ইরানের যুদ্ধ-পরবর্তী বিজয় উদ্‌যাপন হয়তো শেষ হয়েছে, কিন্তু দেশটির শাসকদের উদ্বেগ এখনো কাটেনি। গত মাসের ঘটনাপ্রবাহ ইরানের বৃহত্তর কৌশলগত সীমাবদ্ধতা উন্মোচন করেছে। ইরানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ প্রেক্ষাপটে ইরানের শাসকগোষ্ঠী এখন চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চেষ্টা করছে। গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যাচ্ছে, ইরান প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনাকাটার জন্য চীনের দিকে ঝোঁকার পরিকল্পনা নিয়েছে। বিশেষ করে নিজেদের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা কাটাতে চীনের ওপর ভরসা করতে চাইছে ইরান।

কিন্তু ইরান-চীন প্রতিরক্ষাসহায়তা কয়েকটি কারণে কঠিন। এর মধ্যে ইরানের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা থেকে শুরু করে আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ রয়েছে।

যদি অতীতের দিকে তাকানো যায়, তাহলে ১৯৭৯ সাল–পরবর্তী ইরানের নীতিগত সিদ্ধান্তগুলো অনেক সময় আত্মঘাতী প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি দিক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য—বিমানবাহিনীর সক্ষমতার অবনতি, সমান্তরাল সামরিক কাঠামো সৃষ্টি ও অস্ত্র সংগ্রহে রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা।

ইরানের বিমানবাহিনীর সক্ষমতার অবনতি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। একসময় ইরানের বিমানবাহিনী এশিয়ার অন্যতম সেরা বাহিনী ছিল। ইরান-ইরাক যুদ্ধে ইরান নিজেদের সক্ষমতা প্রদর্শন করেছিল। ১৯৮০ সালে অপারেশন কামান-৯৯ ও ১৯৮৩ সালে অপারেশন এইচ-৩ অভিযানে ইরানি বিমানবাহিনী ইরাকি বোমারু বিমানের বহরের বিপুল ক্ষতি করেছিল। শত্রুপক্ষের পাল্টা আক্রমণ চালানোর সক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এসব অর্জনের কোনোটিই ইরানের বিমানবাহিনীর পতন ঠেকাতে পারেনি।

বছরের পর বছর ধরে অবহেলার কারণে ইরানের বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমানগুলো (এফ-৪ ফ্যান্টম, এফ-৫, এফ-১৪ টমক্যাট, চীনা এফ-৭ এবং এসইউ-২৪ ফেন্সার) আধুনিক যুদ্ধবিমানগুলোর (এফ-৩৫, এফ-১৫ এবং এফ-১৬) সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।

চীন যদি ঝুঁকি নিয়ে উন্নত প্রযুক্তি হস্তান্তর করেও তারপরও নতুন প্রযুক্তি আত্তীকরণের সময়টাতে ইরান সেগুলোর সুরক্ষা দিতে পারবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। আকাশযুদ্ধের জন্য ইরানের কাছে তৃতীয় প্রজন্মের যুদ্ধবিমান ও প্রযুক্তি আছে। ইরানকে ৪ দশমিক ৫ বা পঞ্চম প্রজন্মের প্রযুক্তি আত্তীকরণ করতে হবে। দ্রুততম সময়ের মধ্য ইরানের সেটা করা অসম্ভব।

ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রেও একই ধরনের প্রস্তুতিহীনতা দেখা গেছে। ইরান প্রচার করে এসেছে যে দেশটি শুধু রাশিয়ায় নির্মিত এস-৩০০ বা টর-এম মিসাইল ব্যাটারির মতো ব্যবস্থা ব্যবহার করেছে, তা-ই নয়; বরং নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি বাভার ও খোরদাদের মতো প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মোতায়েন করেও কৌশলগত দক্ষতা অর্জন করেছে। কিন্তু এসব প্রতিরক্ষাব্যবস্থার কোনোটিই ইসরায়েলকে ইরানি আকাশসীমায় প্রবেশ থেকে বিরত রাখতে পারেনি কিংবা সংবেদনশীল স্থাপনাগুলোকে সুরক্ষা দিতে পারেনি।

এ দুর্বলতার কারণে তেহরানের পক্ষে ইসরায়েলের ওপর পাল্টা আঘাত হানার সক্ষমতাকে গুরুতরভাবে সীমিত করে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েল দাবি করেছে যে তারা ইরানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ যান ধ্বংস করে দিয়েছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী হামলার যে চিত্র প্রকাশ করেছে তাতে দেখা গেছে, দেশটির বিমানবাহিনী খুব সহজেই ইরানের উৎক্ষেপণ যানগুলো ধ্বংস করতে পেরেছে।

এ সমস্যার মূল কারণ হলো ইরানে সমান্তরাল সামরিক কাঠামো গঠন। ইসলামি বিপ্লবের পর শাসকেরা রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ সুসংহত করতে গিয়ে একটি সমান্তরাল সামরিক কাঠামো তৈরি করেন। ফলে সদ্য গঠিত ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীকে (আইআরজিসি) প্রচলিত সামরিক বাহিনীর তুলনায় অনেক বেশি ক্ষমতা দেওয়া হয়। শাসকগোষ্ঠীর বাহিনী হিসেবে আইআরজিসি দ্রুতই সম্পদ, কৌশল ও সামরিক সরঞ্জামের দিক থেকে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।

আরজিসির কৌশলগত উইং ইরানের কৌশলগত ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি তদারকির দায়িত্বে আছে। আর আরজিসির বিমান শাখা আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করে। দুটি সমান্তরাল বিমানবাহিনী থাকলে সমস্যা কতটা, কীভাবে জটিল আকার ধারণ করে, তা গত জুনে স্পষ্ট হয়েছে। ইসরায়েলের বিমানবাহিনী খুব দ্রুত ইরানের আকাশসীমায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ফেলে।

১২ দিনের যুদ্ধে যে বিষয় খোলাসা হয়েছে, সেটা হলো বছরের পর বছর ধরে চলা পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ইরানকে কতটা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করেছে। একই সঙ্গে তেহরানের নীতিনির্ধারকেরা যে ভূরাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তার প্রভাবও স্পষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে একটি সিদ্ধান্ত ছিল অস্ত্র সংগ্রহের ক্ষেত্রে রাশিয়ার ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা। সাম্প্রতিক বিভিন্ন সংঘাতে (যেমন উপসাগরীয় যুদ্ধ, আর্মেনিয়া, ইউক্রেন ও ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে) রুশ সামরিক সরঞ্জামগুলোর কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে ইরান ভুগেছে। কারণ, রাশিয়া প্রতিশ্রুত অস্ত্র সময়মতো সরবরাহ করতে পারেনি। বহু বছর ধরে বিশ্লেষকেরা বলে আসছিলেন, ইরান রাশিয়া থেকে এসইউ-৩৫ যুদ্ধবিমান পাবে। বাস্তবে তারা পেয়েছে কেবল ইয়াক-১৩০ প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান, কিন্তু এসইউ-৩৫ কখনোই আসেনি। যুদ্ধ চলাকালে ইরানের রুশ সামরিক প্ল্যাটফর্মগুলোর কোনোটিতেই ‘বিয়ন্ড ভিজ্যুয়াল রেঞ্জ’ ক্ষেপণাস্ত্র সচল করা সম্ভব হয়নি। একটি মাত্র স্কোয়াড্রন হয়তো সামরিকভাবে তেমন পার্থক্য আনতে পারত না, কিন্তু ইরানি বাহিনীর মনোবলের জন্য তা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারত।

ভারত–পাকিস্তান সংঘাতের সময় ভারতের যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব ম নব হ ন র ক শলগত দ র বল ইসর য র ওপর ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

বাংলাদেশ ও চীন হাতে হাত রেখে এগিয়ে যাবে: প্রধান উপদেষ্টা

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বাংলাদেশ ও চীন তাদের ব্যাপক কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারত্বকে এগিয়ে নিতে একসঙ্গে এগিয়ে যাবে, যা উভয় দেশ ও বিশ্বের জনগণের জন্য শান্তি, সমৃদ্ধি ও সুখ বয়ে আনবে।

গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের ৭৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এবং বাংলাদেশ-চীন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকী উদ্‌যাপন উপলক্ষে বুধবার রাতে রাজধানীর একটি হোটেলে চীনা দূতাবাস আয়োজিত এক জমকালো সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা এক ভিডিও বার্তায় এ কথা বলেন।

গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার ৭৬তম বার্ষিকী এবং বাংলাদেশ-চীন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকীতে উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের প্রতি চীনের দীর্ঘস্থায়ী আস্থা, সহায়তা ও সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি অর্থনৈতিক উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, দারিদ্র্য বিমোচন এবং জনগণের সেবার মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে অর্জিত উল্লেখযোগ্য সাফল্যের পাশাপাশি গ্লোবাল সাউথ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি এর অনুপ্রেরণা ও অবদানের প্রশংসা করেন।

চীনকে বাংলাদেশের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য অংশীদার উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের প্রতি চীনের দীর্ঘস্থায়ী আস্থা, সহায়তা ও সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন অনুষ্ঠানে বলেন, ২০২৫ সাল কেবল গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের ৭৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী নয়, বরং জাতিসংঘের ৮০তম বার্ষিকীও।

ইয়াও ওয়েন আট দশক আগে বিশ্ব শান্তি রক্ষায় চীনের অপরিসীম ত্যাগের কথা স্মরণ করেন এবং শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে শক্তিশালী রেকর্ডসহ একটি প্রধান শক্তিতে রূপান্তরিত হওয়ার কথা তুলে ধরেন।

রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘চীনের কমিউনিস্ট পার্টির শক্তিশালী নেতৃত্বে চীনা জনগণ নিরঙ্কুশ দারিদ্র্য দূরীকরণের অলৌকিক সাফল্য অর্জন করেছে। চীন সর্বদা বিশ্বে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতির জন্য একটি শক্তি হিসেবে থাকবে।’

রাষ্ট্রদূত ইয়াও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের গ্লোবাল গভর্ন্যান্স ইনিশিয়েটিভের ওপর জোর দিয়ে বলেন, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে তিনি ব্যাপক আন্তর্জাতিক সমর্থন পেয়েছেন, যা বহুপক্ষীয় সহযোগিতা জোরদার করার একটি নজির।

ঢাকা-বেইজিং সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে রাষ্ট্রদূত বলেন, দুই দেশ শ্রদ্ধা, আন্তরিকতা, কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন ও সমান সমান সহযোগিতার দ্বারা পরিচালিত সুসম্পর্কের ভিত্তিতে সর্বদা ‘ভালো প্রতিবেশী, আন্তরিক বন্ধু ও নির্ভরযোগ্য অংশীদার হয়ে থাকবে’। তিনি আরও বলেন, চীন বাংলাদেশকে তার আধুনিকীকরণের যাত্রায় সহায়তা ও সমর্থন অব্যাহত রাখতে এবং ভবিষ্যতে একটি চীন-বাংলাদেশ সম্প্রদায় গঠনে একটি নতুন অধ্যায় লিখতে প্রস্তুত।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশের উন্নয়ন অবকাঠামো, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং স্বাস্থ্যসেবা খাতে চীনের অবদানের প্রশংসা করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এ ধরনের সহযোগিতা বাংলাদেশের জনগণের জন্য বাস্তব সুবিধা প্রদান করেছে।

বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, দুটি দেশ জনগণের মধ্যে গভীর বন্ধন গড়ে তুলেছে। চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক এখন সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের জ্যেষ্ঠ নেতা, বিদেশি কূটনীতিক, আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি, চীনা সম্প্রদায়ের সদস্য, শিক্ষাবিদ, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, থিংকট্যাঙ্ক বিশেষজ্ঞসহ ছয় শতাধিক অতিথি উপস্থিত ছিলেন।

সন্ধ্যায় ইউনান গোল্ডেন অ্যান্ড সিলভার বার্ড আর্ট ট্রুপ এবং কোয়ানঝো আর্ট ট্রুপের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা, জাতিগত নৃত্য, অ্যাক্রোবেটিকস ও ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্রের সংগীত পরিবেশিত হয়। দর্শকদের কাছে তা খুবই উপভোগ্য ছিল।

অতিথিরা চীন-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর উদ্‌যাপন এবং জাপানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চীনা জনগণের প্রতিরোধ যুদ্ধ এবং বিশ্ব ফ্যাসিবাদবিরোধী যুদ্ধে বিজয়ের ৮০তম বার্ষিকী উদ্‌যাপনের প্রদর্শনীও পরিদর্শন করেন।

অনুষ্ঠানস্থলে এন্টারপ্রাইজ বুথ, পর্যটন প্রচারণা এবং সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা কর্নারও ছিল, যা দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বাংলাদেশ ও চীন হাতে হাত রেখে এগিয়ে যাবে: প্রধান উপদেষ্টা
  • পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করল পাকিস্তান-সৌদি আরব
  • কমিউনিটি ব্যাংক ও বাংলাদেশ সার্ভিসেস লিমিটেডের মধ্যে কৌশলগত চুক্তি স্বাক্ষর
  • প্রতিবেশী দেশগুলো অস্থির, ভারত এখন কী করবে
  • কারও ওপর আক্রমণ হলে যৌথভাবে জবাব দেবে পাকিস্তান ও সৌদি আরব