নোশিন আনজুম। ফিদে ওয়ার্ল্ড র্যাপিড ও ব্লিটজ দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২৪-এ অংশ নিয়ে সাফল্যের দেখা পান দেশের জাতীয় নারী চ্যাম্পিয়ন ও ফিদে মাস্টার নোশিন আনজুম। প্রতিযোগিতার ওপেন বিভাগে ৫৬ দেশের ১৮০ জন গ্র্যান্ডমাস্টার ও আন্তর্জাতিক মাস্টার এবং নারী বিভাগে ৩৫ দেশের ১১০ জন দাবাড়ু অংশ নেন। আন্তর্জাতিক এই প্রতিযোগিতায় নোশিনের সাফল্য ও দাবা নিয়ে তাঁর স্বপ্নের কথা শুনেছেন আশিক মুস্তাফা
গত ২৬ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত হয় ফিদে ওয়ার্ল্ড র্যাপিড ও ব্লিটজ দাবা চ্যাম্পিয়নশিপস। এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেন বাংলাদেশের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন আন্তর্জাতিক মাস্টার মনন রেজা নীড় এবং জাতীয় নারী চ্যাম্পিয়ন, নারী ফিদে মাস্টার নোশিন আনজুম। প্রতিযোগিতার ওপেন বিভাগে ৫৬ দেশের ১৩৪ জন গ্র্যান্ডমাস্টার ও ৩২ জন আন্তর্জাতিক মাস্টারসহ ১৮০ জন এবং নারী বিভাগে ৩৫ দেশের ২১ জন গ্র্যান্ডমাস্টার, ২৩ জন নারী গ্র্যান্ডমাস্টার, ৩৬ জন আন্তর্জাতিক মাস্টার ও ১০ জন নারী আন্তর্জাতিক মাস্টারসহ মোট ১১০ জন দাবাড়ু অংশ নেন। নোশিন নারী ওয়ার্ল্ড র্যাপিড দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে ৯ খেলায় ৪ পয়েন্ট নিয়ে ১১০ জনের মধ্যে ১০০তম এবং ব্লিটজে ১০৫তম স্থান অর্জন করেন। দশম রাউন্ডে মোনাকোর নারী ক্যান্ডিডেট মাস্টার বেরেজোভস্কি ফিওরিনাকে পরাজিত করেন নোশিন। একাদশ রাউন্ডের খেলায় চীনের আন্তর্জাতিক মাস্টার লু মিয়ায়ির সঙ্গে ড্র করেন এবং কাজাখস্তানের নারী আন্তর্জাতিক মাস্টার সেরিকবে আসিলের কাছে হেরে যান। ওপেন বিভাগে রাশিয়ার গ্র্যান্ডমাস্টার মারজিন ভোলোদার ১৩ খেলায় ১০ পয়েন্ট পেয়ে চ্যাম্পিয়ন হন। নারী বিভাগে ভারতের গ্র্যান্ডমাস্টার কোনিরু হাম্পি চ্যাম্পিয়ন হন।
উইমেন ক্যান্ডিডেট মাস্টার খেতাব
২০১৮ সালের কথা। শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান স্কুল চেস চ্যাম্পিয়নশিপে নোশিন আনজুম নিজের প্রথম খেতাব অর্জন করেন। টুর্নামেন্টে সবাই মোটামুটি নিশ্চিত ছিল যে স্ট্যান্ডার্ডে অন্তত দ্বিতীয় স্থান, অর্থাৎ রৌপ্য পদক পাবেন নোশিন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে শেষ ম্যাচে পরাজিত হয়ে ব্রোঞ্জ পেয়ে বসেন। নোশিনের চমক তখনও বাকি। সেদিনই ছিল ব্লিটজ সেকশনের খেলা। স্ট্যান্ডার্ডে হারার কারণেই কিনা, ব্লিটজে প্রাণপণ লড়ে শেষ পর্যন্ত স্বর্ণপদক অর্জন করেন। একই প্রতিযোগিতায় ব্রোঞ্জ পেয়ে নিজের প্রথম খেতাব অর্জন করেন– ‘উইমেন ক্যান্ডিডেট মাস্টার’।
কিংবদন্তি দাবাড়ু রানী হামিদকে হারানো এবং ‘উইমেন ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার’ নর্ম অর্জন
এর পরের সময়ে একে একে নোশিনের স্বপ্নের পাখায় যুক্ত হতে থাকে নতুন পালক। পরবর্তী খেতাব পেতেও তাঁকে বেগ পেতে হয় না। কিছুদিন পরেই, ২০১৯ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় ‘এশিয়ান জোনাল চেস চ্যাম্পিয়নশিপ, জোন ৩.
জাতীয় মহিলা দাবায় অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন
২০২২ সালে আসে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় সাফল্য। বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন কর্তৃক আয়োজিত ৪১তম জাতীয় নারী দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে নোশিন অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে তাক লাগিয়ে দেন। প্রতিযোগিতায় ১১ খেলায় সাড়ে ৮ পয়েন্ট পেয়ে শিরোপা জিতে নেন। রানারআপ হন উইমেন
ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার রানী হামিদ।
যেভাবে এলেন দাবায়
সেই এইটুকুন বয়সে দাবায় হাতেখড়ি নোশিনের। দাবায় মেয়ের পাগলামি দেখে নোশিনের মা আফরোজা ইসরাত জাহান ২০১৩ সালের শেষের দিকে ঢাকায় এসে একটি দাবা টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ করে দেন মেয়েকে। ২০১৪ সালের শুরুতে নোশিন ভিকারুননিসা নূন স্কুল ভর্তি হন চতুর্থ শ্রেণিতে। মূলত ওই বছরই আয়োজিত হয়েছিল বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের ঠিক পাশের বিল্ডিংয়েই সেই টুর্নামেন্ট। তাতেই তাঁর প্রথম অংগ্রহণ। একই বছর ডিপিএস এসটিএস স্কুলে দাবা টুর্নামেন্টেও অংশ নিয়ে রানারআপ হন নোশিন। প্রথম টুর্নামেন্টে কোনো পুরস্কার না পেলেও দাবা ফেডারেশনে যাওয়ার রাস্তা খুলে যায় নোশিনের সামনে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি, এগিয়ে চলছেন নোশিন।
শৈশব ও দাবার বোর্ডের বাইরে…
একটু বড় হওয়ার পর একমনে দাবা খেললেও ছোটবেলায় কিন্তু নোশিন একদমই শান্ত ছিলেন না। দাবা খেলতে দরকার ধৈর্য, ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই জায়গায় বসে থাকার মানসিকতা। ছোট কারও জন্য চুপ করে বসে থাকা বেশ কঠিনই। ছোটবেলায় দুরন্ত নোশিনের জন্য তো বসে থাকা ছিল অসম্ভবের মতো। নিজের শৈশবের কথা জানতে চাইলে নোশিন আনজুম বলেন, ‘নরসিংদী শহরেই আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। ছোটবেলায় খুব চঞ্চল ছিলাম। জন্মের পর তৃতীয় শ্রেণিতে উঠেই চলে আসি ঢাকায়। চতুর্থ শ্রেণি থেকে শুরু দাবা ফেডারেশনে যাওয়া। তখন আসলে কিছুই বুঝতাম না। তারপর অনেক কষ্ট করে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়েছি। ভিকারুননিসা নূন স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান অনুষদে প্রথম বর্ষে পড়ছি। দিনের অনেকটা সময় দাবা নিয়েই থাকি। অবসর তেমন পাই না। তারপরও যতটুকু পাই, গান শুনি, বই পড়ি।’
আগামীর স্বপ্ন
তাঁর স্বপ্নের কথা জানতে চাইলে নোশিন বলেন, ‘বাংলাদেশে আজও কেউ নারী গ্র্যান্ডমাস্টার হতে পারেননি। সেই স্বপ্ন দেখি। এর জন্য দেশের বাইরে আরও বেশি বেশি খেলতে হবে। বাড়াতে হবে স্পন্সরশিপও। ২০২০ থেকে আমি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত। বেতন যা পাই, তার বড় একটা অংশ চলে যায় খেলার পেছনে। করোনার সময়ের আগে এলিগেন্ট ইন্টারন্যাশনাল দাবা একাডেমিতে গ্র্যান্ডমাস্টারদের কাছে
ক্লাস করতাম। করোনার সময় সেই ক্লাস বন্ধ হয়ে যায়।
আসলে বিদেশি কোচ প্রয়োজন খুব। সেই সঙ্গে বেশি বেশি টুর্নামেন্টও চাই। তবেই স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যেতে পারব বলে আমার বিশ্বাস।’
সেই বিশ্বাস আমাদেরও, সেদিন বেশি দূরে নয়; যেদিন দেশের প্রথম নারী গ্র্যান্ডমাস্টারের খেতাব নামের সঙ্গে জড়িয়ে নিজের এবং মায়ের স্বপ্নেরও বাস্তবায়ন ঘটাবেন এই স্বপ্নবাজ!
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
আশিরের গবেষণাগারে বিএনপি নেতা রিজভী, বললেন, তারেক রহমান পাঠিয়েছেন
ড্রোন ও বিমানের ছয় শতাধিক মডেল তৈরি করে আলোচনায় আসা চট্টগ্রামের বাঁশখালীর তরুণ মো. আশির উদ্দীনের গবেষণাগার পরিদর্শন করেছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। আজ সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বাঁশখালী উপজেলার পুঁইছড়ি ইউনিয়নের দক্ষিণ পুঁইছড়ি গ্রামে আশিরের গবেষণাগার পরিদর্শনে যান তিনি।
পরিদর্শনকালে রিজভী বলেন, ‘আওয়ামী ফ্যাসিবাদ পতনের মূল কারিগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে আমরা এখানে এসেছি। তারেক রহমান লন্ডন থেকে আশির উদ্দীনের ড্রোন প্রযুক্তির ভিডিও দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের পাঠিয়েছেন এই প্রতিভাকে মূল্যায়ন করার জন্য।’
রিজভী আরও বলেন, ‘সারা দেশে কেউ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে, কেউ সংগীতে, কেউ শিল্পী হিসেবে নানাভাবে প্রতিভার ছাপ রাখছে। আমরা খোঁজখবর নিয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তারা যেন উন্নতি করতে পারে, সেটাই মূল লক্ষ্য। প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি প্রতিভাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আমরা এসেছি। আশির উদ্দীনের মতো প্রতিভাবান তরুণেরা আগামী দিনের বাংলাদেশকে গড়ে তুলবে।’
পরিদর্শনকালে রুহুল কবির রিজভীর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন ‘আমরা বিএনপি পরিবার’–এর আহ্বায়ক আতিকুর রহমান, সদস্যসচিব মোকছেদুল মোমিন; বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক মীর হেলাল, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ইদ্রিচ মিয়া, সদস্যসচিব হেলাল উদ্দীন প্রমুখ।
আশির উদ্দীন সরকারি পলিটেকনিক কলেজ থেকে ডিপ্লোমা পাস করেন। গ্রামে তাঁর ‘এয়ারক্রাফট মেইনটেন্যান্স ল্যাব’ নামের ১৫ বর্গফুট আয়তনের একটি ল্যাব আছে। এলাকাবাসীর কাছে তিনি ‘খুদে বিজ্ঞানী’ ও ‘বিমানবিজ্ঞানী’ নামে পরিচিত। ২০১৬ সালে শুরু করে ড্রোন ও বিমানের ছয় শতাধিক মডেল তৈরি করেন তিনি। এরই মধ্যে তাঁকে সম্মানিত করেছে সামরিক বাহিনী।