ভারতের সেনাবাহিনী যুদ্ধের জন্য কতটা সক্ষম
Published: 28th, April 2025 GMT
সীমান্তে হুমকির মুখে আছে ভারতের সেনাবাহিনী। অথচ তার আধুনিকীকরণ এখনো শেষ হয়নি। সেই বাস্তবতা সামনে চলে আসতে পারে। এই ঝুঁকি হয়তো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে প্রতিশোধ নেওয়ার সিদ্ধান্তে সংযত থাকতে বাধ্য করবে।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা চলতেই থাকে। শেষবার যখন তা সরাসরি মুখোমুখি সংঘাতে রূপ নিয়েছিল, তখন ভারতীয় কর্মকর্তারা এক অস্বস্তিকর বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছিলেন। আর তা হলো দেশের বিশাল সেনাবাহিনী ছিল পুরোনো ও সীমান্তের তাৎক্ষণিক হুমকি মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট প্রস্তুত নয়।
২০১৯ সালে পাকিস্তানের হাতে একটি ভারতীয় জেট ভূপাতিত হওয়ার অপমান ভারতের সামরিক শক্তির আধুনিকীকরণ প্রচেষ্টায় গতি এনে দিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সেনাবাহিনীতে কোটি কোটি ডলার ঢালেন। অস্ত্র কেনার জন্য নতুন আন্তর্জাতিক অংশীদার খুঁজে বের করেন। সেই সঙ্গে দেশীয় প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদনক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়।
এসব প্রচেষ্টা আদৌ কতটা ফল দিয়েছে, তা হয়তো খুব শিগগির পরীক্ষা হয়ে যেতে পারে।
ভারত ও পাকিস্তান আবারও একটি সামরিক সংঘাতের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। কাশ্মীরে প্রাণঘাতী একটি সন্ত্রাসী হামলার প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ভারত। আর এই হামলার জন্য তারা পাকিস্তান সম্পৃক্ত বলে অভিযোগ করেছে। উত্তেজনা বেড়ে এমন জায়গায় গেছে যে ভারত পাকিস্তানের দিকে প্রবাহিত একটি প্রধান নদীর প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। এর আগে দুই দেশের একাধিক যুদ্ধের সময়েও তা কখনো করা হয়নি।
পাকিস্তান কাশ্মীর হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। সেই সঙ্গে এই পানিপ্রবাহ বন্ধের সিদ্ধান্তকে তারা ‘যুদ্ধ ঘোষণা’ বলে আখ্যা দিয়েছে।
ভারতীয় কাশ্মীরের পেহেলগামে ২৬ জন পর্যটক নিহত হওয়ায় ভারতবাসী হতবাক হয়ে গেছেন। পাকিস্তানের ওপর আঘাত হানতে মোদি অভূতপূর্ব অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে পড়েছেন। দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সংযোগ বহু আগেই স্তিমিত হয়ে গেছে। বৈশ্বিক শক্তিগুলো বর্তমানে অন্য সব সংকট নিয়ে ব্যস্ত। সব মিলিয়ে বিশ্লেষকেরা সতর্ক করে দিচ্ছেন যে এ অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি ও বিপজ্জনক অচলাবস্থার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের সামরিক বাহিনী এখনো রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি মোদিকে সংযত থাকতে বাধ্য করতে পারে।
২০১৮ সালে একটি সংসদীয় প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ভারতের সেনাবাহিনীর ৬৮ শতাংশ সরঞ্জাম ছিল ‘প্রাচীন’, ২৪ শতাংশ বর্তমান সময়ের জন্য মানানসই এবং মাত্র ৮ শতাংশ ছিল সর্বাধুনিক। পাঁচ বছর পর, ২০২৩ সালের একটি হালনাগাদে সামরিক কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, চ্যালেঞ্জের বিশালতার কারণে অবস্থার যথেষ্ট পরিবর্তন আসেনি।
সংসদীয় সাক্ষ্যমতে, সর্বাধুনিক সামরিক সরঞ্জামের অনুপাত প্রায় দ্বিগুণ হলেও তা এখনো আধুনিক সেনাবাহিনীর চাহিদার তুলনায় অনেক কম। অধিকন্তু, অর্ধেকের বেশি সরঞ্জাম এখনো পুরোনো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে এই সীমাবদ্ধতার কারণে মোদি হয়তো আরও সীমিত ধরনের হামলার মধ্যে সীমিত থাকবেন। যেমন সীমান্তের কাছাকাছি ছোটখাটো বিমান হামলা বা বিশেষ বাহিনীর অভিযান। এতে জনরোষ প্রশমিত হবে, বিব্রতকর দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাবে আবার পাকিস্তানের পাল্টা প্রতিক্রিয়াও খুব বেশি হবে না। পাকিস্তান ইতিমধ্যেই যেকোনো ভারতীয় হামলার পাল্টা জবাব দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে।
চ্যালেঞ্জ হলো এসব নতুন অস্ত্রব্যবস্থা এমন দক্ষতায় ব্যবহার করা, যাতে তা প্রতিপক্ষের কাছে ‘কার্যকর প্রতিরোধ’ হিসেবে প্রমাণিত হয়। শুক্লা বলেন, ‘আমি নিশ্চিত হতে চাই, যেন আমরা নিজেদের ধোঁকা না দিই।’জনগণের আবেগ মোদিকে পাকিস্তানের ওপর আঘাত হানতে উদ্বুদ্ধ করলেও, ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই আবার তাকে চাপ দিতে পারে, যাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়।
অন্যদিকে পাকিস্তানে সামরিক বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে নেপথ্যে থেকে দেশ চালিয়ে এসেছে। তারা সম্ভবত রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে দিয়েই এই সংঘাতকে বাড়তে দেবে। এর ফলে সেনাবাহিনী দেশের ভেতরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসতে পারবে।
ভারত নিজেদের এমন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে হাজির করছে, দেখাতে চাইছে যে তারা সহজেই পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে মোকাবিলা করতে পারবে। যদি এই দাবির সত্যতা পরীক্ষার মুখে পড়ে, তাহলে আরেক প্রতিবেশী চীনও তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে।
ভারত গত কয়েক বছরে পাকিস্তানের তুলনায় চীনকে সীমান্তের জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখছে। বিশেষ করে ২০২০ সালে হিমালয়ে ভারতীয় ও চীনা সেনাদের প্রাণঘাতী সংঘর্ষের পর। তা ছাড়া চীন বারবার ভারতীয় ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশেও করছে।
এর মানে, ভারতের সামরিক নেতাদের এখন পাকিস্তান ও চীন—এই দুই ফ্রন্টে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। এর ফলে সরবরাহ ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা জটিল হয়ে উঠবে।
২০১৯ সালে পাকিস্তানের হাতে একটি ভারতীয় জেট ভূপাতিত হয়। ঘটনার এক বছরের কম সময় পর ২০২০ সালে ভারত–পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত হয়েছিল। অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় জেনারেল এবং দিল্লিভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক সেন্টার ফর ল্যান্ড ওয়ারফেয়ার স্টাডিজের প্রধান দুষ্যন্ত সিং বলেন, সেই জেট ভূপাতিত হওয়ার ঘটনা ভারতের জন্য একপ্রকার সতর্কবার্তা ছিল।
দুষ্যন্ত সিং বলেন, এর পর থেকে ভারত নিজেদের সামরিক ঘাটতি পূরণের জন্য বিভিন্ন পথ অনুসন্ধান করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি সত্ত্বেও রাশিয়া থেকে নতুন মিসাইল প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সংগ্রহ করা হয়েছে। ফ্রান্স থেকে ডজন ডজন যুদ্ধবিমান আনা হয়েছে। কেনা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ড্রোন, হেলিকপ্টার ও মিসাইল।
বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খল অনির্ভরযোগ্য হয়ে পড়ায় ভারত নিজস্ব সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনেও প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। এই উদ্যোগ এখনো ধীরগতিতে এগোচ্ছে। তবে ভবিষ্যতে সেনাবাহিনীর জন্য তা মজবুত ভিত্তি গড়ে দেবে।
দুষ্যন্ত সিং বলেন, ‘এই আধুনিকীকরণের ফলাফল রাতারাতি আসবে না। এতে সময় লাগবে।’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভারতের সামরিক আধুনিকীকরণের চ্যালেঞ্জ বহুস্তরীয়—প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিকও।
মোদি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনাকাটার প্রক্রিয়া সহজ করার চেষ্টা করেছেন। চেষ্টা করছেন বাহিনীগুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়ানোর। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এই প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এ ছাড়া মোদি যে গুরুত্বপূর্ণ জেনারেলকে সেনাবাহিনীর পুনর্গঠনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তিনি ২০২১ সালে এক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। এতে কাজ আরও জটিল হয়ে পড়ে।
ভারতের অর্থনীতি এখন বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম। পাকিস্তানের অর্থনীতির প্রায় ১০ গুণ বেশি। ফলে সামরিক বাহিনীর জন্য টাকা কোনো সমস্যা নয়। তবে ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যয় এখনো মোট দেশজ উৎপাদনের ২ শতাংশের কম। সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, তা যথেষ্ট নয়। সরকারকে দেশের বিশাল জনগণের অন্যান্য প্রয়োজনীয়তার দিকেও মনোযোগ দিতে হচ্ছে।
২০২০ সালের চীনের সঙ্গে সংঘাতের পর চার বছরের জন্য ভারতকে সীমান্তে হাজার হাজার সেনা মোতায়েন রাখতে হয়েছে। এর ফলে আধুনিকীকরণ প্রচেষ্টা ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। আরেকটি বড় বাধা ছিল ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধ ভারতের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী রাশিয়া থেকে অস্ত্র আসা বিলম্বিত করেছে।
সরকারি সংসদীয় সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, অর্থ বরাদ্দ থাকলেও বৈশ্বিক রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অর্ডারগুলো আটকে ছিল।
এই সীমাবদ্ধতার মধ্যে ভারত সবচেয়ে জরুরি ঘাটতিগুলো পূরণের দিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে বলে বিশ্লেষকেরা বলছেন। পাশাপাশি, গোপন অভিযান বাড়ানো হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তানভিত্তিক বহু ভারতবিরোধী জঙ্গিকে টার্গেট করে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে।
গত পাঁচ বছরে ইউক্রেনের পর ভারত বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক। পাকিস্তান ছিল পঞ্চম স্থানে।
রাশিয়া এখনো ভারতের সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী। কিন্তু গত পাঁচ বছরে ভারতের রাশিয়া থেকে কেনাকাটা প্রায় ২০ শতাংশ কমেছে। ভারত এখন বেশি করে ঝুঁকছে ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের দিকে।
ভারতীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে রাশিয়া থেকে কেনা পাঁচটি এস-৪০০ মিসাইল প্রতিরক্ষাব্যবস্থার মধ্যে তিনটি মোতায়েন করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া থেকে এই মিসাইল কেনায় কড়া আপত্তি জানিয়েছিল।
ফ্রান্স থেকে কেনা ৩৬টি রাফালে যুদ্ধবিমান ইতিমধ্যে সেনাবাহিনীতে যুক্ত হয়েছে। আরও ২৬টি কেনার পরিকল্পনা রয়েছে। ভারত নিজস্বভাবে তৈরি প্রচুরসংখ্যক যুদ্ধজাহাজও মোতায়েন করছে।
নতুন প্রযুক্তির প্রভাব সম্পর্কে প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক অজয় শুক্লা বলেন, রাফালের বিমান সংযুক্ত করাটা ভারতীয় বিমানবাহিনীর সক্ষমতায় সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এনেছে। তবে শুক্লা সতর্ক করে দিয়ে বলেন, চ্যালেঞ্জ হলো এসব নতুন অস্ত্রব্যবস্থা এমন দক্ষতায় ব্যবহার করা, যাতে তা প্রতিপক্ষের কাছে ‘কার্যকর প্রতিরোধ’ হিসেবে প্রমাণিত হয়।
শুক্লা বলেন, ‘আমি নিশ্চিত হতে চাই, যেন আমরা নিজেদের ধোঁকা না দিই।.
মুজিব মাশাল দ্য টাইমসের দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরো চিফ
সুহাসিনী রাজ নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদক
নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ জাভেদ হুসেন
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক সরঞ জ ম ব যবস থ সরবর হ র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
দেড় শ বছরের পুরোনো রিয়াজউদ্দিন বাজারে বছরে হাজার কোটি টাকার কেনাবেচা
ভোরের আলো ফোটার আগেই শুরু হয় শ্রমিকদের ব্যস্ততা। রাত থেকে ভিড় করে ট্রাকের সারি। কোনোটিতে সবজি, কোনোটিতে চাল আবার কোনোটিতে বিভিন্ন গৃহস্থালি পণ্য। দিন গড়াতে একে একে খোলা হয় বাজারে থাকা কাপড়, মুঠোফোন, জুতা, গৃহস্থালি পণ্যসহ অন্তত কয়েক শ পণ্যের দোকান। বাজারের ভেতরে দোকানে দোকানে চলে বেচাকেনা আর হিসাব-নিকাশ। চট্টগ্রাম নগরের রিয়াজউদ্দিন বাজারে এই চিত্র প্রতিদিনের।
নগরের ঐতিহ্যবাহী পাইকারি ও খুচরা এই বাজারের বয়স ১৫০ বছরের বেশি। শুরুতে এক জমিদারবাড়ির পাশে ছোট বাজার ছিল এটি। পরে তা রূপ নেয় দেশের বড় বাজারের একটিতে। একসময় নগরের সব বাজারে পণ্য সরবরাহ করা এই বাজার গত এক দশকে কিছুটা জৌলুশ হারিয়েছে। এরপরও বাজারটির সাড়ে তিন হাজারের বেশি দোকানে প্রতিবছর গড়ে এক হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয় বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
জানা গেছে, শেখ মোহাম্মদ ওয়াশীল সিদ্দিকি নামের এক ব্যক্তি তাঁর ছেলে শেখ রেয়াজুদ্দিন সিদ্দিকির নামে এই বাজারের নামকরণ করেন। বাজারটি প্রায় শত বছর ধরে জমজমাট। তবে নগরের বিভিন্ন এলাকায় বাজার গড়ে ওঠার কারণে এখন এই বাজারে ব্যবসার চাপ কমেছে।
প্রবীণ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এবং বিভিন্ন ইতিহাসবিষয়ক বই ঘেঁটে জানা গেছে, চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের (বটতলি স্টেশনের) উত্তর পাশে নগরের বাইশ মহল্লার কবরস্থানের পাহাড়টির নাম কুমদান পাহাড়। এই পাহাড়ের পূর্ব দিক ও স্টেশন রোডের উত্তর দিকের সম্পূর্ণ এলাকাটি ছিল জমিদার দেওয়ান বৈদ্যনাথের জমিদারির অন্তর্গত। সেখানে তাঁর বাগানবাড়ি ও সেগুনবাগিচা ছিল। এই এলাকাই বর্তমানে রিয়াজউদ্দিন বাজার।
আবদুল হক চৌধুরীর বন্দর শহর চট্টগ্রাম বই থেকে জানা যায়, দেওয়ান বৈদ্যনাথের উত্তরাধিকারীদের কাছ থেকে এলাকাটি চট্টগ্রামের প্রথম মুসলমান বিএবিএল (আইন স্নাতক) শেখ রেয়াজুদ্দিন সিদ্দিকির বাবা শেখ মোহাম্মদ ওয়াশীল সিদ্দিকি কিনে নেন। রেয়াজুদ্দিনের সময়ে এর প্রথম উন্নয়ন হয়েছিল। তাই এলাকাটির নামকরণ হয়েছে ‘রেয়াজুদ্দিন বাজার’।
বর্তমানে দেওয়ান বৈদ্যনাথের বাড়ির অস্তিত্ব নেই। সময়ের পরিক্রমায় রেয়াজুদ্দিন বাজারও পরিচিত পায় রিয়াজউদ্দিন বাজার নামে। এখন বিশাল এলাকাজুড়ে এই বাজার অবস্থিত। বাজারে প্রবেশের অন্তত ১৫টি পথ রয়েছে। উত্তরে এনায়েতবাজার, দক্ষিণে স্টেশন রোড, পূর্বে জুবলি রোড এবং পশ্চিমে বিআরটিসির বাসস্ট্যান্ড—এ বিশাল এলাকা নিয়েই বর্তমান রিয়াজউদ্দিন বাজার।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, নগরের স্টেশন রোড এলাকা থেকে বাজারে অন্তত ছয়টি সড়ক রয়েছে। এর মধ্যে চৈতন্যগলি ধরে এগিয়ে গেলে সব সবজির আড়তের দেখা মেলে। এর পাশে আজাদ হোটেলের পাশের দুটি পথ ধরে ঢুকলে ইলেকট্রনিক ও অন্যান্য পণ্যের বাজার। নূপুর মার্কেটের পাশ দিয়ে কাপড়ের দোকানগুলো। জুবলি রোডের পাশ দিয়ে সবজি ও মুরগি বাজার। এই পথ আরও কয়েকটি গলি হয়ে আবার স্টেশন রোডে সংযুক্ত।
কমেছে আড়তের হাঁকডাক
রিয়াজউদ্দিন বাজার বিখ্যাত মূলত সবজির আড়তের জন্য। নগরের সব খুচরা-পাইকারি বাজারে এখানকার আড়ত থেকে সবজি সরবরাহ করা হয়। একসময় উপজেলাগুলোতেও সবজি সরবরাহ হলেও এখন সেই জৌলুশ কমেছে। ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ২০০টি সবজির আড়ত রয়েছে বাজারে।
এসব আড়তের একেকটির বয়সও অন্তত ৫০-৬০ বছর। প্রতিদিন রাত থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যাপারীরা রিয়াজউদ্দিন বাজারে সবজি নিয়ে আসেন। এসব সবজি কমিশন ভিত্তিতে বিক্রি করেন আড়তদারেরা। সবজিভেদে কমিশনের পরিমাণও ভিন্ন। যেমন আলু ছাড়া অন্যান্য সবজির ক্ষেত্রে প্রতি ১০০ টাকায় ৬ টাকা ২৫ পয়সা কমিশন। আলু-পেঁয়াজের ক্ষেত্রে সেটি প্রতি কেজিতে ৫০ পয়সার আশপাশে। আড়তদার সমিতির তথ্যমতে, সবজির বাজারেও আগের জৌলুশ নেই। তবু এখনো বছরে ৫০ কোটি টাকার বেশি ব্যবসা হয় এসব আড়তে।
প্রায় ২৫ বছর ধরে রিয়াজউদ্দিন বাজারের আড়তে ব্যবসা করছেন ফারুক শিবলী। বর্তমানে রিয়াজউদ্দিন বাজার আড়তদার কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক তিনি। ফারুক শিবলী বলেন, গত এক দশকে আড়তগুলো বদলে গেছে। এখন আর আগের মতো ব্যস্ততা নেই। নগরের অনেক বাজারে ছোট ছোট পাইকারি আড়ত হয়েছে। তাঁরা ব্যাপারীদের কাছ থেকে মালামাল কিনে বিক্রি করে।
হাজার কোটি টাকার বেচাকেনা
সবজি ছাড়াও রিয়াজউদ্দিন বাজারে রয়েছে মাছ, মাংস, চাল, ফল, মুদি, পানসুপারি, মসলা, ইলেকট্রনিকস, মুঠোফোন, অন্দরসজ্জা সামগ্রী, স্টেশনারিসহ অন্তত ১০০ ধরনের দোকান। সব কটির আলাদা আলাদা সমিতি থাকলেও সব সমিতি রিয়াজউদ্দিন বাজার বণিক কল্যাণ সমিতির আওতাধীন। সমিতির তথ্য অনুযায়ী, বাজারে ছোট–বড় ২০টি সমিতি তাঁদের আওতায়, যেখানে দোকান সংখ্যা সাড়ে তিন হাজারের বেশি।
বণিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, পণ্যের এমন বৈচিত্র্যময় বাজার সারা দেশে খুবই কমই আছে। রিয়াজউদ্দিন বাজারে সব ধরনের পণ্যই পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে রিয়াজউদ্দিন বাজারে বছরে বেচাকেনা ১ হাজার কোটি টাকার বেশি। যদিও কাগজে–কলমে এর সুনির্দিষ্ট হিসাব নেই।
রিয়াজউদ্দিন বাজার বণিক কল্যাণ সমিতির সভাপতি ছালামত আলী বলেন, আগের সেই জৌলুশ না থাকলেও এখনো চট্টগ্রামের পাইকারি বাজার হিসেবে এ বাজার এগিয়ে। ঈদে পোশাক বিক্রি ছাড়াও সারা বছর সবজি, মুদি, গৃহস্থালি পণ্যসহ সব মিলিয়ে বছরে ৭০০ কোটি টাকার বেশি বেচাকেনা হয়।