বৃষ্টি নেই, খরতাপে সবুজ চা–পাতা লাল হয়ে শিকড় মরে যাচ্ছে
Published: 10th, April 2025 GMT
পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় খরার কবলে পড়েছে হবিগঞ্জের ২৪টি চা-বাগান। খরার কারণে বাগানের ভেতরের ছড়াগুলোও শুকিয়ে গেছে। পানিসংকটে চা–গাছের শিকড় শুকিয়ে পাতা ঝরে যাচ্ছে, নতুন করে পাতা গজাচ্ছে না। চলতি মৌসুমে খরার কারণে চা-শিল্পে বড় ধরনের লোকসান গুনতে হবে বলে আশঙ্কা এই শিল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। তবে আবহাওয়া কার্যালয় বলছে, খুব শিগগির বৃষ্টি হতে পারে। বৃষ্টি হলে খরা থেকে মুক্তি মিলবে।
দেশে ১৬৭টি চা–বাগান আছে। এর মধ্যে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ, বাহুবল, চুনারুঘাট ও মাধবপুর উপজেলায় ছোট-বড় ২৪টি চা–বাগান আছে। আয়তনে প্রায় ১৬ হাজার হেক্টর। প্রতি হেক্টর জমিতে দুই থেকে আড়াই হাজার কেজি চা–পাতা উৎপাদন হয়।
ফাল্গুন থেকে চৈত্র মাসকে চায়ের মৌসুম ধরা হয়। এ সময়ে সবুজ চা–পাতা সংগ্রহের কাজ শুরু হয়। তখন যত বৃষ্টি হয়, চা–পাতা তত সবুজ হয়ে ওঠে। গাছে গাছে নতুন কুঁড়ি গজায়। ঘন সবুজ হয়ে ওঠে বাগানগুলো। নতুন পাতা সংগ্রহের ধুম পড়ে বাগানগুলোতে। তবে এবারের দৃশ্য একেবারে উল্টো। কারণ, প্রয়োজনীয় বৃষ্টি হচ্ছে না। বাগানের ভেতরের ছোট-বড় ছড়াগুলো শুকিয়ে চৌচির হয়ে আছে। বৃষ্টি না হওয়ায় ছড়াগুলোতে পানি জমিয়ে বা সংরক্ষণ করে রাখা যায়নি। পাশাপাশি পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় কৃত্রিমভাবে সেচ দেওয়া সম্ভব হয় না। বাগানের মাটি বালুকাময় হওয়ায় সহজেই মাটি গরম হয়ে উঠছে।
সরেজমিনে মাধবপুরের নোয়াপাড়া, সুরমা চা–বাগান এবং চুনারুঘাটের দেউন্দি ও চণ্ডী চা–বাগানে দেখা গেছে, অনাবৃষ্টির কারণে বাগানের চা–পাতাগুলো লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। চা–গাছের শিকড় শুকিয়ে গেছে। এ জন্য নতুন পাতা (কুঁড়ি) গজাচ্ছে না। বাগানের ভেতরের ছড়াগুলো শুষ্ক। প্রতিটি বাগানে পানির জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে। কোনো কোনো বাগানে গাছ বাঁচাতে কৃত্রিমভাবে পানির পাম্প বসিয়ে পানি দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে আয়তনে বিশাল হওয়ায় পুরো জায়গায় পানি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
গত মঙ্গলবার সকালে চণ্ডী চা–বাগানে কৃত্রিমভাবে পানি দিচ্ছিলেন শ্রমিক পবিত্র কুণ্ড। তিনি বলেন, আগে একসময় কুয়া থেকে পানি দেওয়া হতো। এখন তা কমে গেছে। বাগানে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। পাম্প বসিয়েও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। পানির জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে। অনেক শ্রমিক নিজেদের নিত্যপ্রয়োজনে দূরদূরান্ত থেকে পানি সংগ্রহ করছেন। নারী শ্রমিক মিনতি সাঁওতাল বলেন, বৃষ্টি না থাকায় চা–গাছে এবার সবুজ কুঁড়ি জন্মাচ্ছে না।
চণ্ডী চা–বাগানের ব্যবস্থাপক সেলিমুর রহমান বলেন, খরার কারণে চা উৎপাদন বন্ধ আছে। এভাবে আর কিছুদিন চললে এবার তাঁরা কোনো চা–পাতা সংগ্রহ করতে পারবেন না। দেশের অধিকাংশ বাগান এবার বড় ধরনের লোকসানের দিকে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ চা গবেষণাকেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, চা–গাছ সর্বোচ্চ ২৯ ডিগ্রি পর্যন্ত তাপ সহ্য করতে পারে। তার ওপরের তাপমাত্রা চায়ের জন্য ভালো নয়। চায়ের জন্য ২০ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা উত্তম। তবে চা–বাগানে ছায়াগাছ থাকলে তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। বর্তমানে তাপমাত্রা রেকর্ড হচ্ছে ৩৮ থেকে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সূর্যালোকের উপস্থিতিতে গাছের পাতায় অবস্থিত ক্লোরোফিলের মাধ্যমে গাছ যেভাবে খাদ্য আহরণ করে, তাপমাত্রা ২৯ ডিগ্রি পার হলেই চা–গাছ সেই সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
মাধবপুরের নোয়াপাড়া চা–বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক সোহাগ মাহমুদ বলেন, এবার লম্বা সময় ধরে বৃষ্টি হচ্ছে না। আগে মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র মাসে বৃষ্টি হতো। ফলে বাগানে কচি চা–পাতা সংগ্রহের ধুম পড়ে যেত। এখন মাধবপুরে অনেক শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। তাঁর ধারণা, বায়ুমণ্ডলে কারখানার ধোঁয়া মিশ্রিত হওয়ায় বাগান এলাকায় প্রভাব পড়ছে।
সুরমা চা–বাগানের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক মিলন হোসেন বলেন, গত বছর এ সময়ে বাগানে প্রচুর সবুজ চা–পাতা পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু চলতি মৌসুমে খরার কারণে চা–গাছ টিকিয়ে রাখা কঠিন। কারণ, সূর্যের তাপ সবুজ চা–পাতা সহ্য করতে পারছে না। চা–পাতা লাল হয়ে গাছের শিকড় মরে যাচ্ছে। এখন কারখানায় পাতা প্রক্রিয়াজাত করার সময়। কিন্তু সেই অনুপাতে কিছুই করা যাচ্ছে না। উৎপাদন ও বিক্রি কমে গেলে এবার বড় সংকটে পড়তে হবে।
শ্রীমঙ্গল আবহাওয়া পর্যবেক্ষণকেন্দ্রের কর্মকর্তা আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর মার্চ মাসে বৃষ্টির পরিমাণ ছিল ৪৮ মিলিমিটার। এবার একই সময়ে মাত্র চার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। তবে সামনে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম ধবপ র র জন য সব জ চ হওয় য়
এছাড়াও পড়ুন:
শিক্ষার্থীর গবেষণাপত্রের অংশ অনুমতি না নিয়ে প্রকাশের অভিযোগ, শিক্ষক বলছেন ‘ভিত্তিহীন’
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ইসরাত জাহানের বিরুদ্ধে তাঁর আগের কর্মস্থলের এক শিক্ষার্থীর তৈরি করা গবেষণাপত্রের অংশ নিজের নামে প্রকাশ করার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় ওই শিক্ষার্থী কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
লিখিত অভিযোগ দেওয়া ওই সাবেক শিক্ষার্থীর নাম রিফাত সুলতানা। তিনি নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। বর্তমানে তিনি ফেনী শহরের বাসিন্দা এবং সেখানে একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। ২০১৯ সালে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন ইসরাত জাহান। ওই সময়ের শিক্ষার্থী রিফাত সুলতানার থিসিসের সুপারভাইজার ছিলেন তিনি। প্রায় আড়াই বছর আগে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছেন ইসরাত জাহান।
জানতে চাইলে ইসরাত জাহান মঙ্গলবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেই শিক্ষার্থী আমাকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলবে, কখনো ভাবিনি। আমার সঙ্গে ওই শিক্ষার্থীর দীর্ঘদিনের সম্পর্ক এবং সে নিজেই একাধিকবার আমার সঙ্গে যৌথভাবে জার্নাল প্রকাশের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আমি দীর্ঘদিন তাকে পড়িয়েছি, আমিই তাকে সব সময় উৎসাহিত করেছি থিসিসে। কিন্তু অভিযোগে এবং গণমাধ্যমে সে যেসব কথা বলেছে, তার সবই ভিত্তিহীন। আমি তার সঙ্গে অসংখ্যবার আলোচনা করেই জার্নালে প্রবন্ধ জমা দিয়েছি। আমার কাছে সব প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু কেন সে অভিযোগ করল, এটাই বুঝতে পারছি না।’
২০১৯ সালে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ইসরাত জাহানের অধীন রিফাত সুলতানা একটি থিসিস করেন। যার শিরোনাম ‘সাবজুগেশন, মার্জিনালাইজেশন অ্যান্ড ডাবল কলোনিজেশন: আ রিডিং অব দ্য অবরোধবাসিনী, দ্য ডার্ক হোল্ডস নো টেররস অ্যান্ড দ্য গড অব স্মল থিংস’। ওই থিসিসের বিষয়বস্তুর ওপর ভিত্তি করে গত ৩১ ডিসেম্বর ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ইংলিশ লিটারেচার অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেস’ জার্নালে ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স: আ কোয়েস্ট ফর সেলফ ইন শশী দেশপান্ডে’স দ্য ডার্ক হোল্ডস নো টেররস’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন ইসরাত জাহান। এই প্রবন্ধে রিফাত সুলতানাকে দ্বিতীয় লেখক হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
এরপর গত ১৩ মার্চ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বরাবর অভিযোগ পাঠান রিফাত সুলতানা। যার পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
রিফাত সুলতানা অভিযোগ করেন, ইসরাত জাহান তাঁর অনুমতি ছাড়া এমএ থিসিসের ৩ নম্বর অধ্যায় থেকে সরাসরি অনুলিপি করেছেন। এ ছাড়া থিসিসের অন্যান্য অংশও, যেমন ৬ জানুয়ারি ২০১৯ এবং ২৩ আগস্ট ২০১৯ তারিখে পাঠানো থিসিসের খসড়া নমুনা এবং থিসিস প্রেজেন্টেশন থেকেও তিনি উদ্ধৃতি এবং প্যারাফ্রেজিং ব্যবহার করেছেন। তা ছাড়া ইসরাত জাহান থিসিসের মৌলিক লেখকের নাম প্রকাশে তাঁর সম্মতি নেননি। গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর ইসরাত জাহান তাঁর মুঠোফোনে কল করলেও তিনি ব্যস্ততার কারণে ধরতে পারেননি। এরপর তাঁর সঙ্গে শিক্ষকের আর কোনো যোগাযোগ হয়নি।
রিফাত সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গত ২২ এপ্রিল আমার সাক্ষাৎকার নিয়েছে। তবে সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় তদন্ত কমিটি পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেছে এবং নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। তদন্ত চলাকালীন আমার অভিযোগের তদন্ত না করে আমাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছে তারা। তদন্ত কমিটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমাকে মানসিকভাবে হেনস্তা করেছে।’
তদন্ত কমিটির সদস্যরা তাঁদের মত চাপিয়ে দিতে চেয়েছেন উল্লেখ করে রিফাত সুলতানা আরও বলেন, ‘তাঁরা মনে করেন, থিসিস থেকে শিক্ষার্থী এবং সুপারভাইজার দুজনেই নাকি একক লেখক হিসেবে গবেষণা আর্টিকেল প্রকাশ করতে পারেন এবং কোনো সুপারভাইজার চাইলেই শিক্ষার্থীর থিসিস থেকে প্রথম লেখক হিসেবে আর্টিকেল প্রকাশ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে থিসিসকারী শিক্ষার্থী অনুমতি না নিয়ে আর্টিকেল প্রকাশ করাকে তাঁরা অন্যায় বলে মনে করেন না।’
জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির সদস্য কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (চলতি দায়িত্ব) অধ্যাপক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এগুলো সব মিথ্যা ও বানোয়াট কথাবার্তা। ইসরাত জাহান এই গবেষণা দিয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো প্রকার সুবিধা নেননি। এটি তাঁদের ব্যক্তিগত বিষয়। কারণ, পূর্বের প্রতিষ্ঠানে এটি তাঁদের যৌথ কাজ ছিল। ইসরাত যে গবেষণা জার্নালে প্রকাশ করেছেন, সেখানে তিনি শিক্ষার্থীর নামও দিয়েছেন। এরপরও আমাদের কাছে অভিযোগ করায় আমরা এ নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেছি এবং অভিযোগকারীর কাছ থেকে বিস্তারিত জানান চেষ্টা করেছি। কিন্তু তিনি যেসব কথা বলছেন সেগুলো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও বানোয়াট।’