বিদেশে তৈরি গাড়ির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা ট্রাম্পের
Published: 27th, March 2025 GMT
গাড়ি আমদানি ও গাড়ির যন্ত্রাংশের ওপর গতকাল বুধবার উচ্চ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আগামী সপ্তাহে শুল্ক আরোপের ঘোষণা নিয়ে বাণিজ্যিক অংশীদারদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে, গতকালের এই ঘোষণা তাতে আরও ঘি ঢালবে।
ওভাল অফিসে বসে ওই আদেশে সই করার পর ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা যা করতে চলেছি সেটা হলো, যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি নয়, এমন সব গাড়ির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ।’
আগামী ৩ এপ্রিল ইস্টার্ন টাইম ০০: ০১ মিনিটে এই আদেশ কার্যকর হওয়ার কথা। বিদেশে তৈরি গাড়ি ও হালকা ওজনের ট্রাকের ওপর এই শুল্কের প্রভাব পড়বে। এ মাসের মধ্যে গাড়ির গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশের ওপরও এর প্রভাব পড়বে।
জানুয়ারিতে পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ বাণিজ্য-অংশীদার কানাডা, মেক্সিকো ও চীনের ওপর নতুন করে আমদানি শুল্ক আরোপ করেছেন। পাশাপাশি ট্রাম্প স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন।
ইতিমধ্যেই পণ্যের ওপর যেসব শুল্ক আছে, নতুন শুল্কগুলো তার সঙ্গে যোগ হবে। তবে হোয়াইট হাউস বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো-কানাডা চুক্তির (ইউএসএমসিএ) অধীনে যেসব গাড়ি আমদানি করা হচ্ছে, সেগুলো কম শুল্কে প্রবেশের সুযোগ পেতে পারে। তবে সেটা নির্ভর করবে সেগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের উপাদান কতটা আছে।
আরও পড়ুনকানাডা, মেক্সিকো ও চীনের ওপর শুল্ক আরোপ করে ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ, বিশ্বজুড়ে মন্দার আশঙ্কা০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫একইভাবে, ইউএসএমসিএ চুক্তির অধীন গাড়ির যন্ত্রাংশ আমদানি শুল্কমুক্ত থাকবে। ট্রাম্পের বাণিজ্য পরিকল্পনা নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং এর ফলে মন্দা দেখা দিতে পারে, এমন উদ্বেগ আর্থিক বাজারগুলোকে নাড়া দিয়েছে। শুল্কের কী প্রভাব পড়তে পারে, সে আশঙ্কা থেকে গত কয়েক মাসে ভোক্তাদের আস্থাও হ্রাস পেয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসন বলছে, সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ানো, যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প খাতকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং বিভিন্ন দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকার চাপিয়ে দেওয়ার হাতিয়ার হিসেবে এই শুল্ক আরোপ হচ্ছে।
কিন্তু গাড়ি আমদানিতে শুল্ক আরোপের ফলে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, কানাডা, মেক্সিকো ও জার্মানির মতো ঘনিষ্ঠ অংশীদারদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হতে পারে।
এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে একসময় বাণিজ্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করা ওয়েন্ডি কাটলার বলেন, ‘গাড়ি আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ আমাদের অনেক ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য অংশীদারদের ওপর ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলবে।’
ওয়েন্ডি কাটলার আরও বলেন, কয়েকটি ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষের সঙ্গে ওয়াশিংটনের মুক্তবাণিজ্য চুক্তি আছে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক চুক্তির প্রতিশ্রুতির দাম থাকে কি না সন্দেহ।
আরও পড়ুনইস্পাত-অ্যালুমিনিয়াম আমদানিতে ২৫% শুল্ক আরোপে নির্বাহী আদেশে সই করলেন ট্রাম্প১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি হওয়া গাড়ির প্রায় ৫০ শতাংশ দেশেই তৈরি হয়। বাকি যে ৫০ শতাংশ আমদানি হয়, তার প্রায় অর্ধেক মেক্সিকো ও কানাডা থেকে আসে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও জার্মানি গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহকারী।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি গাড়ির অর্ধেকের বেশির যন্ত্রাংশ আসে বিদেশ থেকে। হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তা এমনটাই জানিয়েছেন। গাড়ি আমদানিতে ট্রাম্পের এই শুল্ক আরোপকে তাঁর দেশের কর্মীদের ওপর সরাসরি হামলা বলে বর্ণনা করেছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি।
আরও পড়ুনট্রাম্পের শুল্কনীতি কি ভারতের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করবে১৯ মার্চ ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শ ল ক আর প র শ শ ল ক আর প আমদ ন ত র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
নোয়াখালীর কৃষকেরা কেন হাইব্রিড ধানবীজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন
দুই একর জমিতে জিংকসমৃদ্ধ ব্রি-৭৪ জাতের ধান চাষ করেছেন নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার পূর্ব চরবাটা এলাকার কৃষক মো. মোস্তফা। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-ব্রি উদ্ভাবিত এই জাতের প্রতি হেক্টরে ফলন হয়েছে ৯ দশমিক ২৩ মেট্রিক টন, যা বাজারে থাকা যেকোনো হাইব্রিড ধানের চেয়ে বেশি।
নিজের খেতে চোখজুড়ানো সোনালি ধান দেখে অনেক বেশি উচ্ছ্বসিত কৃষক মোস্তফা। কারণ, বাজার থেকে কেনা হাইব্রিড ধান থেকে বীজ করা যায় না। কিন্তু ব্রি উদ্ভাবিত এই ধান থেকে অনায়াসে বীজ তৈরি করতে পারবেন তিনি। এতে থাকবে না বীজ কেনা নিয়ে দুশ্চিন্তা। সেই সঙ্গে ধানগুলো জিংকসমৃদ্ধ হওয়ায় পরিবারের জিংকের ঘাটতিও দূর হবে। মোস্তফা বলেন, আগামী দিনে তিনি আরও বেশি পরিমাণ জমিতে এই ধান চাষ করবেন।
মোস্তফার মতো একই এলাকার আরেক কৃষক ওমর ফারুকও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট(ব্রি) উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান ব্রি-৯২ চাষ করেছেন দুই একর জমিতে। বীজ ও সারসহ এ পর্যন্ত তাঁর খরচ হয়েছে ৬২ হাজার টাকা। খেতের ধান এরই মধ্যে পাকা শুরু করেছে। ফলনের যে অবস্থা দেখছেন, তাতে মনে হচ্ছে, একরে ফলন হবে কমপক্ষে ১৭০ মণ। যার বাজারমূল্য দেড় লাখ টাকার বেশি।
ওমর ফারুকের খেতে ব্রির এই উচ্চ ফলনশীল ধানের আবাদ দেখে এরই মধ্যে আশপাশের এলাকার অনেক কৃষক যোগাযোগ করেছেন বীজ নেওয়ার জন্য। কারণ, তাঁরা হাইব্রিড চাষ করে ঝুঁকিতে পড়তে চান না। নিজের বীজে নিজেই স্বয়ংসম্পন্ন হতে চান। তাই ওমর ফারুক ঠিক করেছেন, উৎপাদিত ধান থেকে ২৫ মণ রেখে দেবেন বীজের জন্য। এই বীজ বিক্রি করে বাড়তি আয় হবে তাঁর।
শুধু কৃষক হাজি মোস্তফা কিংবা ওমর ফারুকই নন, নোয়াখালীর সুবর্ণচরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার কৃষকেরা চলতি বোরো মৌসুমে ব্রি উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষ করে সফলতার মুখ দেখেছেন। পাচ্ছেন হাইব্রিড ধানের চেয়েও বেশি ফলন। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর গ্রামের কৃষক মাহফুজা বেগম ও আশরাফ হোসেন দম্পতির খেতে চাষ করা ডায়াবেটিক রোগীদের সহনীয় ব্রি-১০৫ জাতের ধানের ফলন পাওয়া গেছে হেক্টরপ্রতি ৮ দশমিক ২ টন, যা বাজারের হাইব্রিড বীজের সমান। এই ধানেরও বীজ সংরক্ষণ করতে পারবেন কৃষকেরা।
চলতি বোরো মৌসুমে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলে নতুন জাতের ব্রি ধানের ৪৯০টি প্রদর্শনী খামার করেছে। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন-পিকেএসএফের স্থানীয় সহযোগী প্রতিষ্ঠান সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে এসব প্রদর্শনীতে ব্রি উদ্ভাবিত ৮ জাতের ধান চাষ করা হয়েছে। এই জাতের ধানগুলো উচ্চ ফলনশীল, রোগ প্রতিরোধী এবং বিভিন্ন পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ।
কৃষকেরা জানান, এত দিন তাঁরা বাজার থেকে বিভিন্ন কোম্পানির হাইব্রিড ও দেশীয় উফশী (উচ্চ ফলনশীল) জাতের ধানের বীজ কিনে আবাদ করে আসছেন। এবার এসবের বাইরে ব্রি উদ্ভাবিত উফশী ২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ ধান আবাদ করেছেন অনেকে। এর মধ্যে হাইব্রিড বীজের প্রতি কেজির দাম ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা। আর ব্রির উফশী ধানের বীজ ৫০-১০০ টাকায় পাওয়া যায়। এর মধ্যে প্রতি একর জমিতে চাষ করতে হাইব্রিড ধানের বীজ লাগে ৬ কেজি এবং উফশী জাতের বীজ লাগে ১০ কেজি। এসব বীজের মধ্যে হাইব্রিড প্রতি একরে উৎপাদন হয় ৯০ মণ, উফশী (উচ্চ ফলনশীল) ব্রি-২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ উৎপাদন হয় ৭০-৭৫ মণ।
পিকেএসএফের কৃষি ইউনিট পরিচালিত সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার কৃষিবিদ শিবব্রত ভৌমিক প্রথম আলোকে বলেন, নোয়াখালী অঞ্চলের ৯৫ শতাংশ কৃষক বোরো মৌসুমে মূলত বাজারের হাইব্রিড ধানের ওপর নির্ভর থাকেন। আর দেশীয় উদ্ভাবিত ব্রি ধান জাত আবাদ করেন মাত্র ৫ শতাংশ কৃষক। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, হাইব্রিড ধান রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এতে অনেক কৃষকই লোকসানের মুখে পড়ছেন। তবে এ ক্ষেত্রে ব্রি উদ্ভাবিত নতুন ব্রি-ধানগুলোর ফলন হাইব্রিডের মতো ফলন দেয় এবং কিন্তু রোগবালাই নেই বললেই চলে। এতে কৃষকের খরচ কমে। লাভ হয়, আর বীজও থাকে নিজের হাতে।
ব্রির উচ্চফলনশীল জাতের নতুন জাতের ধান চাষের কথা বলতে গিয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মীরা রানী দাশ প্রথম আলোকে বলেন, ব্রি-উদ্ভাবিত বিভিন্ন পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ ধানগুলো চাষাবাদে কৃষকদের মধ্যে তাঁরা ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ করছেন। এর প্রধান কারণ হলো, এসব ধান চাষ করলে একদিকে পুষ্টির ঘাটতি পূরণ হবে, অন্যদিকে কৃষকেরা নিজেরা নিজেদের বীজ সংরক্ষণ করতে পারবেন। তা ছাড়া ব্রি উদ্ভাবিত এসব ধানে রোগবালাইয়ের আক্রমণ হাইব্রিডের তুলনায় কম এবং ফলন হাইব্রিডের সমান কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে হাইব্রিড থেকেও বেশি।
এ বিষয়ে ব্রির ফেনীর সোনাগাজীর আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্রি এ পর্যন্ত ১১৫টি জাত আবিষ্কার করেছে। আগে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল খাদ্যের অভাব দূর করা, ফলন বাড়ানো। বর্তমানে আমাদের উদ্দেশ্য খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা। খাবার যাতে পুষ্টিমানসম্পন্ন হয়। অধিকাংশই আমিষ ও ভিটামিনের উৎস মাছ, মাংস, ডিম এবং ফলমূল। কিন্তু এসব সবাই কিনে খেতে পারেন না। যেহেতু ভাত প্রধান খাদ্য, এখন আমাদের যে জাতগুলো, এগুলো উদ্ভাবনে পুষ্টির দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে।’ নতুন জাতগুলো পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, সেই সঙ্গে হাইব্রিডের প্রতি নির্ভরতা কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে তাঁরা আশা করছেন।