সময়ের দাবিতে সাড়া দিতে বামপন্থিরা ব্যর্থ হচ্ছে?
Published: 15th, May 2025 GMT
গত ২০ এপ্রিল রাজধানীর একটি হোটেলে বিএনপির সঙ্গে সিপিবি ও বাসদের বৈঠকটি অনানুষ্ঠানিক হলেও সংবাদমাধ্যমে জায়গা করে নিয়েছিল। এর একটা কারণ, দীর্ঘদিন পর প্রায় বিপরীত মেরুর দু’পক্ষের একসঙ্গে বসা। সর্বশেষ ২০১৬ সালে সিপিবি-বাসদ নেতারা বামপন্থিদের ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতাদের নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে গিয়েছিলেন।
উপলক্ষ চায়ের আমন্ত্রণ রক্ষা। এর পর ২০১৮ সালের নির্বাচন এবং পরবর্তী সময়ে আওয়ামী সরকারবিরোধী আন্দোলনে অনেক চেষ্টা করেও বাম জোটকে বিএনপি সঙ্গে পায়নি। এক পর্যায়ে ওই জোটের দুটি দল গণসংহতি আন্দোলন ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে গেলেও বাম জোটের বাকিরা শাসক শ্রেণির দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ-বিএনপির সঙ্গে সমদূরত্ব নীতি রক্ষা করে গেছে। এমনকি গত জুলাই-আগস্টের সরকার পতনের সফল আন্দোলনেও তারা নিজেদের মতো রাস্তায় থেকেছে।
সাম্প্রতিক বৈঠকটি যে সময়ের দাবি পূরণের চেষ্টা, সেটাও অনেকে বলেছেন। সময়ের দাবিটা হলো, দেশকে দ্রুত গণতন্ত্রের ধারায় ফিরিয়ে নেওয়া, যা কেবল একটা অবাধ, সুষ্ঠু, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের পক্ষেই সম্ভব। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, শিগগির এ দাবি পূরণ হচ্ছে না।
নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো দ্বিধাবিভক্ত। এ মুহূর্তে দেশের প্রধান দল ধরা হচ্ছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপিকে। তাদের মধ্যে কেবল বিএনপিই ডিসেম্বর বা তারও আগে নির্বাচন চায়। অন্যরা মনে করে, নির্বাচন বিলম্বে হলেও ক্ষতি নেই। আর এ সুযোগে অন্তর্বর্তী সরকারও নির্বাচন ছাড়া অন্য সব কিছুতে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। বিএনপি গত চার মাসে অন্তত দু’বার সরকারপ্রধানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দাবি করেছে। সরকার তাতে কোনো কর্ণপাত করছে না।
এই যে সম্প্রতি সরকার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করল এবং তার সূত্র ধরে নির্বাচন কমিশনও দলটির নিবন্ধন স্থগিত করে দিল, তাতে বিএনপির সমর্থন থাকলেও দলের নেতারা নির্বাচন বিলম্বিত হওয়ার আশঙ্কাও করছেন। ১২ মে সমকালের এক প্রতিবেদনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য প্রশ্ন তুলেছেন– ‘আওয়ামী লীগের বিচার করতে কতদিন লাগবে? বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত কি নির্বাচনও হবে না? কোনো পক্ষ যদি এমন দাবি তোলে– বিচার কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন হবে না। তাহলে কি সরকার তাও মেনে নেবে?’
স্পষ্টত, এই মুহূর্তে নির্বাচন নিয়ে দলটি সোচ্চার হলেও কীভাবে এ দাবি আদায় হবে, বিএনপি তার পথ পাচ্ছে না। দেড় যুগেরও বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে অবস্থানকারী বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একা এ দাবিতে সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিজের দীর্ঘ সময়ের মিত্রদের শত্রু হতে চাচ্ছে না দলটি। মনে রাখতে হবে, বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির ভোটব্যাংক প্রায় একই। তাই দলটি এখন নতুন মিত্রের সন্ধানে। সেখানে যদি বাম দলগুলোকে কাছে পায়, নেহাত ছোট অর্জন হবে না।
সত্য– ভোটের মাঠে বাম দলগুলো বড় শক্তি নয়। তাদের রাজনৈতিক ভাবমূর্তির ঔজ্জ্বল্যও কালের পরিক্রমায় কিছুটা ম্লান। তদুপরি, আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে উদারমনা মানুষদের একটা অংশকে যদি বাম দলগুলো সঙ্গে পায়, অন্তত নির্বাচন আদায়ের আন্দোলনে সেটা ফ্যাক্টর হতে পারে। মোদ্দা কথা, একসঙ্গে ভোট না করলেও, একসঙ্গে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে নামলে বিএনপি ও বাম জোট ব্যর্থ হওয়ার শঙ্কা কম।
স্মরণ করা যেতে পারে, ২০ এপ্রিলের বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে, সে সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেছিলেন, ‘আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন প্রশ্নে কীভাবে গ্রেটার ঐক্য করা যায়, সে ব্যাপারে সিপিবি, বাসদসহ বাম ধারার দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হয়।’ (বণিক বার্তা, ২০ এপ্রিল, ২০২৫)। এ নিয়ে তখন সিপিবি ও বাসদ নেতারাও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তারাও ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আদায়ে বিএনপির সঙ্গে সহমত পোষণ করেছিলেন।
বিস্ময়কর হলো, বিএনপির সঙ্গে ঐক্যের প্রশ্নটি তাদের জোটে আলোচনা করে চূড়ান্ত হবে বলে তখন সিপিবি ও বাসদ নেতারা বললেও এর কোনো ফলোআপ আজও দেখা যায়নি। ওই বৈঠক নিয়ে ২৪ এপ্রিল এই স্তম্ভে আমি বিএনপির উল্লিখিত দুর্বলতা তুলে ধরে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলাম যে, বাম জোট এগিয়ে না এলে ওই উদ্যোগ হয়তো আর এগোবে না। সেই আশঙ্কাই কি সত্য হতে চলল?
নির্বাচন নিয়ে যৌথ আন্দোলনে বাম জোটের এগিয়ে আসা গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে, একমাত্র বাম জোট স্পষ্ট ভাষায় নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণের দাবি তুলেছে। উপরন্তু, দু’পক্ষই প্রায় একই সময়ে নির্বাচনের দাবিতে রাস্তায় নামার ঘোষণা দিয়েছিল। তা গণতন্ত্রপ্রত্যাশী মানুষের কাছে বামদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দিত। কিন্তু শিগগিরই তা হচ্ছে বলে মনে হয় না।
মনে আছে নিশ্চয়, গত মার্চে মাগুরায় শিশু আছিয়ার ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় দেশব্যাপী যে বিক্ষোভ হয়, তাতে বাম দলগুলোর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। দেশে তখন আরও বেশ কিছু ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এসবের বিরুদ্ধে বাম গণতান্ত্রিক জোটভুক্ত দলগুলোর ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে অন্য বাম সংগঠনও লাগাতার কর্মসূচি পালন করে। এসব থামাতে অন্তর্বর্তী সরকার এমনকি হামলা-মামলার আশ্রয় নেয়। ওই আন্দোলনে বাম দল ও সংগঠনগুলোর ভূমিকা এতটাই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে যে, রাজনৈতিক ময়দানে তখন প্রায় মার্চ মাসজুড়ে বামপন্থিদের প্রাধান্য থাকে। এর আগের ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনেও বামপন্থিরা প্রধান ভূমিকা রাখে। যে আন্দোলনের ফলে সরকার শেষ পর্যন্ত অনেকাংশেই পিছু হটে।
আমার বিশ্বাস ছিল, বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে হলেও বামপন্থিরা এ ‘মোমেন্টাম’ ধরে রাখবে, যেখানে নির্বাচন একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হতে পারত। জানা মতে, সিপিবি ও বাসদ এ বিষয়ে বেশ আন্তরিক হলেও জোটের মধ্যে বিশেষত ইস্যুর গুরুত্ব সম্পর্কে ভিন্নমত আছে। তেমনটা হলে সেটাও সামনে আনা উচিত। কথা হলো, একেক দিন একেকটা ইস্যু নিয়ে মাঠে লেফট-রাইট করার চেয়ে সুনির্দিষ্ট দু-একটা জাতীয় ইস্যুতে সম্ভাব্য সব মিত্রকে সঙ্গে নিয়ে ধারাবাহিকভাবে মাঠে থাকা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও ফলদায়ক। সে ক্ষেত্রে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশকে গণতন্ত্রের ধারায় ফিরিয়ে আনা হতে পারে কার্যকর একটা ইস্যু।
সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব এনপ ব এনপ র স ব ম দলগ ল ড স ম বর ব মপন থ ব ম দল র একট সময় র আওয় ম সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
সরকারের ভেতরে একটা অংশ নির্বাচন বানচালের পাঁয়তারা করছে: এনসিপি
সরকারের ভেতরের একটি পক্ষ ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশের বাইরে গিয়ে নিজেরাই ঐকমত্য কমিশন হওয়ার চেষ্টা করছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন। তিনি বলেন, এই চেষ্টার কারণে নির্বাচন ঝুঁকিতে পড়বে।
আজ সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর বাংলামোটরে এনসিপির অস্থায়ী কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আখতার হোসেন এ কথা বলেন।
আখতার হোসেন বলেন, তাঁদের কাছে স্পষ্টতই প্রতীয়মান যে সরকারের ভেতরের কোনো একটা অংশ সংস্কারকে ভন্ডুল করে নির্বাচন বানচালের পাঁয়তারা করছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ–আলোচনার ভিত্তিতেই কমিশন সুপারিশ উপস্থাপন করেছে উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির সদস্যসচিব বলেন, সেই সুপারিশের ভিত্তিতেই সরকার আদেশ জারি করবে, সেটাই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যখন সরকারের তরফ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে আরও এক সপ্তাহ রাজনৈতিক দলগুলোকে আলাপ–আলোচনার কথা বলা হয়, তখন মনে হয় যে সরকার আসলে এই সংস্কারের বিষয়গুলো নিয়ে সাপ-লুডো খেলছে। তিনি বলেন, ‘আমরা ৯৬-তে পৌঁছে গিয়েছিলাম, সেটাকে আবার তিনে নিয়ে আসা হয়েছে সাপ কেটে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের বর্তমান যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, তাতে সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে।’
অতি দ্রুত সরকারকে দায়িত্বশীল আচরণ করার আহ্বান জানিয়ে এনসিপির সদস্যসচিব বলেন, সরকারকে নিজেকেই দায়িত্ব নিয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করতে হবে। সামনের সংসদকে গাঠনিক ক্ষমতা প্রদান করার মধ্য দিয়ে সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। গণভোটের মাধ্যমে অর্জিত জনগণের অভিপ্রায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে যেন বাস্তবায়িত হয়, সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে।