মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক ব্রিটিশ নাগরিককে আট বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া সিলেটে থাকা তাঁর স্ত্রী, শ্যালক ও মামাকে চার বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

আজ বৃহস্পতিবার সিলেটের বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালতের বিচারক মো. শাহাদাৎ হোসেন প্রামানিক এ রায় ঘোষণা করেন। দুদক সিলেটের আদালত পরিদর্শক মো.

জাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে রায়ের তথ্য নিশ্চিত করে জানান, আদালত কারাদণ্ডপ্রাপ্ত চার আসামিকে ৮৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন।

দণ্ডপ্রাপ্ত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক হচ্ছেন সিলেটের শাহজালাল উপশহর এলাকার স্প্রিং গার্ডেনের বাসিন্দা মিসবাহ উদ্দিন ওরফে রবিন চৌধুরী। অন্য তিনজন হলেন তাঁর স্ত্রী শাহিদা বেগম, বিয়ানীবাজার উপজেলার ছোটদেশ গ্রামের বাসিন্দা মিসবাহর মামা আবদুল খালেক ওরফে মাখন উদ্দিন এবং মিসবাহর শ্যালক ও গোলাপগঞ্জ উপজেলার উত্তর রায়গড় গ্রামের রিপন সিরাজ। রায় ঘোষণা শেষে মিসবাহ উদ্দিনসহ তিন আসামিকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। শাহিদা পলাতক থাকায় তাঁর বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালের ৬ জুন যুক্তরাজ্যের হোম অফিসের এক চিঠির ভিত্তিতে মিসবাহ উদ্দিন চৌধুরীর বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, মিসবাহ লন্ডনে একটি প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপক থাকাকালে ২০০৭ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে নিজ নামে মোট ১৩টি জাল মর্টগেজ আবেদনের মাধ্যমে তিনি এবং অন্যরা মিলে ৫০ লাখ পাউন্ডেরও বেশি টাকা আত্মসাৎ করেন, যার বড় একটি অংশ বাংলাদেশে পাঠানো হয়।

চুরি, মিথ্যাচার ও নিজ অবস্থানের অপব্যবহার করে জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা প্রাপ্তি ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে ২০১১ সালের আগস্ট মাসে মিসবাহ লন্ডন পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন বলেও দুদক জানিয়েছে। সংস্থাটি আরও জানায়, পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে মিসবাহ নিজের নাম পরিবর্তন করে রবিন চৌধুরী নাম ধারণ করেন এবং এ নামে যুক্তরাজ্যের পাসপোর্ট ও ড্রাইভিং লাইসেন্সও সংগ্রহ করেন।
২০০৮ সালে রবিন চৌধুরী ইংল্যান্ড থেকে ১৬ কোটি টাকার রেমিট্যান্স বাংলাদেশে পাঠান। এসব টাকা তিনি তাঁর বাবা আবদুর রহিম, স্ত্রী শাহিদা বেগম, শ্যালক রিপন সিরাজ ও মামা মাখন উদ্দিনের নামে পাঠান। এর বাইরেও রবিন আরও টাকা বাংলাদেশে পাঠান। সব মিলিয়ে ৪৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা তিনি যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশে আনেন।

দুদক জানিয়েছে, মিসবাহ উদ্দিন মর্টগেজ ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে পাওয়া টাকা এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে এনে বিভিন্ন ব্যাংক শাখায় তাঁর নিজের, স্ত্রী ও বাবার নামে টাকা স্থানান্তর করে এফডিআর বিনিয়োগ, এসওডি ঋণ গ্রহণ করে শেয়ার ক্রয়, ফ্ল্যাট ক্রয়, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগসহ বিভিন্ন ব্যাংকে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে হস্তান্তর করে মানি লন্ডারিং করেছেন। এ অবস্থায় তাঁদের বিরুদ্ধে দুদক মামলা করে।

মামলার তদন্ত শেষে ২০১৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি দুদক প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারী মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্র দাখিলের পর আসামি আবদুর রহিম মৃত্যুবরণ করায় ২০১৭ সালের ১৪ মে এক আদেশে তাঁকে বাদ দেওয়া হয়।

দুদক সিলেটের কোর্ট পরিদর্শক মো. জাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চার আসামিকে আদালত সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন। এ ছাড়া অর্থদণ্ড পরিশোধের জন্য ২০২৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন। এ সময়ের মধ্যে দণ্ডিত অর্থ পরিশোধ না করলে আসামিদের প্রত্যেককে এক বছর করে বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন আদালত। এ ছাড়া আসামিদের ব্যাংকে অবরুদ্ধ টাকাসহ মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে আনা টাকা ও কেনা সম্পত্তি আদালত রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করেছেন।

মো. জাহিদুল ইসলাম আরও জানান, দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে শাহিদা পলাতক থাকায় তাঁর বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানা ইস্যু করেছেন আদালত। এ ছাড়া অন্য তিন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কর ছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

গন্ধগোকুলের বাঁচার লড়াই

দেশের অনেক এলাকা থেকেই গন্ধগোকুল হারিয়ে গেছে; কিন্তু পাবনার বেড়া পৌর এলাকার কয়েকটি মহল্লায় এখনো এ প্রাণীর বিচরণ চোখে পড়ে। তবে আগের মতো অত বেশি দেখা যায় না। প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোটের (আইইউসিএন) তালিকা অনুযায়ী এগুলো ‘বিপদাপন্ন’ প্রাণী।

প্রাণীটির আসল নাম গন্ধগোকুল হলেও বেড়া উপজেলায় এটি ‘নেল’ নামে পরিচিত। অনেকে এগুলোকে বাগডাশও বলেন। এর শরীর থেকে পোলাও চালের গন্ধের মতো মিষ্টি গন্ধ ছড়ায়। সন্ধ্যার পর অন্ধকার নামলে পৌর এলাকার বিভিন্ন বাড়ির ঘরের চাল ও গাছের ওপর দিয়ে শুরু হয় এর চলাচল। এ সময় এর শরীরের গন্ধ উৎপাদনকারী গ্রন্থি থেকে রস নিঃসৃত হতে থাকে বলে যে স্থান দিয়েই এরা যাক না কেন, বেশ কিছুক্ষণ ধরে সেখানে সেই গন্ধ নাকে আসে। তখন মহল্লার বাসিন্দারা বুঝতে পারেন, আশপাশে হয়তো গন্ধগোকুল আছে, নয়তো একটু আগেই আশপাশ দিয়ে গেছে।

দীর্ঘদিন ধরেই গন্ধগোকুল বা নেল নামের প্রাণীটির সঙ্গে বেড়া পৌরবাসীর সম্পর্ক। বেশির ভাগ বাসিন্দার কাছেই প্রাণীটি বেশ পছন্দের। তবে অল্প কিছু মানুষ এগুলোকে অপছন্দ করেন গৃহপালিত হাঁস-মুরগি, কবুতর ধরে নিয়ে যাওয়ার কারণে। তবে গত ১০-১২ বছরের মধ্যে পৌরবাসী এই প্রাণীকে ফাঁদ পেতে ধরেছেন বা এগুলোর কোনো ক্ষতিসাধন করেছেন বলে শোনা যায় না।

বন্য প্রাণী ও পরিবেশবিশেষজ্ঞদের মতে, গন্ধগোকুল প্রকৃতির উপকারী একটি নিশাচর প্রাণী। গন্ধগোকুল ব্যাঙ, ইঁদুরসহ ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে উদ্ভিদের বংশবৃদ্ধিতে দারুণ ভূমিকা রাখে; কিন্তু ভুল ধারণার কারণে অনেকেই প্রাণীটির জীবন হুমকির দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। একটি সময় ছিল, যখন এগুলোকে দেশের প্রায় সর্বত্রই— বনাঞ্চল বা বনসংলগ্ন ঝোপঝাড় বা গ্রামাঞ্চলে দেখা যেত। তবে এখন এগুলো বিলুপ্তির পথে।

গন্ধগোকুল তাল ও খেজুরের রস পান করে, ইঁদুর, ছোট পাখি ও পোকামাকড় প্রভৃতি খেয়ে জীবনধারণ করে; কিন্তু কখনো কখনো গৃহপালিত হাঁস-মুরগি বা কবুতর ধরে নিয়ে যায় বলে মানুষ এগুলো ফাঁদ পেতে ধরে হত্যা করে। আবার অনেক সময় রাস্তা পারাপারের সময় গাড়িচাপায়ও মারা যায়। এতে এগুলোর অস্তিত্ব কিছুটা হুমকির মুখে পড়েছে। এগুলোকে বিপদাপন্ন বলা যেতে পারে।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গন্ধগোকুলের রয়েছে বিশেষ এক ভূমিকা। খাদ্যশৃঙ্খলের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান প্রাণীটির। এগুলো মূলত ক্ষতিকর পোকামাকড় ও ফলমূল খেয়ে এর বীজ বিস্তারের মাধ্যমে পরিবেশের প্রচুর উপকার সাধন করে। যেমন বটের ফল বা অন্যান্য ফল যখন খায়, তখন এর মলের দ্বারা নির্গত সেই বীজগুলো সফল উদ্ভিদে পরিণত হয়। অর্থাৎ এর পেটের ভেতর দিয়ে ফলের বীজগুলো গজানোর উপযুক্ত পরিবেশ (জার্মিনেশন) পায় বলে তা পরবর্তী সময়ে বীজের অঙ্কুরোদ্‌গমে শতভাগ কার্যকর হয়ে থাকে।

বছরে সাধারণত দুবার প্রজনন করে। গর্ভধারণকাল দুই মাসের কিছু বেশি। পুরোনো গাছের খোঁড়ল, গাছের ডালের ফাঁক, পরিত্যক্ত ঘর, ধানের গোলা বা তাল-সুপারির আগায় ছানা তোলে। সাধারণত প্রতিবারই ছানা হয় তিনটি।

বেড়ার মনজুর কাদের মহিলা কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, ‘দেশের অনেক এলাকা থেকেই গন্ধগোকুল বিলুপ্ত হতে বসেছে। তবে বেড়া পৌর এলাকায় এগুলোর বিচরণ যেমন কিছুটা বেশি, তেমনি পৌরবাসীও এগুলোর প্রতি সহানুভূতিশীল।’

প্রাণীটির ছবি তুলে রাজশাহী বিভাগীয় বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বন্য প্রাণী পরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবিরের কাছে পাঠালে তিনি সেটিকে ‘বাগডাশ’বলে শনাক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘প্রাণীটির অস্তিত্ব এখনো দেশের বিভিন্ন জায়গায় আছে। এর মধ্যে বেড়া পৌর এলাকায় এগুলোর বিচরণ কিছুটা বেশি বলে শুনেছি।’

বেড়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, বাগডাশ বা গন্ধগোকুল মানুষের কাছাকাছি থাকে; কিন্তু মানুষ দেখলে খুবই ভয় পায়। খুবই লাজুক স্বভাবের প্রাণী এটি। আবাসভূমি ধ্বংস ও হাঁস-মুরগি বাঁচানোর জন্য ব্যাপক নিধনের কারণে এগুলো এখন বিপন্ন। তবে প্রাণীটি কিন্তু প্রকৃতির বন্ধু। তাই সবারই উচিত এগুলোর প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া।

সম্পর্কিত নিবন্ধ