একাত্তরের উত্তাল মার্চে ঘটতে থাকে একের পর এক আশাজাগানিয়া ঘটনা। ৮ মার্চ থেকে পূর্ব পাকিস্তানে প্রশাসনিক ক্ষমতা কার্যত পাকিস্তানিদের কর্তৃত্বে ছিল না। সব প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণায় দেশের সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, সব আদালত স্থবির হয়ে যায়। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়ী বঙ্গবন্ধুর আদেশ-নির্দেশেই দেশ পরিচালিত হচ্ছিল। সংসদ অধিবেশন ডাকা নিয়ে নানা টালবাহানার কৌশলে সময় ক্ষেপণে পাকিস্তানিদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে সামরিক অভিযান শুরু করে। শুরু হয় বাঙালি জাতি নিধনে দেশব্যাপী গণহত্যা। অপ্রস্তুত এ জাতি নির্বিচারে হত্যার শিকারে পরিণত হয়। এ ধরনের ঘটনার আভাস নেতারা পেয়েছিলেন, কিন্তু দেশবাসীকে কোনো বার্তা দেননি। তাই জাতীয়, প্রাদেশিক পরিষদের সব সদস্য এবং দলীয় নেতারা আত্মরক্ষায় প্রতিবেশী ভারতে চলে গিয়েছিলেন। যশোরে মাত্র একজন নির্বাচিত সংসদ সদস্য প্রাণ হারিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নিয়ে যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী।
জাতির ওই চরম ক্রান্তিকালে কিন্তু নেতৃত্বের নির্দেশের অপেক্ষায় না থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাঙালি পুলিশ, ইপিআর, আনসার এবং সেনাবাহিনীর সদস্যরা স্থানীয় জনতাকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধে শামিল হয়েছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হিসেবেই প্রতিরোধ যুদ্ধকে গণ্য করা যায়। প্রতিরোধ যুদ্ধ এমনকি মুক্তিযুদ্ধও প্রথাসিদ্ধ যুদ্ধ ছিল না। ছিল অনিবার্যরূপে জনযুদ্ধ।
ভারতে প্রবাসী সরকার গঠনের পরই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রশিক্ষণ শুরু হয় এবং প্রশিক্ষণ শেষে শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রাভিযান। গেরিলা কায়দায় এবং সম্মুখ সমরে যুদ্ধ পরিচালিত হয়। চোরাগোপ্তা আচমকা হামলা চালিয়ে হানাদার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করাই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের রুটিন কার্যক্রম। সময় যতই এগিয়ে আসছে, মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধাভিযান ততটাই শানিত হয়ে ওঠে। ঢাকা শহরজুড়ে ক্র্যাক প্লাটুন যোদ্ধাদের একের পর এক গেরিলা আক্রমণে দিশেহারা হয়ে ওঠে হানাদার বাহিনী। মুক্তিযোদ্ধারা সম্মুখ সমরেও বীরবিক্রমে লড়াই চালিয়ে যায়। দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়, আহারসহ সব প্রকার সহায়তা করেছিল স্থানীয় মানুষ। হানাদারের সহযোগী কতিপয় পাকিস্তানপন্থি ব্যতীত দেশের সিংহভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছিল। নিজেদের জীবনের ঝুঁকি উপেক্ষা করে দেশবাসী সর্বাত্মক মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা না করলে মুক্তিযুদ্ধ ভয়ানক বিপদাপন্ন হতে পারত।
মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রাভিযানে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে যুদ্ধ অব্যাহত গতিতে চলেছে।
মুক্তিযুদ্ধের সফল অগ্রযাত্রায় দিশেহারা পাকিস্তান ভারতের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় যাতে বিঘ্ন ঘটে; পূর্ব পাকিস্তান থেকে যেন ভারতীয় বাহিনী পশ্চিমাঞ্চলে নিজ ভূখণ্ড রক্ষায় মনোনিবেশ করে; পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধরত হানাদার বাহিনীর জীবন রক্ষার অভিপ্রায়ে ৩ ডিসেম্বর ভারত আক্রমণ করে বসে। যশোর পতনের সংবাদ ২ ডিসেম্বর ইয়াহিয়া জানার পরই তাদের টনক নড়ে ওঠে। পূর্ব পাকিস্তান তাদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে– সেটা টের পাওয়ার পরই লক্ষাধিক পাকিস্তানি সৈন্যের প্রাণ রক্ষায় ৩ ডিসেম্বর বিমান হামলার মাধ্যমে ভারত আক্রমণ করে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সূচনা করে। শুরু হয় দুই পক্ষের তুমুল যুদ্ধ। ভারতীয় বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে বিমান আক্রমণ এবং বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে সাঁড়াশি আক্রমণ পরিচালনা করায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দশা দাঁড়ায়– হয় মৃত্যু, নয় আত্মসমর্পণ। পাশাপাশি মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণে পতন ঘটতে থাকে জেলা, মহকুমা থেকে একে একে দেশের প্রায় সব অঞ্চল। জেনারেল নিয়াজিকে আত্মসমপর্ণের জন্য ভারতের সেনাপ্রধান বার্তা দিলে শুরুতে প্রত্যাখ্যান করলেও শেষে শর্ত সাপেক্ষে সম্মত হন। শর্ত ছিল– তারা আত্মসমর্পণ করবে ভারতীয় বাহিনীর কাছে; বাংলাদেশের কাছে নয়। এ নিয়ে পরস্পর বিতর্কের পরও পাকিস্তানিদের শর্ত মেনে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
১৯৪৯ সালে তৃতীয় জেনেভা কনভেনশনের ধারা ১১৮ ছিল মুক্তি ও প্রত্যাবর্তন। অর্থাৎ শত্রুতা শেষ হলে যুদ্ধবন্দিদের অবিলম্বে মুক্তি দিয়ে নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে হবে। ভারত ও পাকিস্তান জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ; কিন্তু বাংলাদেশ নয়। কেননা, তখনও বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার বিদ্যমান। ভূখণ্ডের স্বাধীনতা তখনও হস্তগত হয়নি। বাংলাদেশের কাছে আত্মসমর্পণ করলে সব পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিকে নির্বিচারে হত্যা করলেও তার দায় ও জবাবদিহি বাংলাদেশকে বহন করতে হতো না। ওই বিবেচনা সামনে রেখেই জেনারেল নিয়াজি বাংলাদেশের পরিবর্তে ভারতের কাছে আত্মসমর্পণে সম্মত হয়েছিলেন। ভারত নিয়াজির শর্ত না মানার চেষ্টা করলেও নিয়াজিকে রাজি না করতে পারার কারণে অগত্যা পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণে সম্মত হয়েছিল ভারত। সে জন্য ইস্টার্ন জোনের কমান্ডার জেনারেল অরোরার কাছে আত্মসমপর্ণ দলিলে নিয়াজি স্বাক্ষর করে জেনেভা কনভেনশনের সুযোগ নিয়ে ৯৪ হাজার সৈন্যসমেত পাকিস্তানে ফিরে যেতে পেরেছিলেন। যুদ্ধের পরিসমাপ্তির লক্ষ্যে ভারতের পক্ষে এর বিকল্প তখন ভাবা সম্ভব হয়নি। সে কারণে জেনারেল ওসমানী আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি। শুধু প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এ.
পাকিস্তান সেনাবাহিনী কেন বাংলাদেশের কাছে আত্মসমর্পণে সম্মত হয়নি– এ নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়েছে এবং হচ্ছে। প্রকৃত সত্য জানা সম্ভব হলে এ নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ থাকার কথা নয়।
মযহারুল ইসলাম বাবলা: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
দখলদারদের কাছে প্রশাসনের আত্মসমর্পণ
বরিশালের আগৈলঝাড়া ও গৌরনদী উপজেলার কয়েক হাজার কৃষকের জীবন-জীবিকার উৎস ঐতিহ্যবাহী টরকী–বাশাইল খালটি করুণ মৃত্যুর প্রহর গুনছে। নাব্যতাসংকট, নির্বিচার দখল, দূষণ ও কর্তৃপক্ষের লাগাতার অবহেলার শিকার হয়ে প্রায় সাড়ে ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই খালের এমন পরিণতি খুবই দুঃখজনক। এটি পরিবেশের ওপর কাঠামোগত আগ্রাসনের ধারাবাহিকতারই চিত্র।
খালটি যখন প্রবহমান ছিল, তখন তা ছিল দুই উপজেলার কৃষকদের জন্য আশীর্বাদ। কিন্তু প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কৃষকদের এখন সেচের
জন্য ‘ডাবল লিফটিং’ (দুবার পানি উত্তোলন) করতে হচ্ছে। প্রথমে পাম্প দিয়ে কোনোমতে খালে পানি আনতে হয়। এরপর সেই পানি আবার পাম্প দিয়ে জমিতে দিতে হয়। এই প্রক্রিয়ায় কৃষকের সেচ খরচ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০ শতক জমিতে যেখানে খরচ হতো ৭০০ টাকা, সেখানে এখন গুনতে হচ্ছে ১ হাজার ২০০ টাকা। লাভের মুখ দেখতে না পেয়ে অনেক কৃষক বোরো আবাদ ছেড়ে মাছের ঘের বা পানের বরজ তৈরি করতে বাধ্য হচ্ছেন, নয়তো আবাদি জমির পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে স্থানীয় খাদ্যনিরাপত্তা ও কৃষি অর্থনীতিতে মারাত্মক ধস নামতে বাধ্য।
এ বিপর্যয়ের মূল কারণটি অত্যন্ত স্পষ্ট—অবৈধ দখলদারত্ব ও প্রশাসনিক দুর্বলতা। খালের উৎসমুখ, অর্থাৎ টরকী বন্দরসংলগ্ন পালরদী নদীর মোহনা দখলদারেরা পুরোপুরি রুদ্ধ করে দিয়েছেন। প্রায় এক কিলোমিটারজুড়ে খাল ভরাট করে গড়ে উঠেছে অসংখ্য পাকা ও আধা পাকা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। গৌরনদী ভূমি কার্যালয়ের পক্ষ থেকে ‘খালের জমি কাউকে ইজারা দেওয়া হয়নি’—এমনটা বলা হলেও দখলদারেরা কীভাবে খালের জায়গাকে ‘রেকর্ডীয় সম্পত্তি’ বা ‘ইজারা নেওয়া জমি’ দাবি করেন? এর মধ্য দিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালীরা প্রকাশ্যেই সরকারি সম্পত্তি দখল করে অবৈধভাবে ইমারত নির্মাণ করছেন।
এই দখলদারদের দাপট এতটাই বেশি যে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) গত বছর খাল খননের আবেদন পেয়েও কাজ শুরু করতে পারেনি। বিএডিসির উপসহকারী প্রকৌশলী সাহেদ আহমেদ চৌধুরী জানিয়েছেন, অবৈধ স্থাপনার কারণে খননযন্ত্র চালানো বা খনন করা মাটি রাখার মতো সামান্য জায়গাও সেখানে নেই। অর্থাৎ মুষ্টিমেয় অবৈধ দখলদার একটি সরকারি উন্নয়ন সংস্থাকে তার আইনি দায়িত্ব পালনে পঙ্গু করে রেখেছেন এবং স্থানীয় প্রশাসন এই দখলদারত্বের সামনে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ কেন এই অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না? কার ইশারায় এই দখলদারত্ব এত বছর ধরে চলতে দেওয়া হলো? টরকী–বাশাইল খালকে পুনরুদ্ধার করতে এখন কি কোনো আন্তরিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে, নাকি আমরা এ জলধারার উৎসের পুরোপুরি মৃত্যু নিশ্চিত হতে দেখব?