হিরু-সাদিয়ার কারসাজিতে এশিয়া ইন্স্যুরেন্স, ১৯ কোটি টাকা অর্থদণ্ড
Published: 4th, March 2025 GMT
পুঁজিবাজারে বিমা খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি এশিয়া ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের শেয়ার কারসাজিতে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে সমবায় অধিদপ্তরে উপ-নিবন্ধক ও শেয়ার ব্যবসায়ী মো. আবুল খায়ের হিরুর বিরুদ্ধে। এ কারসাজিতে তার সহযোগী ছিলেন স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান ও সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠান ডিআইটি কো-অপারেটিভ।
তদন্তে শেয়ার কারসাজির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আবুল খায়ের হিরু, তার স্ত্রী ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে মোট ১৯ কোটি টাকা জরিমানা করেছে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
২০২০ সালের ২২ অক্টোবর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত কারসাজি করে এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারের দাম বাড়ানো হয়। কোম্পানিরর শেয়ার কারসাজিতে হিরু, তার স্ত্রী ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান একাধিক বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাব খুলে সিরিজ ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে অস্বাভাবিকভাবে দাম বাড়িয়ে মুনাফা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে বিএসইসির তদন্তে জানা গেছে।
পুঁজিবাজারে কয়েক বছর ধরে গুঞ্জন ছিল—এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার নিয়ে কারসাজি করেছিল হিরু ও তার সহযোগীরা। অবশেষে তদন্ত সাপেক্ষে কোম্পানির শেয়ার কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় এনেছে বিএসইসি।
বিগত সরকারের আমলে আইন লঙ্ঘন করা শেয়ার কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তবে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন পুনর্গঠিত বিএসইসি যেকোনো ধরনের কারসাজির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএসইসির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এসব তথ্য রাইজিংবিডি ডটকমকে নিশ্চিত করেছেন।
বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কারসাজির দায়ে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স, ১৯৬৯ এর সেকশন ১৭(ই)(৫) এর ক্ষমতাবলে মো.
কারসাজিতে জড়িতদের পরিচিতি
এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কারসাজি করে সমবায় অধিদপ্তরে উপ-নিবন্ধক আবুল খায়ের হিরু ও তার সহযোগীরা বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। এ কাজের মূলহোতা ছিলেন হিরু। কারসাজিতে তার সহযোগী হিসেবে ছিলেন স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান ও তার সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠান ডিআইটি কো-অপারেটিভ।
এর আগেও ডজনখানেক কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি করার দায়ে আবুল খায়ের হিরু ও তার সহযোগীদের একাধিকবার বড় অংকের জরিমানা করেছে বিএসইসি।
৩১তম বিসিএসের (সমবায়) কর্মকর্তা আবুল খায়ের হিরু দশ বছর আগেও বিনিয়োগকারীদের কাছে খুব একটা পরিচিত ছিলেন না। কিন্তু, পাঁচ বছর আগে আলাদিনের চেরাগ নিয়ে হাজির হন পুঁজিবাজারের আলোচিত ও সমালোচিত বিনিয়োগকারী হিরু ও তার সহযোগীরা।
সম্প্রতি সোনালী পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস ও এনআরবিসি ব্যাংকের শেয়ার কারসাজির দায়ে আবুল খায়ের হিরুকে ৫ কোটি ৬ লাখ টাকা, তার প্রতিষ্ঠান ডিআইটি কো-অপারেটিভকে ২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ও তার স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসানকে ২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়া, হিরুর ব্যবসায়িক পার্টনার বিশ্বখ্যাত ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকেও সোনালী পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলসের শেয়ার কারসাজির দায়ে ২ কোটি ২৬ লাখ টাকা জরিমানা করে বিএসইসি।
বিএসইসির তদন্ত কার্যক্রম
আবুল খায়ের হিরু, তার স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ডিআইটি কো-অপারেটিভ যোগসাজস করে এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার সিরিজ ট্রানজেকশন (লেনদেন) করে। কারসাজির সঙ্গে জড়িতরা ২০২০ সালের ২২ অক্টোবর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারের দাম বাড়ায়। এ সময়ের মধ্যে কোম্পানির শেয়ারের দাম ৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১৪.১০ টাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। আলোচ্য সময়ে কোম্পানির শেয়ারের দাম ৫৪.১০ বা ৯০.১৭ শতাংশ বেড়ে যায়।
কারসাজির পরিপ্রেক্ষিতে বিএসইসির সিদ্ধান্ত
অভিযুক্ত আবুল খায়ের হিরু স্বল্প সময়ে এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের বিপুল সংখ্যক শেয়ার সিরিজ লেনদেন করেন। এর ফলে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম অযৌক্তিভাবে বেড়ে যায়, যা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিনেন্স, ১৯৬৯ এর সেকশন ১৭(ই)(৫) সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ কর্মকাণ্ডের মাধ্যেমে তারা একটি কৃত্রিম বাজার সৃষ্টি ও পুঁজিবাজারের সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ক্রয়ের জন্য প্রভাবিত করার অপপ্রয়াস চালিয়েছেন। উক্ত আইন ইচ্ছাকৃতভাবে লঙ্ঘনের ফলে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স, ১৯৬৯ এর সেকশন ২২ অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ।
এদিকে, ডিআইটি কো-অপারেটিভ ও কাজী সাদিয়া হাসানের বিও হিসাবের মধ্যে এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের বিপুল সংখ্যক শেয়ার সিরিজ লেনদেন হয়। এর ফলে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম অযৌক্তিভাবে বেড়ে যায়, যা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স, ১৯৬৯ এর সেকশন ১৭(ই)(২) সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ডিআইটি কো-অপারেটিভ স্বল্প সময়ে এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার সিরিজ লেনদেন করে, যার ফলে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম অযৌক্তিভাবে বেড়ে যায়, যা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স, ১৯৬৯ এর সেকশন ১৭(ই)(৫) সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। প্রতিষ্ঠানটি একটি কৃত্রিম বাজার সৃষ্টি ও পুঁজিবাজারের সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ক্রয়ের জন্য প্রভাবিত করার অপপ্রয়াস চালিয়েছে।
কাজী সাদিয়া হাসান তার দুটি বিও হিসাব থেকে শেয়ার লেনদেনের ফলে বেনিফিশিয়ারি ওনার্সশিপের কোনো পরিবর্তন হয়নি। যা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স, ১৯৬৯ এর সেকশন ১৭(ই)(৩) এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কাজী সাদিয়া হাসান স্বল্প সময়ে এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার সিরিজ লেনদেন করে, যার ফলে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম অযৌক্তিভাবে বেড়ে যায়, যা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স, ১৯৬৯ এর সেকশন ১৭(ই)(৫) সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তিনি একটি কৃত্রিম বাজার সৃষ্টি ও পুঁজিবাজারের সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ক্রয়ের জন্য প্রভাবিত করার অপপ্রয়াস চালিয়েছেন।
শেয়ার কারসাজিতে জড়িতদের বক্তব্য ও তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, অভিযোগগুলো সঠিক ও ইচ্ছাকৃত এবং এ কর্মকাণ্ডের ফলে পুঁজিবাজারের সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অভিযুক্তদের কর্মকাণ্ড সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স, ১৯৬৯ এর সেকশন ১৭(ই)(৫), সেকশন ১৭(ই)(২) এবং সেকশন ১৭(ই)(৩) লংঘন করেছে, যা সিকিউরিটিজ আইনের পরিপন্থী।
যেহেতু, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স, ১৯৬৯ এর সেকশন ২২ অনুযায়ী সিকিউরিটিজ আইন ও বিধি-বিধান পরিপালনে ব্যর্থতার জন্য এবং পুঁজিবাজারের শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা ও জনস্বার্থে অভিযুক্তদের জরিমানা করা হয়েছে।
ঢাকা/এনটি/রফিক
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ইন স য র ন স র শ য র স র জ ল নদ ন ব যবস য় ক প র ও ত র সহয গ ব এসইস র র জন য তদন ত
এছাড়াও পড়ুন:
পুঁজিবাজারে আস্থা ফেরাতে একগুচ্ছ পদক্ষেপ নেবে বিএসইসি
শেয়ার সূচকের নিয়মিত পতনের মূল কারণ খুঁজে বের করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। সেই সঙ্গে যেসব শেয়ারের অস্বাভাবিক বিক্রির চাপ দেখা যাচ্ছে, বাজার তদারকির মাধ্যমে সেসব শেয়ার চিহ্নিত করা হবে বলেও জানিয়েছে তারা।
দেশের পুঁজিবাজারে সাম্প্রতিক নিম্নমুখী প্রবণতার পরিপ্রেক্ষিতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি। গতকাল মঙ্গলবার এক সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। সভায় পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে তাৎক্ষণিক কিছু কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সভায় উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী। এ ছাড়া সভায় বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক, বিএসইসির কমিশনার মু. মোহসিন চৌধুরী, মো. আলী আকবর, ফারজানা লালারুখ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব দেলোয়ার হোসেন, পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের প্রতিনিধি ও বিএসইসির নির্বাহী পরিচালকেরা উপস্থিত ছিলেন।
সভার সিদ্ধান্ত হয়, বিনিয়োগকারীদের জ্ঞান ও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় টক শো ও বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। পাশাপাশি বিআইসিএম ও বিএএসএম পুঁজিবাজার-বিষয়ক শিক্ষণীয় ভিডিও তৈরি করবে। ফেসবুক ও ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে পুঁজিবাজার সম্পর্কে ইতিবাচক বার্তা প্রচার ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সচেতন করা হবে।
প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানির শেয়ার পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রমালিকানাধীন লাভজনক কোম্পানির শেয়ার অফলোড করা, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্তিতে উৎসাহিত করা এবং টেক্সটাইল ও ওষুধ খাতের দেশী লাভজনক কোম্পানিগুলোর শেয়ার পুঁজিবাজারে নিয়ে আসা হবে।
যেসব কোম্পানি এখনো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়নি, তাদের তালিকাভুক্ত হতে উৎসাহিত করার জন্য আকর্ষণীয় করছাড় দেওয়া হবে। পাশাপাশি ব্যাংকিং খাত থেকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের সুযোগ সীমিত করা এবং পুঁজিবাজারকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের প্রধান উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সভায় আরও সিদ্ধান্ত হয়, পুঁজিবাজারের উন্নয়নের স্বার্থে দেশের আর্থিক খাতের অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো হবে। সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা হবে। এ ছাড়া আসন্ন জাতীয় বাজেটে বিনিয়োগকারীদের জন্য করছাড়ের সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব করা হবে। এর মধ্যে লভ্যাংশ আয়ের ওপর করছাড় এবং পুঁজিবাজারের বিনিয়োগের ওপর বিশেষ করছাড়ের সুবিধা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।