ষিণপন্থী, খ্রিষ্টবাদী ও রক্ষণশীল। চলতি সপ্তাহের নতুন উদ্বাস্তু নীতিতে বলা হয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসন শ্বেতকায় ও ইউরোপীয় আশ্রয়প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেবে। এই অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতকায় নাগরিকবৃন্দ, ট্রাম্প প্রশাসনের চোখে যারা সে দেশের সরকারের বৈষম্যের শিকার।
এই প্রতিক্রিয়াশীল রিপাবলিকান পার্টির বিপরীতে একটি আধুনিক ও প্রগতিশীল ডেমোক্রেটিক আন্দোলন গড়ে ওঠার সুযোগ রয়েছে। সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স ও কংগ্রেস সদস্য ওকাসিও-কর্তেজ ইতিমধ্যে এই আন্দোলনের প্রধান মুখপাত্র হয়ে উঠেছেন। সবাই মানেন, মামদানির মতো তরুণ ও বুদ্ধিমান নেতৃত্ব এই আন্দোলনকে আরও বেগবান করবে।
এই সম্ভাবনার কথা খুব স্পষ্ট করে বলেছেন বার্নি স্যান্ডার্স। তাঁর কথায়, এই দেশ করপোরেট আমেরিকার নির্দেশে চলবে, না তার রাজনীতির কেন্দ্রে থাকবে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ—এ মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। ‘যদি আমরা দ্বিতীয় পথটি বেছে নিতে চাই, করপোরেট আমেরিকার বদলে সাধারণ মানুষের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিই, তাহলে আমাদের মামদানির পাশে দাঁড়াতে হবে।’
কোন পথ বেছে নেবে নিউইয়র্ক, মঙ্গলবারেই তা নিশ্চিত হবে।