ভোলায় আটকে রাখা ৮টি গ্যাসভর্তি গাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা
Published: 21st, April 2025 GMT
ভোলায় পাওয়া গ্যাস দিয়ে জেলার উন্নয়নসহ পাঁচ দফা দাবি বাস্তবায়নে আন্দোলনের অংশ হিসেবে আটক ইনট্রাকো কোম্পানির এলপিজি গ্যাসভর্তি আরও আটটি গাড়ি (কাভার্ড ভ্যান) ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। গতকাল রোববার রাত ১২টার দিকে ভোলার বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান বদ্বীপ ছাত্রকল্যাণ সংসদের নেতারা।
এ সময় আন্দোলনের নতুন কর্মসূচিও দেওয়া হয়। ঘোষণা অনুযায়ী, আগামীকাল মঙ্গলবার থেকে ভোলার সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড কার্যালয়ের সামনে ছাত্র-জনতা লাগাতার অবস্থান ধর্মঘটে বসবে।
ভোলাবাসী গত তিন বছর পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন। দাবিগুলো হলো, ভোলার গ্যাস ভোলায় ব্যবহার করতে হবে, ঘরে ঘরে গ্যাস–সংযোগ দিতে হবে, ইন্ট্রাকোর সঙ্গে করা অসম চুক্তি বাতিল করতে হবে, ভোলায় একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল স্থাপন করতে হবে, ভোলার হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকের শূন্য পদ পূরণ ও একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ভোলা-বরিশাল সেতু নির্মাণ করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বদ্বীপ ছাত্রকল্যাণ সংসদের আহ্বায়ক রাহিম ইসলাম বলেন, ‘ইন্ট্রাকো কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে। তারা আমাদের দাবির প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছে। শুক্রবার সকাল থেকে রোববার রাত পর্যন্ত আমাদের ডাকে ছাত্র-জনতা বিক্ষোভ, মানববন্ধন, মশাল মিছিল করে এবং ইন্ট্রাকোর আটটি গ্যাসবাহী গাড়ি আটক করে। পরে নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় এনে গাড়িগুলো ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে ওপর মহলের সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত গ্যাস ভোলার বাইরে যাবে না।’
আরও পড়ুনভোলার গ্যাস নিজেরা ব্যবহার করতে চান ভোলাবাসী, পাঁচ দাবিতে বিক্ষোভ-সমাবেশ১৩ ঘণ্টা আগেরাহিম ইসলাম আরও বলেন, ‘ফেসবুকে কিছু মানুষ আমাদের নিয়ে বাজে মন্তব্য করছে, আমরা নাকি টাকার বিনিময়ে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে চাই, গাড়িগুলো কেবল নিরাপত্তার স্বার্থে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বিশ্বাস করি।’
‘আগামীর ভোলা’ সংগঠনের মুখ্য সংগঠক মীর মোশাররফ বলেন, ভোলার ঘরে ঘরে গ্যাস সংযোগ দেওয়া বন্ধ রয়েছে একটি বিশেষ আইনের কারণে, যা সরকারের স্বার্থে প্রণীত। অথচ অন্যান্য এলাকায় ইন্ডাস্ট্রিতে গ্যাস–সংযোগ বন্ধ থাকলেও ভোলায় তা চলছে। এখন যেহেতু সংসদ বন্ধ, তাই রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করে ঘরে ঘরে গ্যাস–সংযোগ দেওয়া সম্ভব।
এ সম্পর্কে ইন্ট্রাকোর ভোলা ডিপোর উপমহাব্যবস্থাপক নুরুন্নবী বলেন, ‘আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে। তাঁরা আমাদের গাড়িগুলো ছেড়ে দিয়েছেন। পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত আমরা গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখছি।’
আরও পড়ুনভোলায় গ্যাসভর্তি আরও তিনটি গাড়ি আটকে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ, উত্তেজনা১৯ এপ্রিল ২০২৫.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
এই অদম্য মেয়েদের আমরা হারিয়ে যেতে দিতে পারি না
অবহেলিত মেয়েরা কঠিন একটি কাজ সম্পন্ন করেছেন। অনেকের কাছে এখনো অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। অসাধ্য এক অর্জনকে বাস্তবের জমিনে নামিয়ে এনেছেন আমাদের বাঘিনীরা। সাফ পর্যায় জয় করে নারীদের ফুটবলকে এশীয় পর্যায়ে নিয়ে গেলেন। বিশ্বকাপও খেলে ফিরতে পারেন এই অদম্য বাঘিনীরা।
এখন বলাই যায়, নারী ফুটবলের বিশ্ব পর্যায়ে কড়া নাড়ছেন আমাদের মেয়েরা। ফুটবলকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তাঁরা। শুধু ফুটবলই নয়, আমাদের নারী জাগরণের নতুন দিশা হতে পারে মেয়েদের এই সাফল্য। এই মেয়েরা সারা দেশের মেয়েদের জন্য উদাহরণ। নারী অধিকার, নারী ক্ষমতায়নের নতুন দিনের আলোকবর্তিকা আমাদের নারী ফুটবল দল।
ফুটবলে মেয়েদের এই সাফল্যের পেছনে আছে দীর্ঘদিনের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস। সফলতা খুব সহজে আসেনি। নানা প্রতিবন্ধকতা পার করে কঠিন এক সংগ্রামের ফসল মেয়েদের আজকের এই অর্জন। ঠাকুরগাঁওয়ের প্রত্যন্ত পল্লি থেকে কোহাটি কিষ্ক, কলসিন্দুরের মারিয়া মান্দা, শামসুন্নাহার, তহুরা খাতুন, সানজিদা আক্তার বা রাঙামাটির দুর্গম গ্রাম মগছড়ি থেকে ঋতুপর্ণা চাকমাদের আজকের এই পর্যায়ে আসার ইতিহাসটা আমরা কমবেশি সবাই জানি।
এই পথচলায় সামাজিক বিধিনিষেধ ছিল। ছিল আর্থিক টানাপোড়েন, অনিশ্চয়তা। জীবনের এমন কোনো সংকট নেই, যা তাঁদের সামনে আসেনি। কিন্তু হিমালয়সম সেই বাধাকে সাহসিকতার সঙ্গে পেছনে ঠেলে আজকে তাঁরা এশীয় পর্যায়ে নিজেদের উন্নীত করেছেন।
তাঁদের অর্জনের তুলনায় রাষ্ট্র দিতে পেরেছে খুবই কম। বলতে গেলে, তাঁরা পেটেভাতে দেশের জন্য খেলে দিচ্ছেন। যেন খেলার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চলছে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আদলে। যৎসামান্য যে বেতন দেওয়া হয়, সেটাও অনিয়মিত। যেকোনো সাফল্যের পর যখন মেয়েদের কাছে শুনতে চাওয়া হয়, ‘আপনারা কী চান?’ উত্তরে মেয়েরা জানান, ‘নিয়মিত বেতনটা চাই। আর বেতনটা বাড়ালে আরও ভালো হয়।’ ২০২৫ সালে এসে এটা মেনে নেওয়া কঠিন।
দেশে মেয়েদের নিয়মিত লিগ হয় না। অন্য কোনো টুর্নামেন্টও হয় না নিয়মিত। নিয়মিত খেলার জন্য আমাদের মেয়েদের ভুটান লিগে খেলতে যেতে হয়। কেবল আবাসিক ক্যাম্পের প্রশিক্ষণ ও কিছু প্রস্তুতিমূলক ম্যাচ খেলেই মেয়েদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিযোগিতামূলক খেলায় নামতে হয়। সেই সব খেলায় তাঁরা নিয়মিত লিগ খেলা দলগুলোকে বলে-কয়ে হারাচ্ছে।
আমাদের খেলাধুলাকে রাজধানীকেন্দ্রিক না রেখে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। শুধু নারী ফুটবল নয়, সব ধরনের খেলাধুলার আয়োজন করতে হবে তৃণমূল থেকে। তবেই নতুন নতুন প্রতিভাবান খেলোয়াড় বেরিয়ে আসবে। ঢাকাকেন্দ্রিক খেলার কুফল কী হতে পারে, তার বড় উদাহরণ আমাদের ছেলেদের ফুটবল। সারা দেশে নিয়মিত প্রতিযোগিতামূলক লিগ না হওয়ার কারণে নতুন নতুন ফুটবলার বেরিয়ে আসছেন না।কী পরিমাণ প্রতিভার অধিকারী হলে ন্যূনতম সুবিধা না পেয়েও এ পর্যায়ে সাফল্য অর্জন করা যায়, তা এককথায় অবিশ্বাস্য। ভারত ও নেপালে নিয়মিত মেয়েদের খেলা হয়, লিগ হয়। আর আমরা তাদের এখন নিয়মিতই হারাই। এখন সাফের বাইরের দলগুলোকেও আমরা হারাতে শুরু করেছি।
এই মেয়েদের প্রচেষ্টা ও সাহস নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রচণ্ড রকম ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে তাঁরা খেলতে নামেন। ভয়হীন ফুটবল খেলেন। সব থেকে বড় কথা, খেলার যেকোনো ধরনের ট্যাকটিকসের সঙ্গেই তাঁরা দ্রুত মানিয়ে নিতে পারেন। আগে আমাদের মেয়েরা কিছুটা রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলতেন। রক্ষণ সামলে প্রতি-আক্রমণে যেতেন। এবার এশিয়ান কাপের বাছাইয়ে মেয়েরা পুরো খেলার ধরন বদলে ফেলেছেন।
আমাদের মেয়েরা এবার হাই প্রেসিং ফুটবল খেলেছেন। এই দল আগের থেকে দ্রুতগতিসম্পন্ন ফুটবল খেলে। বল পায়ে রাখতে পারে। তাদের বল ডিস্ট্রিবিউশন আগের থেকে অনেক উন্নত হয়েছে। পাসিংও ভালো। পজিশন সেন্স চমৎকার। বিশেষ করে বল হারালে দ্রুত নিজেরা অবস্থান নিতে পারে।
এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে হাই লাইন ডিফেন্স করে গেছে দুর্দান্তভাবে। আর বাহরাইনের সঙ্গে শামসুন্নাহার জুনিয়র যেভাবে গতি সঞ্চার করে ডিফেন্স থেকে বেরিয়ে ওয়ান টু ওয়ানে গোলরক্ষককে পরাজিত করলেন ঠান্ডা মাথায়, তা আমাদের পুরুষ দলের স্ট্রাইকার বা উইঙ্গাররাও করতে পারেন না। নিয়মিত খেলার মধ্যে না থাকা একটি দলের কাছে এর বেশি আশা করা উচিত নয়। কিন্তু তাঁরা আমাদের সেই আশাকে ছাড়িয়ে গেছেন। তাঁরা পরিস্থিতি বুঝে মাঠে খেলাটা তৈরি করতে পারেন।
মেয়েদের এই লড়াইকে ধরে রাখতে হবে। তাঁদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সিরাত জাহান স্বপ্না বা আঁখি খাতুনের মতো খেলোয়াড়দের আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে ফুটবল থেকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। মেয়েদের প্রতিযোগিতামূলক লিগ নিয়মিত আয়োজন করতে হবে। এর পাশাপাশি জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে লিগের আয়োজন করতে হবে।
‘সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে এই মেয়েরা আমাদের ফুটবল নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবেন।’