একটা সময় ছিল, যখন গ্রামের বাড়িগুলোর দরজা খোলা থাকত। প্রতিবেশীরা একে অপরের বাড়িতে যেত, গল্প করত, সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিত। মুখে কথাই ছিল তখন অটুট প্রতিশ্রুতি, যেন একটা অলিখিত চুক্তি। এই ‘স্বাভাবিক বিশ্বাস’ সমাজকে চলতে সাহায্য করত। বিশ্বাস ছিল তখন সমাজ-ইঞ্জিনের জ্বালানি শক্তি।

কিন্তু সময় বদলেছে। শহর বড় হয়েছে, জীবন জটিল হয়েছে। মানুষের শরীর কাছাকাছি এলেও মনের দূরত্ব বেড়েছে। ছলনা আর ভাঙা প্রতিশ্রুতির গল্পে সেই বিশ্বাসের জাল ছিঁড়তে শুরু করেছে। আমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে ‘সন্দেহের সংস্কৃতি’—যা কখনো কখনো যুক্তিসঙ্গত হলেও সমাজের গতিকে বারবার আটকে দেয়।

অতীতের জন্য শুধু আফসোস নয়, বরং সাহস নিয়ে ভবিষ্যৎ গড়তে হবে। আমাদের সেই পুরনো ‘স্বাভাবিক বিশ্বাস’ থেকে এগিয়ে যেতে হবে ‘সচেতন বিশ্বাস’-এর দিকে।

তাহলে কী করব? অতীতের জন্য শুধু আফসোস নয়, বরং সাহস নিয়ে ভবিষ্যৎ গড়তে হবে। আমাদের সেই পুরনো ‘স্বাভাবিক বিশ্বাস’ থেকে এগিয়ে যেতে হবে ‘সচেতন বিশ্বাস’-এর দিকে। এই নতুন বিশ্বাস হুট করে আসবে না। এটি আমাদের নিজেদের হাতে গড়তে হবে, সচেতনভাবে।

এর জন্য দরকার একটা নতুন সামাজিক চুক্তি—যার নিয়ম থাককে স্পষ্ট, নৈতিকভাবে স্বচ্ছ এবং আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গেও যার বিরোধ তাকবে না। এই চুক্তি শুধু ব্যক্তিগত সম্পর্ক নয়, আমাদের সমষ্টিগত জীবনকেও নতুন জীবন দেবে।

আরও পড়ুনআখিরাতে বিশ্বাস সত্কর্মের অনুপ্রেরণা০৪ মে ২০১৮বিশ্বাসের চুক্তির ৫ নিয়ম

এই নতুন বিশ্বাস গড়তে আমাদের দরকার একটা স্পষ্ট চুক্তি। এগুলো শুধু নিয়ম নয়, জীবনের নীতি, যা আমাদের দৈনন্দিন কাজে প্রতিফলিত হবে।

১.

স্বচ্ছতা ও স্পষ্টতা: অস্পষ্টতা না থাকলে ভুল বোঝাবুঝি কমে আসবে। আমাদের সংস্কৃতিতে স্বচ্ছতার কথা বলতে অনেকে সংকোচ করে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, স্বচ্ছতা একটা নৈতিক চুক্তির ভিত্তি। যে কাজে স্পষ্টতা নেই, তা ‘গারার’ বা অস্পষ্ট ঝুঁকি তৈরি করে। ইসলামি ফিকহে বলা হয়, এমন চুক্তি বৈধ নয়, কারণ এতে বিশ্বাস ভাঙার আশঙ্কা থাকে। (আল-সারাখসী, আল-মাবসুত, ১৫/৪৫, দার আল-মা'রিফাহ, বৈরুত, ১৯৯৩) 

স্বচ্ছতা ছাড়া কোনো সম্পর্ক টেকে না।

তোমরা সবাই দায়িত্বশীল এবং সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্বের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭১৩৮

২. পরামর্শ করা: পরামর্শ মানে এখানে সবার সঙ্গে আলোচনা করে কাজ করার অভ্যাস করা। সামাজিক কাজে সমাজের সবাইকে জড়িয়ে নেওয়া শুধু ভালো ব্যবস্থাপনা নয়, এটা কোরআনের শিক্ষাও বটে। কোরআনে বলা হয়েছে, “তাদের সঙ্গে তাদের বিষয়ে পরামর্শ কর।” (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৯)

এই পরামর্শের নীতি পরিবার থেকে রাষ্ট্র—সব জায়গায় প্রযোজ্য। এটা বিশ্বাসের জালকে আরও মজবুত করে।

৩. আমানত ও দায়িত্ব: নবীজি বলেছেন, “তোমরা সবাই দায়িত্বশীল এবং সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্বের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭১৩৮)

যিনি কোনো কাজের দায়িত্বে আছেন, তিনি শুধু বস নন, তিনি একজন আমানতদারও বটে—যার ওপর সমাজের সম্পদ, সময় আর স্বপ্নের দায়িত্ব রয়েছে। এই শিক্ষা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, নেতৃত্ব মানে অন্যদের সেবার দায়িত্ব নেওয়া। অধস্তনদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করাও আমানত।

৪. খোঁজখবর নেওয়া ও সম্পর্ক রক্ষা: পরিচিতজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করা মানে শুধু মিটিং করা নয়। মানুষের খোঁজ নেওয়া, তাদের সঙ্গে হৃদয়ের সংযোগ রাখা, বিয়েতে অভিনন্দন জানানো, কারও মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা—এগুলো আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। কোরআন বলে, “তোমরা নিকটাত্মীয়তার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা কর।” (সুরা নিসা, আয়াত: ১)

এই সংযোগ সমাজকে উষ্ণ রাখবে এবং পারস্পরিক বিশ্বাসের ভিত্তি তৈরিতে সহায়ক হবে।

৫. মর্যাদা রক্ষা করা: এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কোরআনে বলা হয়েছে, “সুন্দর কথা ও ক্ষমা করা সেই দানের চেয়ে উত্তম, যার পরে কষ্ট দেওয়া হয়।” (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৬৩)

কোনো কাজের ফল যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার ধরনও ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। যিনি উপকার পাচ্ছেন, তার যেন কখনও অপমানিত বোধ না হয়, বরং তিনি নিয়েও যেন সম্মানিত বোধ করেন। এটা বিশ্বাসের ভিত মজবুত করবে।

আরও পড়ুনহজরত আলী (রা.)-এর ১০টি কালজয়ী উক্তি২৮ জুন ২০২৫বিশ্বাস থেকে সমাজের বন্ধন ও সভ্যতা গড়ে উঠবে

কেউ হয়তো ভাবতে পারে, এই সন্দেহের যুগে বিশ্বাস গড়তে এত পরিশ্রম কেন করতে হবে? কেউ তো ভালো সেজে বিশ্বাসের অপব্যবহারও করতে পারে। হ্যাঁ, ঝুঁকি আছে। কিন্তু সচেতন বিশ্বাস মানে সরল মনে সব মেনে নেওয়া নয়। সেতু বানানোর মানে পাহারা দেওয়া বন্ধ করা নয়।

অন্ধ বিশ্বাস বা অন্ধ সন্দেহ দুইটাই ক্ষতিকর। আমাদের দরকার এমন দৃষ্টিভঙ্গি, যা বোঝে যে সমাজকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে বিশ্বাসের সেতু গড়তে হবে।

তবে বিশ্বাসের ক্ষতির সঙ্গে সন্দেহের ক্ষতিটাও তুলনা করে দেখতে হবে। সন্দেহ শুধু সম্পর্ক ভাঙে তা নয়, কাজের গতি কমায়, নতুন উদ্যোগ মেরে ফেলে, আর অতিরিক্ত নিয়ম-কানুনের জটিলতায় সৃজনশীলতা হারায়।

সবচেয়ে বড় ক্ষতি? সন্দেহ আমাদের সমাজের গোষ্ঠীগত ঐক্যকে ধ্বংস করে। ইতিহাসবিদ ইবনে খালদুন বলেছেন, এই ঐক্যই একটা জাতির আত্মা, যা তাকে শক্তিশালী রাখে। এই ঐক্য ছাড়া সমাজ ভেঙে পড়ে। (ইবন খালদুন, আল-মুকাদ্দিমা, ১/৯৮-৯৯, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, প্রিন্সটন, ১৯৬৭)। 

অন্ধ বিশ্বাস বা অন্ধ সন্দেহ দুইটাই ক্ষতিকর। আমাদের দরকার এমন দৃষ্টিভঙ্গি, যা বোঝে যে সমাজকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে বিশ্বাসের সেতু গড়তে হবে। আমরা যে পাঁচটি স্তম্ভের কথা বললাম—স্বচ্ছতা, পরামর্শ, দায়িত্ব, সম্পর্ক, মর্যাদা—এগুলো শুধু বিশ্বাস গড়ার হাতিয়ার নয়, অপব্যবহারের ঝুঁকি কমানোর জন্যও সহায়ক।

আরও পড়ুননামাজে রাকাত নিয়ে সন্দেহ হলে কী করবেন০৫ জানুয়ারি ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সন দ হ র আম দ র স আম দ র দ র জন য দরক র ক রআন

এছাড়াও পড়ুন:

সিলেট নগরে দখলমুক্ত সাত ফুটপাত

সিলেট নগরের গুরুত্বপূর্ণ সাতটি এলাকার ফুটপাত ও প্রধান সড়কের একাংশ হকারদের দখলে ছিল। প্রতিদিনই হাজারো হকার বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসতেন। এতে যানজট হতো, পথচারীরাও নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারতেন না। অবশেষে প্রশাসনের তৎপরতায় ভোগান্তির অবসান হয়েছে। জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও সিটি করপোরেশনের তৎপরতায় ফুটপাতগুলো দখলমুক্ত করা হয়েছে।

স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, গত ১৩ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ হকার উচ্ছেদে অভিযান শুরু করে। সে সময় নগরের লালদিঘির পাড় এলাকায় হকারদের জন্য আগে থেকে নির্ধারিত স্থানটি আবার সংস্কারের পর ব্যবসার উপযোগী করে পুনর্বাসনের যাবতীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়।

সিটি করপোরেশন জানিয়েছে, হকার পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার যাবতীয় প্রস্তুতি এরই মধ্যে শেষ করেছে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। এরপর হকারদের ফুটপাত ছেড়ে ওই নির্দিষ্ট স্থানে চলে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়। আহ্বানে সাড়া দিয়ে অনেকে সেখানে চলে গেছেন। যাঁরা যাননি, তাঁদের উচ্ছেদে গতকাল রোববার বেলা আড়াইটা থেকে অভিযান শুরু হয়। এ অবস্থায় কোনো হকারকেই ফুটপাতে বসতে দেওয়া হয়নি। আজ সোমবারও পুলিশের তৎপরতার কারণে কোনো হকার ফুটপাতে বসেননি।

সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানান, নগরের কিনব্রিজ, সুরমা পয়েন্ট, তালতলা, বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার, মহাজনপট্টি ও চৌহাট্টা এলাকায় সাতজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পুলিশের কয়েক শ সদস্য গতকাল রোববার অভিযানে নামেন। আজ সোমবারও পুলিশের তৎপরতা আছে। এখন থেকে যাঁরাই ফুটপাত দখল করবেন, তাঁদের বিরুদ্ধেই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আজ দুপুরে সরেজমিন দেখা গেছে, গতকালের অভিযানসংশ্লিষ্ট স্থানগুলোয় হকার নেই। পথচারীরা ফুটপাত দিয়ে নির্বিঘ্নে যাতায়াত করছেন। দোকানমালিকদেরও তাঁদের সামনের ফুটপাতের অংশ দখল করে পণ্য রাখতে বাধা দেয় পুলিশ। গতকালের মতো আজও যানজট ছিল সহনীয় পর্যায়ে। তবে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য এলাকাও হকারমুক্ত করার দাবি জানান নগরের বাসিন্দারা।

গতকাল বিকেলে বন্দরবাজার এলাকার পথচারী মমতাজুর রহমান বলেন, এখন ফুটপাত ও সড়কের একাংশ হকারমুক্ত থাকায় ভোগান্তি ও যানজট কমেছে। তবে আগে কালেক্টরেট মসজিদের সামনের সড়কের আশপাশের যে অংশে হকারেরা বসতেন, এখন তা দখলমুক্ত হওয়ায় সিএনজি, অটোরিকশা ও লেগুনা দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠানামা চলছে। এটাও রোধ করতে হবে। তবেই ভোগান্তি পরিপূর্ণভাবে নিরসন হবে।

সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেজাই রাফিন সরকার বলেন, অন্তত আড়াই হাজার হকার পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কোনো হকারকে ফুটপাত কিংবা রাস্তায় ব্যবসা করতে দেখলেই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর অস্থায়ী স্ট্যান্ডগুলোতে কতটি সিএনজি, অটোরিকশা ও লেগুনা একসঙ্গে যাত্রী পরিবহন করতে পারবে, সেটা ট্রাফিক পুলিশ নির্ধারণ করে দিয়েছে। এর বেশি সড়কে থাকলেই সংশ্লিষ্ট চালকদের বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।

সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘শহরটা আমাদের সবার। এই শহর যদি সুশৃঙ্খল থাকে, তাহলে এর সুফল আমরা সবাই পাব। শহরের ফুটপাত দখল করা হকারদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হয়েছে। তাই কোনো ধরনের অজুহাত আর মানা হবে না। নগরের ফুটপাত ও রাস্তাঘাট এখন থেকে হকারমুক্ত থাকবে। এ জন্য প্রশাসনের জিরো টলারেন্স থাকবে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ