ঘূর্ণিঝড় শক্তি: মতলব দক্ষিণে রাস্তার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি
Published: 1st, June 2025 GMT
চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণে ঘূর্ণিঝড় শক্তির প্রভাবে হওয়া বৃষ্টিতে কাঁচা রাস্তার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এভাবে বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে এ ক্ষতির সম্ভাবনা আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রবিবার (১ জুন) নন্দীখোলা, পিতাম্বদী ও গ্রামীণ অর্থনীতির নবনির্মিত রাস্তাগুলোর মাটি অধিকাংশ স্থানেই বৃষ্টির পানিতে ধসে গেছে।
মতলবের প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এই উপজেলায় চলতি অর্থ বছরে প্রায় ৪ কোটি টাকা ও ২৩৮ মেট্টিক টন খাদ্যশস্যে নির্মিত টিআর-কাবিখা কর্মসূচির আওতায় মোট পাঁচটি ইউনিয়ন ও দুইটি পৌরসভায় ২৭৮টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। অধিকাংশ প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে।
আরো পড়ুন:
দুর্বল হচ্ছে নিম্নচাপ, শুক্রবারও ভারী বৃষ্টির আভাস
আম্ফানের ৫ বছর
জীবন-জীবিকার লড়াই আরো কঠিন!
এছাড়া মতলব দক্ষিণ উপজেলায় প্রায় ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন ২০টি সেতু প্রকল্পের মধ্যে ১৮টির কাজ শেষ হয়েছে।
তুষপুর ঘোনা সংযোগ রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পের সভাপতি ও নায়েরগাঁও ইউপি সদস্য শারমিন আক্তার জানান, মাত্র এক সপ্তাহ আগে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ শেষ করা হয়। কিন্তু চলমান বৃষ্টির অঝোর ধারায় রাস্তার স্লোপের মাটি সরে গিয়ে অকেজো হয়ে পড়েছে।
খাদেরগাও-লামছড়ি সংযোগ রাস্তার উপকারভোগী সৌদি প্রবাসী মো.
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, “অতিবর্ষণ ও জোয়ারের পানির ঢেউয়ে নির্মিত অ্যাপ্রোচ রোডের সলিং ও মাটির রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গ্রামীণ মাটির রাস্তায় এইচবিবিকরণ প্রকল্পের আওতায় ৮০ লাখ টাকায় নির্মিত প্রকল্পটির নায়েরগাঁও উত্তর অংশটিও অতিবৃষ্টিতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
তিনি বলেন, “আমাদের সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান ও প্রকল্প চেয়ারম্যানগন জানিয়েছেন কাবিখা-কাবিটা প্রকল্পের আওতায় নির্মিত কাঁচা রাস্তাগুলো অবিরাম বর্ষণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এছাড়া নবনির্মিত ব্রিজের অ্যাপ্রোচ সড়ক ও এইচবিবি রাস্তাও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
তিনি আরো বলেন, “এই এলাকায় কাদামাটি ও বেলেমাটি হওয়ায় লাগাতার বৃষ্টিতে প্রকল্পের রাস্তার মাটি ধুয়ে গেছে। এছাড়া ড্রেসিং-এ লাগানো ঘাস এখনও মাটি ধরে রাখার সুযোগ পায়নি। মূলত কাবিটা-টিআরে নির্মিত রাস্তাগুলো মাটির হওয়ায় অধিকাংশ প্রকল্প প্রবল বর্ষণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছি।”
এ বিষয়ে মতলব দক্ষিণের উপজেলা প্রকৌশলী মো. মেহেদী হাসান বলেন, “ঘূর্ণিঝড় শক্তির প্রভাবে প্রবল বর্ষণ চলমান থাকায় কাঁচা রাস্তাগুলো ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সবকিছুই আমাদের পর্যবেক্ষণে রেখেছি।”
চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণের উপজেলা নির্বাহী অফিসার আমজাদ হোসেন বলেন, “প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ সমাপ্ত হতে না হতেই ঘূর্ণিঝড় শক্তির প্রভাবে সৃষ্ট অতিবর্ষণে কাঁচা রাস্তাগুলো বিধ্বস্ত হয়েছে। আগামী অর্থবছরে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্থ রাস্তাগুলো মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হবে।”
ঢাকা/অমরেশ/মেহেদী
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ঘ র ণ ঝড় প রকল প র উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
খেলাপি ঋণে বাংলাদেশ এশিয়ায় কেন শীর্ষে
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে মন্দ বা খেলাপি ঋণ অনেক দিনের বিরাট সমস্যা। শুরুতে শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় এ ব্যাধি বিদ্যমান হলেও পরবর্তী সময়ে বৃহৎ ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকেও ছড়িয়ে পড়ে। এটি, তথা ঋণখেলাপির সংস্কৃতি ধীরে ধীরে এক মহিরুহ আকার ধারণ করেছে।
গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংক খাতের লুকানো খেলাপি ঋণ বের হয়ে আসছে। আবার অনেক আওয়ামী লীগ নেতা ও তাঁদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের ঋণও খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। তাতে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ এক বছরের ব্যবধানে মোট ঋণের ১২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৮ শতাংশ ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা ঋণের এক-চতুর্থাংশের বেশি এখন খেলাপি।
সম্প্রতি প্রকাশিত এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণের দিক থেকে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের শীর্ষে উঠে আসার বিষয়টি সামনে এসেছে। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর আর্থিক বিভিন্ন সূচকের অবস্থা নিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। অবশ্য খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে ২০২৩ সালের তথ্য। তাতেই বাংলাদেশ শীর্ষে। এটি যে ২০২৫ সালে অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তা আমরা জানি।
আগে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কায়দায় বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ কম দেখানো হতো। অন্যদিকে সহজে ঋণ পুনঃ তফসিল ও পুনর্গঠন করার কারণেও খেলাপি ঋণ কম ছিল। এখন ঋণমানে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসরণ করা শুরু হয়েছে। আবার ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা ও আওয়ামী রাজনীতি–সমর্থিত ব্যক্তিদের ব্যবসা খারাপ হয়ে পড়ায় খেলাপি ঋণ বাড়ছে।
খেলাপি ঋণ এভাবে বাড়তে থাকলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে, সন্দেহ নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করতে উদ্যোগ নিতে হবে। যাঁরা ভালো ব্যবসায়ী, তাঁরা যেন আবার ব্যবসা শুরু করতে পারেন, সে ব্যবস্থা করতে হবে। সেটি নিয়ে সরকার কাজও করছে।
এডিবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। ২০২৩ সাল শেষে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সাল থেকে প্রতিবছরই বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের হার বেড়েছে। ২০২১ সালে এই হার ছিল ৮ শতাংশ, ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৭ শতাংশে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের মতো ২০২১ সাল থেকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে নেপাল ও শ্রীলঙ্কার।
দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দেশগুলোর খেলাপি ঋণ কমেছে। যেমন ভুটানের খেলাপি ঋণের হার ২০২০ সালে ছিল ১১ দশমিক ৭ শতাংশ, যা ২০২২ সালে কমে হয়েছে ৩ শতাংশ। ভারতের খেলাপি ঋণের হার ২০২০ সালে ছিল ৭ দশমিক ৯ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে কমে হয়েছে ১ দশমিক ৭ শতাংশ। মালদ্বীপের খেলাপি ঋণ এই সময়ে ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ। একই প্রতিবেদন অনুযায়ী, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম খেলাপি ঋণ তাইওয়ান ও কোরিয়ার। দেশ দুটির খেলাপি ঋণের হার যথাক্রমে শূন্য দশমিক ১ ও শূন্য দশমিক ২ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ২০২৪ সাল শেষে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ছিল ২০ দশমিক ২০ শতাংশ। ২০২৫ সালের জুন শেষে এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকায়, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা মোট ঋণের চার ভাগের এক ভাগের বেশি খেলাপি হয়ে গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বলতে শুনেছি, গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে যে অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে, তা এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে। আগেই বলেছি, ঋণখেলাপি হওয়ার নিয়ম আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার কারণেও দেশে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। যেসব ঋণ নবায়ন করা হয়, তার অনেকগুলো আদায় হচ্ছে না। অনিয়মের কারণে অনেক ঋণকে খেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগ। এতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, যা সামনে আরও বাড়তে পারে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এর পর থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করছিলেন, বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নানা অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বের করে নিয়ে যাচ্ছেন, যার একটা বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।
সূত্রগুলো বলছে, দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ও বহুল সমালোচিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া ব্যাংকগুলোর ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হতে শুরু করেছে। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। একইভাবে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেড়েছে। এই পাঁচ ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই কাজ বাস্তবায়ন করতে এরই মধ্যে প্রশাসক নিয়োগের সিদ্ধান্তও হয়ে গেছে। পাশাপাশি সরকারি খাতের জনতা ও রূপালী এবং বেসরকারি খাতের ইউসিবি, আইএফআইসি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ট্রাস্ট ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেড়েছে।
পত্রিকা সূত্রে জানা গেছে, খেলাপি হয়ে পড়া প্রায় ১ হাজার ২৫০ প্রতিষ্ঠান বিশেষ ব্যবস্থার অধীন ঋণ পুনর্গঠনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করেছে। এর মধ্যে প্রায় ৩০০ প্রতিষ্ঠানের ঋণ নিয়মিত করার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন একটি বিস্তৃত নীতিমালা তৈরি করে ব্যাংকগুলোকে ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দিতে চাইছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জানা গেছে, এই নীতিমালায় নির্দিষ্ট অর্থ জমা দিয়ে ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া হবে। তবে ঋণ পরিশোধে যতটা সময় অবকাশ পাবে, ওই সময়ে সুদ পরিশোধ করতে হবে। এর ফলে খেলাপি ঋণ কমে আসবে বলে আশা করছেন অনেকে। তবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী না করলে কিংবা ব্যবসা পরিচালনায় মনোযোগী না হলে তার উল্টোটাও ঘটতে পারে। সুযোগের অসৎ ব্যবহারের উদাহরণ বাংলাদেশে অনেক।
সামগ্রিক ঋণখেলাপির সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পেতে গেলে আমাদের দুষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি তথা স্বজনতোষী পুঁজিবাদ থেকে যেমন বেরিয়ে আসতে হবে, তেমনি ঋণ সম্প্রসারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। কমাতে হবে পরিচালকদের অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ।
মামুন রশীদ ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
মতামত লেখকের নিজস্ব