লালমনিরহাটে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল সোমবার সকালে এ গণশুনানিতে সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে সেবা পেতে হয়রানি ও দুর্নীতির নানা চিত্র উঠে আসে। লালমনিরহাট জেলা পরিষদ অডিটোরিয়াম হলে যৌথভাবে এ গণশুনানির আয়োজন করে জেলা প্রশাসন ও দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন দুদক চেয়ারম্যান ড.
উপবৃত্তির টাকা প্রতিষ্ঠানপ্রধানের পকেটে– এমন অভিযোগ নিয়ে দুদকের গণশুনানিতে হাজির হন সদর উপজেলার মোগলহাট ইউনিয়নের ফুলগাছ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কয়েকজন অভিভাবক। শুনানিতে অভিভাবক মিঠু ও রোজিনা বেগম জানান, প্রধান শিক্ষক সামিউল ইসলামের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নম্বরে উপবৃত্তির টাকা আসত। সেই টাকা প্রধান শিক্ষক হাতিয়ে নেন।
অভিযোগকারীদের বক্তব্য শুনে সেবাদাতা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল হামিদ সরকার বলেন, অভিযোগ পেয়ে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রধান শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। পরে আবদুল মোমেন বলেন, বিষয়টি দুদক আমলে নিয়েছে। তদন্ত করা হবে।
শুনানিতে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন মোগলহাট ইউনিয়নের এক ভুক্তভোগী। তিনি বলেন, ২০২৩ সালে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে কয়েক বখাটে স্কুলে যাওয়ার পথে তাঁর মেয়েকে উত্ত্যক্ত করে। এ অভিযোগে তিনি সদর থানায় মামলা করতে যান। কিন্তু তাঁর মামলা নেওয়া হয়নি। তৎকালীন এসআই রেজাউল ইসলাম বখাটেদের সঙ্গে যোগসাজশে উল্টো তাঁকে বেকায়দায় ফেলেন। থানায় এলে আটকের হুমকিও দেন। ঘটনার পর থেকে তাঁর মেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন ওই বাবা। এ অবস্থায় অভিযোগ খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন পুলিশ সুপার তরিকুল ইসলাম।
এভাবে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত চলে গণশুনানি। দুদক চেয়ারম্যান ও দুদক কমিশনার (তদন্ত) ধৈর্য সহকারে অভিযোগকারীদের বক্তব্য শুনে প্রতিকার দেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পর ড. ইউনূসের যে সরকার, সেটি দুর্নীতিমুক্ত। আগে তো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও ঘুষ দিতে হতো। ড. ইউনূসের কার্যালয়ে ঘুষ দিতে হয় না। দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়তে সবার সহযোগিতা চাই।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।
জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।
পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।
জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।
মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।