ঋণ, মুনাফা হাজার কোটি টাকা ছাড়ালে আসতে হবে শেয়ারবাজারে
Published: 23rd, May 2025 GMT
বছরে অন্তত হাজার কোটি টাকার মুনাফা হয় এমন ভালো কোম্পানিগুলোকে শেয়ারবাজারমুখী করতে নতুন মূলধন সংগ্রহের পরিবর্তে এগুলোর মালিকদের নিজের শেয়ার বিক্রি করে তাদের ভালো মুনাফার সুযোগ করে দেওয়ার সুপারিশ করেছে শেয়ারবাজার সংস্কার টাস্কফোর্স। একই সঙ্গে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে এ সুযোগ অবারিত করার প্রস্তাব করেছে তারা। বর্তমানে এভাবে শেয়ার বিক্রির সুযোগ কেবল সরকারি কোম্পানিগুলোর জন্য সীমিত করে রাখা আছে।
শেয়ারবাজার সংস্কারে গত বছরের ৭ অক্টোবর পাঁচ সদস্যের করা টাস্কফোর্স গঠন করেছিল শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। গত ২০ মে এই টাস্কফোর্স বিএসইসির কাছে আইপিও বিষয়ে তাদের চূড়ান্ত সুপারিশমালায় এমন প্রস্তাব করেছে। ১৭টি ইস্যুতে সংস্কার সুপারিশ চাইলেও আইপিওসহ এখন পর্যন্ত মাত্র তিনটি ইস্যুতে সুপারিশমালা জমা দিয়েছে টাস্কফোর্স। এই সুপারিশগুলোর আলোকে আইন সংশোধনের খসড়া তৈরি হবে। অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে সেটি চূড়ান্ত করা হবে।
সংস্কারের সুপারিশ প্রণয়নে গঠিত টাস্কফোর্স আরও প্রস্তাব করেছে– ব্যক্তি খাতের কোনো কোম্পানির মোট ব্যাংক ঋণ হাজার কোটি টাকা ছাড়ালে এবং ঋণ ও মূলধন ৩০ অনুপাত ৭০ শতাংশ বা তার বেশি হলে, ওই কোম্পানিকে বাধ্যতামূলকভাবে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করার প্রয়োজনীয় আইনি বিধান করা যেতে পারে।
শেখ হাসিনা সরকারের ১৬ বছরের শেয়ারবাজারে যেসব অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে, তার মধ্যে আইপিওকেন্দ্রিক অভিযোগই বেশি। আবার আইপিওতে আসা কোম্পানির শেয়ারের দাম বহুগুণ বাড়িয়ে মুনাফা লুটতে সেকেন্ডারি শেয়ারবাজারেও কারসাজি হয়েছিল। এমন প্রেক্ষাপটে আইপিও দুর্নীতির লাগাম টানা এবং মূলধন সংগ্রহের এ বাজারে ব্যক্তি খাতের কোম্পানিকে আকৃষ্ট করার জন্য ব্যাপক সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে।
টাস্কফোর্স তাদের এ-সংক্রান্ত চূড়ান্ত সুপারিশমালায় প্রস্তাব করেছে, কোনো কোম্পানির আইপিও প্রসপেক্টাস বা তথ্য বিবরণীর তথ্য বা আর্থিক প্রতিবেদনে বড় ধরনের গরমিল পাওয়া গেলে বা অসত্য প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট ইস্যু ম্যানেজার ও ক্রেডিট রেটিং কোম্পানি দায়িত্বশীলদের জেল বা জরিমানা বা উভয় প্রকার শাস্তি আরোপের বিধান করা যেতে পারে। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল করারও প্রস্তাব করেছে টাস্কফোর্স। এ ছাড়া কোনো অডিটর প্রতিষ্ঠানের কোনো অংশীদার একসঙ্গে দুটি কোম্পানির আইপিও-সংক্রান্ত আর্থিক প্রতিবেদনের অডিট করতে পারবেন না– এমন বিধানও করতে হবে।
খসড়া সুপারিশে আইপিও অনুমোদন প্রক্রিয়ায় স্টক এক্সচেঞ্জের মতকে চূড়ান্ত করে অনুমোদন করার যে সুপারিশ করা হয়, চূড়ান্ত সুপারিশেও তা বহাল রাখা হয়েছে। এতে বলা হয়, স্টক এক্সচেঞ্জ কোনো আইপিও আবেদনে সায় না দিলে বিএসইসি তা অনুমোদন করবে না। আবার প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর আপিল করলে সে ক্ষেত্রেও স্টক এক্সচেঞ্জের নিরপেক্ষ দল সন্তুষ্ট না হলে, সে ক্ষেত্রেও অনুমোদন দেবে না বিএসইসি। আবার স্টক এক্সচেঞ্জের অমত সত্ত্বেও যে আইনি ক্ষমতাবলে কোনো কোম্পানিকে বাধ্যতামূলক তালিকাভুক্ত করার আদেশ প্রদানে বিএসইসির যে ক্ষমতা রয়েছে, তা তুলে নেওয়ারও সুপারিশ করেছে সংস্কার টাস্কফোর্স।
সুপারিশে বলা হয়, আইপিও আবেদন মূল্যায়নে দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে স্টক এক্সচেঞ্জের একাধিক আইপিও এক্সপার্ট প্যানেল গড়তে হবে। এ প্যানেল যে বিষয়গুলো দেখবে তা হলো– সংশ্লিষ্ট কোম্পানির ব্যবসা পরিস্থিতি, ব্যবসায় নিজের বাজার অংশ, সংশ্লিষ্ট খাতের প্রবৃদ্ধির ধারা, কোম্পানির মালিকানা, ব্যবস্থাপনা এবং আর্থিক প্রতিবেদনের মান, ঋণ ও দায় শোধের ইতিহাস, কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা ও পারিবারিক বিরোধ, লভ্যাংশ দেওয়ার সক্ষমতা, আইপিও অর্থ ব্যবহার বাস্তবসম্মত কিনা, স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লেনদেন ইতিহাস ইত্যাদি।
সংস্কার টাস্কফোর্স আইপিওতে স্বচ্ছতা বাড়াতে স্টক এক্সচেঞ্জকে আবশ্যিকভাবে সংশ্লিষ্ট আবেদনকারী কোম্পানির অফিস ও কারখানা সরেজমিন পরিদর্শন প্রতিবেদন দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। উদ্যোক্তা-পরিচালকদের শেয়ারে লক-ইন বিদ্যমান তিন বছর বহাল রাখার পাশাপাশি কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শেয়ারে এক বছরের এবং আইপিও আসার আগের দুই বছরের মধ্যে প্রাইভেট প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি হলে ওই প্লেসমেন্ট শেয়ারধারীদের ক্ষেত্রেও তিন বছরের লক-ইন রাখার প্রস্তাব করেছে।
আইপিওতে যোগ্য বিনিয়োগকারী এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য সমান ৫০ শতাংশ হারে কোটা বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ৫০ শতাংশ কোটার ৫ শতাংশ প্রবাসী বাংলাদেশি, ১৫ শতাংশ উচ্চবিত্ত এবং ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা রাখতেও বলা হয়েছে। তবে বুক বিল্ডিং পদ্ধতির আইপিওর ক্ষেত্রে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ১০ শতাংশ ছাড়ে শেয়ার বিক্রির ধারা তুলে নেওয়ার কথা বলেছে টাস্কফোর্স।
বুক বিল্ডিং প্রক্রিয়ায় যৌক্তিক শেয়ারদর নির্ধারণের স্বার্থে যোগ্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ২ শতাংশের বদলে সর্বোচ্চ ১ শতাংশ শেয়ারের আবেদন করার বিধানের কথা বলেছে। এ প্রক্রিয়ায় দর নির্ধারণের কারণে আইপিওতে শেয়ার বিক্রির পরিমাণ মূলধনের ১০ শতাংশের কম হতে পারবে না। এমনটি হলে কোটার বাইরে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে শেয়ার বিক্রি করতে হবে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: শ য় রব জ র শ য় রব জ র র আইপ ও ব এসইস প রক র র জন য ম লধন বছর র
এছাড়াও পড়ুন:
লাভজনক গাজী ওয়্যারস এখন লোকসানে ধুঁকছে
দেশের একমাত্র তামার তার প্রস্তুতকারী রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠান গাজী ওয়্যারস। প্রতিষ্ঠানটির তৈরি পণ্যের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ছিল বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি)। প্রতিবছর গড়ে ৪০০ টন তার কিনত তারা। বছর চারেক ধরে আর তার নিচ্ছে না বিআরইবি। এতে লোকসান গুনতে হচ্ছে গাজী ওয়্যারসকে। গত বছর ৫ কোটি ৬৩ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। সদ্য সমাপ্ত ২০২৪–২৫ অর্থবছরেও লোকসানের পরিমাণ ৫ কোটির বেশি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিআরইবি ছিল গাজী ওয়্যারসের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। ২০২০-২১ অর্থবছরে সর্বশেষ তার কিনেছিল তারা। এখন বাড়তি দামের কথা বলে আর তার কিনছে না। এ কারণেই মূলত লোকসান গুনতে হচ্ছে গাজী ওয়্যারসকে। একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীলতাই লোকসানের অন্যতম কারণ। আবার বিকল্প ক্রেতা খোঁজার ক্ষেত্রেও গাজী ওয়্যারসের উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে।
গাজী ওয়্যারস হলো শিল্প মন্ত্রণালয়ভুক্ত বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের (বিএসইসি) নিয়ন্ত্রণাধীন সরকারি মালিকানার একটি প্রতিষ্ঠান। ১৯৬৫ সালে ব্যক্তিমালিকানায় জাপানের ফুরুকাওয়া ইলেকট্রিক কোম্পানির সহযোগিতায় এটি চালু হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ সালে জাতীয়করণ করে এটিকে বিএসইসির সঙ্গে একীভূত করা হয়। এরপর আবার এটিকে বিএসইসির অঙ্গপ্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়। বর্তমানে তিন ধরনের তার উৎপাদন করছে গাজী ওয়্যারস। এগুলো হচ্ছে সুপার এনামেল তামার তার (গেজ ১২ থেকে ৪৬), এনিল্ড তামার তার (গেজ ১০ থেকে ৪৬) ও হার্ডড্রন বেয়ার তামার তার (গেজ ১ থেকে ৪৬)। সবচেয়ে বেশি বিক্রি ও উৎপাদন হয় সুপার এনামেল তামার তার। প্রতিষ্ঠানটিতে ১২৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন।
সর্বশেষ ২০২০–২১ অর্থবছরে পৌনে ৫ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল। সেখানে গত অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি লোকসান করেছে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা।প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলছেন, গাজী ওয়্যারসের বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা দেড় হাজার টন। তবে চাহিদা না থাকায় ওই সক্ষমতা অনুযায়ী কখনো উৎপাদন হয়নি। মোটাদাগে ৮০০ টন তার উৎপাদন করলে প্রতিষ্ঠানটির লোকসান হয় না। কিন্তু গত বছর উৎপাদন হয়েছে ২৬৭ টন। আর চলতি অর্থবছরে উৎপাদন মাত্র ৮৭ টন। প্রতি কেজিতে উৎপাদন খরচ ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকার কাছাকাছি।
জানতে চাইলে গাজী ওয়্যারসের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুল হালিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেশি দামের কথা বলে বিআরইবি তার কেনা বন্ধ রেখেছে। অথচ আমরা ভালো মানের তার উৎপাদন করি। তাই লোকসান কমাতে এখন আমরা বিকল্প বাজার খোঁজার চেষ্টা করছি। সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। এর মধ্যে রয়েছে বিপিসির বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠান, পেট্রোবাংলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।’
আবদুল হালিম আরও বলেন, ‘বিআরইবি কর্তৃপক্ষ গত ২২ মে গাজী ওয়্যারস কারখানা পরিদর্শন করেছে। তারা দাম নিয়ে আবার আলোচনা করছে। এ প্রতিষ্ঠান আবার তার কেনা শুরু করলে লাভে ফিরতে পারব। অন্যদিকে গত মাসে জ্বালানি মন্ত্রণালয় সব সরকারি প্রতিষ্ঠানকে গাজী ওয়্যারস থেকে পণ্য কেনার বিষয়ে আদেশ দিয়েছে।’
লোকসান বেড়েছে ১১ গুণ
প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক আর্থিক বিবরণী অনুযায়ী, ২০১৪-২০১৫ থেকে ২০২০-২০২১ অর্থবছর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৭৩ কোটি টাকা লাভ করেছিল। ২০২০-২০২১ অর্থবছরেও ৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা লাভ হয়। এরপর ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে এসে প্রতিষ্ঠানটির লোকসান একলাফে বেড়ে দাঁড়ায় ৫ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। সদ্য সমাপ্ত ২০২৪–২৫ অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত এই লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা। সেই হিসাবে চার বছরের ব্যবধানে লোকসান বেড়েছে প্রায় ১১ গুণ।
অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা
ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে যে প্রতিষ্ঠানটি দিন দিন বাজার হারাচ্ছে, তা–ও উঠে এসেছিল বিএসইসির এক তদন্ত প্রতিবেদনে। ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি শক্তিশালী ও আধুনিকীকরণ প্রকল্পের দুর্নীতি ও অনিয়মসংক্রান্ত অভিযোগ পর্যালোচনায় কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটি পরে অনিয়মের সত্যতা খুঁজে পায়। মূলত ওই প্রকল্পে জাপান ও তাইওয়ানে উৎপাদিত ‘জাপানি মানের’ ৪৫ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনার কথা। কিন্তু কেনাকাটা শেষে যন্ত্রপাতি কারখানায় স্থাপন করা হয়ে গেলেও জানা যায়নি এগুলো আসলে কোন দেশে তৈরি। যন্ত্রপাতি কেনার আগে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নেওয়ার বিধান থাকলেও তা মানা হয়নি।
পরিকল্পনার ঘাটতি, এক ক্রেতার ওপর নির্ভরশীলতা, বাজার সম্প্রসারণ না করা ও অদক্ষতার কারণে প্রতিষ্ঠানটি লোকসানে ধুঁকছে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যুরো অব বিজনেস রিসার্চের পরিচালক অধ্যাপক মো. আলী আরশাদ চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাজার সম্প্রসারণ বা ক্রেতা না বাড়ালে প্রতিষ্ঠানটি লাভে ফিরতে পারবে বলে মনে হয় না। এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটি বাঁচাতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।