সরকার পরিবর্তন হলেও ফ্যাসিস্ট ‘রেজিম’ পরিবর্তন হয়নি: সলিমুল্লাহ খান
Published: 26th, April 2025 GMT
লেখক ও অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেছেন, ফ্যাসিস্ট সরকার পরিবর্তন হলেও ফ্যাসিস্ট ‘রেজিমের’ পরিবর্তন হয়নি। তিনি বলেন, গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যে গুম, খুন এবং বিশেষ করে আন্দোলনের সময় যে হত্যাকাণ্ড হয়েছে, সেটির বিচার এখনো শুরু হয়নি। এটা বর্তমান সরকারের অযোগ্যতা ও অদূরদর্শিতা, অক্ষমতাও বলা যায়।
অধ্যাপক সলিমুল্লাহ বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ ছিল বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে; আর এবারের আন্দোলন হয়েছে রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে, দেশের শক্তির বিরুদ্ধে। এবারের আন্দোলনে মানুষ বৈষম্যবিরোধী শব্দটিকে নিয়েছে। এই শব্দের মধ্যে ম্যাজিকের ব্যাপার আছে। আরেকটি হলো মানবিক মর্যাদা, যেটি শুধু শেখ হাসিনার আমলে নয়, বাংলাদেশে কোনোদিনই ছিল না। সেই মূলমন্ত্রই আবার উচ্চারিত হয়েছে জুলাইয়ের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে।
আজ শনিবার রাজধানীর গ্রিন রোডে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের (ইউপিএল) কার্যালয়ে একটি বইয়ের প্রকাশনা উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় সলিমুল্লাহ খান এসব কথা বলেন। বইটির নাম ‘জুলাই অভ্যুত্থান ও বৈষম্যবিরোধী সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়: পনেরো সমন্বয়কের সাক্ষাৎকার’।
শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে সলিমুল্লাহ খান বলেন, শিক্ষা কমিশন করার সাধ্য অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। তিনি বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কমপক্ষে ৮ থেকে ১০টি শিক্ষা কমিশন হয়েছে; কিন্তু অধিকাংশই নামকাওয়াস্তে।
১৫ সমন্বয়কের সাক্ষাৎকার নিয়ে সম্পাদিত বইটি প্রসঙ্গে সলিমুল্লাহ খান বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের ইতিহাসকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে এই বইটা প্রকাশ করা দরকার ছিল। তিনি বলেন, জুলাই আন্দোলনের বছর পার না হতেই মানুষ কেন বলছে, জুলাইয়ের স্পিরিট হারাতে বসেছে, তা বোঝা জরুরি। ‘এ বই যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা নিয়ে আমার দ্বিমত নেই। জুলাই আন্দোলন নিয়ে আরও বই হওয়া উচিত।’
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম বলেন, আন্দোলনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা যোগ দেওয়ার পর অনেক মানুষ যোগ দিয়েছেন। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও তখন আন্দোলন করছিলেন এবং অন্যরাও যে যুক্ত, সেটি বড়ভাবে দৃশ্যমান হলো।
আজকের এ আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রেজওয়ানা করিম, লিম্যান কলেজ সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের ফ্যাকাল্টি শিবলী আজাদ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক ফারহান হাসান। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।
জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।
পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।
জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।
মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।