দেশে গত বছরের নভেম্বর থেকে শুরু করে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত প্যাকেটজাত তরল দুধের দাম কয়েক দফায় বেড়েছে। আড়ং, প্রাণ, মিল্ক ভিটাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের দুধের দাম বাড়িয়েছে প্রতি লিটারে ১০ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত। বর্তমানে আড়ংয়ের এক লিটার পাস্তুরিত দুধের দাম ১০৫ টাকা, মিল্ক ভিটার এক লিটার দুধের দাম ১০০ টাকা। দাম বাড়ায় অনেক ভোক্তা এরই মধ্যে তাদের দৈনিক দুধ গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছেন। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোতে শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় দুধ সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একজন মানুষের দৈনিক ২৫০ মিলিলিটার দুধ প্রয়োজন। দুধের দাম বাড়ায় এই চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে অনেক পরিবার।
এমন প্রেক্ষাপটে আজ রোববার অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে পালন হচ্ছে বিশ্ব দুগ্ধ দিবস। এ উপলক্ষে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর আজ রাজধানীর ফার্মগেটের কেআইবি মিলনায়তনে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার।
জানা গেছে, লোকসানের মুখে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়েই দাম বাড়ানোর পথে হেঁটেছে মিল্ক ভিটা। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘খামারিদের কাছ থেকে দুধের ক্রয়মূল্য বাড়ানো হয়েছে। গড়ে ৪ শতাংশ ফ্যাটযুক্ত দুধের দাম ৫৮ টাকা প্রতি লিটার, পরিবহন খরচসহ ৬১ টাকার বেশি। প্রক্রিয়াজাতকরণসহ অন্যান্য খরচ যোগ করে আমাদের ক্রয়মূল্য দাঁড়ায় ৮২ টাকার ওপরে। তবে পরিবেশকদের কাছে আমরা দুধ বিক্রি করছি ৭৮ টাকায়। ফলে প্রতি মাসে ২ থেকে আড়াই কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।’
দুধের দাম বাড়ানোর কারণ জানতে চাইলে প্রাণের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বলেন, ‘খামারি পর্যায়ে উৎপাদন খরচ বাড়ার কারণে দুধের দাম বাড়াতে হয়েছে। যেটা আমরা ভোক্তা পর্যায়ে বাড়িয়েছি। খামারিদের দাবি ছিল, গো-খাদ্যের দাম বেড়ে গেছে। সে জন্য তাদের লোকসান হচ্ছে। তারা বাড়তি দাম চাচ্ছিলেন, যে কারণে আমাদেরও বিক্রির দাম বাড়াতে হয়েছে।’
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে দেশে দুগ্ধ খামারির সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশে দুধ উৎপাদন হতো প্রায় ৫০ লাখ ৭০ হাজার টন। এর পরের তিন অর্থবছরে সেটি বেড়ে ৭২ লাখ টনের বেশি হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে উৎপাদন বেড়ে হয় ৯২ লাখ টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে দুধের উৎপাদন ছিল ১ কোটি ৩০ লাখ ৭৪ হাজার টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সেটি বেড়ে প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ টন আর ২০২৪ সালে ১ কোটি ৫২ লাখ ৫২ হাজার টন হয়েছে। বিপরীতে দেশে বছরে তরল দুধের চাহিদা ১ কোটি ৫৬ লাখ ৬৮ হাজার টনের বেশি। বাকি চাহিদা মেটানো হয় গুঁড়া দুধ আমদানি করে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ৮ থেকে ৯ লাখ টন দুধ প্রক্রিয়াজাত করে বিভিন্ন দুগ্ধজাত পণ্য প্রস্তুত করছে। বাকি দুধ খামারিরা মিষ্টি তৈরির দোকান এবং খোলাবাজারে বিক্রি করেন।
দাম নিয়ে জানতে চাইলে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের আতিক ডেইরি ফার্মের স্বত্বাধিকারী আল মাহমুদ বলেন, আমরা মিল্ক ভিটাকে দুধ সরবরাহ করি। আমার খামারে দৈনিক ২০০ থেকে সাড়ে ৩০০ লিটার দুধ পাই। এগুলো ৫৮ থেকে ৬১ টাকার মধ্যেই সাধারণত বিক্রি করি। তবে বাজার কখনও কখনও নেমেও যায়।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, পাবনার ফরিদপুর, ভাঙ্গুরাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের খামারিরা জানান, প্রতিষ্ঠানগুলো দুধের দাম বাড়ালেও খামারিদের কাছ থেকে ক্রয়মূল্য কমিয়ে দিয়েছে। অনেক খামারি বর্তমানে প্রতি লিটার দুধ ৪৫ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন, যা গো-খাদ্যের খরচ মেটাতে পর্যাপ্ত নয়।
শাহজাদপুরে দুগ্ধ খামারি আছেন প্রায় ৩০ হাজার। প্রতিদিন দুধ উৎপাদন হয় ৫ লাখ লিটার। খামারির কাছ থেকে বড়-ছোট দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠান দিনে সাড়ে ৩ লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে মিল্ক ভিটা, আড়ং, প্রাণ, ইগলু ও আকিজের দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র রয়েছে শাহজাদপুরে।
উল্লাপাড়ার পশ্চিমপাড়া গ্রামের খামারি জাহিদুল ইসলাম বলেন, দুধের টাকা দিয়ে গরুর খাবার কিনতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। খাবারের দামের চেয়ে দুধের দাম পেলে কিছুটা আয় হতো।
পুষ্টিবিদরা বলছেন, শিশুর দৈহিক বৃদ্ধির জন্য তো বটেই, বড়দের খাদ্য তালিকায়ও দুধ থাকা উচিত। তবে দাম বেড়ে যাওয়ায় নিম্নবিত্তের খাবার তালিকা থেকে বাদ পড়ছে দুধ। এতে শিশুদের পুষ্টি ঘাটতির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লেলিন চৌধুরী বলেন, দুধে প্রোটিন, ক্যালসিয়ামসহ গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান রয়েছে। দাম বাড়ায় নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোতে দুধের গ্রহণ কমে যাচ্ছে; যা শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
জাতীয় পুষ্টি পরিষদের মহাপরিচালক ডা.
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. মো. আসাদুজ্জামান বলেন, প্রান্তিক খামারিদের জন্য দুধ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণের সুবিধা বাড়াতে হবে। উদ্যোগ নিতে হবে পরিবহন সমস্যা সমাধান ও পণ্য বহুমুখীকরণে। দুধের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার, প্রতিষ্ঠান ও খামারিদের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। তা না হলে পুষ্টি সংকট ও খামারিদের লোকসান আরও বাড়বে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু সুফিয়ান বলেন, খামারিদের ঘাস চাষে উৎসাহিত করা হচ্ছে, যা গো-খাদ্যের খরচ কমাতে সহায়ক।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ধ প রক র য় জ ত হ জ র টন ল খ টন
এছাড়াও পড়ুন:
প্রথম চালানে ৩৭ হাজার ৪৬০ কেজি ইলিশ গেল ভারতে
দুর্গাপূজা উপলক্ষে যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে প্রথম চালানে ৩৭ হাজার ৪৬০ কেজি ইলিশ মাছ ভারতে রপ্তানি হয়েছে। আজ বুধবার দেশের ছয়টি প্রতিষ্ঠান ১২ দশমিক ৫০ ডলার কেজিতে এই ইলিশ রপ্তানি করা হয়েছে, যা বাংলাদেশি টাকায় ১ হাজার ৫২৫ টাকা।
অথচ এদিন যশোর শহরের মাছের আড়তে ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম আকারের প্রতি কেজি ইলিশ মাছ ১ হাজার ৪৫০ থেকে ১ হাজার ৫৫০ টাকায় পাইকারি বেচা–কেনা হয়েছে। খুচরা বাজারে সেই ইলিশ কেজিতে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেশি দরে ভোক্তাকে কিনতে হচ্ছে; অর্থাৎ দেশের খুচরা বাজারের দামের চেয়ে কম দামে ইলিশ ভারতে রপ্তানি হচ্ছে।
দেশের চেয়ে কম দামে ইলিশ মাছ রপ্তানি কীভাবে সম্ভব হচ্ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে রপ্তানিকারকদের ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং (সিএন্ডএফ) এজেন্ট জুয়েল এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘রপ্তানিকারকেরা ইলিশের জাহাজ থেকে সরাসরি মাছ কেনেন। ছোট–বড় মিলিয়ে যখন কেনেন, তখন একটু কম দামে তাঁরা কিনতে পারেন। এ কারণে তাঁদের পুষিয়ে যায়। এর চেয়ে বেশি কিছু আমার জানা নেই।’
যশোর শহরের বড় বাজারের মাছ বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ইলিশ মাছের সরবরাহ কম। যে কারণে ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ মাছ ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা কেজি দরে বেচাকেনা হচ্ছে। খুচরা ইলিশ বিক্রেতা লিয়াকত আলী বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় এ বছর ইলিশ মাছের দাম বাড়তি। বাজারে সরবরাহ কম। যে কারণে এ বছর ইলিশ মাছের দাম কমার সম্ভাবনা আর দেখছি না।’
যশোর বড় বাজার মৎস্যজীবী আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ পিয়ার মোহাম্মদ জানান, আজ যশোরের বাজারে ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম আকারের ইলিশ মাছ ১ হাজার ৪৫০ থেকে ১ হাজার ৫৫০ টাকা কেজি দরে পাইকারি কেনাবেচা হয়েছে। আর কেজি আকারের ইলিশ প্রতি কেজি ৩ হাজার টাকার ওপরে বেচাকেনা হয়েছে। ভারতের রপ্তানির কারণে স্থানীয় বাজারে এখন ইলিশ মাছ সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে, যে কারণে দাম বেশি। অথচ গত বছর এই সময়ে কেজি আকারের ইলিশ মাছের দাম ছিল সর্বোচ্চ ১ হাজার ৬০০ টাকা কেজি। এবার প্রায় দ্বিগুণ দামে সেই ইলিশ কেনাবেচা হচ্ছে।
বেনাপোল স্থলবন্দরের মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, এ বছর সরকার ৩৭টি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ১ হাজার ২০০ টন ইলিশ ভারতে রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে। আজ থেকে ইলিশ মাছ রপ্তানি শুরু হলো। গত বছর ইলিশ রপ্তানির অনুমতি ছিল ২ হাজার ৪২০ টন। বেনাপোল বন্দর দিয়ে রপ্তানি হয়েছিল মাত্র ৫৩২ টন। এবারও অনুমোদনকৃত ইলিশ রপ্তানির কোটা পূরণ হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ৫ অক্টোবরের মধ্যে ইলিশ রপ্তানি শেষ করতে নির্দেশ দিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর।
জানতে চাইলে বেনাপোল স্থলবন্দরের মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের ফিশারিজ কোয়ারেন্টিন সজীব সাহা বলেন, দুর্গাপূজা উপলক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অনুমোদিত ইলিশ রপ্তানির প্রথম চালানে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ১২ দশমিক ৫০ ডলার মূল্যে ৩৭ দশমিক ৪৬০ টন ইলিশ রপ্তানি হয়েছে। ছয়টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই ইলিশ ভারতে পাঠানো হয়েছে। রপ্তানি করা ইলিশের একটি বাক্স খুলে দেখা গেছে, ৩৮টি ইলিশ মাছের ওজন ২১ কেজি; অর্থাৎ প্রতিটি ইলিশের ওজন ছিল ৫৫০ গ্রাম। এ ছাড়া ৭০০ থেকে ৮৫০ গ্রাম ওজনের ইলিশ মাছও রপ্তানি হয়েছে। ৫৫০ গ্রাম থেকে ৮৫০ গ্রাম আকারের মধ্যে ইলিশ মাছ রপ্তানি হচ্ছে।
পদ্মার রুপালি ইলিশ স্বাদ আর গন্ধে অতুলনীয় হওয়ায় দুই বাংলায় এ মাছ বেশ জনপ্রিয়। বিশেষ করে দুর্গাপূজায় অতিথি আপ্যায়নে খাবারের প্রধান তালিকায় ইলিশ রাখেন কলকাতার বাঙালিরা। আগে ইলিশ সাধারণ রপ্তানি পণ্যের তালিকায় উন্মুক্ত থাকলেও উৎপাদন সংকট দেখিয়ে ২০১২ সালে দেশের বাইরে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ করে দেয় তৎকালীন সরকার। তবে ২০১৯ সাল থেকে বিশেষ বিবেচনায় কেবল দুর্গাপূজা উপলক্ষে আবারও ইলিশ রপ্তানির সুযোগ দেয় সরকার।
আরও পড়ুনদুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতের ‘বিশেষ অনুরোধে’ ইলিশ রপ্তানির অনুমতি: মৎস্য উপদেষ্টা২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪