একই বিসিএসের মাধ্যমে যোগদান করে প্রশাসন ক্যাডারের কোনো কর্মকর্তা সিনিয়র সচিব কিংবা মন্ত্রিপরিষদ সচিব হন; আর কেউ তাঁদের চেয়ে পাঁচ-ছয় ধাপ নিচের পদ থেকে অবসরে যান। কোনো ক্যাডার কর্মকর্তারা সরকারি গাড়ি-বাড়ি-চালক সুবিধা পান; আর কেউ অফিস চালানোর ন্যূনতম আবর্তন ব্যয়টুকুও পান না, নিজের টাকায় অফিস চালান। কেউ গাড়ি কেনার ব্যাপক সুবিধা পান, কেউ পান না।

অতীতে যে ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তারা রাষ্ট্রের যত বেশি ক্ষতি করেছেন, তাঁরাই সুবিধাও পেয়েছেন তত বেশি। যাঁরা ক্ষতি করেননি, তাঁদের কোনো সুবিধাও নেই। বর্তমানে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে মোট ক্যাডারের সংখ্যা ২৬। এর মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে অন্যান্য ক্যাডারের বৈষম্যের চিত্র চূড়ান্ত পর্যায়ের। এই বৈষম্য থেকে সৃষ্ট বিরোধ চরমে পৌঁছেছে।

ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তার মধ্যকার বৈষম্য দূর করার জন্য ২৫ ক্যাডারের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে ‘আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’। এই সংগঠনের স্লোগান ‘ক্যাডার যার, মন্ত্রণালয় তার’। নিজেদের দাবি আদায়ে তাঁরা বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করেছেন। এ পরিষদের আয়োজনে ‘জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণে প্রত্যাশিত সিভিল সার্ভিস’ শীর্ষক একটি সেমিনার ২০২৫ সালের ১৮ জানুয়ারি ঢাকায় কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত হয়। আমাকে সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেই সেমিনারে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন পরিষদের সমন্বয়ক ড.

মুহম্মদ মফিজুর রহমান।

সেমিনারে লিখিত বক্তব্যে সমস্যার কথা যেমন তুলে ধরা হয়েছে তেমনি সমাধানের পথও দেখানো হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সব ক্যাডারের পদোন্নতি প্রশাসন ক্যাডারের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা নিজেদের পদোন্নতির ব্যবস্থা করেন। অন্যেরগুলোর সঙ্গে সমতা বিধান করেন না। সমস্যা নিরসনে পিএসসির অধীনে পদোন্নতি দেওয়ার ক্ষমতা অর্পণের দাবি তোলা হয়েছে। প্রশাসনসহ সব ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি পিএসসি দেবে।

উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের যেকোনো কাজ প্রশাসন ক্যাডারের অধীনে থাকায় সেই কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে ও অন্তঃকোন্দল সৃষ্টি হচ্ছে। সে জন্য প্রশাসন ক্যাডারের অধীনতা থেকে এসব কাজ মুক্ত করার দাবি জানানো হয়। মন্ত্রীদের খুব কাছে থাকার সুবাদে চাকরির অনেক সুবিধা কেবল প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা পান বলেও উল্লেখ করা হয়। সব ক্যাডারের জন্য সমসংখ্যক পদসোপান সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে, যাতে একই সময়ে একই বিসিএসের সবার পদোন্নতি নিশ্চিত করা যায়।

অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষেই সহজেই সম্ভব এই বৈষম্যমূলক পদ্ধতির মূলোৎপাটন করা। বৈষম্যবিরোধী সরকারের হাত ধরে আন্তক্যাডার বৈষম্য দূর হোক। এটি বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিসের যুগ যুগ ধরে চলে আসা জটিলতা দূর করবে। ২৫টি ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তাদের দাবি আমলে নেওয়া হোক। দেশটা আমাদের সবার। এমনও আছে, পরিবারের একেকজন একেক ক্যাডারের কর্মকর্তা। আমরা চাই, সবার যৌথ প্রচেষ্টায় দেশ এগিয়ে যাক।

উল্লিখিত সেমিনারপত্রে ওই সময়ের প্রশাসন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, পুলিশ ও পশু সম্পদ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতির তুলনামূলক একটি চিত্র হাজির করা হয়েছে। সেমিনারপত্র অনুযায়ী, ওই সময়ে Ñপ্রশাসন ক্যাডারে মোট কর্মকর্তা ৭ হাজার ৭৬ জনের মধ্যে ১০৪ জন ছিলেন প্রথম গ্রেডে, ৪৬১ জন ছিলেন দ্বিতীয় গ্রেডে, ৮৫১ জন তৃতীয় গ্রেডে। এ ছাড়া কয়েকজন সিনিয়র সচিব ও মন্ত্রিপরিষদের সচিব ছিলেন।

পুলিশের ৩ হাজার ১০০ কর্মকর্তার মধ্যে প্রথম গ্রেডে ছিলেন ২ জন, দ্বিতীয় গ্রেডে ছিলেন ৮, তৃতীয় গ্রেডে ছিলেন ১৩৫ জন। কৃষি ক্যাডারের ৩ হাজার ২০০ জনের মধ্যে প্রথম গ্রেডে কেউ নেই, দ্বিতীয় গ্রেডে ছিলেন ৫, তৃতীয় গ্রেডে ছিলেন ৪৯ জন। শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা ১৫ হাজার ৫০০ জন। তাঁদের মধ্যে একজনও প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় গ্রেডে নেই। স্বাস্থ্য ক্যাডারে ৩২ হাজার জনের মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রেডে একজনও নেই। তৃতীয় গ্রেডে ছিলেন ৬৫৭ জন। পশু সম্পদ ক্যাডারে ২ হাজার ৯৩ জনের মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রেডে কেউ নেই। তৃতীয় গ্রেডে ছিলেন ৩৩ জন। ওই সময়ের সঙ্গে বর্তমান অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি, বরং বৈষম্য আরও বেড়েছে বলে মনে হয়।

শিক্ষা ক্যাডারের সাড়ে ১৫ হাজার কর্মকর্তার মধ্যে একজনও প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় গ্রেডে নেই। অবিশ্বাস্য বৈষম্য! কেন চতুর্থ গ্রেডের ওপরে কেউ নেই—এর কোনো সদুত্তর আছে কি? তাঁরা এক নম্বর গ্রেডে গেলে শিক্ষাব্যবস্থার ওপর কি ভীষণ নেতিবাচক প্রভাব পড়বে? বরং চার নম্বর গ্রেডে গিয়ে থেমে যাওয়ার কারণে তাঁরা মানসিকভাবে আহত হচ্ছেন। রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার ওপর সৃষ্ট বিরক্তি হতাশাগ্রস্ত করে তুলছে। যার প্রভাব পড়ছে পাঠদানে।

প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রায় সবাই পর্যায়ক্রমে দ্বিতীয় গ্রেডে উন্নীত হবেন। প্রথম গ্রেডেও যাবেন অনেকে। কেবল তা–ই নয়, সুপার গ্রেডে সিনিয়র সচিব মন্ত্রিপরিষদ সচিব হবেন অনেকেই। সিনিয়র সচিব ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব—দুটি গ্রেড এক নম্বর গ্রেডেরও ওপরে। স্পেশাল গ্রেডের পদ। আপাতদৃষ্টে বেতন স্কেলে ২০টি ধাপ মনে করা হলেও প্রশাসন ক্যাডারের জন্য ২২টি। ওপরের দুটি সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করা যায় না, এতটাই ওপরে তাঁরা।

আনুপাতিক হারে চিকিৎসকদের প্রথম কিংবা দ্বিতীয় গ্রেডে যাওয়ার সুযোগ দিলে কি স্বাস্থ্যব্যবস্থার চরম সর্বনাশ হতো? চিকিৎসকেরা প্রথম–দ্বিতীয় গ্রেডে গেলে কি তাঁদের সেবার মান খারাপ হয়ে যেত? অন্য যেকোনো ক্যাডারের চেয়ে একাডেমিক অনেক বেশি যোগ্যতা নিয়েও কেন তাঁরা ওই দুই গ্রেডে যেতে পারবেন না, এ প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। স্বাস্থ্য ক্যাডারের অনেক পদ শূন্য থাকা সত্ত্বেও বছরের পর বছর ধরে সেগুলোয় পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে না। কোনো কোনো বিভাগে গত ছয় বছরে একবারও পদোন্নতি দেওয়া হয়নি।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা ভেবেছিলেন, বৈষম্য দূর হবে। বাস্তবে সেই বৈষম্য আরও বাড়ছে। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি পাচ্ছেন। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের মাসখানেকের মধ্যে একেকজন কর্মকর্তা কয়েকবার পদোন্নতিও নিয়েছেন। মৃত কর্মকর্তাদেরও পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি নেই।

এখন বিসিএসের ব্যাচ ধরেই পদোন্নতি হয়েছে ও হচ্ছে। স্বাস্থ্য ক্যাডারেও সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এর ভিন্নতা হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বৈষম্য সৃষ্টিতে নতুন নজির স্থাপিত হবে। বৈষম্য দূরীকরণের চেষ্টায় যেন নতুন বৈষম্য সৃষ্টি না হয়। স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা কতটা দুর্ভাগা যে তাঁদের পদোন্নতির জন্য কর্মবিরতি পালনের মতো কর্মসূচিও দিতে হচ্ছে।

পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তারা দুজন ছাড়া কেন অন্যরা এক নম্বর গ্রেডে যেতে পারছেন না? এক নম্বর গ্রেডে বেশিসংখ্যক গেলে কি তাঁরা আইনশৃঙ্খলার সামাল দিতে পারবেন না? সিনিয়র সচিব পদমর্যাদায় পুলিশসহ অন্যান্য ক্যাডারের কেউ কেন হতে পারবেন না? কৃষি ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কেউ কেন এক নম্বর গ্রেডে যেতে পারবেন না? পশু সম্পদ ক্যাডারের কর্মকর্তা তো তৃতীয় গ্রেডে চাকরির ইতি টানতে হয়। কেন এত বৈষম্য, সেই প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।

কেবল উল্লিখিত কয়েকটি ক্যাডার নয়, দুজন পুলিশ এবং প্রশাসন ছাড়া অন্য সব ক্যাডারের কর্মকর্তাদের এক নম্বরে রাখা হয়নি কী কারণে? প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা সবার ভাগ্য নির্ধারণ করার দায়িত্ব পেয়েছেন বলে কি তাঁদের সবার ওপরের আসনে বসে থাকতে হবে? এখানে একটি বিষয় বলে রাখা ভালো, পদোন্নতির সঙ্গে খুব বেশি আর্থিক লাভালাভ থাকে না। এর কারণ, বার্ষিক বৃদ্ধিতে বেতন এমনতিই স্কেলের উচ্চতায় চলে যায়।

একই সঙ্গে একই প্রশ্নের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২৬ ক্যাডারের কর্মকর্তারা চাকরিতে যোগদান করেন। কেবল তা–ই নয়, চাকরি স্থায়ীকরণ ও সিনিয়র স্কেল পরীক্ষাও হয় একই প্রশ্নে। এখানে মেধার প্রশ্ন নয়। সবাই অভিন্ন প্রশ্নপত্রে প্রতিযোগিতা করে এসেছেন। কেউ যদি বিশেষ সুবিধা পান, তাহলে তা হওয়া উচিত বিশেষায়িত বিষয়ের ক্যাডার কর্মকর্তারা। স্বাস্থ্য, প্রকৌশল, কৃষি কিংবা পশু সম্পদ।

প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা নাকি বেশি মেধাবী, তাই তাঁদের বেশি সুবিধা পাওয়া উচিত—এমন একটি পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন আদালত। ওই বিচারক হয়তো জানেন না, সম্মিলিত মেধার পেছনে থাকা কতজন প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি করেন। ‘জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণে প্রত্যাশিত সিভিল সার্ভিস’ শীর্ষক সেমিনারপত্রে দেখানো হয়েছে, ২৫তম বিসিএস পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধার দিক থেকে শেষ ৫০ জনের মধ্যে ৩০ জন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা হয়েছেন।

বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যাঁরা চাকরিতে যোগদান করেন, তাঁরা প্রত্যেকে সেবকমাত্র। এসব সেবকের মধ্যে একটি ক্যাডারের নামকরণ যখন হয়, প্রশাসন তখন আর সেবকচরিত্রে তাঁদের মধ্যে থাকে না। এ জন্য এই ক্যাডারের নামও পরিবর্তন করা প্রয়োজন। আন্তক্যাডার বৈষম্য দূরীকরণ এখন দেশের স্বার্থে জরুরি হয়ে পড়েছে।

বিশেষ একটি ক্যাডারের প্রতি অন্তর্বতী সরকারের যে বিশেষ দরদ, তা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। অথচ বিগত দিনগুলোতে জনস্বার্থ বিসর্জন দেওয়ার ক্ষেত্রে এই ক্যাডারের কর্মকর্তাদের তুলনা নেই।

ভোটের অধিকার থেকে অনেক অধিকার ক্ষুণ্ন করার ক্ষেত্রে এই ক্যাডার সর্বাগ্রে ছিল। ভবিষ্যতে যাতে কোনো রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে যোগসাজশ করে দেশকে নিলামে তুলতে না পারে, সেই ব্যবস্থাও রাখতে হবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষেই সহজেই সম্ভব এই বৈষম্যমূলক পদ্ধতির মূলোৎপাটন করা। বৈষম্যবিরোধী সরকারের হাত ধরে আন্তক্যাডার বৈষম্য দূর হোক। এটি বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিসের যুগ যুগ ধরে চলে আসা জটিলতা দূর করবে। ২৫টি ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তাদের দাবি আমলে নেওয়া হোক। দেশটা আমাদের সবার। এমনও আছে, পরিবারের একেকজন একেক ক্যাডারের কর্মকর্তা। আমরা চাই, সবার যৌথ প্রচেষ্টায় দেশ এগিয়ে যাক।

তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ক য ড র র কর মকর ত দ র সব ক য ড র র প রথম গ র ড প রব ন ন সরক র র ব যবস থ ন কর ন পর ক ষ র সব র ব স এস র জন য দ র কর র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

‘ভোল পাল্টে’ সক্রিয় কিশোর গ্যাং, অতিষ্ঠ বাসিন্দারা

লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চর আবাবিল ইউনিয়নের উদমারা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। এলাকায় নারীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, মারামারি, খুনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের এসব সদস্যদের বিরুদ্ধে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার ছত্রচ্ছায়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। তবে এখন ভোল পাল্টে স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ভিড়েছে তারা।

সম্প্রতি এলাকাটিতে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন জাহাঙ্গীর আলম (৫২) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন। মসজিদের পাশে জুয়ার আসর বসানো ও মাদক সেবনে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁর ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে। গত ৩ এপ্রিল তাঁর ওপর হামলা করা হয়। এরপর গত শনিবার তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন কয়েকজন স্থানীয় তরুণ। ওই তরুণেরা রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় মিছিল-সমাবেশে কিশোরদের ব্যবহার করে আসছেন। ফলে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতাও এসব কিশোরকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশ্রয় দেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আগে এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল চর আবাবিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম ও ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দারের হাতে। তাঁরা এসব কিশোরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই কিশোরেরা ভোল পাল্টে বিএনপির কর্মসূচিতে সক্রিয় হচ্ছে। আবদুর রহিম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি এসব তরুণকে নতুন করে আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছেন। রহিম ইউনিয়ন বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও তাঁর পদপদবি নেই।

জাহাঙ্গীর আলম খুনের ঘটনায় আবদুর রহিমকেও আসামি করা হয়। মামলার পর তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আমি প্রশ্রয় দিচ্ছি—এমন অভিযোগ প্রায় করা হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমাকে হয়রানির উদ্দেশ্যে মামলায় জড়ানো হয়েছে।’

ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দার বলেন, ‘কিশোর গ্যাংকে আমি কখনো প্রশ্রয় দিইনি। তারা (কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা) আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করত।’ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম আত্মগোপনে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

জানতে চাইলে রায়পুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জেড এম নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির দলীয় কোনো নেতা-কর্মী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের প্রশ্রয় দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো নেতা-কর্মীর অপকর্মের দায় দল নেবে না।

জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলার ঘটনায় গত ৭ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনের নাম উল্লেখ ও ২০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলার আবেদন করেন তাঁর স্ত্রী রাজিয়া বেগম। আদালত রায়পুর থানাকে মামলাটি গ্রহণের নির্দেশ দেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, মসজিদের আশপাশে জুয়ার আসর ও মাদক সেবন করত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এসব বিষয়ের প্রতিবাদ করাকে কেন্দ্র করে সাব্বির হোসেন, জুবায়ের হোসেনসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে ৮–১০ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলা করেছেন। নিহত জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে শারমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, মামলার পর আতঙ্কে দিন কাটছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের। স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিয়ে আসছে।

জানতে চাইলে রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশের ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

লক্ষ্মীপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাঈন উদ্দিন পাঠান বলেন, কিশোর-তরুণদের খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের ফেরাতে না পারলে অপরাধ আরও বেড়ে যাবে। কেউ যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকে তৎপর থাকতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ