মিগ-২১ যুদ্ধবিমানকে চিরবিদায় জানাতে যাচ্ছে ভারত
Published: 23rd, July 2025 GMT
দিনটা ছিল ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল। ঢাকার গভর্নরস হাউসে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর আবদুল মোতালেব মালিকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন জাতিসংঘের উদ্বাস্তুসংক্রান্ত হাইকমিশনারের পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি জন কেলি। হঠাৎই আকাশে উড়ে এসেছিল চারটি ভারতীয় বিমান। সব কটিই মিগ–২১ যুদ্ধবিমান।
ভারতীয় বিমানবাহিনী থেকে এয়ার ভাইস মার্শাল হিসেবে অবসর নেওয়া ভূপেন্দ্র কুমার বিষ্ণোই ওই অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। নিজের লেখা বই, ‘থান্ডার ওভার ঢাকা’-তে তিনি লিখেছেন, ‘গভর্নরস হাউসের ওপর প্রতিটা বিমান নিয়ে দুবার করে চক্কর কেটে মোট ১২৮টি রকেট ফেলেছিলাম আমরা।’
বিষ্ণোই আরও লিখেছিলেন, ‘স্বাভাবিকভাবেই বেসামরিক সরকারের শিরদাঁড়া সেদিনই ভেঙে গিয়েছিল। দুই দিন পর পাকিস্তানের সর্বাধিনায়ক জেনারেল নিয়াজি তাঁর ৯৩ হাজার সেনা নিয়ে আত্মসমর্পণ করেন।’
কয়েক বছর আগে ভূপেন্দ্র কুমার বিষ্ণোই মারা গেছেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে করা এক চুক্তির আওতায় ভারত সরকার বিমানবাহিনীর জন্য যুদ্ধবিমান আর ক্ষেপণাস্ত্রের প্রথম বহরটি এনেছিল। সে দফায় কেনা ১২টি মিগ টুয়েন্টি ওয়ানই ছিল ভারতের প্রথম কোনো যুদ্ধবিমান, যা পশ্চিমা বিশ্বের বাইরের কোনো দেশের তৈরি। তৈরি বিমান কেনা ছাড়াও ভারতেই যাতে এ যুদ্ধবিমানগুলো উৎপাদন করা যায়, এ জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে কারিগরি সহায়তাও পেয়েছিল দিল্লি।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কয়েক বছর আগেই গঠিত হয় ভারতের ২৮ নম্বর ‘ফার্স্ট সুপারসনিকস’ স্কোয়াড্রন। ওই স্কোয়াড্রন দিয়েই ভারতীয় বিমানবাহিনীতে মিগ টুয়েন্টি ওয়ানের যাত্রা শুরু হয়েছিল। রাশিয়ায় তৈরি ‘মিকোয়ান গুরেভিচ’ বা মিগ বিমান প্রথম ভারতে আসে ১৯৬৩ সালে।
ছয় দশকের বেশি সময় পর এবার ভারতীয় বিমানবাহিনী চিরবিদায় জানাবে ‘মিগ টোয়েন্টি ওয়ান’ যুদ্ধবিমানকে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো গতকাল মঙ্গলবার জানিয়েছে, বর্তমানে ২৩ নম্বর ‘প্যান্থার্স’ স্কোয়াড্রনের অন্তর্ভুক্ত মিগ টোয়েন্টি ওয়ান শেষবারের মতো আকাশে উড়বে আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর।
গত সোমবার বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এফ–৭ যুদ্ধবিমান ঢাকায় বিধ্বস্ত হয়েছে, সেটি এই মিগ টোয়েন্টি ওয়ানেরই প্রতিরূপ, অর্থাৎ চীনে তৈরি অনুরূপ বিমান।
মিগ টোয়েন্টি ওয়ানকে বিদায় জানানোর বিষয়ে বিবিসি বাংলাকে ভারতীয় বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত গ্রুপ ক্যাপ্টেন এস সুজান বলেন, সিদ্ধান্তটা অনেক আগেই নেওয়া উচিত ছিল। মিগ অনেক বছর আগেই তার কার্যকাল শেষ করেছে।
সুজান নিজে ১২-১৩ বছর মিগ টোয়েন্টি ওয়ান যুদ্ধ বিমান উড়িয়েছেন।
ভারতের আসামের গুয়াহাটি থেকে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সকালে একটা ‘মিশনে’ গিয়েছিলেন ভারতীয় বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা ভূপেন্দ্র কুমার বিষ্ণোই। তাঁর ডাকনাম ছিল ‘ভূপ’।
ভারতের সামরিক বাহিনীর তথ্যসংক্রান্ত পোর্টাল ‘ডিফেন্স ওয়াচ’-এর ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘তেজস’ নির্মাণকারী হিন্দুস্তান অ্যারোনটিকস লিমিটেড ২০২৭-২৮ সালের মধ্যে ভারতকে ৮৩টি যুদ্ধবিমান দেবে।‘থান্ডার ওভার ঢাকা’ বইয়ে ভূপেন্দ্র লিখেছেন, ‘গ্রুপ ক্যাপ্টেন উলেন আমাদের অপারেশনস রুমে দৌড়ে এসে বললেন, ভূপ, একটা অত্যন্ত জটিল আর জরুরি কাজ এসেছে বিমানবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে। ঢাকার সার্কিট হাউসে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক চলছে। ঠিক ১১টা ২০ মিনিটে ওখানে হামলা চালাতে হবে।’
বিষ্ণোই আরও লিখেছেন, ‘আমি বললাম, প্রথমত এখনই তো ১০টা ৫৫ বাজে, ঢাকায় পৌঁছাতে ২১ মিনিট লাগে। তার ওপরে ঢাকায় এই সার্কিট হাউসটা কোথায়! উনি বললেন, জলদি করলে হয়তো সময়ের মধ্যে পৌঁছাতে পারবে। আর এই নাও ঢাকার একটা ট্যুরিস্ট ম্যাপ—এই রাস্তার মোড়ে সার্কিট হাউস।’ বিষ্ণোই তখন ‘ফার্স্ট সুপারসনিকস’ স্কোয়াড্রনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।
চারটি মিগ টোয়েন্টি ওয়ান নিয়ে আকাশে ওড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে একজন ফ্লাইট অপারেটর দৌড়াতে দৌড়াতে বিমানের কাছে আসেন।
বিষ্ণোই লিখেছেন, ‘একজন ফ্লাইট কমান্ডার হাতে একটা কাগজ নিয়ে দৌড়ে এসে বলল, স্যার এটা আপনার জন্য। টার্গেট সার্কিট হাউস নয়, গভর্নরস হাউস, রিপিট গভর্নমেন্ট হাউস। বেস্ট অব লাক অ্যান্ড গুড শুটিং।’
কোলে রাখা ওই পর্যটন মানচিত্র দেখেই ভূপেন্দ্র চিহ্নিত করেন গভর্নরস হাউস। এর আগে ডিসেম্বরের ৫, ৭ আর ৮ তারিখে ঢাকার তেজগাঁও আর কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটিতে বারবার বোমা বর্ষণ করে এসেছে ‘ভূপ’–এর নেতৃত্বে ‘মিগ’ বাহিনী।
সামরিক বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করেন, মিগ টোয়েন্টি ওয়ান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের হিসাব–নিকাশ অনেকটাই পাল্টে দিয়েছিল।
সেই কথা স্মরণ করে ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর উদ্যাপন উপলক্ষে ঢাকা সফরকালে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের হাতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া একটি মিগ টোয়েন্টি ওয়ানের প্রতিমূর্তি তুলে দিয়েছিলেন।
যেভাবে মিগ এসেছিল ভারতে
ভারতের বিমানবাহিনীর ওয়েবসাইটে লেখা হয়েছে, ১৯৬২ সালের আগস্ট মাসে এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এর ফলে পরবর্তী কয়েক দশকে ভারতীয় বিমানবাহিনীর রূপ আর শক্তিতে নিবিড় বদল ঘটেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে করা এক চুক্তির আওতায় ভারত সরকার বিমানবাহিনীর জন্য যুদ্ধবিমান আর ক্ষেপণাস্ত্রের প্রথম বহরটি এনেছিল।
সেই দফায় কেনা ১২টি মিগ টুয়েন্টি ওয়ানই ছিল ভারতের প্রথম কোনো যুদ্ধবিমান, যা পশ্চিমা বিশ্বের বাইরের কোনো দেশের তৈরি। তৈরি বিমান কেনা ছাড়াও ভারতেই যাতে এ যুদ্ধবিমানগুলো উৎপাদন করা যায়, এ জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে কারিগরি সহায়তাও পেয়েছিল দিল্লি।
মিগ সিরিজের বিমানই ছিল ভারতের হাতে আসা প্রথম সুপারসনিক যুদ্ধবিমান। এ যুদ্ধবিমান শব্দের থেকেও দ্রুত উড়তে পারে।
১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হোক বা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধ—সব সামরিক সংঘাতেই মিগ ব্যবহার করেছে ভারতীয় বিমানবাহিনী।
২০১৯ সালে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভারত ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালানোর সময়ে অভিনন্দন বর্তমান নামের এক ভারতীয় পাইলট বিমান দুর্ঘটনার কবলে পড়ে পাকিস্তানে আটক হন। সেই গ্রুপ ক্যাপ্টেনও একটি মিগ টোয়েন্টি ওয়ান বাইসন বিমানই ওড়াচ্ছিলেন।
এমনকি সম্প্রতি ‘অপারেশন সিঁদুর’ নাম দিয়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে হামলা চালানোর সময়ও মিগ বিমান স্কোয়াড্রনকে সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছিল।
৬০ বছরের বেশি সময় ধরে ভারতীয় বিমানবাহিনী ৮৭০টি মিগ বিমান ব্যবহার করেছে।
প্রথম থেকেই দুর্ঘটনায় পড়ে মিগ
কারিগরি দিক থেকে যথেষ্ট উন্নত ছিল মিগ। তবে প্রথম থেকেই দুর্ঘটনার কবলেও পড়েছে। প্রথম বছর, ১৯৬৩ সালেই দুটি মিগ বিধ্বস্ত হয়।
সরকারি তথ্যের ভিত্তিতে ভারতের সংবাদপত্র ‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ লিখেছে, পাঁচ শর বেশি মিগ টোয়েন্টি ওয়ান ভেঙে পড়েছে, ১৭০ জন পাইলটসহ দুই শর বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। গত ১৫ বছরেই ২০টি মিগ বিমান ভেঙে পড়েছে।
এত বেশি দুর্ঘটনায় পড়েছে বলেই মিগ টোয়েন্টি ওয়ানকে কখনো ‘কফিন-মেকার’ বা ‘উইডো-মেকার’ বলা হয়।
প্রথম যুগের মিগ টোয়েন্টি ওয়ানগুলোতে অনেক পরিমার্জন করা হয়েছে। সর্বশেষ যে মিগ টুয়েন্টি ওয়ান আকাশে উড়তে সক্ষম, তার নাম মিগ টুয়েন্টি ওয়ান ‘বাইসন’।
ভারতীয় বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত গ্রুপ ক্যাপ্টেন এস সুজান বলছিলেন, ‘মিগ টোয়েন্টি ওয়ানগুলোতে এত বছর ধরে অনেক পরিমার্জন করা হয়েছে। যদিও সেগুলো যথেষ্ট প্রাচীন হয়ে গেছে। মিগের বেশ কয়েকটা সীমাবদ্ধতাও আছে। সব থেকে বড় সমস্যা হলো মিগে একটি মাত্র ইঞ্জিন থাকে। এ ছাড়া আরেকটা সীমাবদ্ধতা হলো এর পে–লোড ক্যাপাসিটিও কম। জ্বালানি এবং অস্ত্র বহনের ক্ষমতা কম। আবার মিগের রেঞ্জও যেমন কম, তেমনই আকাশে ওড়ার সময়েই জ্বালানি ভরার ব্যবস্থাও নেই মিগের।
সুজান আরও বলেন, ‘যেকোনো আধুনিক বিমানবাহিনীতে মিগ টোয়েন্টি ওয়ান এখন আর আদর্শ যুদ্ধবিমান নয়। যে বিমানে দ্বিতীয় ইঞ্জিনের সুবিধা নেই, আকাশে ওড়ার সময়ে জ্বালানি ভরা যায় না বা ভার বহনের ক্ষমতাও কম—সে রকম একটা যুদ্ধবিমান এখন আর চলে না। কার্যকাল শেষ হওয়া পরও যান্ত্রিক পরিমার্জন ঘটিয়ে এত দিন টেনেছে মিগ টুয়েন্টি ওয়ান। এটা ঠিক যে মিগ টোয়েন্টি ওয়ানে বহু দুর্ঘটনা ঘটেছে, আমাদের কমরেডরা নিহতও হয়েছেন। তবে দেখুন, দুর্ঘটনা তো যেকোনো বিমানেই হতে পারে। মিগ টোয়েন্টি ওয়ানের যদি আরও উন্নতমানের যন্ত্রাংশ থাকত, ভালো অটো-পাইলট ব্যবস্থা থাকত, তাহলে হয়তো এত দুর্ঘটনা এড়ানো যেত।’
মিগ টোয়েন্টি ওয়ানের বিকল্প
মিগ টোয়েন্টি ওয়ানের বিকল্প হিসেবে ভারতীয় বিমানবাহিনী ‘তেজস’ যুদ্ধবিমান নিয়ে এসেছে।
অবসরপ্রাপ্ত গ্রুপ ক্যাপ্টেন সুজান বলছিলেন, তবে ‘তেজস’ পরিকল্পনা রূপায়িত হতে বহু বছর দেরি হয়েছে।
সুজান বলেন, ‘আমরা যখন বিমানবাহিনীতে যোগ দিলাম, সেই নব্বইয়ের দশকের গোড়ায়, আমাদের বলা হয়েছিল যে আমরা সম্ভবত পাস করার আগেই “তেজস” ওড়ানোর প্রশিক্ষণ পেয়ে যাব। তবে এখনো যথেষ্ট “তেজস” বাহিনীতে নেই।’
ভারতের সামরিক বাহিনীর তথ্যসংক্রান্ত পোর্টাল ‘ডিফেন্স ওয়াচ’-এর ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘তেজস’ নির্মাণকারী হিন্দুস্তান অ্যারোনটিকস লিমিটেড ২০২৭-২৮ সালের মধ্যে ভারতকে ৮৩টি যুদ্ধবিমান দেবে।
ওই সাইটেই লেখা হয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মধ্যে ১৮টি বিমান দেওয়ার কথা। তবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে জিইয়ের ইঞ্জিন পাওয়া নিয়ে বড় সমস্যা রয়েছে। ফলে তেজসের পরিকল্পনা অনেক বছর পিছিয়ে রয়েছে।
সুজান বলেন, আসলে মিগ টোয়েন্টি ওয়ানের বিকল্প যে লাগবে, তার জন্য অনেক আগে পরিকল্পনা করা দরকার ছিল। এটা তো বিমানবাহিনীর প্রধান নিজেও স্বীকার করেছেন। সে জন্যই এত বছর ধরে মিগ বিমান দিয়েই চালাতে হচ্ছে।
তবে আর নয়। সেপ্টেম্বরের ১৯ তারিখে ইতিহাসের পাতায় চলে যাবে মিগ টুয়েন্টি ওয়ান।
সুজান বলেন, ‘আমরা সতীর্থরা প্রায় সবাই মিগ টোয়েন্টি ওয়ান উড়িয়েই কর্মজীবন শুরু করেছি। কারণ, তখনো সেগুলোই ছিল বিমানবাহিনীর মূল যুদ্ধবিমানবহর। মিগের বহরে সাধারণত আমরা পাঁচ-ছয় বছর থাকতাম। এরপর আমাদের আরও উন্নত বিমান যেমন মিরাজ টু থাউজেন্ড বা মিগ টুয়েন্টি নাইন ইত্যাদিতে পাঠানো হতো। আমি নিজে প্রায় ১২-১৩ বছর মিগ টোয়েন্টি ওয়ান উড়িয়েছি। তারপর আমাকে দেওয়া হয়েছিল সুকোই থার্টি। এখন মিগ টোয়েন্টি ওয়ানের বিদায় বেলায় এসে মনটা ভারাক্রান্ত তো হচ্ছেই।’
সুজান মনে করেন, কোনো বিমানবহর যখন বাহিনী থেকে অবসর নেয়, তার সঙ্গে জড়িত থাকে অনেক সুখস্মৃতি। তবে বাস্তবতা বিবেচনা করলে মিগ টোয়েন্টি ওয়ানকে অবশেষে বিদায় জানানোর সিদ্ধান্তটা সঠিক।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স জ ন বল ন দ র ঘটন র প রথম হয় ছ ল য় ড রন আম দ র র জন য ক বছর র সময় সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
হনুমান কি পর্বত কাঁধে করে উড়ে এসেছিলেন?
হিন্দু ধর্মগ্রন্থ রামায়ণের এক বিশিষ্ট অধ্যায়ে উঠে আসে এক অলৌকিক ঘটনার কথা। রাম-রাবণের মহাযুদ্ধে শ্রীরামচন্দ্রের ভাই লক্ষ্মণ অচেতন হয়ে পড়লে, তাঁকে জীবিত রাখতে প্রয়োজন হয় একটি বিশেষ ভেষজ উদ্ভিদের—সঞ্জীবনী বুটি। আয়ুর্বেদাচার্য সুষেণের পরামর্শে হনুমান ছুটে যান হিমালয়ের পাদদেশে গন্ধমাদন পর্বতে।
রামায়ণে বর্ণিত আছে, নির্দিষ্ট গাছটি শনাক্ত করতে না পারায় হনুমান পুরো গন্ধমাদন বা দ্রোণগিরি পর্বতটাই তুলে কাঁধে নিয়ে পা বাড়ান লঙ্কার উদ্দেশে। বিশ্বাস করা হয় যে তিনি দীর্ঘ আকাশপথ পাড়ি দেন এই পাহাড় বহন করে। পথিমধ্যে তিনি কিছু স্থানে বিশ্রামও নেন; যেসব স্থান আজও ‘হনুমান টোক’, ‘হনুমান চট’, ‘হনুমান ধারা’ নামে পরিচিত।
নির্দিষ্ট গাছটি শনাক্ত করতে না পারায় হনুমান পুরো গন্ধমাদন বা দ্রোণগিরি পর্বতটাই তুলে কাঁধে নিয়ে পা বাড়ান লঙ্কার উদ্দেশে।পৌরাণিক গ্রন্থগুলোয় সব ঘটনা রূপকভাবে লেখা আছে। এককথায় পুরাণের মধ্যে সবকিছু গোলমাল পাকিয়ে আছে। গোলটা ফেলে মালটা বের করতে পারলে পৃথিবীর অনেক কল্যাণ হয়। এই ঘটনার রূপকতা ব্যাখ্যা করতে একটা গল্পের উল্লেখ করছি।
আরও পড়ুনভারতের আদিতম মহাকাব্য রামায়ণ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩বাড়িতে ২০০ মানুষকে নিমন্ত্রণ করে এক ব্যক্তি বাজারে গিয়ে অনেক বাজার করেছেন। ফেরার সময় তিনি নিজের সাইকেলের দুই হ্যান্ডলে দুটো ব্যাগ ঝুলিয়েছেন, পেছনে দুটো ব্যাগ ঝোলানো, ক্যারিয়ারে একটা বস্তা বাঁধা। জায়গা না পেয়ে নিজের দুই কাঁধে দুটো ব্যাগ ঝুলিয়ে বাজার থেকে বাড়ির উদ্দেশে যাওয়ার পথে রাস্তায় এক লোক তাঁকে দেখে বললেন ‘কী হে ভাই, তুমি তো দেখি পুরা বাজার উঠিয়ে নিয়ে এসেছ!’ এর মানে কিন্তু এই নয় যে সেই ব্যক্তি পুরো বাজার উঠিয়ে নিয়ে এসেছেন।
তিনি আসলে অনেক বাজার করেছেন। হনুমানের ক্ষেত্রেও একই রকম ঘটেছিল।
রামভক্ত হনুমান ছিলেন যোগী পুরুষ। তিনি যোগবলে অনেক অলৌকিক শক্তি অর্জন করেছিলেন। তিনি যোগবলে নিজের আকার এত ছোট করে ফেলতে পারতেন যে তাঁকে খালি চোখে দেখা কষ্টকর হয়ে যেত। আবার তিনি ইচ্ছা করলে যোগবলে নিজের আকার অনেক বড় করে ফেলতে পারতেন। আর তিনি ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী।
‘কী হে ভাই, তুমি তো দেখি পুরা বাজার উঠিয়ে নিয়ে এসেছ!’ এর মানে কিন্তু এই নয় যে সেই ব্যক্তি পুরো বাজার উঠিয়ে নিয়ে এসেছেন। তিনি আসলে অনেক বাজার করেছেন।তিনি আসলে ‘সঞ্জীবনী বুটি’ চিনতে না পেরে যোগবলে নিজের শরীরটা অনেক বড় করে সামনে যত ধরনের বৃক্ষ ও লতাপাতা পেয়েছিলেন, সেই সবকিছু সংগ্রহ করে বিশাল এক বোঝা বানিয়ে নিজের পিঠের ওপর তুলে যখন অতি দ্রুত এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে লাফ দিচ্ছিলেন, তখন সেই বিশালদেহী হনুমানকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন গোটা পাহাড়টাই পিঠে তুলে নিয়ে লাফাচ্ছেন।
আরও পড়ুনদুর্গাপূজার কাহিনি২০ অক্টোবর ২০২৩হনুমানের এই অসাধারণ কীর্তিকে অনেকেই অলৌকিক বলেই ভাবেন। কিন্তু অলৌকিকতা ছাপিয়ে এটা তাঁর গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা এবং গুরুর আদেশের প্রতি দৃঢ় সংকল্পের প্রতীক। ভারতের হিমাচল, উত্তরাখন্ড, মধ্যপ্রদেশ এমনকি বাংলাদেশের মহেশখালীর আদিনাথ ধামসহ কিছু স্থানে এই ঘটনার স্মৃতি বহন করে, এমন লোককথা এখনো প্রচলিত।
একটি পাহাড় কাঁধে বহন করে উড়ে যাওয়া প্রকৃতির নিয়মের বাইরে। আর অবতার, মহাপুরুষ বা প্রেরিত পুরুষেরা কখনো প্রকৃতির নিয়মের বাইরে যান না। রামায়ণের এ ঘটনাকে মূলত রূপক বা প্রতীকী ঘটনা হিসেবেই বিবেচনা করেন হিন্দুধর্মীয় অবতার-মহাপুরুষেরা। আর পৃথিবীতে অলৌকিক বলে কিছু নেই।
রামায়ণের এ ঘটনাকে মূলত রূপক বা প্রতীকী ঘটনা হিসেবেই বিবেচনা করেন হিন্দুধর্মীয় অবতার-মহাপুরুষেরা। আর পৃথিবীতে অলৌকিক বলে কিছু নেই।মনে করেন, একজন যোগী পুরুষ নদীর তীর থেকে যোগবলে অদৃশ্য হয়ে নদীর মধ্যে ভেসে উঠলেন। আমি দেখতে পাচ্ছি না, জানতে পারছি না যে তিনি কীভাবে গিয়েছেন, তাই আমার কাছে অলৌকিক। আর ওই যোগী জানেন যে তিনি কীভাবে গিয়েছেন, তাই তাঁর কাছে লৌকিক।
যুগের পর যুগ ধরে লাখ লাখ ভক্তের হৃদয়ে এই ঘটনা গুরুর প্রতি শিষ্যের ভালোবাসা এবং নিজেকে গুরুর প্রতি সম্যকভাবে ন্যস্ত করার এক আস্থা ও অনুপ্রেরণার গল্প হয়ে রয়েছে। হনুমানের এই গাথা তাঁর ভক্তিমূলক চরিত্রকে যেমন সমৃদ্ধ করে, তেমনি মানবজাতির দুর্দম সাহস ও আত্মত্যাগের কথাও মনে করিয়ে দেয়।
তথ্যসূত্র: ১. বাল্মীকি রামায়ণ. ২. কৃত্তিবাসী রামায়ণ, ৩. শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র কথিত ‘আলোচনা প্রসঙ্গে’ গ্রন্থ, ৪. মহেশখালীর আদিনাথ ধাম অঞ্চলের লোককথা।
পার্থ দেব বর্মন: গবেষক, সৎসঙ্গ রিসার্চ সেন্টার
আরও পড়ুনরামচন্দ্র, বিষ্ণুর অবতার কিন্তু মানবিক১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩