যে কারণে এক সপ্তাহের মাথায় বাতিল হলো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিশেষ নিরাপত্তা নির্দেশিকা
Published: 11th, March 2025 GMT
দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিশেষ নিরাপত্তা দিতে তৈরি করা একটি নির্দেশিকা এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাতিল করল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে গত ৯ মার্চ ‘প্ররক্ষা নির্দেশিকা ২০২৫’ বাতিল করা হয়। এর ফলে আগের নির্দেশিকা দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তা দেওয়া হবে।
এর আগে ২ মার্চ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বিশেষ নিরাপত্তা প্রদানবিষয়ক নির্দেশনাটি জারি করেছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে ৬ মার্চ এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনিকে তলব করেন হাইকোর্ট। সচিবকে ১৮ মার্চ আদালতে হাজির হতে বলা হয়। তাঁর আদালতে হাজির হওয়ার আগেই নির্দেশনাটি বাতিল করা হলো।
দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও পদাধিকারবিশিষ্ট ব্যক্তিদের বিশেষ নিরাপত্তা দিতে ২০০১ সালে করা প্ররক্ষা নির্দেশিকা দিয়ে এত দিন চলছিল। গত দুই দশকে বেশ কয়েকবার এটি সংশোধন হয়েছিল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার নতুন করে নির্দেশিকাটির খসড়া তৈরি করে। তাতে নতুন করে বেশ কিছু বিষয় যুক্ত করা হয়। একই সঙ্গে পদক্রমে পরিবর্তন আনা হয়।
নতুন নির্দেশিকায় বলা হয়, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান উপদেষ্টার দৈহিক নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট আইন, ম্যানুয়াল, বিধিমালা ও নির্দেশনাবলির মাধ্যমে প্রতিপালিত হবে। জাতীয় সংসদের স্পিকার, মন্ত্রিসভার সদস্য ও উপদেষ্টাদের দৈহিক নিরাপত্তা প্রতিপালিত হবে সংশ্লিষ্ট বিধির আলোকে।
নির্দেশিকার ৪ নম্বর পদক্রম তালিকায় রাখা হয় প্রধান বিচারপতি, আপিল বিভাগের বিচারপতি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, র্যাবের মহাপরিচালক, বিশেষ শাখা, সিআইডি, অ্যান্টিটেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক, বিভাগীয় কমিশনার, রেঞ্জ ডিআইজি, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারকে। এসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তিনটি সুবিধা আবাসিক প্রহরী, দেহরক্ষী/গানম্যান ও গাড়ি প্রটেকশন স্কট পাবেন।
নির্দেশিকার ৫ নম্বর ক্রমিক তালিকায় রাখা হয় হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি, নির্বাচন কমিশনার, দুর্নীতি দমন কমিশনার, অ্যাটর্নি জেনারেল, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, বাংলাদেশের মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান, সরকারের জ্যেষ্ঠ সচিব ও সচিবদের। নির্দেশিকায় বলা হয়, এসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি শুধু দেহরক্ষী/গানম্যান প্রাপ্য হবেন।
নির্দেশিকার ৬ নম্বর পদক্রম তালিকায় জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা ও দায়রা জজ এবং জেলা পুলিশ সুপারকে রাখা হয়। এতে বলা হয়, তাঁরা দুটি সুবিধা আবাসিক প্রহরী ও দেহরক্ষী/গানম্যান প্রাপ্য হবেন। তবে উল্লেখিত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হলে তিনি এসব সুবিধা প্রাপ্য হবেন না।
নির্দেশিকায় আরও বলা হয়, বিশিষ্ট বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তির নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা থাকলে তিনি সংশ্লিষ্ট পুলিশ কমিশনার বা পুলিশ সুপারের (এসপি) কাছে লিখিতভাবে আবেদন করবেন। সংশ্লিষ্ট পুলিশ কমিশনার বা এসপি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। সংসদ সদস্য, বিদেশি রাষ্ট্রদূত এবং সংসদে প্রতিনিধিত্ব রয়েছে বা ছিল, এমন রাজনৈতিক দলের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, মহাসচিব বিশেষ পুলিশি নিরাপত্তার জন্য সরাসরি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে পারবেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঝুঁকি পর্যালোচনা করে তা প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান উপদেষ্টার কাছে পাঠাবেন। প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদনক্রমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষ নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় আদেশ জারি করবে।
২০০১ সালের সঙ্গে ২০২৫ সালের নির্দেশিকার তুলনা করলে বেশ কিছু পার্থক্য দেখা যায়। ২০০১ সালের নির্দেশিকায় প্রধান বিচারপতিকে এককভাবে পদক্রমে ‘ক’ তালিকায় রাখা হয়। তবে এবারের পদক্রমে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আরও ১৪ জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে যুক্ত করা হয়। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে খসড়া নির্দেশিকা নিয়ে পর্যালোচনা হয়। পরে ২ মার্চ তা জারি করা হয়।
এরপর ৬ মার্চ গুরুত্বপূর্ণ বা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বিশেষ নিরাপত্তা প্রদানসংক্রান্ত প্ররক্ষা নির্দেশিকার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি শিকদার মাহমুদুর রাজীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ আদেশ দেন। ওই নির্দেশিকার বিষয়টি আদালতের নজরে এনে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আখতার হোসেন মো.
পরে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে নিরাপত্তা প্ররক্ষা নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে, এখানে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতিকে রেঞ্জ ডিআইজি, পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ অন্যদের সঙ্গে একই রকমভাবে তুলনা করা হয়েছে। হাইকোর্টের বিচারকদের সিনিয়র সচিব ও সচিবদের সঙ্গে রাখা হয়েছে।
শিশির মনির বলেন, একই বিষয়ে আপিল বিভাগ একটি রায় দিয়েছিলেন, সে মামলায় আপিল বিভাগ যে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স (রাষ্ট্রীয় পদক্রম) ফিক্স (নির্ধারণ) করে দেওয়া হয়েছে এবং সর্বশেষ ২০২০ সালের যে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স আছে—সবকিছু লঙ্ঘন করে এটি জারি করা হয়েছে। এ জন্য ওই নোটিফিকেশন (নির্দেশিকাটি) আদালতের নজরে আনা হয়েছে।
আদালতে ২০২০ সালের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স দেখানো এবং আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি হওয়া মামলার রায়ের কথা উল্লেখ করেছেন বলে জানান শিশির মনির। তিনি বলেন, সেই মামলার রিভিউ আবেদন ২৭ এপ্রিল শুনানির জন্য রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কী করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ ধরনের নিরাপত্তা প্ররক্ষা নীতিমালা জারি করা হলো, এটা একটা বিস্ময়কর বিষয়। আইনকানুন ও ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের তোয়াক্কা না করে এই ধরনের নীতিমালা জারি করে মূলত বাংলাদেশের সংবিধান এবং বিচার বিভাগের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছে।
শুনানি নিয়ে আদালত সুয়োমোটো রুল ইস্যু করেন, কেন এই নির্দেশিকাকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না। সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনিকে ১৮ মার্চ আদালতে সশরীর হাজির হয়ে তাঁর কনডাক্ট, কী কারণে পত্র জারি করেছেন, তাঁর আচরণ ব্যাখ্যার জন্য নির্দেশনা দেন।
কিন্তু এর আগেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আমিনুল ইসলামের সই করা এক আদেশে বলা হয়, জারিকৃত গুরুত্বপূর্ণ/বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে বিশেষ নিরাপত্তা প্রদান বিষয়ে ‘প্ররক্ষা নির্দেশিকা ২০২৫’–এর কার্যকারিতা বাতিল করা হলো।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শ শ র মন র ব ত ল কর উপদ ষ ট র জন য সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইসরায়েলের হামলা
রবিবার বিকেল থেকে ইরানজুড়ে নতুন করে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। সামরিক স্থাপনার পাশাপাশি ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।
রবিবার রাতে ইরানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইদ খাতিবজাদেহ ইসরায়েলি হামলার তথ্য নিশ্চিত করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ একটি পোস্টে তিনি জানান, রবিবার রাজধানী তেহরানে ইসরায়েলি হামলায় ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খবর তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদোলুর।
এক্স-পোস্টে সাইদ বলেছেন, “ইসরায়েলের অপরাধী শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঠিক বিপরীতে অবস্থিত ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভবনে ইচ্ছাকৃত এবং নির্মম হামলা চালিয়েছে।”
আরো পড়ুন:
ইসরায়েলের নতুন হামলায় ইরানের আইআরজিসির গোয়েন্দা প্রধান নিহত
ইসরায়েলে ৫০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল ইরান, তেল আবিব ও হাইফাতে সরাসরি আঘাত
উপ-মন্ত্রী আরো বলেন, “এই হামলায় বেশ কয়েকজন বেসামরিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন, আমার বেশ কয়েকজন সহকর্মীও আহত হয়েছেন, যাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।”
সাইদ বলেন, “এটি আরো একটি স্পষ্ট যুদ্ধাপরাধ, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি শাসকগোষ্ঠীর চলমান ও নিয়মতান্ত্রিক আগ্রাসন অভিযানের অংশ।”
এর আগে শনিবার ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরে হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েল।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা তেহরানের অস্ত্র উৎপাদন ক্ষমতা ধ্বংস করার লক্ষ্যে ইরানের আইআরজিসি ও সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে রবিবার নতুন করে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, এই হামলায় ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি), গার্ডস কুদস ফোর্স এবং ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর অবকাঠামো লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী আরো জানিয়েছে, ইরানজুড়ে অসংখ্য অস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্রে হামলা চালানো হয়েছে।
ইরানি বার্তাসংস্থা তাসনিম নিউজ জানিয়েছে, ইসরায়েলের এই হামলায় আইআরজিসিরি গোয়েন্দা প্রধান মোহাম্মদ কাজেমি এবং তার সহকারী হাসান মোহাকিক নিহত হয়েছেন। এছাড়া মোহসেন বাঘারি নামে আইআরজিসির আরো একজন জেনারেল নিহত হয়েছেন। এর প্রতিশোধ নিতে রবিবার রাতে ইসরায়েলে ৫০টি ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও শতাধিক ড্রোন ছুড়েছে ইরান।
ইসরায়েলের ফায়ার ও রেসকিউ সার্ভিসের বরাত দিয়ে টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, উত্তর ইসরায়েলে দুটি এবং হাইফায় একটি আবাসিক ভবনে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি আঘাত হানার খবর পেয়েছে তারা।
ইসরায়েলি জাতীয় জরুরি সেবা সংস্থা জানিয়েছে, হাইফায় ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে সাতজন আহত হয়েছেন। এছাড়া কিরিয়াত গাটের কাছে দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি শহরে একজন আহত হয়েছেন।
এ ঘটনায় ইসরায়েলি সেনাপ্রধান ইয়াল জামির ইরানের ওপর আক্রমণ আরো তীব্র করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একটি বিবৃতি জারি করে ইসরায়েরি সেনাপ্রধান বলেছেন, “আমরা আমাদের অভিযান তীব্রতর করে যাব এবং এটি করে, আগামী বছরগুলোতে আমাদের নিরাপত্তা জোরদার করব। আমরা জানতাম এর একটি মূল্য দিতে হবে এবং এটিই বোঝায় যে, আমরা কেন এখনই পদক্ষেপ নিয়েছি, তা অনেক দেরি হওয়ার আগেই।”
ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শুক্রবার থেকে ইসরায়েলি হামলায় ২২৪ জন নিহত এবং ৯০০ জন আহত হয়েছেন।
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কমপক্ষে ১৩ জন নিহত এবং ৩৭০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন।
ঢাকা/ফিরোজ