ইরান–ইসরায়েলের পাল্টাপাল্টি হামলা রূপ নিতে পারে দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতে
Published: 15th, June 2025 GMT
ইরান–ইসরায়েল পাল্টাপাল্টি হামলা ঘিরে উত্তেজনা বেড়েছে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামলা চালিয়ে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে তেহরান। একই হুমকি দিয়েছে ইসরায়েলও। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চলতে থাকলে তেহরানকে জ্বালিয়ে দেওয়া হবে। এমন পরিস্থিতিতে দুই দেশ দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকদের অনেকে।
এই সংঘাতের শুরু বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে ইরানে ইসরায়েলের ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামের অভিযানের মধ্য দিয়ে। ওই রাতে ইরানের পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনায় হামলা চালানো হয়। বৃহস্পতিবার রাতের হামলার পর শুক্র ও শনিবারও ইরানের বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এতে নিহত হন ইরানের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা, পরমাণুবিজ্ঞানীসহ ৭৮ জন। শনিবার রাতেও ইরানের বিভিন্ন স্থানে ইসরায়েলের হামলা চলছে।
ইসরায়েলের হামলার কড়া জবাব দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিসহ বিভিন্ন কর্মকর্তা। এরপর শুক্রবার রাতে ইসরায়েলের তেল আবিব ও জেরুজালেমে ক্ষেপণাস্ত্র এবং রকেট হামলা চালায় ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড কোর (আইআরজিসি)। এ হামলায় বিধ্বস্ত হয় বেশ কয়েকটি ভবন। নিহত হন তিন ইসরায়েলি। আহত হন অন্তত ৩৪ জন।
ইসরায়েলে ‘ট্রু প্রমিজ–৩’ নামে অভিযান চালিয়ে যাওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ইরানের কর্মকর্তারা। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে এক ইরানি কর্মকর্তা শনিবার দেশটির বার্তা সংস্থা ফারস নিউজকে বলেন, গত রাতে ইরানের চালানো সীমিত হামলার মধ্য দিয়ে ইসরায়েলকে মোকাবিলা শেষ হবে না। হামলা চলবে। আগ্রাসনকারীদের জন্য তা হবে খুবই পীড়াদায়ক। নিজেদের কাজের জন্য তারা অনুতপ্ত হবে।
ইসরায়েলের পাশাপাশি দেশটির মিত্রদেরও হুমকি দিয়েছে ইরান। শুক্রবার রাতে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে সহায়তা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের সামরিক ঘাঁটি এবং যুদ্ধজাহাজ রয়েছে। ইসরায়েলের মিত্র এই দেশগুলো চলমান সংঘাতে হস্তক্ষেপ করলে তাদেরও হামলার লক্ষ্যবস্তু করা হবে বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে ইরান সরকার।
তেহরানকে ‘জ্বালিয়ে দেওয়ার’ হুমকি
ইরান ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে গেলে তেহরানকে ‘জ্বালিয়ে দেওয়ার’ হুমকি দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ। শনিবার এক বিবৃতিতে তিনি আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির উদ্দেশে বলেছেন, খামেনি ইরানের নাগরিকদের জিম্মি করছেন। ইসরায়েলের জনগণের ক্ষতি হলে ইরানকে চড়া মূল্য দিতে হবে। খামেনি যদি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে থাকেন, তাহলে তেহরান ‘জ্বলবে’।
পরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘আমরা আয়াতুল্লাহ সরকারের প্রতিটি স্থাপনা ও লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানব। (ইসরায়েলের হামলা) থেকে এত দিন তারা যা টের পেয়েছে, তা আগামী দিনগুলোতে যে হামলা চালানো হবে, তার তুলনায় কিছুই নয়।’ বর্তমানে ইসরায়েলি বাহিনী ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনের সক্ষমতা ধ্বংস করছে বলে জানান তিনি।
এমন পরিস্থিতিতে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি সামরিক সংঘাত শুরু হতে পারে বলে মনে করছেন বিবিসির মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সংবাদদাতা হুগো বাচেগা। তিনি বলেন, ইরানে চালানো হামলাকে দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতের সূচনা বলে ইতিমধ্যে উল্লেখ করেছেন ইসরায়েলের কর্মকর্তারা। এর অর্থ হলো তাঁরা ইরানে আরও লম্বা সময় ধরে হামলা চালাতে চান।
‘সবকিছু কাঁপছিল’
শুক্রবার রাতে ইসরায়েলে চালানো ইরানের হামলার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ট্রু প্রমিজ–৩’। এদিন রাতভর তেল আবিব ও জেরুজালেম লক্ষ্য করে শত শত ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইরানের সামরিক বাহিনী। ইসরায়েলের অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস গতকাল জানিয়েছে, এই হামলায় এক নারীসহ তিন ইসরায়েলি নিহত হয়েছেন। আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন অন্তত ৩৪ জন।
তেল আবিবে ইরানের হামলা শুরুর পর বিভিন্ন এলাকা থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। স্থানীয় বাসিন্দারা আতঙ্কে ছোটাছুটি শুরু করেন। অনেকে ভূগর্ভস্থ আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটে যান। এমনই একজন চেন গাবিজোন। আল–জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘ভূগর্ভস্থ কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়ার কয়েক মিনিট পর বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাই। সবকিছু কাঁপছিল। চারদিক ধোঁয়া ও ধুলায় ঢেকে যায়।’
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম হারেৎজ–এর খবরে বলা হয়েছে, ইরানের হামলায় তেল আবিবের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় একটি বহুতল ভবনের নিচের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া শহরের উপকণ্ঠে আরও নয়টি ভবন ধ্বংস হয়ে যায়। জেরুজালেমেও বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শোনা যায়।
শুক্রবার রাতে ইরান দেড় শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম হারেৎজ। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর দাবি, এসব ক্ষেপণাস্ত্রের বেশির ভাগই আকাশে থাকতে প্রতিহত করা হয়েছে। একই সঙ্গে সংঘাত বৃদ্ধির শঙ্কায় লেবানন ও জর্ডান সীমান্তে সেনা মোতায়েন করেছে ইসরায়েল। আর পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত দেশটির বেন গুরিয়ন বিমানবন্দর বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।
তেহরানের এক ভবনেই নিহত ৬০
বৃহস্পতিবার রাতের হামলায় তেহরান থেকে ২২৫ কিলোমিটার দূরে নাতাঞ্জ পরমাণু প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে শুক্রবার ও শনিবার ইরানের ফোর্ডো ও ইসপাহান পরমাণুকেন্দ্রে হামলা চালায় ইসরায়েল। তবে হামলার পর এসব পরমাণুকেন্দ্র থেকে তেজস্ক্রিয় পদার্থের বিকিরণ বৃদ্ধি পায়নি বলে জানিয়েছে বৈশ্বিক পারমাণবিক নজরদারি সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি (আইএইএ)।
বৃহস্পতিবার রাতের হামলায় প্রায় ২০০ যুদ্ধবিমান অংশ নিয়েছিল বলে জানায় ইসরায়েল। শুক্র ও শনিবারের হামলায়ও কয়েক ডজন যুদ্ধবিমান অংশ নেয় বলে জানিয়েছে তারা। ইরানের বেশ কিছু ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন কারখানায় হামলা চালানো হয়েছে। এ ছাড়া তেহরানের মেহরাবাদ বিমানবন্দরে যুদ্ধবিমান রাখার স্থানেও হামলা হয়েছে। বোমাবর্ষণ করা হয়েছে জানজান শহরের একটি সেনাঘাঁটিতে।
পরে শনিবার রাতে ইরানের দক্ষিণাঞ্চলের বুশেহর প্রদেশে সাউথ পার্স গ্যাসক্ষেত্রে ইসরায়েল বোমা হামলা চালায়। এতে গ্যাসক্ষেত্রটিতে আগুন ধরে যায়। পরে ইরান জানায়, তাদের দুটি গ্যাসক্ষেত্রে হামলা হয়েছে। শনিবার রাতে দেশটির বন্দর আব্বাসেও হামলা হয়েছে বলে জানিয়েছে আল–জাজিরা।
ইসরায়েলের পক্ষ থেকে শনিবার জানানো হয়েছে, হামলা শুরুর পর থেকে ইরানের মোট ২০ জন সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যা করেছে তারা। এর মধ্যে দেশটির সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল বাঘেরি ও আইআরজিসির প্রধান হোসেইন সালামি রয়েছেন। এ ছাড়া ৯ জন পরমাণুবিজ্ঞানীকে হত্যা করা হয়েছে।
জাতিসংঘে ইরানের রাষ্ট্রদূত আমির সায়েদি শুক্রবার জানিয়েছেন, ইসরায়েলের হামলায় ইরানে ৭৮ জন নিহত হন। আহত হয়েছেন ৩২০ জনের বেশি। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই বেসামরিক লোকজন। এর মধ্যে তেহরানের একটি বহুতল আবাসিক ভবনে হামলায় ২০টি শিশুসহ প্রায় ৬০ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল।
পাল্টাপাল্টি হামলার মধ্যে শনিবার ইসরায়েলের তিনটি এফ–৩৫ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবি করেছে তেহরান। এসব যুদ্ধবিমানের দুই পাইলটকে আটক করা হয়েছে বলে ইরানের সেনাবাহিনীর বরাতে জানিয়েছে তেহরান টাইমস।
ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র পাঠিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র
সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই–এর খবরে বলা হয়েছে, ইরানে হামলার আগে ইসরায়েলকে গোপনে প্রায় ৩০০টি অত্যাধুনিক ‘হেলফায়ার’ ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুই মার্কিন কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়েছেন। ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহের বিষয়টি ইঙ্গিত দেয় যে ইরানে ইসরায়েলের হামলার পরিকল্পনার বিষয়ে আগে থেকেই জানত যুক্তরাষ্ট্র।
যদিও ইসরায়েলের হামলার বিষয়টি আগে থেকে জানার কথা রয়টার্স, ফক্স নিউজসহ একাধিক গণমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ হামলায় মার্কিন বাহিনী ভূমিকা রাখেনি বলেও জানিয়েছিলেন তিনি। তবে ইরানে হামলার আগে যুক্তরাষ্ট্র যে ইসরায়েলে বিপুল হেলফায়ার ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করেছে, সে খবর এত দিন প্রকাশ করা হয়নি।
হেলফায়ার হলো লেজারনিয়ন্ত্রিত আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার জন্য এই ক্ষেপণাস্ত্র উপযুক্ত নয়। তবে বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুলভাবে আঘাত হানার জন্য এটি বেশ কার্যকর। যুক্তরাষ্ট্রের এক জ্যেষ্ঠ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা মিডল ইস্ট আইকে বলেন, হেলফায়ার ব্যবহারের নির্দিষ্ট সময় ও ক্ষেত্র আছে। এগুলো ইসরায়েলের জন্য বেশ কার্যকর।
ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প নিয়ে রোববার তেহরানের সঙ্গে ওয়াশিংটনের আলোচনায় বসার কথা ছিল। ইসরায়েলের হামলার পর তা স্থগিত করেছে ইরান। এ হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দোষারোপ করে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইসমাইল বাকাই বলেছেন, ‘একদিকে আপনি আলোচনার দাবি করবেন, অন্যদিকে জায়নবাদী শাসকগোষ্ঠীকে ইরানের ভূখণ্ডে হামলা চালাতে দেবেন, তা হতে পারে না।’
‘ইরানে শাসক পরিবর্তনের আশায় ইসরায়েল’
ইরান-ইসরায়েলের শত্রুতা বহু পুরোনো। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের সময় দেশটির পশ্চিমাপন্থী নেতা মোহাম্মদ রেজা শাহ ক্ষমতাচ্যুত হন। তিনি ইসরায়েলকে তেহরানের বন্ধু মনে করতেন। তবে এরপর ক্ষমতায় আসা শাসকেরা ইসরায়েলকে শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে আসছেন। ২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় সর্বশেষ সংঘাত শুরুর পর দুই দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে ইরানে হামলার মাধ্যমে ইসরায়েল নিজেদের একটি উদ্দেশ্য পূরণের আশা করছে বলে মনে করেন অস্ট্রেলিয়ার ডেকিন ইউনিভার্সিটির মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক রাজনীতির অধ্যাপক শাহরাম আকবারজাদেহ। সেটি হলো ইরানের শাসক পরিবর্তন। তিনি বলেন, ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাত শুরু হলে ইসরায়েলকে নিরাপত্তা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই সুযোগই কাজে লাগাতে চাইছেন। তিনি চাইছেন, যুক্তরাষ্ট্র যেন এই সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে এবং ইরানে শাসনব্যবস্থায় কোনো ধরনের পরিবর্তন আসে।
তবে ইরান ও ইসরায়েলের সংঘাত যেন আরও ভয়াবহ দিকে মোড় না নেয়, সে জন্য দুই পক্ষকেই সংযত থাকতে বলেছে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ। গত শুক্রবার নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকেও দুই দেশকে সংযত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। গতকাল পোপ চতুর্দশ লিও একই আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, কারও কখনোই অন্যের অস্তিত্বকে হুমকিতে ফেলা উচিত নয়।
এমন পরিস্থিতিতে ইরান–ইসরায়েলের পাল্টাপাল্টি হামলা নিয়ে ফোনালাপ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। মধ্যপ্রাচ্যে এ উত্তেজনা কমানোর বিষয়ে ফোনালাপে একমত হয়েছেন সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারও। আর সৌদি যুবরাজের সঙ্গে ফোনালাপে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বলেছেন, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য ইসরায়েল সবচেয়ে বড় হুমকি।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: এমন পর স থ ত ত শ ক রব র র ত য ক তর ষ ট র ইসর য় ল র প ও ইসর য় ল র ন ইসর য় ল র কর মকর ত র বর ত বল ছ ন লক ষ য র জন য মন ত র দ শট র হয় ছ ন ল র জন পরম ণ
এছাড়াও পড়ুন:
২০২৬ সালে বিশ্ববাজারে জিনিসপত্রের দাম আরও ৭% কমতে পারে, বাংলাদেশে কেন কমছে না
চলতি বছরের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে দাম কমার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে, চলতি বছরে সামগ্রিকভাবে পণ্যমূল্য ৭ শতাংশ কমবে। আগামী বছর, অর্থাৎ ২০২৬ সালে পণ্যমূল্য আরও ৭ শতাংশ কমবে। এ দাম হবে ছয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।
কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে তার প্রভাব নেই। দেশে মূল্যস্ফীতির হার এখনো ৮ শতাংশের ঘরে। যদিও একসময় তা দুই অঙ্ক ছাড়িয়ে গিয়েছিল। গত সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ হয়েছে। দেশের মানুষকে এখনো বাড়তি দামেই পণ্য ও সেবা কিনতে হচ্ছে। আগামী বছর নিত্যপণ্যের দাম কমবে কি না, সেই নিশ্চয়তাও নেই। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমলেও দেশে এর প্রভাব কম।
বিশ্বব্যাংকের ‘কমোডিটি মার্কেটস আউটলুক অক্টোবর ২০২৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, ২০২৫ সালের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। যার মূল কারণ হিসেবে তারা চিহ্নিত করেছে জ্বালানির দাম কমে যাওয়া। সেই সঙ্গে আরও কিছু কারণ চিহ্নিত করেছে তারা। সেগুলো হলো চীনে তেলের চাহিদা বৃদ্ধির গতি কমে যাওয়া এবং বিশ্ববাজারে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় তেলের দামে বড় ধরনের পতন ঘটা। খাদ্যপণ্যের দাম বছরের শুরু থেকে ধীরে ধীরে কমতে থাকে, কিন্তু বছরের প্রথমার্ধে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে পানীয় পণ্যের দাম হঠাৎ অনেকটা বেড়ে যায়। এ ছাড়া বছরের দ্বিতীয়ার্ধে সোনার দাম রেকর্ড উচ্চতায় ওঠে। মূলত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে নিরাপদ বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে মানুষ সোনার দিকে ছুটেছেন।
বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য নির্ধারণে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে জ্বালানি তেলের দাম। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালে জ্বালানির দাম আগের বছরের তুলনায় ১২ শতাংশ এবং ২০২৬ সালে আরও ১০ শতাংশ কমবে। ২০২৭ সালে তা আবার প্রায় ৬ শতাংশ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস ২০২৬ সালে কৃষিপণ্য, খাদ্য ও কাঁচামালের দাম কমবে। চলতি বছরেও এসব পণ্যের দাম কমেছে।
জ্বালানি তেলবিশ্বব্যাংকের ২০২৬ সালের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা বাড়ায় গ্যাসের দাম কিছুটা বাড়লেও তেলের দাম কমে যাবে এবং সেই প্রভাবকে ছাপিয়ে যাবে। ২০২৫ সালে ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম হতে পারে ব্যারেলপ্রতি গড়ে ৬৮ ডলার; ২০২৪ সালের ৮১ ডলারের তুলনায় যা বেশ কম। ২০২৬ সালে এই দাম আরও কমে ব্যারেলপ্রতি গড়ে ৬০ ডলারে নামতে পারে ধারণা করা হচ্ছে।
এই পূর্বাভাস অনুযায়ী, তেলের ব্যবহার বৃদ্ধির হার আরও কমবে—মূলত চীনের চাহিদা কমে যাওয়া, বৈদ্যুতিক ও হাইব্রিড গাড়ির দ্রুত প্রসার ও বৈশ্বিক তেল সরবরাহ বৃদ্ধির কারণে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।
২০২৫ সালে বৈশ্বিক তেলের বাজারে সরবরাহ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০২৬ সালে তা আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২০ সালের সর্বোচ্চ মাত্রার তুলনায় প্রায় ৬৫ শতাংশ বেশি হবে এ সরবরাহ।
কৃষিপণ্যবিশ্বব্যাংক গ্রুপের পূর্বাভাস অনুযায়ী, কৃষিপণ্যের মূল্যসূচক ২০২৫ সালে স্থিতিশীল আছে। ২০২৬ সালে তা সামান্য ২ শতাংশ ও ২০২৭ সালে আরও ১ শতাংশ কমবে।
খাদ্যপণ্যের দাম, যেমন শস্য, তেল, প্রোটিনজাত খাবারসহ অন্যান্য খাদ্যের দাম সাম্প্রতিক সীমার কাছাকাছি থাকবে। তবে মাঝেমধ্যে সামান্য কিছুটা ওঠানামা থাকবে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, প্রধান ফসলগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধির হার আবার দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতায় ফিরে আসছে।
২০২৫ সালের বাকি সময়ে সয়াবিনের দাম কমবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের যে সয়াবিন সাধারণত চীনে রপ্তানি হয়, তা এবার কম দামে অন্য ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতে হতে পারে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্রে হচ্ছে এই সয়াবিন। চীন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সয়াবিন কিনছে না। ফলে ২০২৬ ও ২০২৭ সালে এই পণ্যের দাম তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্ববাজারে দাম কমে গেলে যুক্তরাষ্ট্রে সয়াবিন চাষের পরিমাণ কিছুটা কমতে পারে, তবে ব্রাজিল তার সয়াবিন আবাদ আরও বাড়ানোর পথে রয়েছে। পানীয় পণ্যের দাম ২০২৬ সালে ৭ শতাংশ ও ২০২৭ সালে প্রায় ৫ শতাংশ কমবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
এদিকে চলতি বছর সারের দাম সামগ্রিকভাবে ২১ শতাংশ বাড়তি। চাহিদা বৃদ্ধি, বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতা ও কিছু অঞ্চলে সরবরাহ–ঘাটতির কারণে এ দাম বেড়ে যাওয়া। ২০২৬ ও ২০২৭ সালে দাম প্রায় ৫ শতাংশ কমতে পারে। তবু ২০১৫-১৯ সালের গড় দামের তুলনায় তা অনেক বেশি থাকবে। এর কারণ হলো উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, রপ্তানি সীমাবদ্ধতা ও চলমান আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা।
চীন ইতিমধ্যে নাইট্রোজেন ও ফসফেট সার রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। অন্যদিকে পটাশ সরবরাহকারী বড় দেশ বেলারুশ এখনো ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার আওতায় আছে। রাশিয়া ও বেলারুশ—উভয় দেশই সারের ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের আরোপিত নতুন শুল্কের সম্মুখীন।
দেশে কেন দাম বেশিবিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশের বাজার দাম না কমার অন্যতম প্রধান কারণ ডলারের দামের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন। গত তিন বছরে ডলার দাম অনেকটা বেড়েছে। সেই সঙ্গে দেশের অনেক আমদানি পণ্যে শুল্ক বেশি বলে মনে করেন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে দাম কমছে না। বাজারে চাহিদা কত বা কখন কোন পণ্য আমদানি করতে হবে, সে বিষয়ে যথাযথ তথ্যের ঘাটতি আছে। ফলে সময়মতো পণ্য আমদানি হয় না।
আরেকটি বিষয় হলো দেশে যেসব পণ্য আমদানি করা হয়, তার অনেক কিছু উৎপাদিতও হয়। কিন্তু বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় এসব পণ্যের সরবরাহে টান পড়েছে। বাজারের পণ্যমূল্যে তার প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন মোস্তাফিজুর রহমান।
তিন বছর আগে দেশে ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। এখন তা বেড়ে ১২২ টাকা হয়েছে। এ ছাড়া কয়েক মাস ধরে আমদানির ঋণপত্র খোলাও কমেছে। এতে আমসদানিতে চাপ পড়ছে।
দেশের বাজার উচ্চ মূল্যের কারণ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক সেলিম রায়হান বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি, কৃষি ও খাদ্যপণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশের বাজারে তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। জ্বালানি ও পরিবহন ব্যয়, শুল্ক ও করের চাপ ও বাজার ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতার কারণে দাম কমছে না। পাইকারি থেকে খুচরা পর্যন্ত অতি মুনাফা ও অস্বচ্ছ বাণিজ্যিক শৃঙ্খলের কারণেও বাজারে কৃত্রিমভাবে উচ্চমূল্য বিরাজ করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে টাকার অবমূল্যায়ন। ফলে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে এবং আন্তর্জাতিক মূল্যহ্রাসের সুফল ভোক্তাপর্যায়ে পড়ছে না।
সেলিম রায়হান আরও বলেন, এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার কারণ ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে এসেছে। বিনিয়োগকারীরা নতুন ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। পণ্য পরিবহন ও আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সরবরাহ শৃঙ্খল দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে বাজারে পণ্যের ঘাটতি ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। এটি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
দেশে তিন বছর ধরেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। সম্প্রতি তা কিছুটা কমলেও সেপ্টেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গত আগস্ট মাসে এই হার ছিল ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ।