কার্ল মার্ক্স ১৭৩ বছর আগে বলেছিলেন, ইতিহাসে কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেমন ট্র্যাজেডি আকারে হতে পারে, তেমনি প্রহসন রূপেও হয়। বঙ্গের ভাগ্য অতীতেও বহুবার বিলাতে নির্ধারিত হয়েছে। এখন আরেকবার যদি সে রকম হয়, তাকে অন্তত ‘ট্র্যাজেডি’ হিসেবেই শনাক্ত করব আমরা।
ট্র্যাজেডি এটা বহু কারণে। প্রথমত, ঠিক দশ মাস পর গণ–অভ্যুত্থানের ভবিষ্যৎ ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত দর-কষাকষির বিষয়ে পরিণত হলো। জনগণ আর সেসবে চালকের আসনে নেই, অন্তত ‘স্থানীয়’ সমাজের সে রকমই পর্যবেক্ষণ।
বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক বোধ-বুদ্ধি তীক্ষ্ণ, কল্পনাশক্তিও ব্যাপক। গ্রামগঞ্জের চায়ের দোকানে ঈদের ছুটির আড্ডার বিষয় গরু-ছাগলের বেচাবিক্রি থেকে প্রায় আট হাজার কিলোমিটার দূরের লন্ডনের দিকে ছুটে গেছে ইতিমধ্যে।
এ অঞ্চলের শাসকদের ভ্রমণপ্রীতি ও লন্ডনপ্রীতি পুরোনো হলেও চলতি লন্ডন–অধ্যায় বাড়তি মুখরোচক। বহুকালের অধরা জাতীয় নির্বাচন কবে, কেন, কীভাবে হবে; তার অনেকখানি সিদ্ধান্ত যে এ সপ্তাহে লন্ডনে হচ্ছে, মানুষের অনুমান সে রকম। কিন্তু ‘সিদ্ধান্ত’ কি আদৌ সহজে হওয়া সম্ভব? বাংলাদেশের কুলীন সমাজ কি আদৌ ‘আপসের শিল্পকলা’য় দক্ষ?
নিকট অতীতের নজির সুখকর নয়। ২০০৬ ও ২০১৩ সালে সে রকম তিক্ত দুটি অধ্যায় দেখেছে বাংলাদেশ, যার খেসারত দিতে দিতে ২০২৪ সাল পর্যন্ত লেগে গিয়েছিল।
এবার বিপুল সম্ভাবনায় মোড়ানো ইতিহাসের সুন্দরতম দশটি মাস ইতিমধ্যে আমরা হেলাফেলায় হারিয়ে ফেলেছি। আর কয় দিন পরই ‘৩৬ জুলাই’য়ের প্রথম বার্ষিকী। স্বজন হারানোদের চোখের জল ও শোকের মাতম কিছুই থামেনি। কিন্তু মাঠে-ময়দানে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর পারস্পরিক বিবাদের চিত্র এখন, এমনকি ‘৩৬ জুলাই’য়ের আগের চেয়েও বহুমুখী ও বিচিত্র।
বলা যায়, গত দশ মাসে বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে প্রত্যাশামতো এগোতেই পারল না। নতুন কোনো অর্জন নেই তার। আপাতত তীব্র কোনো প্রসববেদনাও নেই আর সমাজের গর্ভে। এর মাঝে, নীতিনির্ধারকেরা নির্দলীয় অভিভাবকত্বের জায়গা থেকে বিবদমান শক্তিগুলোকে কাছাকাছি টেনে রাখার বদলে অনেক সময়ই ভিন্ন কাজ করেছে।
সংস্কারের বিষয়ে বিএনপিসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল ইতিমধ্যে যার যার অবস্থানের অনেকটাই প্রকাশ করে ফেলেছে। তাতে এক চিমটি ঐক্য ও একমুঠো ব্যবধানের কথাই প্রচারিত হচ্ছে। ঐকমত্যের বিষয়গুলো নিয়ে আগামী মাসে একটা ‘ঘোষণাপত্র’ তৈরি হতে পারে, যা নির্বাচনোত্তর সংসদকর্তৃক অনুমোদিতও হওয়ার কথা। এতে চলমান ‘মব’ থামবে কি না, বলা কঠিন।সমাজে সমন্বয়বাদী নীতির বদলে বিভেদবাদ ইন্ধন পেয়েছে। ফলে এখন প্রশাসনিক অভিভাবকদের রাজনৈতিক মাঠের কোনো কোনো পক্ষের হয়ে দর–কষাকষিতে লিপ্ত হতে হচ্ছে। এ রকম পরিণতি রাষ্ট্রের অভিভাবকদের জন্য নৈতিক দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ। সেই ঝুঁকি আসন্ন রাজনীতিকে বাড়তি উত্তপ্ত করতে পারে। যার পার্শ্বফল হিসেবে শিগগির অন্তবর্তী সরকারের সংস্কারের দাবিও উঠতে পারে। নানা তরফ থেকে কয়েকজন উপদেষ্টাকে অপসারণের দাবিও উঠিয়েছেন বিবদমান রাজনীতিবিদেরা।
দক্ষতা ও নিরপেক্ষতায় এই সরকারের অধীন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান আদৌ সম্ভব কি না, সামনে সে প্রশ্ন ওঠা অসম্ভব নয়। যদিও আপাতত সবকিছুর ফয়সালা নির্ভর করছে লন্ডন অধ্যায়ের পরিণতির ওপর।
সংস্কারের বিষয়ে বিএনপিসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল ইতিমধ্যে যার যার অবস্থানের অনেকটাই প্রকাশ করে ফেলেছে। তাতে এক চিমটি ঐক্য ও একমুঠো ব্যবধানের কথাই প্রচারিত হচ্ছে। ঐকমত্যের বিষয়গুলো নিয়ে আগামী মাসে একটা ‘ঘোষণাপত্র’ তৈরি হতে পারে, যা নির্বাচনোত্তর সংসদকর্তৃক অনুমোদিতও হওয়ার কথা। এতে চলমান ‘মব’ থামবে কি না, বলা কঠিন।
দেশের কৃষক, শ্রমিক ও নিচুতলার অন্য পেশাজীবীদের জন্য এই ঘোষণাপত্রে অতি আগ্রোহদ্দীপক কিছু আছে বলে জানা যায় না। প্রশ্ন হলো, এর বাইরে লন্ডনে আলোচনার বিষয় আর কী আছে? কেন এই আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ এবং কেন এই বৈঠকের ফলাফল নিয়ে কৌতূহল?
গ্রাম-শহরের জনসমাজে চায়ের আড্ডায় আঁচ-অনুমানের তালিকায় আছে বেশ অনেক কিছু। ‘৩৬ জুলাই’য়ের সংগঠকদের রাজনৈতিক ভাগ্য এবং তাঁদের সে সময়কার ‘ভূমিকা’র সাংবিধানিক-প্রশাসনিক সুরক্ষার বিষয় নিয়ে অনেকে ভাবছেন। এ রকম ভাবুকেরা হয়তো এসব বিষয়ে ভবিষ্যৎ নীতিনির্ধারকদের কাছে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি চাইবে। তবে এসব বিষয়ে কতটুকু ঐক্য হলো, কতটা ব্যবধান থাকল তার সামান্যই হয়তো জনতা জানবে, কিন্তু সাধারণ বাংলাদেশিরা সব অনুমান করে নেবেন ঠিক ঠিক।
দশ মাসের ব্যবধানে অভ্যুত্থান-পরবর্তী দৃশ্যপট যত পাল্টাচ্ছে, মানুষের অনুমান-কল্পনার দৌড়ও তত তীব্র হচ্ছে। মানুষ দেখছে, সর্বশেষ বাস্তবতায় ও মেরুকরণে জুলাই-সংগঠকদের রাজনৈতিক অর্জন ও সম্ভাবনা ঝুঁকির মুখে পড়েছে। অ্যাকটিভিজম ও সংসদীয় রাজনীতির ফারাকটা বুঝতে বুঝতে অনেক দেরি হয়ে গেছে তাঁদের। নির্বাচনী হাওয়ার মুখে নির্বাচনপন্থী হয়ে তাঁরা নিশ্চিতভাবেই কঠিন বাস্তবতার মুখে আছেন এখন।
এর বাইরে, ভবিষ্যতে স্বাভাবিক প্রশাসনিক ও পুলিশি কার্যক্রম শুরু হলে অভ্যুত্থানকালীন ও অভ্যুত্থান-পরবর্তী আরও কিছু রূঢ় প্রসঙ্গ সামনে আসবে। এ রকম সব বিষয়ে, সংস্কারের আলোচনার ছায়ায় ভিন্ন কিছু আলোচনার অবকাশ ছিল। ক্রমে সেসবই বেশি দরকারি বিষয় হয়ে উঠছে, অনেকের কাছে, অনেকের জন্য। কারণ, সময় এগোচ্ছে দ্রুত। অর্থনীতির সূচকগুলো নিম্নগামী। নির্বাচনী রোডম্যাপের পুরোটা না দেখে বিনিয়োগকারীরাও হাত খুলবেন না।
লন্ডন বৈঠক এসব এড়াতে গুরুত্বপূর্ণ। এই গুরুত্ব অন্তত আরও দুই কারণেও। প্রথমত, নির্বাচনকালীন সরকারের রূপ যদি ভিন্ন হয় এবং অন্তর্বর্তী সরকার যদি কোনোভাবে রূপান্তরিত হয়, তাহলে তার আকার ও গঠন কীভাবে হবে, কাদের নিয়ে হবে? কার কাজের পরিসরই–বা কী হবে?
দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের পর সম্ভাব্য বিজয়ীরা যদি কথামতো কথিত জাতীয় সরকার গঠন করে, তাহলে সে-ই সরকারে কারা, কী মাত্রায় অংশ নিতে পারবে এবং অন্তর্বর্তী সরকারের এত দিনকার ‘কাজকর্ম’কে তারা কীভাবে মূল্যায়ন করবে ও সম্মান দেখাবে—এসব প্রশ্নও এখনি কিছু প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার খুঁজছে বলে মনে হয়।
এত সব বিবেচনায় অতীত বঙ্গের মতোই লন্ডন থেকেই আবারও আমাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ রচিত হতে পারে। এ রকম দৃশ্য গণ–অভ্যুত্থানের বৈপ্লবিক ব্যাখ্যা দানকারীদের জন্য সুখকর নয়, তবে এটাই নিদারুণ বাস্তবতা।
বিপুল জনসমর্থন পেয়েও সুশীল সমাজের সেরা মানুষেরা আমাদের যে জায়গায় দাঁড় করালেন, রাজনীতিবিদদের সেখান থেকেই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হবে। ব্যর্থ রাষ্ট্রের ঝুঁকির চেয়ে পুরোনো ‘স্থিতিশীলতা’ উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্তের বেশি পছন্দ। গরিবেরা আপাতত যে বেখবর, তার নজির সদ্যঘোষিত বাজেট-দলিল। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, শেষের বিষয়টি লন্ডনে কোনো ইস্যু হবে না।
আলতাফ পারভেজ ইতিহাস বিষয়ে গবেষক
*মতামত লেখকের নিজস্ব
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: দ র র জন ত ক সরক র র ব যবধ ন অন ম ন এ রকম
এছাড়াও পড়ুন:
বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে
বাংলাদেশে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী এক বছরে ১৯ দশমিক ১৩ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে দিয়ে দেশে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশের প্রতি আন্তর্জাতিক আস্থার প্রতিফলন দেখা গেছে।
বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সম্প্রতি যেসব দেশে গণঅভ্যুত্থান ঘটেছে, সেসব দেশে পরবর্তী এক বছরে এফডিআই উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। এর মধ্যে শ্রীলঙ্কায় ২০২২ সালের পর এফডিআই কমেছে ১৯.৪৯ শতাংশ, চিলিতে ২০১৯ সালের পর কমেছে ১৫.৬৮ শতাংশ, সুদানে ২০২১ সালের পর ২৭.৬০ শতাংশ, ইউক্রেনে ২০১৪ সালের পর ৮১.২১ শতাংশ, মিশরে ২০১১ সালের পর ১০৭.৫৫ শতাংশ এবং ইন্দোনেশিয়ায় ১৯৯৮ সালের পর ১৫১.৪৯ শতাংশ কমেছে। এই ধারাবাহিক হ্রাসের মধ্যে বাংলাদেশে এফডিআইর ১৯.১৩ শতাংশ বৃদ্ধির চিত্র বিশেষভাবে নজরকাড়া।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেছেন, “বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গুণ হলো—শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অর্থনীতিকে পুনরায় চালু করার অদ্ভুত ক্ষমতা। এই পরিসংখ্যান তার দারুন একটা প্রতিফলন। সাধারণত, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যায়, কিন্তু আমরা উল্টা দেখছি। সঠিক নীতি নির্ধারণ, বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার আন্তরিকতা এবং প্রাইভেট সেক্টরের অদম্য স্পৃহা কারণে এটি সম্ভব হয়েছে। আমরা সব সময় বিনিয়োগকারীদের সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। সব সমস্যার সমাধান হয়নি, তবে সদিচ্ছার কোনো ত্রুটি ছিল না। শিগগিই সারা বছরের একটি আমলনামা (রিপোর্ট কার্ড) প্রকাশ করা হবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ৪৮৮ দশমিক ৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৭০ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলারে। ২০২৩ সালে বিনিয়োগের পরিমাণ হয় ৯২৪ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার, তবে ২০২৪ সালে কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৬৭৬ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলারে। ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯২ দশমিক ৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এই ধারা বজায় থাকা অত্যন্ত ইতিবাচক। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, দীর্ঘমেয়াদি নীতি সহায়তা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে আরো বড় পরিসরে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারবে বলে মনে করছেন তারা।
ঢাকা/নাজমুল/রফিক