সকালবেলার রোদটা একটু আলতো, বাতাসের দস্যিপনা নেই। একটা শান্ত, স্মৃতিমাখা স্পর্শ ছড়িয়ে যাচ্ছে সেগুনবাগিচার কচি-কাঁচার মেলা প্রাঙ্গণে। প্রাঙ্গণ ভরা শিশুদের দৌড়ঝাঁপ, কল্লোল। ওরা খেলছে সুনাগরিকের স্বপ্নালয়ে কচি-কাঁচার মেলায়। পাশেই কিছু বৃদ্ধ-বৃদ্ধা গল্পে মেতেছেন একটা নামে। নামটা দাদাভাই। যাঁর আসল নাম রোকনুজ্জামান খান।

বুধবার কচি-কাঁচার মেলার অডিটরিয়ামে তিন দিনব্যাপী দাদা ভাইয়ের জন্মশতবর্ষের সমাপনী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। তাঁর সৃষ্টিশীলতা ও অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলা তিন দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে।

অনুষ্ঠানের শুরুতে মেলা প্রাঙ্গণে দাদাভাইয়ের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। তারপর বিকেলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলোচনা পর্বে দাদাভাইয়ের জন্মশতবর্ষ শ্রদ্ধার্ঘ্যে রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই বইয়ের স্মারক উন্মোচন করা হয়।

বিকেলে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কথাসাহিত্যিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে কচি-কাঁচার মেলার সভাপতি খোন্দকার মো.

আসাদুজ্জামান শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন।

অনুষ্ঠানে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, দাদাভাই যখন কচি-কাঁচার মেলা নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন, তখন শিশু অধিকার নিয়ে সরকারের তেমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না। শিশুদের সুনাগরিক ও আলোর মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তিনি আজীবন কাজ করে গেছেন। কচি-কাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। মৃত্যুর দিনও তিনি কচি-কাঁচার মেলা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।

কচি-কাঁচার মেলার অডিটরিয়ামে তিন দিনব্যাপী দাদা ভাইয়ের জন্মশতবর্ষের সমাপনী অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক আয়োজন

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: অন ষ ঠ ন

এছাড়াও পড়ুন:

‘সিনেমায় প্রথম দিনের শুটিংয়ের জন্য তিন দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে’

স্মৃতিচারণা, আলোচনা, সংগীত ও চলচ্চিত্রের নির্বাচিত দৃশ্যের প্রদর্শনী দিয়ে সাজানো মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক কুমার ঘটক ও তাঁর যমজ বোন প্রতীতি দত্তকে জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হলো।

রোববার বিকেলে ছায়ানট সংস্কৃতি–ভবনের রমেশ চন্দ্র দত্ত স্মৃতি মিলনকেন্দ্রে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপন কমিটি। অনুষ্ঠানে একই সঙ্গে ভাষাসৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ১৩৯তম জন্মতিথি উপলক্ষে তাঁর প্রতিও বিশেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।

অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল সমবেত কণ্ঠে ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’গানটি দিয়ে। এরপর স্মৃতিচারণা করেন ঋত্বিক কুমার ঘটকের বিখ্যাত চলচ্চিত্র তিতাস একটি নদীর নাম–এর প্রযোজক হাবিবুর রহমান খান। তিনি বলেন, বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই ধ্রুপদি চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রহণের কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই। ১৯৬২ সালে সুবর্ণ–রেখা চলচ্চিত্রটি নির্মাণের দশ বছর পর তিতাসের কাজ শুরু করেছিলেন ঋত্বিক কুমার। প্রায় এক বছর ধরে কাজ হয়েছে। এই এক বছর তিনি ঋত্বিক কুমারের সঙ্গে কাটিয়েছেন। সবারই জানা কিছুটা খ্যাপাটে স্বভাবের ছিলেন ঋত্বিক। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে বাদপ্রতিবাদ হয়েছে। তিনি বলেন, লক্ষ্য ছিল, যা কিছু হোক ঋত্বিক কুমারকে দিয়ে চলচ্চিত্রটির নির্মাণ শেষ করানো। এসব করতে গিয়ে গভীর ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছিল এই অনন্য প্রতিভাবান মানুষটির প্রতি। নির্মাণ শেষে ঋত্বিক বলেছিলেন, এই চলচ্চিত্রটি তিনি নির্মাণ করেছেন সময়ের চেয়ে ২০ বছর এগিয়ে।

তিতাস একটি নদীর নাম চলচ্চিত্রে যাঁরা অভিনয় করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে একমাত্র আবুল হায়াতই জীবিত আছেন। অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, এটি তাঁর জীবনের প্রথম চলচ্চিত্র। ঋত্বিক কুমারের মতো নির্মাতার হাত ধরে এত বিখ্যাত একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে পারা তাঁর অভিনয়জীবনের একটি বড় সৌভাগ্যের বিষয়। সিনেমায় প্রথম দিনের শুটিংয়ের জন্য টানা তিন দিন তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছে। তখন ঢাকা ওয়াসাতে প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করতেন। শুটিং হচ্ছিল মানিকগঞ্জে। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে যেতেন আর সারা দিন অপেক্ষা করার পর পরিচালক তাঁকে পরের দিন আসতে বলতেন। অবশেষে তৃতীয় দিন রোজী সামাদের সঙ্গে তাঁর শুটিং হয়। তিনি বলেন, বাইরে থেকে ঋত্বিক কুমারকে দেখে যেমন মনে হতো, ভেতরের মানুষটি ছিল তার বিপরীত। খুব ঠান্ডা, নরম হৃদয়ের ছিলেন তিনি।

নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, সবাই জানেন ঋত্বিক কুমার নিজের জীবনের প্রতি যত্নবান ছিলেন না। মাত্র পঞ্চাশ বছরের জীবন। আরও অনেক কিছু দিতে পারতেন তিনি। বৈচিত্র্যময় প্রতিভাবান ছিলেন। নাটকে অভিনয় করেছেন। মৌলিক নাটক রচনা করেছেন পাঁচটি। গল্প লিখেছেন। তবে চলচ্চিত্রের জন্যই তিনি খ্যাত হয়েছেন। দেশভাগ তাঁর হৃদয়কে বিক্ষত করেছিল। দেশভাগ, সামাজিক অবক্ষয়, নারীর অবস্থান—এসব বারবার এসেছে তাঁর নাটক, গল্প ও চলচ্চিত্রে।

প্রাবন্ধিক মফিদুল হক তাঁর আলোচনার শুরুতে ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের অবদান তুলে ধরেন। তিনি পাকিস্তান গণপরিষদে প্রথম বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। নতুন প্রজন্মকে তাঁর অবদান স্মরণ করতে হবে।

ঋত্বিক কুমার সম্পর্কে মফিদুল হক বলেন, ঋত্বিক কুমারের কথা বলতে সাধারণত উষ্কখুষ্ক চুল, মলিন বেশভূষার একটি মানুষের কথাই মনে আসে। তবে এটি তাঁর প্রকৃত চেহারা নয়। তাঁর বাবা সুরেশ চন্দ্র ঘটক ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। তাঁর বড় ভাই বিখ্যাত সাহিত্যিক মণীশ ঘটক। মণীশের কন্যা মহাশ্বেতা দেবী। শৈশবে ঋত্বিক ও তাঁর যমজ বোন প্রতীতি কলকাতায় স্কুলে পড়েছেন। গাড়িতে করে যাতায়াত করেছেন। তবে তিনি জন্মস্থান রাজশাহীতে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেছিলেন। এখানেই তাঁর নাটকে অভিনয় ও সাহিত্যচর্চার শুরু। দেশভাগ ঋত্বিককে বদলে দিয়েছিল। জন্মস্থান ছেড়ে বাবার সঙ্গে কলকাতায় চলে যান। যমজ বোন প্রতীতির বিয়ে হয় ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পুত্রের সঙ্গে। দেশভাগের বেদনা ঋত্বিক তাঁর কাজে বিভিন্নভাবে তুলে ধরেছেন। রাজশাহীতে তাঁর স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন বলে তিনি তাগিদ দেন।

আলোচনায় আরও অংশ নেন নারী নেত্রী সুলতানা কামাল, নির্মাতা শামীম আকতার, পারিবারিক বন্ধু মাহেরা খাতুন, কিশওয়ার কামাল, প্রতীতি দত্তের মেয়ে আরমা দত্ত।

অনুষ্ঠানে ঋত্বিক কুমারের বিভিন্ন চলচ্চিত্রের বিভিন্ন দৃশ্য বড় পর্দায় প্রদর্শন করে সেগুলোর বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করেন নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেল। সংগীত পরিবেশন করেন লাইসা আহমদ লিসা। সঞ্চালনা করেন মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘সিনেমায় প্রথম দিনের শুটিংয়ের জন্য তিন দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে’