পঁচিশ ক্যাডার বনাম এক ক্যাডার: সরকার কোন পক্ষে
Published: 1st, April 2025 GMT
একই বিসিএসের মাধ্যমে যোগদান করে প্রশাসন ক্যাডারের কোনো কর্মকর্তা সিনিয়র সচিব কিংবা মন্ত্রিপরিষদ সচিব হন; আর কেউ তাঁদের চেয়ে পাঁচ-ছয় ধাপ নিচের পদ থেকে অবসরে যান। কোনো ক্যাডার কর্মকর্তারা সরকারি গাড়ি-বাড়ি-চালক সুবিধা পান; আর কেউ অফিস চালানোর ন্যূনতম আবর্তন ব্যয়টুকুও পান না, নিজের টাকায় অফিস চালান। কেউ গাড়ি কেনার ব্যাপক সুবিধা পান, কেউ পান না।
অতীতে যে ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তারা রাষ্ট্রের যত বেশি ক্ষতি করেছেন, তাঁরাই সুবিধাও পেয়েছেন তত বেশি। যাঁরা ক্ষতি করেননি, তাঁদের কোনো সুবিধাও নেই। বর্তমানে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে মোট ক্যাডারের সংখ্যা ২৬। এর মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে অন্যান্য ক্যাডারের বৈষম্যের চিত্র চূড়ান্ত পর্যায়ের। এই বৈষম্য থেকে সৃষ্ট বিরোধ চরমে পৌঁছেছে।
ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তার মধ্যকার বৈষম্য দূর করার জন্য ২৫ ক্যাডারের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে ‘আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’। এই সংগঠনের স্লোগান ‘ক্যাডার যার, মন্ত্রণালয় তার’। নিজেদের দাবি আদায়ে তাঁরা বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করেছেন। এ পরিষদের আয়োজনে ‘জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণে প্রত্যাশিত সিভিল সার্ভিস’ শীর্ষক একটি সেমিনার ২০২৫ সালের ১৮ জানুয়ারি ঢাকায় কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত হয়। আমাকে সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেই সেমিনারে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন পরিষদের সমন্বয়ক ড.
সেমিনারে লিখিত বক্তব্যে সমস্যার কথা যেমন তুলে ধরা হয়েছে তেমনি সমাধানের পথও দেখানো হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সব ক্যাডারের পদোন্নতি প্রশাসন ক্যাডারের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা নিজেদের পদোন্নতির ব্যবস্থা করেন। অন্যেরগুলোর সঙ্গে সমতা বিধান করেন না। সমস্যা নিরসনে পিএসসির অধীনে পদোন্নতি দেওয়ার ক্ষমতা অর্পণের দাবি তোলা হয়েছে। প্রশাসনসহ সব ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি পিএসসি দেবে।
উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের যেকোনো কাজ প্রশাসন ক্যাডারের অধীনে থাকায় সেই কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে ও অন্তঃকোন্দল সৃষ্টি হচ্ছে। সে জন্য প্রশাসন ক্যাডারের অধীনতা থেকে এসব কাজ মুক্ত করার দাবি জানানো হয়। মন্ত্রীদের খুব কাছে থাকার সুবাদে চাকরির অনেক সুবিধা কেবল প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা পান বলেও উল্লেখ করা হয়। সব ক্যাডারের জন্য সমসংখ্যক পদসোপান সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে, যাতে একই সময়ে একই বিসিএসের সবার পদোন্নতি নিশ্চিত করা যায়।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষেই সহজেই সম্ভব এই বৈষম্যমূলক পদ্ধতির মূলোৎপাটন করা। বৈষম্যবিরোধী সরকারের হাত ধরে আন্তক্যাডার বৈষম্য দূর হোক। এটি বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিসের যুগ যুগ ধরে চলে আসা জটিলতা দূর করবে। ২৫টি ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তাদের দাবি আমলে নেওয়া হোক। দেশটা আমাদের সবার। এমনও আছে, পরিবারের একেকজন একেক ক্যাডারের কর্মকর্তা। আমরা চাই, সবার যৌথ প্রচেষ্টায় দেশ এগিয়ে যাক।উল্লিখিত সেমিনারপত্রে ওই সময়ের প্রশাসন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, পুলিশ ও পশু সম্পদ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতির তুলনামূলক একটি চিত্র হাজির করা হয়েছে। সেমিনারপত্র অনুযায়ী, ওই সময়ে Ñপ্রশাসন ক্যাডারে মোট কর্মকর্তা ৭ হাজার ৭৬ জনের মধ্যে ১০৪ জন ছিলেন প্রথম গ্রেডে, ৪৬১ জন ছিলেন দ্বিতীয় গ্রেডে, ৮৫১ জন তৃতীয় গ্রেডে। এ ছাড়া কয়েকজন সিনিয়র সচিব ও মন্ত্রিপরিষদের সচিব ছিলেন।
পুলিশের ৩ হাজার ১০০ কর্মকর্তার মধ্যে প্রথম গ্রেডে ছিলেন ২ জন, দ্বিতীয় গ্রেডে ছিলেন ৮, তৃতীয় গ্রেডে ছিলেন ১৩৫ জন। কৃষি ক্যাডারের ৩ হাজার ২০০ জনের মধ্যে প্রথম গ্রেডে কেউ নেই, দ্বিতীয় গ্রেডে ছিলেন ৫, তৃতীয় গ্রেডে ছিলেন ৪৯ জন। শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা ১৫ হাজার ৫০০ জন। তাঁদের মধ্যে একজনও প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় গ্রেডে নেই। স্বাস্থ্য ক্যাডারে ৩২ হাজার জনের মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রেডে একজনও নেই। তৃতীয় গ্রেডে ছিলেন ৬৫৭ জন। পশু সম্পদ ক্যাডারে ২ হাজার ৯৩ জনের মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রেডে কেউ নেই। তৃতীয় গ্রেডে ছিলেন ৩৩ জন। ওই সময়ের সঙ্গে বর্তমান অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি, বরং বৈষম্য আরও বেড়েছে বলে মনে হয়।
শিক্ষা ক্যাডারের সাড়ে ১৫ হাজার কর্মকর্তার মধ্যে একজনও প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় গ্রেডে নেই। অবিশ্বাস্য বৈষম্য! কেন চতুর্থ গ্রেডের ওপরে কেউ নেই—এর কোনো সদুত্তর আছে কি? তাঁরা এক নম্বর গ্রেডে গেলে শিক্ষাব্যবস্থার ওপর কি ভীষণ নেতিবাচক প্রভাব পড়বে? বরং চার নম্বর গ্রেডে গিয়ে থেমে যাওয়ার কারণে তাঁরা মানসিকভাবে আহত হচ্ছেন। রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার ওপর সৃষ্ট বিরক্তি হতাশাগ্রস্ত করে তুলছে। যার প্রভাব পড়ছে পাঠদানে।
প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রায় সবাই পর্যায়ক্রমে দ্বিতীয় গ্রেডে উন্নীত হবেন। প্রথম গ্রেডেও যাবেন অনেকে। কেবল তা–ই নয়, সুপার গ্রেডে সিনিয়র সচিব মন্ত্রিপরিষদ সচিব হবেন অনেকেই। সিনিয়র সচিব ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব—দুটি গ্রেড এক নম্বর গ্রেডেরও ওপরে। স্পেশাল গ্রেডের পদ। আপাতদৃষ্টে বেতন স্কেলে ২০টি ধাপ মনে করা হলেও প্রশাসন ক্যাডারের জন্য ২২টি। ওপরের দুটি সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করা যায় না, এতটাই ওপরে তাঁরা।
আনুপাতিক হারে চিকিৎসকদের প্রথম কিংবা দ্বিতীয় গ্রেডে যাওয়ার সুযোগ দিলে কি স্বাস্থ্যব্যবস্থার চরম সর্বনাশ হতো? চিকিৎসকেরা প্রথম–দ্বিতীয় গ্রেডে গেলে কি তাঁদের সেবার মান খারাপ হয়ে যেত? অন্য যেকোনো ক্যাডারের চেয়ে একাডেমিক অনেক বেশি যোগ্যতা নিয়েও কেন তাঁরা ওই দুই গ্রেডে যেতে পারবেন না, এ প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। স্বাস্থ্য ক্যাডারের অনেক পদ শূন্য থাকা সত্ত্বেও বছরের পর বছর ধরে সেগুলোয় পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে না। কোনো কোনো বিভাগে গত ছয় বছরে একবারও পদোন্নতি দেওয়া হয়নি।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা ভেবেছিলেন, বৈষম্য দূর হবে। বাস্তবে সেই বৈষম্য আরও বাড়ছে। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি পাচ্ছেন। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের মাসখানেকের মধ্যে একেকজন কর্মকর্তা কয়েকবার পদোন্নতিও নিয়েছেন। মৃত কর্মকর্তাদেরও পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি নেই।
এখন বিসিএসের ব্যাচ ধরেই পদোন্নতি হয়েছে ও হচ্ছে। স্বাস্থ্য ক্যাডারেও সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এর ভিন্নতা হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বৈষম্য সৃষ্টিতে নতুন নজির স্থাপিত হবে। বৈষম্য দূরীকরণের চেষ্টায় যেন নতুন বৈষম্য সৃষ্টি না হয়। স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা কতটা দুর্ভাগা যে তাঁদের পদোন্নতির জন্য কর্মবিরতি পালনের মতো কর্মসূচিও দিতে হচ্ছে।
পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তারা দুজন ছাড়া কেন অন্যরা এক নম্বর গ্রেডে যেতে পারছেন না? এক নম্বর গ্রেডে বেশিসংখ্যক গেলে কি তাঁরা আইনশৃঙ্খলার সামাল দিতে পারবেন না? সিনিয়র সচিব পদমর্যাদায় পুলিশসহ অন্যান্য ক্যাডারের কেউ কেন হতে পারবেন না? কৃষি ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কেউ কেন এক নম্বর গ্রেডে যেতে পারবেন না? পশু সম্পদ ক্যাডারের কর্মকর্তা তো তৃতীয় গ্রেডে চাকরির ইতি টানতে হয়। কেন এত বৈষম্য, সেই প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
কেবল উল্লিখিত কয়েকটি ক্যাডার নয়, দুজন পুলিশ এবং প্রশাসন ছাড়া অন্য সব ক্যাডারের কর্মকর্তাদের এক নম্বরে রাখা হয়নি কী কারণে? প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা সবার ভাগ্য নির্ধারণ করার দায়িত্ব পেয়েছেন বলে কি তাঁদের সবার ওপরের আসনে বসে থাকতে হবে? এখানে একটি বিষয় বলে রাখা ভালো, পদোন্নতির সঙ্গে খুব বেশি আর্থিক লাভালাভ থাকে না। এর কারণ, বার্ষিক বৃদ্ধিতে বেতন এমনতিই স্কেলের উচ্চতায় চলে যায়।
একই সঙ্গে একই প্রশ্নের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২৬ ক্যাডারের কর্মকর্তারা চাকরিতে যোগদান করেন। কেবল তা–ই নয়, চাকরি স্থায়ীকরণ ও সিনিয়র স্কেল পরীক্ষাও হয় একই প্রশ্নে। এখানে মেধার প্রশ্ন নয়। সবাই অভিন্ন প্রশ্নপত্রে প্রতিযোগিতা করে এসেছেন। কেউ যদি বিশেষ সুবিধা পান, তাহলে তা হওয়া উচিত বিশেষায়িত বিষয়ের ক্যাডার কর্মকর্তারা। স্বাস্থ্য, প্রকৌশল, কৃষি কিংবা পশু সম্পদ।
প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা নাকি বেশি মেধাবী, তাই তাঁদের বেশি সুবিধা পাওয়া উচিত—এমন একটি পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন আদালত। ওই বিচারক হয়তো জানেন না, সম্মিলিত মেধার পেছনে থাকা কতজন প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি করেন। ‘জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণে প্রত্যাশিত সিভিল সার্ভিস’ শীর্ষক সেমিনারপত্রে দেখানো হয়েছে, ২৫তম বিসিএস পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধার দিক থেকে শেষ ৫০ জনের মধ্যে ৩০ জন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা হয়েছেন।
বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যাঁরা চাকরিতে যোগদান করেন, তাঁরা প্রত্যেকে সেবকমাত্র। এসব সেবকের মধ্যে একটি ক্যাডারের নামকরণ যখন হয়, প্রশাসন তখন আর সেবকচরিত্রে তাঁদের মধ্যে থাকে না। এ জন্য এই ক্যাডারের নামও পরিবর্তন করা প্রয়োজন। আন্তক্যাডার বৈষম্য দূরীকরণ এখন দেশের স্বার্থে জরুরি হয়ে পড়েছে।
বিশেষ একটি ক্যাডারের প্রতি অন্তর্বতী সরকারের যে বিশেষ দরদ, তা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। অথচ বিগত দিনগুলোতে জনস্বার্থ বিসর্জন দেওয়ার ক্ষেত্রে এই ক্যাডারের কর্মকর্তাদের তুলনা নেই।
ভোটের অধিকার থেকে অনেক অধিকার ক্ষুণ্ন করার ক্ষেত্রে এই ক্যাডার সর্বাগ্রে ছিল। ভবিষ্যতে যাতে কোনো রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে যোগসাজশ করে দেশকে নিলামে তুলতে না পারে, সেই ব্যবস্থাও রাখতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষেই সহজেই সম্ভব এই বৈষম্যমূলক পদ্ধতির মূলোৎপাটন করা। বৈষম্যবিরোধী সরকারের হাত ধরে আন্তক্যাডার বৈষম্য দূর হোক। এটি বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিসের যুগ যুগ ধরে চলে আসা জটিলতা দূর করবে। ২৫টি ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তাদের দাবি আমলে নেওয়া হোক। দেশটা আমাদের সবার। এমনও আছে, পরিবারের একেকজন একেক ক্যাডারের কর্মকর্তা। আমরা চাই, সবার যৌথ প্রচেষ্টায় দেশ এগিয়ে যাক।
তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক য ড র র কর মকর ত দ র সব ক য ড র র প রথম গ র ড প রব ন ন সরক র র ব যবস থ ন কর ন পর ক ষ র সব র ব স এস র জন য দ র কর র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
৬ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টাকে স্মারকলিপি দেবে ৮ দল
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি, সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) বহাল এবং নির্বাচনের আগে গণভোটসহ পাঁচ দফা দাবিতে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিসসহ আন্দোলনরত আট দল।
সোমবার (৩ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর পুরনো পল্টনে খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত যৌথ প্রেস ব্রিফিংয়ে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক।
আরো পড়ুন:
৩০০ আসনে প্রার্থী বাছাই প্রায় চূড়ান্ত: তারেক রহমান
বরগুনায় জামায়াতে যোগ দিলেন বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা মামুন
কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, আগামী বৃহস্পতিবার (৬ নভেম্বর) বেলা ১১টায় প্রধান উপদেষ্টা বরাবর গণমিছিল সহকারে স্মারকলিপি প্রদান। এতে সন্তোষজনক অগ্রগতি না হলে আগামী ১১ নভেম্বর (বুধবার) ঢাকায় গণসমাবেশ কর্মসূচি পালন করা হবে। তবে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি, গণভোটসহ বিষয়গুলোর সুন্দর সমাধানে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের আয়োজন করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
এ সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম, পীর সাহেব চরমোনাই ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ তাহের।
এর আগে খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বৈঠকে বসেন আট দলের শীর্ষ নেতারা। দলগুলো হলো বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, নেজামে ইসলাম পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) ও ডেভেলপমেন্ট পার্টি।
নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে মামুনুল হক বলেন, “বাংলাদেশ ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। তবে জুলাই সনদ নিয়ে দেশের মানুষ যে স্বপ্ন দেখেছিল এবং নতুন বন্দোবস্তের স্বপ্ন এখনো অধরা।’’
পূর্ব ঘোষিত ৫ দফা দাবি আদায়ে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে তিনি বলেন, “আমাদের আটটি দলের পাঁচ দফা দাবিতে সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। আমরা জুলাই সনদের আইনিভিত্তি দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছি। অবিলম্বে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারি করতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের আগেই পৃথকভাবে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট করতে হবে। আরপিও সংশোধন করা হলে আমরা সেটা মানব না। অর্থাৎ আরপিও আগের মতোই রাখতে হবে। এগুলোই এখন আমাদের মূল দাবি।
“আশা করি আলোচনার ভিত্তিতে সকল রাজনৈতিক দল সমাধান করতে পারব এবং জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির মাধ্যমে আগামী নির্বাচন হবে’’ বলেন তিনি।
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ও গণভোট আয়োজন নিয়ে মতপার্থক্য নিরসনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ আয়োজন করে সেই আলোচনায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে ‘রেফারির’ ভূমিকায় থাকার আহ্বান জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের।
সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, ‘‘আমরা যে ঐকমত্যে পৌঁছেছিলাম, তাতে হঠাৎ করে একটি দল বিরোধিতা করছে। আমরা আশা করি, তারা তাদের দলীয় অবস্থান স্পষ্ট করবে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন না হলে গণভোট আগে আর পরে করে লাভ নেই। বরং গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে। কারণ নির্বাচনের দিন ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোটে কারও মনযোগ থাকবে না।’’
তাহের বলেন, “আমি গতকালকে (২ নভেম্বর) দলগুলোর মধ্যে একটি আলোচনার আহ্বান করেছিলাম। আজকে উপদেষ্টা পরিষদও সেই রকম একটি আহ্বান দলগুলোর কাছে জানিয়েছে। আমরাও দেখতে চাই, মেইন স্টেক হোল্ডার দলগুলো এই আহ্বানে যেন সাড়া দেয়। তারাও যদি আমাদের মতো একইভাবে সাড়া দেয়, তাহলে একটা রাস্তা বেরিয়ে আসবে।’’
জামায়াতের এই সিনিয়র নেতা বলেন, “উপদেষ্টা পরিষদ যে মনে করেছে, তাদের আর কোনো দায়িত্ব নেই, তারা আর কিছুই করবে না, দলগুলো মিলে করবে… তাহলে এখানে একটা রেফারির অভাব হতে পারে। উপদেষ্টা পরিষদের পক্ষ থেকে, বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টা এখানে একটা রেফারির ভূমিকা পালন করবেন আগের মতো, এটা আমরা আশা করি।’’
মুফতি রেজাউল করীম বলেন, ‘‘জুলাই সনদের আইনিভিত্তি হলো প্রধান বিষয়। এটা না হলে এই সরকার, জুলাই গণঅভ্যুত্থান সবকিছু আইনি প্রশ্নের মুখে পড়বে। ৫ আগস্টের পরে সংস্কার, বিচার ও নির্বাচনের দায়িত্ব নিয়ে সরকার গঠিত হয়েছিল। সেই লক্ষ্যে সংস্কার কমিশন হয়েছে, ঐকমত্য কমিশন হয়েছে। গণভোটের বিষয়ে সবাই একমতও হয়েছে। এখন গণভোটের দিনক্ষণ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে বিভেদ তৈরি হয়েছে, তা দুঃখজনক। এই ক্ষেত্রে বিএনপির আচরণের কোনো অর্থ আমি বুঝি না।’’
উপদেষ্টা পরিষদের আজকের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে সকল রাজনৈতিক দলের একত্রে বসে চলমান বিভেদ দূর করে শান্তিপূর্ণ অবস্থা তৈরির আহ্বান জানান পীর সাহেব চরমোনাই।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর আমীর মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম (পীর সাহেব চরমোনাই), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসে আমীর মাওলানা মুহাম্মাদ মামুনুল হক, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা. আব্দুল্লাহ আবু তাহের, খেলাফত মজলিসের আমীর মাওলানা আব্দুল বাসিত আজাদ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির মাওলানা মাহবুবুল হক ও মাওলানা কুরবান আলী কাসেমী, খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমীর মাওলানা সাখাওয়াত হুসাইন, জাগপার সহ-সভাপতি ও মুখপাত্র রাশেদ প্রধান, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর মহাসচিব অধ্যক্ষ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দিন আহমাদ, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. হামিদুর রহমান আজাদ, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মাওলানা মুসা বিন ইজহার, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা ইউসুফ সাদিক হক্কানী, খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টির মহাসচিব মো. কাজী নিজামুল হক নাঈম।
ঢাকা/নঈমুদ্দীন/বকুল