স্বাস্থ্য খাত: বিশ্ব পরিস্থিতি ও বাংলাদেশের সংকট
Published: 8th, February 2025 GMT
গত বছর বিখ্যাত মেডিকেল জার্নাল দ্য ল্যানসেটের একটি সংখ্যায় বলা হয়েছে, দুর্নীতি বিশ্ব স্বাস্থ্য খাতের অন্যতম ঝুঁকি। জার্নাল অনুসারে সারাবিশ্বে স্বাস্থ্যসেবা খাতে খরচ হয় ৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার ১০ থেকে ২৫ শতাংশ রোগীদের পর্যন্ত পৌঁছায় না। জেনেভা গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউটের কো-ডিরেক্টর ভিম কিম নুয়েনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিবছর এই চুরির কারণে ১ লাখ ৪০ হাজার শিশু মারা যায়; নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে ৫৭ লাখ; দরিদ্র আয়ের দেশে ৮৪ লাখ মানুষ এসব মৃত্যুর জন্য দায়ী। লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের পাবলিক হেলথের প্রফেসর ড.
রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাব চিকিৎসক এবং চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় লোপাটের জন্য বেশি দায়ী। বেশির ভাগ দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার সর্বোচ্চ পোস্টগুলো বণ্টন হয় রাজনৈতিক প্রভাব এবং ঘুষে। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে রিক্রুটমেন্ট, ট্রান্সফার, পোস্টিং, প্রমোশনে মেধার তোয়াক্কা করা হয় না বললেই চলে। ফলে তৈরি হয় অনিয়ম ও চুরির সূতিকাগার। অর্থ লোপাটের কারণ ঘুষ, যার কোনো মানি রিসিট হয় না। অথচ স্বার্থসিদ্ধি হয়। স্বার্থের সংঘাতে এক দেশ অন্য দেশের বা এক কোম্পানি অন্য কোম্পানির বা এক চিকিৎসক অন্য চিকিৎসকের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রডাক্ট বা পলিসি বা মুনাফা বা রিপোর্ট সম্পর্কে অপবাদ বা প্রতিবেদন দেয়। সরকারি বা আন্তর্জাতিক অর্থ বা ওষুধ বা চিকিৎসা সামগ্রী আত্মসাৎ করে। যেমন কভিড-১৯ এর সময় বহু দেশে আমলারা পিপিই স্বাস্থ্যসেবা দানকারী কর্মীদের না দিয়ে নিজেরাই পরে বসে ছিলেন বাসায় বা অফিসে। কভিড-১৯ অতিমারিকালে বহু স্বাস্থ্যসেবা কর্মীর বরাদ্দকৃত ভাতা আজও দেওয়া হয়নি। অথচ তাদের জন্য বরাদ্দকৃত হোটেল খরচ হোটেল মালিকদের সঙ্গে ওভার প্রাইসিং করে, ৫০ শতাংশ করে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন বহু দেশের রাজনৈতিক নেতা বা আমলারা। ওভার ইনভয়েস করে বিদেশ থেকে ১০ হাজার ডলারের জিনিস কেনা হয় ৫০ হাজার ডলারে; মেডিকেল সেক্টরে রিক্রুটমেন্ট, পোস্টিং, ট্রান্সফার ও প্রমোশনের সময় স্বচ্ছভাবে কারণ দর্শানো হয় না বা জনসমক্ষে আনা হয় না; সরকারি মেডিকেল সামগ্রী বা ওষুধ কালোবাজারে যে বিক্রি হয়, তার নমুনা আমাদের দেশেও বহুবার মিটফোর্ড ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশে র্যাবের অভিযানে প্রমাণিত।
বর্তমানে চীনে পৃথিবীর বড় বড় ব্র্যান্ডের কোম্পানির ইলেকট্রো-মেডিকেল যন্ত্রাদি তৈরি হচ্ছে। একই মেশিন নানা মানের নানা দামের হয়ে থাকে, কিন্তু লেভেল সবারই এক। সাপ্লাইয়ার কোটেশন দেয় বেশি দামেরটা, গ্যারান্টি দেয় এক বছরের আর ওয়ারেন্টি দেয় ১০ বছরের। নিম্ন বা মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে যন্ত্র স্থাপন করে কমিশন করতেই লাগে এক বছর। ততদিনে গ্যারান্টি শেষ, বাকি থাকে ওয়ারেন্টি। কিন্তু মেশিন নষ্ট হলে সেই পার্টস আমদানি করে মেশিন ঠিক করার আগেই তা ঝরঝরা হয়ে যায়, তখন খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হয়। সুতরাং লোকসান হয় জনগণ বা সরকারের।
রেফারেল সিস্টেমকে তোয়াক্কা না করে বা জুনিয়র চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সুযোগ না দিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা সামান্য সর্দি-কাশিরও রোগী দেখেন, যা অত্যন্ত বাজে উদাহরণ তৈরি হয় ভবিষ্যৎ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডাক্তারদের জন্য। নিম্ন বা নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলোর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ফিজিশিয়ান স্যাম্পল ওষুধ তাদের ড্রাইভার বা পিয়ন দিয়ে ওষুধের দোকানে পাঠিয়ে বিনিময়ে অর্থ আনেন, যা দিয়ে তাঁর সাপোর্ট স্টাফের বেতন দেন; মেডিকেল কনফারেন্সে যোগ দেওয়ার জন্য ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো ডাক্তারদের এয়ার টিকিট উপহার হিসেবে দেন। ফার্মাসিউটিক্যাল ওষুধ কোম্পানির মাধ্যমে বিদেশে অধ্যয়নরত নিজ সন্তানদের কাছে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠান আফ্রিকার বহু চিকিৎসক। বহু হাসপাতালে অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনা হয় কমিশন খাওয়ার জন্য, আমলাতন্ত্রের সহায়তায়। অনেক হাসপাতালে ইলেকট্রো-মেডিকেল যন্ত্রপাতি কেনা হয়, অথচ সেই যন্ত্র চালানোর কোনো টেকনিশিয়ানের পোস্টই ক্রিয়েট করা হয়নি। ভুয়া সার্টিফিকেটধারী ডাক্তারে আমাদের উপমহাদেশসহ আফ্রিকান দেশগুলো ছেয়ে গেছে। সিআইডির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতের শুধু পশ্চিমবঙ্গেই ৫০০ ভুয়া ডাক্তার ধরা পড়েছে। আমাদের দেশে তো নামকরা হাসপাতালের পরিচালক ও ডাক্তারের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেটই ছিল ভুয়া; মেডিকেল ফিল্ডে ভারতের স্থান ১৯৫-এর মধ্যে ১৪৫। বহু স্বাস্থ্যসেবা দানকারী দিনের পর দিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতিবছর ২৬ লাখ মানুষ মারা যায় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা দানকারীদের ভুল চিকিৎসার কারণে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স মেডিসিনের তথ্য অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২.৫ লাখ রোগী মারা যায় প্রতিবছর স্বাস্থ্যসেবা দানকারীদের ভুল চিকিৎসায়। এর ৭০ শতাংশই মারা যায় ডাক্তার, নার্স, হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট ও রোগীর মাঝে কমিউনিকেশন গ্যাপের কারণে। সুতরাং মানুষের জীবন নিয়ে এ ধরনের ছিনিমিনি খেলা এক ধরনের দুর্নীতি। অতএব পৃথিবীতে রোগীর তুলনায় কোয়ালিফায়েড ডাক্তার, নার্স ও হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্টের সংখ্যা বাড়াতে হবে; রোগীদের অসুবিধা পরিপূর্ণভাবে শুনতে হবে; বিহেভিরাল সায়েন্স পড়ে মনেপ্রাণে তা ধারণ করে রোগীদের সেবা দিতে হবে এবং স্বাস্থ্যসেবা দানকারীদের মধ্যে টিমওয়ার্ক বাড়াতে হবে। এগুলোর জন্য দরকার গুড গভর্ন্যান্স, স্বাস্থ্যসেবার প্রতিটি সেক্টরে অটোমেশন সিস্টেম, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, থার্ড পার্টির মাধ্যমে পুঙ্খানুপুঙ্খ অডিট, প্রত্যেকের যোগ্যতানুযায়ী উপযুক্ত পারিশ্রমিক, কর্মদক্ষতা অনুযায়ী প্রণোদনা। কন্টিনিউইং মেডিকেল এডুকেশন প্রোগ্রাম পৃথিবীর প্রতিটি দেশে প্রতিটি শহরের প্রতিটি হাসপাতালে প্রতি ১৫ দিনে ন্যূনতম ১.৫ ঘণ্টার জন্য চালু থাকতেই হবে; মালপত্র কেনার সময় সাপ্লাইয়ারদের ইতিহাস ও গুণগত মান জনসমক্ষে এনে প্রতিযোগিতামূলক দাম প্রকাশ করতে হবে; রোগী ও সমাজকে আরও সচেতন করতে হবে; রোগীর ফিডব্যাক পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই করতে হবে; দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান করতে হবে এবং বন্ধ করতে হবে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর মাফিয়াগিরি।
ডা. গোলাম শওকত হোসেন:
চিকিৎসক ও শিক্ষক
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
ইউটিউবে ভুয়া ‘টক শো’র ছড়াছড়ি, বিভ্রান্ত মানুষ
এক পাশে বেগম খালেদা জিয়া, অন্য পাশে শেখ হাসিনা, মাঝখানে খালেদ মুহিউদ্দীন—ইউটিউবে একটি ‘টক শো’তে তিনজনকে এভাবেই দেখা যায়। যদিও বিষয়টি পুরোটাই ভুয়া।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা কখনোই সুপরিচিত উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীনের টক শোতে (আলোচনা অনুষ্ঠান) যাননি; কিন্তু ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।
সুপরিচিত নবীন ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ, আলোচিত ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয় বিশ্লেষক, সাংবাদিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘ইনফ্লুয়েন্সার’দের নিয়ে এ ধরনের ভুয়া টক শো তৈরি করা হচ্ছে। তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাব বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, ইউটিউবে এমন ভুয়া টক শো অনেক রয়েছে।
ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।ডিসমিসল্যাব ২৮৮টি ভিডিও পর্যালোচনা করেছে। তারা বলছে, অধিকাংশ ভিডিওতে মূল সাক্ষাৎকারগুলোকে প্রাসঙ্গিকতার বাইরে গিয়ে কাটাছেঁড়া করে এমনভাবে বানানো হয়েছে, যা আদতে ঘটেনি। এসব ভিডিও গড়ে ১২ হাজারবার দেখা হয়েছে।
‘ভুয়া টক শোকে উসকে দিচ্ছে ইউটিউব, যেখানে আসল কনটেন্ট জায়গা হারাচ্ছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন গতকাল বুধবার প্রকাশ করে ডিসমিসল্যাব। এতে বলা হয়, ভুয়া টক শোতে বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হয়। অর্থাৎ সেখান থেকে অর্থ আয়ের সুযোগের সম্ভাবনাও রয়েছে। ইউটিউবের নিজস্ব নীতিমালা ভঙ্গ করে বানানো এ ধরনের ভিডিও প্রচার করে ইউটিউব নিজেও লাভবান হচ্ছে।
ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।
খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে বানানো ভিডিওটি পর্যালোচনা করে ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভিডিওতে দেখা যায়, ক্যামেরার দিকে মুখ করে দুই নেত্রী অনলাইনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ‘ভার্চু৵য়াল টক শো’তে অংশ নিয়েছেন। যেখানে সঞ্চালক খালেদ মুহিউদ্দীন শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান, ২০২৪ সালের আগস্টে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে; কিন্তু কিছুক্ষণ যেতেই দর্শক বুঝবেন, ভিডিওটি ভুয়া। খালেদা জিয়ার নড়াচড়া স্বাভাবিক না। শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বর তাঁর মুখভঙ্গির সঙ্গে মিলছিল না। খালেদার ভিডিও ফুটেজ বিকৃত বা টেনে লম্বা করা হয়েছে। উপস্থাপকের হাতের অঙ্গভঙ্গি বারবার একই রকম দেখা যাচ্ছিল। বিভিন্ন উৎস থেকে ক্লিপ কেটে জোড়া লাগিয়ে কথোপকথন তৈরি করে এই ভুয়া টক শো বানানো হয়েছে।
এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরীডিসমিসল্যাব জানায়, ভুয়া টক শোটি চলতি মাসের শেষ নাগাদ ফেসবুকে দুই লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে। ভিডিওটির ওপর একটি লোগো ছিল ‘টক শো ফার্স্ট নিউজ’ নামে, যা একই নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে মিলে যায়। সেখানে একই ভিডিওটি আরও ১ লাখ ৩৫ হাজারবার দেখা হয়েছে। ওই চ্যানেলে এমন বেশ কিছু ক্লিপ ছিল, যা একইভাবে বিকৃত বা সাজানো হয়েছিল।
প্রবাসী সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন ইউটিউবে ‘ঠিকানায় খালেদ মুহিউদ্দীন’ নামে একটি চ্যানেলে টক শো উপস্থাপনা করেন। সম্প্রতি তাঁর ছবি, ফুটেজ ব্যবহার করে বিভিন্ন ক্লিপ যুক্ত করে প্রচুর ভুয়া টক শো তৈরি করে প্রচার করা হয়েছে। ডিসমিসল্যাব এ বিষয়ে গবেষণা করেছে। তারা ইউটিউবে ‘খালেদ মুহিউদ্দীন টক শো’ লিখে খোঁজ করে অন্তত ৫০টি চ্যানেল চিহ্নিত করেছে। খালেদ মুহিউদ্দীন ছাড়াও এসব চ্যানেলে অন্যান্য উপস্থাপক ও রাজনৈতিক বক্তাদের বিভিন্ন বক্তব্যের ক্লিপ জুড়ে দিয়ে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। গত ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মার্চে খুঁজে পাওয়া এসব চ্যানেলের মধ্যে ২৯টি চ্যানেল অন্তত একটি বিকৃত টক শো প্রচার করেছে।
ডিসমিসল্যাব বলছে, চিহ্নিত ২৯টির মধ্যে ২০টি চ্যানেল তৈরি হয়েছে ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। বাকি চ্যানেলগুলো ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তৈরি। পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।পর্যালোচনা করা ভিডিওগুলোতে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ (নেপথ্যের দৃশ্য) বদলানো, ফুটেজ কাটাছেঁড়া বা জুম করা এবং মূল প্রসঙ্গ বিকৃত করা হয়েছে। অধিকাংশ ভিডিও ইউটিউব, টেলিভিশন শো, ফেসবুক লাইভ এবং অডিও রেকর্ডিং থেকে ক্লিপ জোড়া লাগিয়ে তৈরি। অনেক ক্ষেত্রে, মূল বক্তার ফুটেজে এমন ভয়েসওভার (কথা) জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে নেওয়া এবং যার সঙ্গে কথোপকথনের কোনো সম্পর্ক নেই; কিন্তু বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের ২৭ মার্চ প্রকাশিত একটি ভিডিওর শিরোনাম ছিল, ‘ড. ইউনূস চীন সফরের পরপরই পদত্যাগ করলেন’। যেখানে যমুনা টিভির লোগো ব্যবহার করা হয়। যমুনা টিভির সঙ্গে ডিসমিসল্যাব যোগাযোগ করে জানতে পারে যে তাদের অনুমতি ছাড়া লোগো ব্যবহার করা হয়েছে। ভিডিওটিতে উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীন এবং রাজনীতিবিদ গোলাম মাওলা রনির আলাদা আলাদা ফুটেজ জোড়া লাগানো হয়েছে।
ডিসমিসল্যাব বলছে, রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলের নেতা ফজলুর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের ফুটেজও এসব ভুয়া টক শোতে ব্যবহার করা হয়েছে।
পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।ভুয়া টক শোর বিষয়ে ডিসমিসল্যাবকে খালেদ মুহিউদ্দীন বলেন, তিনি দর্শকদের তাঁর ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেলের আধেয়র ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানান।
ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভুয়া টক শোগুলোতে বক্তব্য তুলে ধরা হয় মূলত রাজনৈতিক দল ও সরকারকে নিয়ে। ভুয়া টক শোগুলোর ৪০ শতাংশেই অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।
বেশিবার দেখা হয়েছে, এমন পাঁচটি ভুয়া টক শো খুঁজে বের করেছে। এসব টক শোতে প্রচার করা হয়েছে অশনিবার্তা, আলোর রাজনীতি ও রাজনৈতিক আলোচনা নামের ইউটিউব চ্যানেল থেকে। পাঁচটি টক শো দুই থেকে ছয় লাখ বার দেখা হয়েছে।
নিজের নিয়মই মানছে না ইউটিউবইউটিউবের স্প্যাম ও প্রতারণামূলক আচরণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, এমন শিরোনাম, থাম্বনেইল বা বিবরণ ব্যবহার করা যাবে না, যার সঙ্গে ভিডিওর প্রকৃত বিষয়বস্তুর মিল নেই এবং যা দর্শকদের বিভ্রান্ত করে। এসব ভুয়া টক শোতে এ নীতি মানা হয়নি।
ইউটিউবের ছদ্মবেশ ধারণ নিষেধাজ্ঞা নীতিমালায় বলা আছে, অন্য কারও আসল নাম, ব্যবহারকারী নাম, ছবি, ব্র্যান্ড, লোগো বা ব্যক্তিগত কোনো তথ্য ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুমতি ছাড়া সাংবাদিক, টক শো উপস্থাপক ও কনটেন্ট (আধেয়) নির্মাতাদের ফুটেজ ব্যবহার করায় এগুলো ইউটিউবের কপিরাইট নীতিমালাও লঙ্ঘন করতে পারে।
ডিজিটাল মিডিয়া–বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিজস্ব নীতিমালা থাকলেও ইউটিউব এ ধরনের ভুয়া ভিডিওকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে। এতে গুণগত সাংবাদিকতা পিছিয়ে পড়ে।
২০২২ সালে একটি খোলাচিঠিতে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্টচেকিং নেটওয়ার্ক অভিযোগ করেছিল, ইউটিউব তাদের প্ল্যাটফর্মকে অপব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে—যেখানে অসাধু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিভ্রান্তি ছড়ানো, মানুষকে প্রতারিত করা, এমনকি সংগঠিত হয়ে অর্থ সংগ্রহ পর্যন্ত করছে।
মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, এ ধরনের ভুয়া কনটেন্ট বা আধেয় বন্ধ করতে প্ল্যাটফর্মগুলোর নিজস্ব নীতি মনে করিয়ে দিয়ে তাদের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে উদ্যোগী হতে হবে।