ঢাকা-দিল্লির পদক্ষেপই ঠিক করবে সম্পর্কের গতিপথ
Published: 6th, April 2025 GMT
ব্যাংককে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের পর অনুষ্ঠিত বৈঠকে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদি দুই দেশের সম্পর্কের ‘চরম টানাপোড়েন’ দূর করতে নিজেদের উদ্বেগের বিষয়গুলো একে অন্যকে বলেছেন। কোনো কোনো ইস্যুতে দুই নেতা পাল্টা বক্তব্য দিয়েছেন। আবার শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ও আলোচনায় এসেছে।
তবে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ আর ভারতের শীর্ষ নেতারা দুই দেশের জনগণের স্বার্থে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে জোর দিয়েছেন। বিশেষ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আলোচনায় বলেছেন, ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের কেন্দ্রে মানুষ। দুই প্রতিবেশীর সম্পর্ক মানুষের স্বার্থে। সম্পর্কটা কোনো ব্যক্তিবিশেষ বা দলকে ঘিরে নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে এ বার্তা বাংলাদেশের জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার অনুরোধ করেছেন নরেন্দ্র মোদি।
গত শুক্রবার থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের সাংরিলা হোটেলে আধা ঘণ্টার বেশি সময়ের ওই বৈঠকে দুই শীর্ষ নেতা অতীত আর বর্তমানের বিষয়গুলো সামনে এনেছেন সম্পর্কের ভবিষ্যতের স্বার্থে। আর আলোচনাজুড়ে ছিল দুই দেশের প্রসঙ্গগুলো।
অধ্যাপক ইউনূস চীনের কাছে নদী ও পানি ব্যবস্থাপনার ৫০ বছরের মহাপরিকল্পনা চেয়েছেন। তবে কি চীন প্রসঙ্গটি ব্যাংককের আলোচনায় ঊহ্য থেকে গেল!শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে ওই বৈঠকে উপস্থিত সূত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া গেছে যে এটা নির্ভর করছে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণের ওপর। শেখ হাসিনার বিচারপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার বিষয়টিও এসেছে।
ইউনূস-মোদির প্রতীক্ষিত বৈঠকটি এমন এক সময়ে হলো, যার ঠিক এক সপ্তাহ আগে চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বেইজিংয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করেছিলেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। বেইজিংয়ের সেই বৈঠকে ভারতের সঙ্গে অভিন্ন নদীর তিস্তার প্রস্তাবিত প্রকল্পে চীনের ঠিকাদারদের স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ। অধ্যাপক ইউনূস চীনের কাছে নদী ও পানি ব্যবস্থাপনার ৫০ বছরের মহাপরিকল্পনা চেয়েছেন। তবে কি চীন প্রসঙ্গটি ব্যাংককের আলোচনায় ঊহ্য থেকে গেল!
আরও পড়ুনইউনূস–মোদি বৈঠক: যেসব বিষয়ে আলোচনা হলো১৪ ঘণ্টা আগেইউনূস-মোদির বৈঠকে উপস্থিত বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে বাংলাদেশ-ভারতের শীর্ষ নেতাদের আলোচনায় সরাসরি ‘চীন’ শব্দটি উল্লেখ না থাকলেও বিষয়টি এসেছে। নরেন্দ্র মোদি আলোচনার এক পর্যায়ে বলেছেন, দুই দেশের সম্পর্কের মাঝে ‘তৃতীয় পক্ষের’ কোনো প্রয়োজন নেই। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন, তার অভ্যুদয়—সব মিলিয়ে দুই দেশ একে অন্যকে যতটা জানে, বোঝে, তা নিশ্চয় অন্য কারও পক্ষে সম্ভব নয়! কাজেই বাংলাদেশের সফলতা, সংকটে সব সময় পাশে থাকার বাসনা ভারতের।
সম্পর্ক খারাপ হয় এমন বক্তব্য পরিহার করার যে প্রসঙ্গ ভারতের প্রধানমন্ত্রী সামনে এনেছেন, একই বিষয় তাঁদেরও বিবেচনায় থাকা বাঞ্ছনীয়।সাবেক রাষ্ট্রদূত ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) সভাপতি এম হুমায়ুন কবীরসংখ্যালঘুদের বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের প্রসঙ্গ এলে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হিসেবে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের যে ভূমিকা রয়েছে, সেটা ভারত উল্লেখ করেছে। এ সময় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়, নির্যাতনের বেশির ভাগ ঘটনা ৫ থেকে ৮ আগস্ট। যার সঙ্গে বিশেষ কোনো সম্প্রদায় নয়, রাজনৈতিক কারণ জড়িত। তারপরও বাংলাদেশ বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। সরেজমিনে পরিস্থিতি দেখতে ভারতের সাংবাদিকদের বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
দুই দেশ ভবিষ্যৎমুখী ও জনগণকেন্দ্রিক সম্পর্কের ওপর জোর দিয়েছে। তাই খোলাখুলিভাবে শীর্ষ দুই নেতা চ্যালেঞ্জগুলোর কথাও বলেছেন। কিন্তু গত প্রায় আট মাসের চরম টানাপোড়েনের জেরে ভুক্তভোগী হয়েছেন সাধারণ জনগণ। বাংলাদেশের জনগণের জন্য ভারতীয় ভিসা একেবারেই সীমিত হয়ে পড়েছে। এতে ভারতে তো বটেই, ভারত থেকে তৃতীয় দেশের ভিসা পাওয়া বাংলাদেশের মানুষের জন্য প্রায় দুষ্কর হয়ে পড়েছে। আর ভিসার হার নেমে আসায় দুই দেশের মধ্যে বাস-ট্রেন যোগাযোগও প্রায় কমে গেছে। অথচ শুক্রবারের আলোচনায় ভিসা আর যোগাযোগের প্রসঙ্গগুলো আসেনি।
নরেন্দ্র মোদি আলোচনার এক পর্যায়ে বলেছেন, দুই দেশের সম্পর্কের মাঝে ‘তৃতীয় পক্ষের’ কোনো প্রয়োজন নেই। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন, তার অভ্যুদয়—সব মিলিয়ে দুই দেশ একে অন্যকে যতটা জানে, বোঝে, তা নিশ্চয় অন্য কারও পক্ষে সম্ভব নয়!বৈঠকে সীমান্ত হত্যার বিষয়টি এসেছে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এসব হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি সব সময় কষ্ট অনুভব করেন। ভারতকে এই ঘটনাগুলো প্রতিরোধের জন্য উপায় খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, প্রাণহানির সংখ্যা কমাতে একসঙ্গে কাজ করলে কেবল অনেক পরিবারই বড় ধরনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে না, বরং আস্থা ও আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে এবং ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও জোরদার করতে সাহায্য করবে।
এ বিষয়ে নরেন্দ্র মোদি বলেন, ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা শুধু আত্মরক্ষার জন্য গুলি চালায় এবং মৃত্যুর ঘটনাগুলো ভারতের ভেতরে ঘটে। উভয় নেতা বিষয়টি নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
ব্যাংককে উপস্থিত কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া গেছে, বিমসটেকের শীর্ষ সম্মেলনে নেতাদের সম্মানে আয়োজিত নৈশভোজে অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির কথা হয়েছে। অর্থাৎ বৃহস্পতিবারের সেই অনানুষ্ঠানিক আলোচনার পর দিনের বৈঠকের জন্য একধরনের ইতিবাচক আবহ তৈরি করেছিল। সব মিলিয়ে ব্যাংককে শুক্রবারের আলোচনা ইতিবাচক হলেও দুই পক্ষই নিজেদের অবস্থান জোরালোভাবে তুলে ধরেছে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দুই দেশের সম্পর্ক এখন যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক স্তরে যোগাযোগটা জরুরি ছিল। এখন ইউনূস-মোদি বৈঠকের পর সময় বলে দেবে, সম্পর্ক এগিয়ে দুই পক্ষ কতটা উদ্যোগী ভূমিকা নিচ্ছে।
ব্যাংককের আলোচনায় উপস্থিত কয়েকজন কূটনীতিক আভাস দিয়েছেন, এক বৈঠকেই সব সংকট কেটে যাবে, এমন উচ্চাশা কোনো পক্ষই করেনি। বৈঠক হওয়াটাও ইতিবাচক। কারণ, দুই শীর্ষ নেতাই মুখোমুখি বসে কথা বলেছেন। আর বৈঠকের জন্য তৈরি হয়েই ব্যাংককে একে অন্যের সঙ্গে কথা বলেছেন। প্রাসঙ্গিকভাবেই এসেছে ব্যক্তিগত যোগাযোগের স্মৃতিচারণা। সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার যে প্রত্যয় দুই নেতা ব্যক্ত করেছেন, তাঁদের পরবর্তী পদক্ষেপই নির্ধারণ করবে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার গতিমুখ।
সব মিলিয়ে ব্যাংককে শুক্রবারের আলোচনা ইতিবাচক হলেও দুই পক্ষই নিজেদের অবস্থান জোরালোভাবে তুলে ধরেছে।সাবেক রাষ্ট্রদূত ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) সভাপতি এম হুমায়ুন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, দুই নেতা প্রথমবারের মতো আলোচনায় বসে দুই দেশের আগের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন। সামনাসামনি বসে এ বিষয়গুলো আলোচনায় উত্থাপনের ফলে তা সুরাহার জন্য তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক একধরনের দায়বোধ তৈরি হতে পারে। ফলে দুই নেতা হয়তোবা নতুন করে ভাবার সুযোগ পাবেন। এতে দুই দেশের সম্পর্কে হয়তো গতির সঞ্চার হতে পারে। দুজনের জন্যই সম্পর্ককে সাবলীল রাখার একধরনের চাপ তৈরি হতে পারে। ফলে সামগ্রিকভাবে ব্যাংককের বৈঠককে ইতিবাচকই বলা চলে।
এম হুমায়ুন কবীরের মতে, সম্পর্ক খারাপ হয় এমন বক্তব্য পরিহার করার যে প্রসঙ্গ ভারতের প্রধানমন্ত্রী সামনে এনেছেন, একই বিষয় তাঁদেরও বিবেচনায় থাকা বাঞ্ছনীয়।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইউন স ম দ শ ক রব র সব ম ল য় উপস থ ত প রসঙ গ র জন য র প রস বল ছ ন র ওপর ব ষয়ট
এছাড়াও পড়ুন:
মানুষ বলছে, সব দলের শাসন দেখা হয়েছে, বাকি শুধু ইসলামি শাসন দেখার: গোলাম পরওয়ার
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘আপনারা বিগত ৫৪ বছরে বিভিন্ন দলের শাসন দেখেছেন। সেখানে জনগণের কাঙ্ক্ষিত কল্যাণ সাধিত হয়নি। বিগত সরকারগুলো হত্যা, লুটপাট, দুর্নীতি, অন্যায়, অত্যাচার, অবিচারের মাধ্যমে দেশকে একটি অস্থিতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। দেশের মানুষ এখন বলতে শুরু করেছে, সব দলের শাসন দেখা হয়েছে, শুধু বাকি রয়েছে ইসলামি শাসন দেখার। তাই তো আমিরে জামায়াত শফিকুর রহমান একটি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের ডাক দিয়েছেন। একটি জনমুখী ও কল্যাণকর রাষ্ট্রের রূপরেখা ঘোষণা করেছেন। যেখানে লুটপাট-দুর্নীতির মাধ্যমে দেশ তলাবিহীন ঝুড়ি হবে না, বেকারত্বের অভিশাপ কোনো যুবককে বয়ে বেড়াতে হবে না, সকল বৈষম্য দূর হবে। মানুষ সত্যিকার একটি কল্যাণরাষ্ট্র দেখতে পাবে।’
আজ রোববার সকালে পবিত্র হজ পালন শেষে মিয়া গোলাম পরওয়ার নিজ বাড়িতে আসার পথে খুলনার সিকিরহাট, ফুলতলা বাজার ও শিরোমনি শহীদ মিনার চত্বরে স্থানীয় জামায়াত আয়োজিত পথসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন।
মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রধান উপদেষ্টার লন্ডন সফরের কথা অনুযায়ী হয়তো আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচন হতে পারে। জামায়াতে ইসলামী একটি নির্বাচনমুখী দল। মহামান্য হাইকোর্টের রায়ের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ও প্রতীক দাড়িপাল্লা ফিরিয়ে দিয়েছে। সুতরাং আগামী নির্বাচনে দাড়িপাল্লা প্রতীকের পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টির জন্য এখন থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।
সকাল ১০টায় ফুলতলা ইউনিয়ন জামায়াতের আমির মফিজুল ইসলামের সভাপতিত্বে সিকিরহাট খেয়াঘাট চত্বরে, সকাল সাড়ে ১০টায় ফুলতলা উপজেলা জামায়াতের আমির অধ্যাপক আবদুল আলীম মোল্যার সভাপতিত্বে ফুলতলা বাসস্ট্যান্ড চত্বরে ও খানজাহান আলী থানা জামায়াতের আমির সৈয়দ হাসান মাহমুদের সভাপতিত্বে শিরোমনি শহীদ মিনার চত্বরে অনুষ্ঠিত পৃথক পৃথক পথসভা হয়। এসব পথসভায় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন খুলনা জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি মুন্সী মিজানুর রহমান, সহকারী সেক্রেটারি মিয়া গোলাম কুদ্দুস, জেলা অফিস সেক্রেটারি আশরাফুল ইসলাম, জেলা কর্মপরিষদ সদস্য শেখ সিরাজুল ইসলাম, জেলা যুব বিভাগের সভাপতি গোলাম মোস্তফা আল মুজাহিদ, জেলা ছাত্রশিবির সভাপতি ইউসুফ ফকির প্রমুখ।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মনে করেন, কল্যাণকর ও জনমুখী রাষ্ট্র নির্মাণ করতে হলে সৎ মানুষের প্রয়োজন। জামায়াত নির্বাচিত হলে দেশ ও জনগণের কল্যাণে কী কী করা হবে, বক্তব্যে সেসব তিনি তুলে ধরেন।
অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনা-৫ আসনে জামায়াতে ইসলামীর সংসদ সদস্য ছিলেন গোলাম পরওয়ার। বক্তব্যে নিজের সংসদীয় এলাকায় ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বর্ণনাও তুলে ধরেন তিনি।