খেলাপি ঋণ বেড়ে ৩ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা
Published: 27th, February 2025 GMT
খেলাপি ঋণের আসল চিত্র সামনে আসতে শুরু করেছে। গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। এটি মোট ঋণের ২০ দশমিক ২০ শতাংশ। এই খেলাপি ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ২ লাখ ১৩১ কোটি টাকা বেশি। গত বছরের শেষ তিন মাসে বেড়েছে ৬০ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর গতকাল সংবাদ সম্মেলনে খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি গভর্নরের দায়িত্ব নিয়ে বলেছিলাম খেলাপি ঋণ বাড়বে। এখন দেখা যাচ্ছে, আমার অনুমান ঠিক আছে। তবে এখনও আমাদের খেলাপি ঋণ সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছায়নি। সামনে এটা আরও বাড়বে। কোনো তথ্য আমরা লুকিয়ে রাখব না।’ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর পর এটা আবার কমবে বলে তিনি মনে করেন। নতুন করে বিতরণ করা ঋণ যেন খেলাপি না হয় সেজন্য বিভিন্ন আইনি কঠোরতা আনার কথা জানান তিনি।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে কয়েকটি গ্রুপ ঋণের নামে বিপুল অর্থ বের করে নিয়েছে। তাদের বেশির ভাগই এখন পলাতক। কেউ কেউ গ্রেপ্তার হয়ে জেলে আছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ঋণ পরিশোধ না করেও বিভিন্ন উপায়ে নিয়মিত দেখানোর সুযোগ দেওয়া হয়। তবে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এখন তারা খেলাপি। এরই মধ্যে এস আলম, বেক্সিমকোসহ শীর্ষ ঋণগ্রহীতাদের অনেকেই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বিতরণ করা মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ১১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। তিন মাস আগে তা ছিল ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৮২২ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের মোট ঋণের ৪২ দশমিক ৮৩ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। তিন মাস আগে তা ছিল ৪০ দশমিক ৩৫ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৫ দশমিক ৬০ শতাংশ হয়েছে।
২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়। সে হিসাবে এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ১৩১ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের জুন শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। অর্থাৎ ছয় মাসে বেড়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। তিন মাস আগে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা ছিল খেলাপি। গত কয়েক প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ দ্রুত বেড়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ বেড়েছে, আরও বাড়বে। এর কারণ খেলাপি ঋণের হিসাব পদ্ধতিতে পরিবর্তন এসেছে। আগে একটি মেয়াদি ঋণ অপরিশোধিত থাকার ৬ মাস পর থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ হিসাব করা হতো। এখন তিন মাস এবং আগামীতে অপরিশোধিত থাকার পরদিন থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ হিসাব করা হবে। এখন আদালতের স্থগিতাদেশ-সংক্রান্ত রিট ভ্যাকেট হচ্ছে। নতুন করে পুনঃতপশিল হচ্ছে কম।
গভর্নর বলেন, আমরা চাচ্ছি ব্যাংক থাকুক না থাকুক আমানতকারী যেন অর্থ ফেরত পান। একই সঙ্গে একটি শত্তিশালী ব্যাংক খাত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হচ্ছে। কিছু ব্যাংক একীভূতকরণ করা হবে। আমানতকারীর টাকা পেতে যেন সমস্যা না হয় এজন্য বীমা তহবিল থেকে অর্থ ফেরতের পরিমাণ দ্বিগুণ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, একটি সমস্যা হলো– চাহিদা মতো আমানত বাড়ছে না। বর্তমানে ৭-৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি গ্রহণযোগ্য না। জনগণের আস্থা ফেরানোর মাধ্যমে আমানত বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। আবার বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন ভারসাম্যে ইতিবাচক ধারা বজায় রাখা, রিজার্ভ আরও শক্তিশালী অবস্থানে নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে এসব ক্ষেত্রে ইতিবাচক কিছু পরিবর্তন এসেছে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের সময় খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এর পর থেকে খেলাপি ঋণ বেড়েই চলছে। মাঝে কয়েক বছর নানা শিথিলতার মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর চেষ্টা করা হয়। এ ক্ষেত্রে কখনও বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনঃতপশিল, কখনও ঋণ ফেরত না দিলেও নিয়মিত দেখানোর সুযোগ দেওয়া হয়। গুটিকয়েক ব্যবসায়ীকে সুবিধা দিতে গিয়ে পুরো ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। এতদিন লুকিয়ে রাখা খেলাপি ঋণ এখন বেরিয়ে আসছে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ড স ম বর ঋণ ব ড় দশম ক সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
নোয়াখালীর কৃষকেরা কেন হাইব্রিড ধানবীজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন
দুই একর জমিতে জিংকসমৃদ্ধ ব্রি-৭৪ জাতের ধান চাষ করেছেন নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার পূর্ব চরবাটা এলাকার কৃষক মো. মোস্তফা। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-ব্রি উদ্ভাবিত এই জাতের প্রতি হেক্টরে ফলন হয়েছে ৯ দশমিক ২৩ মেট্রিক টন, যা বাজারে থাকা যেকোনো হাইব্রিড ধানের চেয়ে বেশি।
নিজের খেতে চোখজুড়ানো সোনালি ধান দেখে অনেক বেশি উচ্ছ্বসিত কৃষক মোস্তফা। কারণ, বাজার থেকে কেনা হাইব্রিড ধান থেকে বীজ করা যায় না। কিন্তু ব্রি উদ্ভাবিত এই ধান থেকে অনায়াসে বীজ তৈরি করতে পারবেন তিনি। এতে থাকবে না বীজ কেনা নিয়ে দুশ্চিন্তা। সেই সঙ্গে ধানগুলো জিংকসমৃদ্ধ হওয়ায় পরিবারের জিংকের ঘাটতিও দূর হবে। মোস্তফা বলেন, আগামী দিনে তিনি আরও বেশি পরিমাণ জমিতে এই ধান চাষ করবেন।
মোস্তফার মতো একই এলাকার আরেক কৃষক ওমর ফারুকও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট(ব্রি) উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান ব্রি-৯২ চাষ করেছেন দুই একর জমিতে। বীজ ও সারসহ এ পর্যন্ত তাঁর খরচ হয়েছে ৬২ হাজার টাকা। খেতের ধান এরই মধ্যে পাকা শুরু করেছে। ফলনের যে অবস্থা দেখছেন, তাতে মনে হচ্ছে, একরে ফলন হবে কমপক্ষে ১৭০ মণ। যার বাজারমূল্য দেড় লাখ টাকার বেশি।
ওমর ফারুকের খেতে ব্রির এই উচ্চ ফলনশীল ধানের আবাদ দেখে এরই মধ্যে আশপাশের এলাকার অনেক কৃষক যোগাযোগ করেছেন বীজ নেওয়ার জন্য। কারণ, তাঁরা হাইব্রিড চাষ করে ঝুঁকিতে পড়তে চান না। নিজের বীজে নিজেই স্বয়ংসম্পন্ন হতে চান। তাই ওমর ফারুক ঠিক করেছেন, উৎপাদিত ধান থেকে ২৫ মণ রেখে দেবেন বীজের জন্য। এই বীজ বিক্রি করে বাড়তি আয় হবে তাঁর।
শুধু কৃষক হাজি মোস্তফা কিংবা ওমর ফারুকই নন, নোয়াখালীর সুবর্ণচরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার কৃষকেরা চলতি বোরো মৌসুমে ব্রি উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষ করে সফলতার মুখ দেখেছেন। পাচ্ছেন হাইব্রিড ধানের চেয়েও বেশি ফলন। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর গ্রামের কৃষক মাহফুজা বেগম ও আশরাফ হোসেন দম্পতির খেতে চাষ করা ডায়াবেটিক রোগীদের সহনীয় ব্রি-১০৫ জাতের ধানের ফলন পাওয়া গেছে হেক্টরপ্রতি ৮ দশমিক ২ টন, যা বাজারের হাইব্রিড বীজের সমান। এই ধানেরও বীজ সংরক্ষণ করতে পারবেন কৃষকেরা।
চলতি বোরো মৌসুমে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলে নতুন জাতের ব্রি ধানের ৪৯০টি প্রদর্শনী খামার করেছে। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন-পিকেএসএফের স্থানীয় সহযোগী প্রতিষ্ঠান সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে এসব প্রদর্শনীতে ব্রি উদ্ভাবিত ৮ জাতের ধান চাষ করা হয়েছে। এই জাতের ধানগুলো উচ্চ ফলনশীল, রোগ প্রতিরোধী এবং বিভিন্ন পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ।
কৃষকেরা জানান, এত দিন তাঁরা বাজার থেকে বিভিন্ন কোম্পানির হাইব্রিড ও দেশীয় উফশী (উচ্চ ফলনশীল) জাতের ধানের বীজ কিনে আবাদ করে আসছেন। এবার এসবের বাইরে ব্রি উদ্ভাবিত উফশী ২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ ধান আবাদ করেছেন অনেকে। এর মধ্যে হাইব্রিড বীজের প্রতি কেজির দাম ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা। আর ব্রির উফশী ধানের বীজ ৫০-১০০ টাকায় পাওয়া যায়। এর মধ্যে প্রতি একর জমিতে চাষ করতে হাইব্রিড ধানের বীজ লাগে ৬ কেজি এবং উফশী জাতের বীজ লাগে ১০ কেজি। এসব বীজের মধ্যে হাইব্রিড প্রতি একরে উৎপাদন হয় ৯০ মণ, উফশী (উচ্চ ফলনশীল) ব্রি-২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ উৎপাদন হয় ৭০-৭৫ মণ।
পিকেএসএফের কৃষি ইউনিট পরিচালিত সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার কৃষিবিদ শিবব্রত ভৌমিক প্রথম আলোকে বলেন, নোয়াখালী অঞ্চলের ৯৫ শতাংশ কৃষক বোরো মৌসুমে মূলত বাজারের হাইব্রিড ধানের ওপর নির্ভর থাকেন। আর দেশীয় উদ্ভাবিত ব্রি ধান জাত আবাদ করেন মাত্র ৫ শতাংশ কৃষক। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, হাইব্রিড ধান রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এতে অনেক কৃষকই লোকসানের মুখে পড়ছেন। তবে এ ক্ষেত্রে ব্রি উদ্ভাবিত নতুন ব্রি-ধানগুলোর ফলন হাইব্রিডের মতো ফলন দেয় এবং কিন্তু রোগবালাই নেই বললেই চলে। এতে কৃষকের খরচ কমে। লাভ হয়, আর বীজও থাকে নিজের হাতে।
ব্রির উচ্চফলনশীল জাতের নতুন জাতের ধান চাষের কথা বলতে গিয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মীরা রানী দাশ প্রথম আলোকে বলেন, ব্রি-উদ্ভাবিত বিভিন্ন পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ ধানগুলো চাষাবাদে কৃষকদের মধ্যে তাঁরা ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ করছেন। এর প্রধান কারণ হলো, এসব ধান চাষ করলে একদিকে পুষ্টির ঘাটতি পূরণ হবে, অন্যদিকে কৃষকেরা নিজেরা নিজেদের বীজ সংরক্ষণ করতে পারবেন। তা ছাড়া ব্রি উদ্ভাবিত এসব ধানে রোগবালাইয়ের আক্রমণ হাইব্রিডের তুলনায় কম এবং ফলন হাইব্রিডের সমান কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে হাইব্রিড থেকেও বেশি।
এ বিষয়ে ব্রির ফেনীর সোনাগাজীর আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্রি এ পর্যন্ত ১১৫টি জাত আবিষ্কার করেছে। আগে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল খাদ্যের অভাব দূর করা, ফলন বাড়ানো। বর্তমানে আমাদের উদ্দেশ্য খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা। খাবার যাতে পুষ্টিমানসম্পন্ন হয়। অধিকাংশই আমিষ ও ভিটামিনের উৎস মাছ, মাংস, ডিম এবং ফলমূল। কিন্তু এসব সবাই কিনে খেতে পারেন না। যেহেতু ভাত প্রধান খাদ্য, এখন আমাদের যে জাতগুলো, এগুলো উদ্ভাবনে পুষ্টির দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে।’ নতুন জাতগুলো পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, সেই সঙ্গে হাইব্রিডের প্রতি নির্ভরতা কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে তাঁরা আশা করছেন।