ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতারা নতুন ছাত্র সংগঠন গঠন করবেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি নতুন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ছাত্র সংগঠনেরও আত্মপ্রকাশ হতে পারে। প্রাথমিকভাবে আহ্বায়ক কমিটি গঠন হবে। এ কমিটি ছয় মাস থেকে এক বছর মেয়াদি হবে। ছাত্রনেতারা বলছেন, ছাত্র সংগঠনটি দলীয় লেজুড়বৃত্তির বাইরে গিয়ে শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে কাজ করবে। পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অভ্যুত্থানের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে থাকবে। 

জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে। 
জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেছেন, এ মাসেই আনুষ্ঠানিকভাবে দল ঘোষণা করা হবে। এখনও নাম ঠিক হয়নি। বিভিন্ন জনের কাছ থেকে ১০০-এর বেশি নাম প্রস্তাব এসেছে। 
আদালতের রায়ে সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গঠন করে সড়কে নামেন শিক্ষার্থীরা। এতে আওয়ামী লীগ সরকারের হত্যাযজ্ঞে আন্দোলন রূপ নেয় অভ্যুত্থানে। কোটি মানুষ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে রাজপথে নামেন। হাজারো মানুষের আত্মত্যাগে শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অভাবনীয় পতন হয়।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠন করা হয়। জাতীয় নাগরিক কমিটির মাধ্যমে নতুন রাজনৈতিক দলের দিকে এগোচ্ছেন অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতারা। 

হবে কেন্দ্রীয় এবং ঢাবি কমিটি 
প্রাথমিকভাবে ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রীয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আহ্বায়ক কমিটি দেওয়া হবে। কেন্দ্রীয় কমিটি ১৭১ বা ২০১ সদস্যের হতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির আকার আরেকটু ছোট হতে পারে। ছাত্র সংগঠনের মূল কমিটি ৩০১ সদস্যের হতে পারে। 
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার এবং আব্দুল কাদের ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া সমন্বয়ক রশিদুল ইসলাম রিফাত, হাসিব আল ইসলাম, জাহিদ আহসানও নেতৃত্বে আসতে পারেন। কেন্দ্রীয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি ঘোষণার পরে সারাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, জেলায় নতুন ছাত্র সংগঠনের কমিটি গঠিত হবে বলে জানিয়েছেন ছাত্রনেতারা। 
আবু বাকের মজুমদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। অন্যদিকে আব্দুল কাদের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের স্নাতকোত্তরের ছাত্র। 

মূল দলের সঙ্গে আদর্শের মিল থাকবে, তবে ছাত্র সংগঠনকে দলীয় লেজুড়বৃত্তির বাইরে স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র রাখতে চান ছাত্রনেতারা। এখানে সর্বোচ্চ ২৭-২৮ বয়সসীমা নির্ধারণ করা হতে পারে। আবার স্নাতকে ভর্তি হওয়ার পরে সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত ছাত্র সংগঠনে থাকার নিয়ম করার শর্তও বিবেচনা করা হচ্ছে। 

ছাত্র সংগঠনের নাম নিয়ে একাধিক প্রস্তাব 
অভ্যুত্থানের সূত্রপাত করা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অধিকাংশ নেতা এসেছিলেন গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি থেকে। ২০২৩ সালে গঠিত ছাত্রশক্তির সদস্য সচিব ছিলেন উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক ছিলেন আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তারা দু’জনেই এখন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা। 
ঢাবির সদস্য সচিব ছিলেন আবু বাকের। সংগঠনের গঠন এবং প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত ছিলেন আরেক উপদেষ্টা মাহফুজ আলমও। ফলে নতুন ছাত্র সংগঠনের নাম ছাত্রশক্তি করার প্রস্তাব রয়েছে। নতুন নামে ছাত্র সংগঠন হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। 

মূল দলে যাবেন বৈষম্যবিরোধীদের অনেক নেতা 
ছাত্র সংগঠন গঠিত হলেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাধিক নেতা মূল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হবেন। এরমধ্যে বর্তমানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ নতুন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের প্রথম সারিতে থাকবেন। তিনি নিজ শহর কুমিল্লা থেকে জাতীয় নির্বাচনে লড়তে পারেন। 
এ ছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদ, সমন্বয়ক মাহিন সরকারও মূল রাজনৈতিক দলে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। সংগঠন সূত্রের ভাষ্য, সবকিছুই প্রাথমিক আলোচনায় রয়েছে। আব্দুল হান্নান মাসউদ হাতিয়ায় নির্বাচন করার সম্ভাবনা রয়েছে। প্ল্যাটফর্মের মুখপাত্র উমামা ফাতেমাও নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন। 

ছাত্র সংগঠনে প্রজন্মের নেতৃত্ব দিতে যোগ্যদের প্রাধান্য 
হাসিনার পতন ঘটানো অভ্যুত্থানে সবচেয়ে আলোচিত হয় ‘জেনারেশন জুমার্স’ তথা জেন-জি। এ প্রজন্মকে যারা নেতৃত্ব দিতে যোগ্য তাদের কথাই ভাবা হচ্ছে নতুন ছাত্র সংগঠনের জন্য। পাশাপাশি ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে যারা ধারণ করবেন, তারা আসবেন নেতৃত্বে।
আবু বাকের মজুমদার সমকালকে বলেন, যারা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, আবার অনেকে প্রকাশ্যে কথা বলতে পারেননি কিন্তু জুলাইয়ে সর্বতোভাবে তৎপর ছিলেন সবাইকে ছাত্রসংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। 

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ছাত্রদল, ইসলামী ছাত্র শিবিরসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা সর্বাত্মকভাবে অংশ নেন। বাকের মজুমদার বলেছেন, অভ্যুত্থানের পর সবাই যার যার ছাত্র সংগঠনে ফিরে গেছেন। বর্তমান প্রজন্মের যাওয়ার মতো সংগঠন, তাদের মতামত প্রতিষ্ঠা করার মতো সংগঠন নেই। নতুন ছাত্র সংগঠন যেমন শিক্ষার্থীদের অধিকারের বিষয়ে সরব থাকবে, তেমনি একজন শ্রমিকের স্বার্থেও রাজপথে দাঁড়াবে। অর্থাৎ জাতীয় পরিমণ্ডলেও ছাত্র সংগঠন দেশের স্বার্থে কাজ করবে।
সমন্বয়ক আব্দুল কাদের বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে ছাত্র সংগঠন শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করবে। সকল মতের শিক্ষার্থীকেই ধারণ করবে। 

রাজনৈতিক দলের প্রধান হবেন নাহিদ 
তরুণদের রাজনৈতিক দলের প্রধান হবেন নাহিদ ইসলাম– এটি অনেকটাই নিশ্চিত। তিনি এখনই উপদেষ্টা পদ ছেড়ে দলের নেতৃত্ব তুলে নেবেন কিনা এটি নিশ্চিত নয়। তাঁর সঙ্গে আরেকজন কে হবেন নেতৃত্বের অংশ সেটি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তরুণ নেতারা চাচ্ছেন, বয়োজ্যেষ্ঠ কেউ যিনি সর্বজনগ্রাহ্য, এমন জুতসই কাউকে খুঁজছেন তারা। আবার ছাত্রনেতাদের মধ্য থেকেও অনেকের কথা আলোচনা হচ্ছে। এরমধ্যে আখতার হোসেন, জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আলী আহসান জুনায়েদ, হাসনাত আবদুল্লাহর কথা শোনা যাচ্ছে। আবার তাদের কেউ উপদেষ্টাও হয়ে যেতে পারেন। 
দল গঠনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে জনমানুষের প্রত্যাশা জানতে সপ্তাহব্যাপী ‘আপনার চোখে নতুন বাংলাদেশ’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ লাখের বেশি মানুষের মতামত সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন নেতারা।

দলের নাম কী হবে– তাও মানুষের কাছে জানতে চাওয়া হচ্ছে কর্মসূচিতে। এরমধ্যে প্রস্তাবিত কিছু নাম হলো, পিপলস রেভলিউশন পার্টি (পিআরপি), পিপলস পাওয়ার পার্টি (পিপিপি), ইউনাইটেড রেভলিউশন পার্টি (ইউআরপি), ইউনাইটেড পিপলস পার্টি (ইউআরপি), ইকুয়ালিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউডিপি), রেভলিউশনারি পিপলস পার্টি (আরপিপি), ডেমোক্রেটিক পিপলস পার্টি (ডিপিপি), পিপলস মুভমেন্ট পার্টি (পিএমপি) ইত্যাদি। 

 

 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গণঅভ য ত থ ন ছ ত র স গঠন র স গঠন র ন সমন বয়ক উপদ ষ ট কম ট র ইসল ম সদস য

এছাড়াও পড়ুন:

ছয় কোটি শ্রমিক রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার বাইরে

দেশের মোট শ্রমিকের ৮৪ দশমিক ১ শতাংশের কোনো দায়দায়িত্ব নেয় না রাষ্ট্র । শ্রমিক হিসেবে তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। কোনো রকম আইনি ও সামাজিক সুরক্ষা নেই। কর্মস্থলের পরিচয়পত্র নেই। কাজের ক্ষেত্রে অন্যায়ের শিকার হলে তাদের শ্রম আদালতে মামলা করার সুযোগও নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী,  অপ্রাতিষ্ঠানিক এই শ্রমিকের সংখ্যা ৫ কোটি ৯৬ লাখ ৮০ হাজার।

বিশালসংখ্যক শ্রমিকের প্রতি রাষ্ট্রের এ রকম অবহেলার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সরকারের গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গত ২১ এপ্রিল পেশ করা কমিশনের ২৫ সুপারিশের মধ্যে প্রথমে প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সব শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা ও স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। 

দেশের শ্রম খাতের দুর্বলতা চিহ্নিত করা এবং শ্রমিকের অধিকার ও জীবনমান উন্নয়নে সুপারিশ প্রণয়নের উদ্দেশ্যে গঠিত ১৯ সদস্যের কমিশনপ্রধান ছিলেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ। জানতে চাইলে গতকাল তিনি সমকালকে বলেন, ‘আমরা সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছি। শ্রম আইনে অন্য সব শ্রমিকের মতো একই অধিকার এবং সুযোগসুবিধা পাওয়ার পাশাপাশি ক্ষেত্রবিশেষে তাদের বাড়তি সুবিধা দেওয়ার কথা বলেছি। সামাজিক সুরক্ষার আওতায় তাদের জন্য ভাতার কথা বলেছি। প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকের জন্য এ সুবিধার সুপারিশ করা হয়নি। কারণ, তারা চাকরি শেষে কমবেশি কিছু আর্থিক সুবিধা পান।’ 

কমিশনের এ সব সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে নিয়মিত নজরদারি রাখার কথাও জানান তিনি। 

এ বাস্তবতায় আজ বৃহস্পতিবার মহান শ্রমিক দিবস পালন করা হচ্ছে। আজ সরকারি ছুটি থাকবে। এ দিনও কাজ করতে হবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দিবসটি পালনের বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘শ্রমিক মালিক এক হয়ে, গড়ব এ দেশ নতুন করে’। 

বিবিএসের গত নভেম্বরে প্রকাশিত সর্বশেষ জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যা ১২ কোটি ৬ লাখ ২০ হাজার। তাদের মধ্যে শ্রমশক্তি ৭ কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার। মোট শ্রমশক্তির ৮৪ দশমিক ১ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। 

দেশে শ্রমশক্তি বলতে ১৫ বছরের বেশি বয়সের মানুষের মধ্যে যারা কর্মে নিয়োজিত এবং বেকার জনগোষ্ঠীর সমষ্টিকে বোঝায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা–আইএলওর মানদণ্ড অনুযায়ী, যারা সাত দিনে কমপক্ষে ১ ঘণ্টার বেতন, মজুরি বা মুনাফার বিনিময় অথবা পরিবারের নিজস্ব ভোগের জন্য পণ্য উৎপাদনের কাজ করেছেন জরিপে তাদের কর্মে নিয়োজিত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আবার যারা কর্মক্ষম কিন্তু কোনো কাজে নিয়োজিত নন, নির্দিষ্ট সময়ে কাজ খুঁজে বেড়ান এবং ওই সময়ে কাজের সুযোগ পেলে সে কাজ করতে প্রস্তুত তাদের বেকার বলা হয়েছে। এ হিসাবে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৪ লাখ ৬০ হাজার। 

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক কারা 

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা–আইএলওর আন্তর্জাতিক শ্রম পরিসংখ্যানবিদের সম্মেলন ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অব লেবার স্ট্যাটিসিয়ান্স–আইসিএলসির সংজ্ঞা অনুযায়ী, বেসরকারি অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি বা খানামালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান, যেগুলোর আইনি সত্তা নেই, পরিপূর্ণ হিসাব নেই, উৎপাদনের হিসাব দিতে হয় না এবং বেসরকারি ও অনিবন্ধিত–এরকম খাতকে অনানুষ্ঠানিক খাত এবং এ খাতের শ্রমিকদের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক বলা হয়। 

মূলত কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক বেশি। কৃষিতে ৯৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক। শিল্প খাতে ৮২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের বড় অংশই গ্রামে থাকেন। 

বিবিএস বলছে, গ্রামের মোট শ্রমিকের ৮৭ দশমিক ৪ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। সংখ্যায় তারা ৪ কোটি ৬১ লাখ ১০ হাজার। শহরের শ্রমিকদের এ হার কিছুটা কম। ৭৪ দশমিক ৫ শতাংশ। সংখ্যায় এক কোটি ৩৫ লাখ ৭০ হাজার। নারী শ্রমিকদের ৯৫ দশমিক ৭ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে থাকেন।

শ্রম আইনে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকেও অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ কমিশনের 

শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক, কৃষি, গৃহশ্রমিক, অভিবাসী, স্বনিয়োজিত শ্রমিকসহ সব শ্রমিকের জন্য শ্রম আইনে সুরক্ষা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে শ্রমিকদের কাজের স্বীকৃতি, পরিচয়পত্র, নিরবচ্ছিন্ন কাজ এবং আয়ের নিশ্চয়তা, মর্যাদাকর শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়। এতে আরও বলা হয়, এসব শ্রমিকের জন্য রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা হিসেবে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সব অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় থেকে প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আলাদা অফিস অথবা ডেস্ক স্থাপন করতে হবে। শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা এবং কল্যাণে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের সব ধরনের তথ্য নিয়ে তথ্যভান্ডার করা, পরিচয়পত্র দেওয়া এবং অবসর ভাতা চালুসহ বেশ কিছু সুপারিশ করে কমিশন। 

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের প্রবীণ শ্রমিকদের জন্য অসরকালীন ভাতার সুপারিশ 

রাষ্ট্রের নিম্নতম মজুরি বোর্ডের আওতায় বিভিন্ন সুবিধা পেয়ে থাকেন প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা। অবসরের পরও কিছু সুবিধা পান তারা। তবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা সারা জীবন খাটুনির পর প্রবীণ বয়সে আরও কষ্টে থাকেন। কারণ সামান্যতম কোনো সুবিধা পান না তারা। এ বিবেচনা থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য অসরকালীন ভাতা বা তাদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনার সুপারিশ করেছে কমিশন। তাদের অবসরের বয়সসীমা ৬০ বছর নির্ধারণের কথা বলা হয় এতে। দরিদ্র বেকার শ্রমিকদের বয়স্কভাতা এবং তাদের প্রতিদিনের খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা ও অন্যান্য চাহিদা বিবেচনায় বয়স্কভাতার পরিমাণ নির্ধারণের কথা বলেছে কমিশন। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের পেশা ও খাত অনুযায়ী সংগঠিত হওয়া, প্রতিনিধিত্ব করা ও নিয়োগকারী, তাদের সমিতি করার সুযোগ দেওয়ার কথাও বলা হয় কমিশনের সুপারিশে। 

প্রাতিষ্ঠানিকের ৫৫ খাতেও ন্যূনতম মজুরি নেই 

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের চেয়ে কিছুটা ভালো হলেও প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের অবস্থাও খুব বেশি ভালো নয়। এখনও অনেক শিল্প খাতকে ন্যূনতম মজুরি কাঠামোর আওতায় আনা হয়নি। মালিকপক্ষ যা দেয়, তা মেনে নিয়ে কাজ করেন শ্রমিকরা। এরকম অন্তত ৫৫টি খাতে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হয়নি। 

শ্রম মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশের স্বীকৃত শিল্প আছে ১০২টি। 

টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পের মজুরি বোর্ড হয় সর্বশেষ ১৯৮৩ সালে। অর্থাৎ, গত তিন যুগ ধরে একই মজুরি চলছে এ খাতে। জানতে চাইলে সরকারের নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সচিব রাইসা ইসলাম গতকাল সমকালকে বলেন, ন্যূনতম মজুরি কাঠামোতে বর্তমানে ৪৭টি শিল্প রয়েছে। নতুন করে দুটি শিল্পকে ন্যূনতম মজুরির আওতায় আনা হবে। আরও ২০ শিল্পকে এর আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে। তিনি জানান, পেট্রোল পাম্পের শ্রমিকদের মজুরি পুনঃনির্ধারণে বোর্ড গঠন হয়েছে। মালিক পক্ষ এ-সংক্রান্ত সভায় আসছে না। এ অবস্থায় করণীয় জানতে শ্রম মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ চেয়েছে মজুরি বোর্ড। 

টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পে তিন যুগ ধরে একই মজুরির বিষয়ে জানতে চাইলে রাইসা ইসলাম বলেন, টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পের আর অস্তিত্ব নেই। খাতটি হয়তো বিলুপ্ত ঘোষণা করা হবে। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ